বই যেখানে কথা বলে
সিদ্ধার্থ সিংহ
পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তেই থাকুন না কেন, তিনি যদি বাঙালি হন এবং বাংলায় লেখালিখি করেন, তাঁর বই যত বড় প্রকাশনী থেকেই বেরোক না কেন, কলেজ স্ট্রিট বইপড়া থেকে কোনও বই না বেরোলে, তিনি লেখকই নন... কিছু দিন আগেই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজে মুখোমুখি বসে এই কথাটাই আমাকে বলেছিলেন, এই সময়ের অত্যন্ত মেধাবী কবি--- মধুবন চক্রবর্তী।
উনি বলেছিলেন। কারণ উনি জানতেন, মধ্য কলকাতার বউবাজারের মোড় থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী রোড ছাড়িয়ে যে দেড় কিলোমিটার রাস্তাটা সোজা চলে গেছে বাটার মোড় অবধি, সেই কলেজ স্ট্রিট এবং তার লাগোয়া আশপাশের জায়গা নিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলা বইয়ের সব চেয়ে বড় বাজার।
শুধু বাংলা নয়, যদি এ দেশের সব রাজ্যের ভাষাও ধরা হয়, তা হলেও দেখা যাবে, বিক্রির দিক থেকে এটাই
ভারতের বৃহত্তম বইয়ের বাজার। তাই আজও গোটা উপমহাদেশে বইপ্রেমীদের মুখে মুখে ঘোরে কলেজ স্ট্রিটের নাম। কিন্তু কবে থেকে বই-বাজারের এই খ্যাতি লাভ করল কলেজ স্ট্রিট? তার সঠিক ইতিহাস এখনও জানা যায়নি। তবে কলকাতার বাংলা বইয়ের উল্লেখযোগ্য প্রকাশক, দে'জ পাবলিশিংয়ের কর্ণধার সুধাংশু শেখর দে বললেন, আগে কলকাতার বইয়ের বাজার এই কলেজ স্ট্রিটে ছিল না। ছিল চিৎপুর এলাকায়।
কলেজ স্ট্রিট জুড়ে যখন একের পর এক প্রেসিডেন্সি কলেজ, যা এখন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় (১৮১৭),
হিন্দু স্কুল (১৮১৭), হেয়ার স্কুল (১৮১৮), সংস্কৃত কলেজ (১৮২৪), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭),
কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (১৮৫৭) গড়ে উঠছিল, ঠিক তখনই চিৎপুর থেকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন
দু'-একজন বই-ব্যবসায়ী এই কলেজ স্ট্রিটে এসে বইয়ের কারবার খুলে বসেন। তার পর একটু একটু করে কলেজ স্ট্রিটই হয়ে ওঠে বাংলা হইয়ের সেরা বাজার।
এই মুহূর্তে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় রয়েছে কম করেও এক হাজারেরও বেশি প্রকাশনা সংস্থা এবং বই
বিক্রির প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে শুধু যে বাংলা বই-ই প্রকাশিত হয় তা কিন্তু নয়, বাংলার পাশাপাশি নিয়মিত
প্রকাশিত হয় ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ওড়িশি, অসমিয়া ভাষার বইও। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পাঠ্য
বই তো প্রকাশিত হয়ই।
তাই কলেজ স্ট্রিট জুড়ে সব সময়ই থাকে বইপ্রেমীদের ভিড় এবং আড্ডা। এই কলেজ স্ট্রিটকে আরও
প্রাণবন্ত করে তুলেছে, বইপাড়ার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ঐতিয্যময় কফি হাউস।
এই কফি হাউসই হল কলকাতার কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গায়ক, লেখক, নাট্যকর্মী, শিল্পী, অধ্যাপক
থেকে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের এক এবং অকৃত্রিম আড্ডাস্থল। কে আসেননি এখানে? নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ
অমর্ত্য সেন, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। চিত্রশিল্পী থেকে রাজনীতিবিদ, প্রথিতযশা প্রায় সকলেই এসেছেন এখানে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছেন বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে।
এই কফি হাউসকে নিয়েই মান্না দে গেয়েছিলেন সেই জনপ্রিয় গান--- 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই।
আগে এই কফিহাউসের নাম ছিল আলবার্ট হল। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। এটা তৈরি হয়েছিল ১৮৮৬ সালে। ১৯৪২ সালে ভারতের কফি বোর্ডের নির্দেশে এখানে প্রথম শুরু হয় কফি বিক্রি। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই কফির দোকানের নাম বদলিয়ে রাখে--- কফি হাউস। সেই থেকে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলে আসছে এই ঐতিয্যবাহী দোকান, থুড়ি প্রতিষ্ঠানটি। তবে ১৯৫৮ সালে এটা একবার বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকেরা এই কফি হাউস খোলার জন্য আন্দোলনে সামিল হন। ফলে শেষমেশ অনেক বাদবিতণ্ডার পরে ওই বছরই আবার চালু হয় এই কফি হাইস। ২০০৬ সালে সমবায় সমিতির গঠন করে এটার নতুন নামকরণ করা হয়--- ইন্ডিয়ান কফি হাউস।
কফি হাউস আর কলেজ স্ট্রিট আজ সমার্থক হয়ে গেছে। কারণ, কলেজ স্ট্রিট যেমন বইয়ের প্রাণ, বইয়ের সূতিকাগার, তেমনি এই কলেজ স্ট্রিটের প্রাণ আবার এই কফি হাউস। তাই দেশ-বিদেশের বিদ্বজ্জনেরা এখনও কলকাতায় এলেই বই কেনার জন্য পা রাখেন এই কলেজ স্ট্রিটে। আর এক কাপ কফি খেতে হাজির হন এই কফি হাউসে।
কলেজ স্ট্রিট শুধু বইপাড়াই নয়। এ এক চলমান সংস্কৃতির নাম। এই সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলেজ স্ট্রিট, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলেজ রো, সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট এবং কথায় কথায় যাঁর নাম তুলে আমরা কটাক্ষ করি, তুই কোথাকার কোন হরিদাস পাল রে? আছে সেই হরিদাস পাল লেনও।
আছে, একদম কলেজ স্ট্রিট মোড়েই, এক সময়ের সব চেয়ে বড় দৈনিক পত্রপত্রিকার একচেটিয়া মূখ্য
পরিবেশক, এখন লিটিল ম্যাগাজিনের সব চেয়ে বড় বিক্রয়কেন্দ্র--- পাতিরাম বুক স্টল। পাশাপাশি গড়ে উঠেছে শ্যামল বুক স্টল, ধ্যানবিন্দু, অরণ্যমন, সুপ্রকাশ বইঘর-এর মতো শুধুমাত্র লিটিল ম্যাগাজিনের স্টল।
আর লিটিল ম্যাগাজিনের কথা উঠলেই খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসতে বাধ্য সন্দীপ দত্তের কথা। তিনি তাঁর বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন--- কলকাতা লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র।
আছে বিখ্যাত মিষ্টির দোকান--- পুঁটিরাম, সন্তোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। আছে দিলখুশা কেবিন, বসন্ত কেবিন
এবং শীতকালেও যেখানে তিল ধারণের জায়গা থাকে না, সেই প্যারামাউন্ট সরবতের দোকান।
আছে, ইউনিভারসিটি ইনস্টিটিউট, মহাবোধি সোসাইটি, বইচিত্র সভাঘর, থিওলজিকাল সোসাইটি, দ্বারভাঙা হল, ওয়াই এম সি এ, ত্রিপুরা হিতসাধনী সভা। আছে অরবিন্দ পাঠমন্দির। আছে খানিক দূরে প্রায় শিয়ালদার কাছে কৃষ্ণপদ মেমোরিয়াল হল-সহ আরও ছোট-বড় বেশ কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহ।
কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার আর একটি আকর্ষণ প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিং ঘেরা সার সার কিয়স্ক। এই পুরোনো বইয়ের দোকানগুলো শুরু হয়েছে ভবানী দত্ত লেন থেকে প্রায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত।
স্বীকার করতেই হবে, কলেজ স্ট্রিটের রেলিং বরাবর এই সব কিয়স্কগুলো দুঃষ্প্রাপ্য বইপ্রেমীদের কাছে
ভীষণ আকর্ষনীয়। তাই এটাকে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরোনো বইয়ের বাজারও বলে।
এক সময়, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এই পুরোনো বই বিক্রেতাদের উৎখাত করবার জন্য
উঠেপড়ে লেগেছিলেন। কিন্তু এই পুরোনো বই বিক্রেতাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে শুধু রাজনীতির বিরোধী পক্ষই নয়, অধ্যাপক নির্মলকুমার বসুও এটা রোধ করার জন্য চিঠি দেন সেই সময়ের পুলিশের আই জি রঞ্জিত গুপ্তকে। তাতে সায় দেন, জাতীয় অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও।
এখন অবশ্য সেই ঝরঝরে ম্রিয়মাণ কিয়স্কগুলো আর নেই। সেই জায়গায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
উদ্যোগে নতুন করে পাকাপাকি স্টল তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
এখন অবশ্য পুরোনো বইয়ের দোকান শুধু ওইটুকু জায়গাতেই আর সীমাবদ্ধ নেই। সেটা মহাত্মা গান্ধী রোড থেকে মির্জাপুর স্ট্রিট হয়ে আরও দূর দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আজও অগণিত মানুষ সেই সব দোকানে, বহু বছর আগেই আউট অব প্রিন্ট হয়ে যাওয়া, পুরোনো, দুষ্প্রাপ্য, প্রায় বিলুপ্ত বইয়ের খোঁজ করতে ভিড় করেন। তাই অনেকেই এই অঞ্চলটাকে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের আঁতুড়ঘরও বলেন।
কলেজ স্ট্রিটে কলকাতার প্রথম সারির প্রকাশনা ও মূল বিক্রয়কেন্দ্রগুলো থাকলেও, পুরোনো বইয়ের বাজার
হিসেবে বিখ্যাত হলেও, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামী-দামি পুস্তককারকের মূল্যবান বই, সেটা নতুন বা পুরোনো, যাই হোক না কেন, সংগ্রহ করতে চাইলে, আর কোত্থাও না পেলে অনায়াসেই পাওয়া যাবে এখানে। তাই এই কলেজ স্ট্রিটকে বইয়ের স্বর্ণখনি বললেও এতটুকুও ভুল হবে না।
আজকের দিনে কলেজ স্ট্রিটকে প্রধানত বইপাড়া বোঝালেও, এর ইতিহাস কিন্তু খুব প্রাচীন নয়। বইপাড়া
হিসাবে এই অঞ্চল বেড়ে উঠেছে খুব বেশি হলে আশি-নব্বই বছর আগে। অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তিকালে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ সময়ে।
কলেজ স্ট্রিটে প্রথম বইয়ের দোকানের মালিক ছিলেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। তিনি প্রথম দিকে হিন্দু
হস্টেলের সিঁড়ির কোণে দুর্গাদাস করের 'মেটেরিয়া মেডিকা' বইটি বিক্রি করতেন। তার পর তিনি কলেজ স্ট্রিটে 'বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরি' নামে একটি দোকান খুলে ডাক্তারি বই বিক্রি করা শুরু করেন। ১৮৮৫ সালে এই দোকানটি তিনি নিয়ে আসেন কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে।
১৮৮৩ সালে রামতনু লাহিড়ির ছেলে শরৎকুমার লাহিড়ি 'এস কে লাহিড়ি অ্যান্ড কোম্পানি' নামে কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। ১৮৮৬ সালে এই কলেজ স্ট্রিটে আরও একটি বইয়ের দোকানের সন্ধান পাওয়া যায়, সেটা হল, 'দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি'। এ ছাড়াও আরও কিছু ছোটখাটো বই ব্যবসায়ী হয়তো কলেজ স্ট্রিটে ছিলেন, কিন্তু কালের স্রোতে বহু দিন আগেই তাঁরা বিলুপ্ত হয়ে গেছেন।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, ১৮৪৭ সালে সংস্কৃত ছাপাখানা স্থাপনের পরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একটি বইয়ের
দোকান খুলেছিলেন, দোকানটির নাম--- 'সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি'। তার ছাপাখানা ছিল আমহার্স্ট স্ট্রিটে আর বইয়ের দোকানটি ছিল আরপুলি লেনে।
১৮৮১ সালে কলুটোলায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'বঙ্গবাসী কার্যালয়'। এরা কবিকঙ্কণ চণ্ডী, পুরাণসমূহ, মহাভারত
ইত্যাদি ছেপে বিক্রি করত। এ ছাড়াও টডের রাজস্থান, স্টুয়ার্টের বাঙ্গলার ইতিহাস, মেডোজ টেলরের ঠগের
আত্মকাহিনী--- এই সব বইয়েরও পুনর্মুদ্রণ করে বিক্রি করত।
১৮৯১ সালে কলুটোলা থেকে হিতবাদী প্রকাশিত হলে, তারাও পত্রিকার পাশাপাশি একের পর এক--- বত্রিশ সিংহাসন, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের 'কঙ্কাবতী' প্রকাশ করে। হিতবাদীই প্রথম রবীন্দ্র গ্রন্থাবলি ছাপিয়ে বিনা পয়সায় গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণ করেছিল। পরবর্তী কালে বসুমতী সাহিত্য মন্দির এবং প্রবাসীও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল।
এখানে জেনে রাখা দরকার, প্রকাশনার জগতে বসুমতী সাহিত্য মন্দির কিন্তু আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যে
ধরনের অসামান্য এক-একটি বই তাঁরা প্রকাশ করেছিলেন এবং এত কম দামে পাঠকদের হাতে তুলে দিতেন যে, আজকের দিনে তা কল্পনাও করা যাবে না।
কলেজ স্টিটের বিখ্যাত বাঙালি প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ছ'পুরুষের সংস্থা দেব সাহিত্য কুটীর,
চক্রবর্তী চ্যাটার্জি, এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স, জে এন চক্রবর্তী, পুণ্য প্রকাশনী, সাহিত্যম, পত্র ভারতী, ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্স, কমলা বুক ডিপো, সেন রায় অ্যান্ড কোং, করুণা প্রকাশনী, দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোং, বীণা লাইব্রেরি, বাণী মন্দির, চক্রবর্তী চ্যাটার্জি অ্যান্ড কোং, ভট্টাচার্য সন্স, এইচ চ্যাটার্জি অ্যান্ড কোং।
অন্য দিকে মিত্র ঘোষ, আশুতোষ লাইব্রেরি, করুণা প্রকাশনী, সরস্বতী লাইব্রেরি, শিশু সাহিত্য সংসদ, এন এম রায়চৌধুরী, বর্মণ পাবলিসিং কোং এবং অবশ্যই বলতে হবে আনন্দ পাবলিশার্স এবং সিগনেট-এর কথা। যে সিগনেট পরে আনন্দ পাবলিশার্স কিনে নেয়।
ডি এম লাইব্রেরিও কোনও অংশে কম ছিল না। তাঁরা অন্য প্রকাশকদের মতো লেখকের কত বই বিক্রি হল, সেই হিসেব করে বছরের শেষে রয়্যালটি দিতেন না। বই বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পাওনাগণ্ডা একসঙ্গে মিটিয়ে দিতেন। শুধু তাই-ই নয়, বই ভাল কাটতি হলে নিজেরাই খুশি হয়ে লেখকদের বিভিন্ন উপঢৌকন পাঠাতেন। যখন অনেক বর্ধিষ্ণু লোকেরাও গাড়ি কেনার আগে দশ বার ভাবতেন, সেই সময়ে একবার কাজী নজরুল ইসলাম আর কথাসাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীকে দু'-দুটো গাড়ি কিনে তাঁরা উপহার দিয়েছিলেন। তবে এই মুহূর্তে কলকাতার
বাংলা বইয়ের বাজারের শীর্ষে রয়েছে দে'জ পাবলিশার্স। তাদের টাইটেল এখন পাঁচ হাজারের ওপর।
বইপাড়ার কথা আলোচনা করতে হলে 'বটতলা'র কথা বলতেই হবে। কলেজ স্ট্রিটে নয়, বইপাড়ার প্রথম সূচনা হয়েছিল বটতলায়। বটতলাটা কোথায় ছিল, কোথায় ছিল সেই বটগাছ? এই প্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেন জানিয়েছেন— 'সেকালে অর্থাৎ আজ থেকে দেড়শো বছর বেশিকাল আগে শোভাবাজার বালাখানা অঞ্চলে একটা বড় বনষ্পতি ছিল, সেই বটগাছের শানবাঁধানো তলায় তখনকার পুরবাসীদের অনেক কাজ চলত। বসে বিশ্রাম নেওয়া হতো, আড্ডা দেওয়া হতো। গান বাজনা হতো, বইয়ের পসরাও বসত। অনুমান হয় এই বই ছিল বিশ্বনাথ দেবের ছাপা। ইনিই বটতলা অঞ্চলে এবং সেকালের উত্তর কলকাতায় প্রথম ছাপাখানা খুলেছিলেন।'
বটতলা অঞ্চলে যে সব পুরোনো পুস্তক বিপণির সন্ধান পাওয়া যায় সেগুলি হল— 'ডায়মণ্ড লাইব্রেরি', 'পাল
ব্রাদার্স', 'হাতিউদ্দিন আহম্মদ', 'ওসমানিয়া লাইব্রেরি', 'তারা লাইব্রেরি', 'ভিক্টোরিয়া লাইব্রেরি', 'ওরিয়েন্ট লাইব্রেরি', 'সুলভ লাইব্রেরি', 'পূর্ণচন্দ্র শীল' ইত্যাদি। যেহেতু বইয়ের দোকান, নানা রকম বই মজুত থাকে এবং লাইব্রেরিতেও প্রচুর বই থাকে, তাই সে সময় বইয়ের দোকানের নামের সঙ্গে 'লাইব্ররি' শব্দটা জুড়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ১৮১৮ সাল থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে বটতলায় চালু হয় ছাপাখানা। উনিশ শতকের বটতলায় যেমন দেখা যায়, মুদ্রণ যন্ত্রের প্রাচুর্য, তেমনি বই প্রকাশনের রমরমা।
বাঙালি প্রবর্তিত সংবাদপত্র 'বাঙ্গাল গেজেটি'ও প্রকাশিত হয়েছিল এই বটতলা থেকেই।
প্রসঙ্গত, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ছিলেন একাধারে কবি এবং সাংবাদিক। তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্র 'সমাচার চন্দ্রিকা' প্রথম প্রকাশিত হয় ৫ই মার্চ, ১৮২২ সালে। তাঁর 'দূতীবিলাস' কাব্য ছাপানো হয়েছিল ৯৩ নং গরাণহাট স্ট্রিট, বটতলা থেকে।
ভবানীচরণ প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন— 'সাহিত্যে তিনিই সর্বপ্রথম ব্যঙ্গ রচনার সূচনা করেন। তিনিই সর্বপ্রথম সাহিত্যের দর্পণে বাবু ও বিবি বাঙালীকে নিজ নিজ মুখ দেখাইয়া আত্মস্থ হইতে শিক্ষা দেন। পথভ্রান্ত বাঙালীকে মানুষ করিয়া তুলিবার প্রথম ইঙ্গিত তাঁহার রচনাতেই আমরা প্রথম দেখিতে পাই।'
বলা বাহুল্য, ভবানীচরণের এই লেখাজোখাই বটতলা সাহিত্যে একটি আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল। বটতলা
সাহিত্যে এই নকশা, প্রহসন ও চটুল গানের ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মধ্য দিয়ে বারবার প্রতিফলিত হয়েছিল উনিশ শতকের সমাজচিত্র। যেমন 'কিসে নাই কি পান্তা ভাতে ঘি' (১৮৬৩) পুস্তিকায় একটি গান ছিল--- কড়াই মুড়ি তাল ফোচ্কে ছুঁড়ি। আবার একটি প্রহসনের নাম, 'হাড় জ্বালানি' (১৮৬১)।
উনিশ শতকের সমাজের যে চিত্র আমরা 'হুতুম প্যাঁচার নকশা'র মধ্যে পাই অথবা দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসনে
পাই, তার প্রকাশ সব চেয়ে বেশি ঘটেছিল বটতলা সাহিত্যে। বটতলার সাহিত্যকে আমরা যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি, নাক সিঁটকোই, নিম্ন রুচির এবং প্রান্তিক বলে সরিয়ে রাখবার চেষ্টা করি না কেন, এই সব সাহিত্য, সঙ্গীত কিন্তু গড়ে উঠেছিল তৎকালীন সামাজিক রুচি ও বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করেই। বটতলার সাহিত্যে এত রকমের মানুষের আনাগোনা হয়েছে, যা অন্য কোনও সাহিত্যে মেলা ভার। যে সাহিত্যকে আমাদের তথাকথিত সাহিত্য বোদ্ধারা 'উচ্চবর্গীয় সাহিত্যে' বলে সম্মোধন করেন, না, সেই সব সাহিত্যে তার ছিঁটেফোটাও দেখা যায়নি।
অজস্র বিষয় নিয়ে বটতলা থেকে বই প্রকাশিত হত। যেমন, ধর্ম-অধর্ম, ইংরাজ ভজনা, ইংরাজ নিন্দা,
জ্যোতিষ, জালিয়াতি, খুন-রাহাজানি, নীতিশিক্ষা, গীতিশিক্ষা, নারীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ, অসম বিবাহ--- অর্থাৎ সামাজিক সমস্ত বিষয়ই বটতলায় হাজির ছিল। বটতলা না থাকলে আমরা আজকের এই 'উচ্চবর্গীয় সাহিত্য'কে কিছুতেই পেতাম না। বটতলার বই আমাদের হারিয়ে যাওয়া অতীতকে প্রামাণ্য করে রেখেছে।
কলেজ স্ট্রিটে একাধারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃত কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো যত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে লাগল, ততই যেন প্রগতি চেতনা নতুন করে অক্সিজেন জোগাল এই অঞ্চলের পুস্তক ভাণ্ডারগুলোকে। আর তার ফলে ধীরে ধীরে এত দিনকার জৌলুস হারিয়ে ক্রমশ শীর্ণ থেকে আরও শীর্ণ হতে লাগল বটতলার বইপাড়া।
১৯১২ সালে মধ্য কলকাতায় বিদ্যুৎ চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়াকে আরও রসদ জোগাল
আর্ট প্রেস, বিজয় প্রেস, গৌরাঙ্গ প্রেস। যে গৌরাঙ্গ প্রেস পরে কিনে নেয় আনন্দবাজার সংস্থা।
এই মুদ্রণ বিজ্ঞানের উন্নতির ফলেই আধুনিক ছাপাই, বাঁধাই, বিষয়বৈচিত্র্য, আর্টওয়ার্ক দ্রুত পালটে দিতে
লাগল পাঠকদের রুচিবোধ।
কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া বিশ্বের সেরা বইয়ের বাজার হয়ে ওঠার পিছনে এটাও ছিল একটা অন্যতম কারণ।
কিন্তু বটতলার প্রকাশকেরা কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারল না কেন? না পারার প্রধানত কারণ তিনটি--- প্রথমত, পাঠকের পাঠরুচির দ্রুত পরিবর্তন। বটতলায় যে ধরনের বই বেশি কাটতি ছিল, যেমন নকশা, প্রহসন, গদ্যপদ্যের মিশ্রণে তৈরি চম্পু, অদ্ভুত বশীকরণ, তন্ত্রমন্ত্র, পূজা পদ্ধতি, ব্রতকথা, নিত্যকর্ম পদ্ধতি, তর্জা--- যেগুলো ছিল ওঁদের একচেটিয়া বিক্রি, সেই বইগুলো পাঠক আর নিচ্ছিল না। এর পাশাপাশি ওঁরা বুঝতেও পারছিলেন না, পাঠক কী ধরনের বই চাইছে। কী ধরনের বই তাঁদের করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, মুদ্রণ বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া যে ভাবে পাল্লা দিয়ে নিজেদের উন্নত করেছে, বটতলার প্রকাশকেরা তার একআনিও করতে পারেনি।
তৃতীয়ত, কাগজের দাম, ছাপা ও বাঁধাইয়ের খরচ দিন দিন এত বেড়ে গিয়েছিল যে, সেই টাকা লাগানোর মতো পর্যাপ্ত পুঁজি বটতলার অধিকাংশ প্রকাশকেরই ছিল না। ফলে তাঁদের বই-ব্যবসা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
তাঁদের মধ্যে থেকেই যে গুটিকতক প্রকাশক ওখানকার ব্যবসা গুটিয়ে কলেজ স্ট্রিট বা তার আশপাশে এসে
নতুন উদ্যোমে ফের শুরু করেছিলেন প্রকাশনা, একমাত্র তাঁরাই কোনও রকমে টিকে গিয়েছিলেন। তার পরেও যাঁরা কলেজ স্ট্রিটে এসেও পুরোনো ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে বসেছিলেন, তাঁরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কেউ কেউ দোকান বিক্রি করে একেবারে অন্য ব্যবসায় মন দিয়েছিলেন।
যাঁদের বিক্রি করেছিলেন, তাঁরা যে সকলেই বাঙালি ছিলেন, তা কিন্তু নয়। অনেক অবাঙালিও এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু অবাঙালি হলে কী হবে? বাঙালি বই-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে থেকে থেকে আদব-কায়দা শিখে তাঁরাও যেন বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরাও অন্যন্যদের দেখাদেখি ঘটা করে পালন করতেন পয়লা বৈশাখ। সে দিনই লেখকদের বরাদ দিতেন নতুন লেখার। চুক্তিও করতেন সেই দিন।
কিন্তু বইয়ের সেই রমরমা এখন আর নেই। বইপাড়া হারাতে বসেছে তার এত দিনকার সেই পুরোনো ঐতিয্য। তার জৌলুস। কারণ একটাই, নতুন করে আর পাঠক তৈরি হচ্ছে না। লোক যেন দিন দিন বই বিমুখ হয়ে যাচ্ছেন।
প্রকাশকরাও হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন ধীরে ধীরে। ফলে বেশ কয়েক জন প্রকাশক যতই নতুন করে জেগে ওঠার চেষ্টা করুন, লেখকরা যতই নতুন নতুন ভাবনা-চিন্তা করে টগবগ করে ফুটুন, বইপাড়াকে কিন্তু ইতিমধ্যেই গ্রাস করতে শুরু করেছে একটা অশুভ কালো ছায়া। স্কুলপাঠ্য বইয়ের ব্যবসা তো গেছেই, এ বার কি তবে কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধের বইয়ের পালা! কবে যে এর কবল থেকে বইপাড়া রেহাই পাবে, আদৌ পাবে কি না, কে জানে!
----------------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন