মানবতা ও মানুষের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
পাভেল আমান
ছকে বাঁধা জীবন থেকে বেরিয়ে আপন সৃষ্টির মাঝে যে কয়েকজন কবি পাঠক সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল দেখেছিল নতুন স্বপ্ন বেঁচে থাকার নতুন মন্ত্র তন্মধ্যে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অন্যতম। প্রথাগত কবি লেখকদের সংজ্ঞাটাকেই তিনি পাল্টে দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এক শোষণমুক্ত মৈত্রী সংহতি সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের মানব সমাজ। মানুষে মানুষে বিশ্বাস সৌহার্দ্য ভাতৃত্ব সর্বোপরি শান্তিকে স্থিতিশীল করে তুলতে সারাজীবন গেয়েছেন মানবতার গান। তার কবিতার ছত্রছত্রে মানবতা মনুষ্যত্ব প্রতিবাদ বিবেক চেতনা বোধ অন্তস্থ অনুভূতি বারংবার তীব্রভাবে জাগ্রত হয়েছে। এই দুঃসহ সময়ে তাঁর কবিতা যত পড়ি, ততই যেন অমোঘ বলে মনে হয়। তাঁর কবিতা চিরদিন ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেছে। কারণ আপোষে বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ চল্লিশের দশকে তাঁর পথ চলার যাত্রা শুরু৷কখনও পূর্বসূরী কবিদের প্রভাব এড়িয়ে কখনো, আত্মস্থ করে,বাস্তবের রুক্ষ,আগুন_ঝরা মাটিতে পা রাখা,মোহভঙ্গ৷লিখেছেন অজস্র কবিতা৷তাঁর কবিতা লাঞ্চিত আর্ত মানুষের প্রতি সমবেদনায়,সমানুভূতিতে পরিপূর্ণ ও দায়বদ্ধ৷আজ তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধা৷বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মূলত মানুষের কবি। মাটি আর মানুষের কথাই তাঁর কাব্য। এক সচেতন মানবিক প্রত্যয় থেকেই তিনি কবিতা লিখতেন। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পথিকৃৎ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কবিতায় অনুষঙ্গে প্রেম প্রকৃতি মিলেমিশে আছে। সমাজতন্ত্রের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, সাম্যবাদের ওপর আস্থা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকেও নিয়ন্ত্রিত করেছে। আমৃত্যু সে বিশ্বাস হারায়নি। 'রাজা আসে, রাজা বদলায়/ নীল জামা গায়ে, লাল জামা গায়/ এই রাজা আসে, ওই রাজা যায়/ জামা কাপড়ের রং বদলায়...দিন বদলায় না...।' ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিক্রমপুরের চট্টোপাধ্যায় পরিবারে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম। বাল্যকাল থেকেই তিনি একরােখা ধরনের মানুষ। ঢাকা বিক্রমপুরের অভিজাত সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হয়েও তিনি সাধারণ শ্রেণির মানুষদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যেন বেশি স্বস্তি বােধ করতেন। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি বাল্যকাল থেকেই গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছেন। এজন্য তাকে পরিবারের সকলের বিরাগভাজন হতে হয়েছিল। তথাপি তিনি একরােখা প্রকৃতির জন্য নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে অবিচল ও দৃঢ় ছিলেন আজীবন।তিনি বলতেন, প্যাশন, ভিশন, মিশন, এই তিনটের কোনও একটাও কোনও কবির কবিতায় প্রবল ভাবে থাকলে সে কবিতা পাঠককে টানবেই। তাঁর কবিতায় ছড়িয়ে আছে লোকায়ত বাংলার চিত্রকল্প। তাঁর ভাষায়, 'আধুনিক সভ্যতার কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি, কিন্তু...আমাদের আত্মাকে হারিয়েছি। আমাদের বুকের মধ্যে প্রেম আর বাঁশির মতো, মাদলের মতো নিজে থেকে বাজে না।' লিখে গেছেন সেই বোকা মানুষের কথা, সার্কাসের ক্লাউন বা যাত্রাদলের রাজা সাজার ক্ষমতা যার নেই। যে শুধু ভালবাসতে জানে, অথচ একটি শিশুও তাকে দেখে ঢিল ছোড়ে। কিন্তু এই কি সেই অপাপবিদ্ধ খ্রিস্টীয় চরিত্র নয়? কবি লেখেন, 'অথচ তোকেই বুকে জড়িয়ে সমস্ত রাত/ ঈশ্বরের মুখের উপর আলো পড়েছে, সমস্ত রাত/ যখন তুই ঘুমিয়েছিলি।তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন, ঢাকার বুকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিজের চোখে দেখেছেন, দেখেছেন দেশ বিভাগের প্রতিক্রিয়া। মন্বন্তরের করাল ছায়া-বিস্তার এবং দেশের সমাজজীবনে ও অর্থনৈতিক জীবনে তার প্রতিক্রিয়া তিনি দেখেছেন। স্বেচ্ছাসেবকের বেশে তিনি ছুটে গেছেন গ্রামবাংলার দুর্দশা-অধ্যুষিত এলাকায়- মানুষের কাছে মানুষের আবেদন জানাতে তিনি দানের ঝুলি নিয়ে কলকাতার পথে পথে ঘুরেছেন। বিচিত্র মানুষের সান্নিধ্য তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে সন্দেহ নেই। মানুষের কাছে মানুষের পরিমাপকে ছােটো হতে দেখেছেন, আবার বড়াে হতে দেখেছেন।তেভাগা আন্দোলনের অংশীদার চাষিদের ওপর পুলিশ ও জোতদারের সম্মিলিত অত্যাচার দেখেছেন- বন্দুকের গুলিতে কত চাষিকে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছেন। এতে ব্যথিত হয়েছে তার কবি-অন্তর ; মানুষের ইতিহাসে অমানবিক পশুত্বের নজির দেখে তার কবি-আত্মা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে বারে বারে। কবি-আত্মার সেই বিদ্রোহকে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর কবিতার ভাষায়।বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমৃত্যু বিশ্বাস করতেন, 'তিনিই সত্যিকারের কবি, যাঁর আত্মার অমলতা বাইরের সমস্ত ঝড়-ঝাপটায়, এমন কি মানবসমাজের মধ্যে যে বিপরীত অমানুষিকতা … আমাদের উন্মাদ করে, তার বিষক্রিয়াতেও, একই রকম অন্যমনস্ক থাকে।' আর সেইসঙ্গে 'চারদিকের পীড়িত মানবগোষ্ঠীগুলির মধ্যে তার কাজ বিশল্যকরণী বৃক্ষের মতো, যে বৃক্ষ শুধু ছায়া এবং আশ্রয়ই দেয় না, অধিকন্তু আরোগ্যের মন্ত্র জানে।' বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আরোগ্যের সেই মন্ত্র-জানা কবি।আজও তাঁর কবিতা মুখে মুখে ফেরে। সময় বলে দেয় কারা থাকবে কারা থাকবে না। কার লেখা মানুষ গ্রহণ করবে, কার লেখা মানুষ গ্রহণ করবে না। এখনো তিনি বর্তমান পাথরদের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়। তার কবিতা তরুণ সমাজের মননে জাগায় মনুষ্যত্ব বিবেক প্রতিবাদের তীব্র অনুরণন। আজকের সংকটের দিনে চারিদিকে যখন মানবতা বিপন্ন সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা ভেঙে পড়ছে সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ধর্মীয় পরিচয় মানুষের পরিচয় ঠিক সেই মুহূর্তে সমাজকে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মনুষ্যত্বের বাঁধনে ঐক্যবদ্ধ করতে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা বড় প্রাসঙ্গিক। পরিশেষে একটি কথা কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার অসাধারণ কাব্য ভাবনা চেতনা কাব্যজগতের মধ্যে দিয়ে বাঙালি পাঠকের মননে চিরস্থায়ী ও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
=========================
পাভেল আমান- হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন