পাপান ও পুরীর জগন্নাথ মন্দির
গোপা সোম
এবার শীতের ছুটিতে পাপানরা দুই ভাইবোন, ওদের বাবা-মার সাথে পুরী বেড়াতে যাচ্ছে । পুরীতে জগন্নাথ মন্দির দর্শন করে কয় দিনের মধ্যেই বাড়ী ফেরার পরিকল্পনা। রাতের ট্রেনে উঠে, দিনের বেলায় পাপানদের পুরী পৌঁছানোর কথা। সেই মত রাতের সংরক্ষিত কামরায় উঠে, খাওয়া দাওয়া সেরে পাপান জানালার ধারে চুপটি করে বসে আছে। রাতের ট্রেনে চড়ে ভ্রমণ করতে পাপানের খুব ভাল লাগে, বিশেষ করে ট্রেনে বসে বাইরের প্রকৃতি নিরীক্ষণ করতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাইরেটা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ভালো। কোনো কোনো জায়গায়, দুএক ছোটবসতি চোখে পড়ছে, তাতে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। কোথাও আবার অনেক দূরে রাস্তা চলে গেছে, সেই রাস্তায় সারিবদ্ধ ল্যাম্প-পোস্টের আলো গুলি নজর কাড়ছে। আর যখন কোনো বড় স্টেশন আসছে, তখন আলোয় উদ্ভাসিত স্টেশন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু লোক জনের সংখ্যা খুবই কম। রাত যত গভীর হচ্ছে, তত প্লাটফর্ম আরো শুনশান হয়ে যাচ্ছে। শুধু দু এক হকারের গরম চা-গরম চা বলে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন যাত্রীদের উদ্দেশ্যে তারস্বরে চেঁচানি শোনা যাচ্ছে, চা বিক্রীর আশায়। এইভাবেই একের পর এক স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে, আর ট্রেন তার নিজের গতিতে, ঝমঝম করে এগিয়ে যাচ্ছে, কখনো বা নদীর ওপরের সেতু অতিক্রম করছে, কখনো বা বিস্তীর্ণ ভূমির বুক ভেদ করে সামনের দিকে নিজের তালে ।
জানালার কাঁচ উঠিয়ে দিলে, হু হু করে ঠান্ডা বাতাস বইছে, গায়ে যেন কাঁটা বিঁধছে, তাই অগত্যা কাঁচ নামিয়েই বসে আছে পাপান। পাপানের বোন কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। পাপান মনে মনে ভাবে, রাতের বেলায়, ট্রেনে বসে, বাইরের দৃশ্য দেখতে খুবই ভাল লাগে, বেশ একটা এডভেঞ্চার মনে হয়। এখন সে শুয়ে পড়লে, এই দৃশ্য গুলি সে মিস করবে। তাই সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও পাপান কিন্তু ঘুমোচ্ছে না। তবে ভোরের দিকে পাপান কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, সেটা সে বুঝতেই পারেনি। সকাল হলেই পুরী স্টেশন এসে যায়, মোটবাহক দের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। পাপান দের মোটবাহক, পাপান দের জিনিসপত্র সব সাবধানে নামিয়ে দেয়। পাপানরা একটা বিরাট বড় লজে ওঠে। সেই লজে যেতে যেতে, পাপান আর পাপানের বোন সমুদ্র দেখতে পায়, আর দুজনেই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। পাপানের এই নিয়ে দ্বিতীয় বার সমুদ্র দেখতে আসা। এর আগে পাপান একবার এসেছিল, ওর বাবা-মায়ের সাথে, তখন পাপানের বোন হয়নি, ও বলতে একদমই ভুলে গেছি, পাপানের বোনের নাম তিতলি। বেশ সুন্দর, ফুটফুটে, মিষ্টি মেয়ে। পাপানের বাবা সুন্দর দেখে এক লজ বুক করেছেন, তাতে সবাই, ফ্রেশ হয়ে নিয়ে, সামান্য বিশ্রামের পরেই পাপানের বাবা, পাপান আর পাপানের বোন কে নিয়ে সমুদ্রের দিকে নিয়ে যান। পাপানের মা লজে থাকেন, গোছ গাছ সেরে বিকেলে যাবেন, এই ভেবে। একজন নুলিয়া পাপানের বাবার কাছে এসে বলে, চান করবেন বাবু? পাপানের বাবা না করে দেন।
পাপানের পায়ের থেকে পাদুকা এক পাটি খুলে যায়, অসাবধানে, আর ঢেউ এর সাথে সাথে চলে যায়, পাপান চিৎকার করে ওঠে, পাপানের বাবা পাপানকে বোঝান, বাবা, সমুদ্র দেবতা, উনি কিচ্ছু নেন না, কারোর জিনিস চলে গেলে জলের তোড়ে, উনি আবার ফেরত দিয়ে যান। পাপান দেখল, সমুদ্রের ঢেউ যেন এক রাশ ফেনা নিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে, দূর হতে ছুটতে ছুটতে, এসে পাপানকে যেন বলে গেল, এই নাও তোমার পাদুকা। পাপান দেখলো, বালুচরে একপাটি পাদুকা পড়ে আছে। পাপান দেখল ওরই পাদুকা, আনন্দে চিৎকার করে পাদুকা পাটি পায়ে গলিয়ে নিল। তিতলি এটা দেখে হাততালি দিয়ে উঠলো। ঘরে গিয়ে পাপান ভালো করে স্নান, খাওয়া দাওয়া সেরে বড় দেখে একটা ঘুম দেয়, বিকেল গড়িয়ে কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, বুঝতেই পারেনি। পাপান ওর মাকে বলে, আমায় ডেকে দাওনি কেন? পাপানের মা পাপানের মাথায় হাত রেখে বলেন, বাবা, কাল রাতে ভালো ঘুম হয় নি ট্রেনে, বসেছিলি অনেক্ষণ, এই ভেবেই ডাকিনি, ঘুমের ও তো দরকার আছে !
এরপর পাপানরা জলযোগ সেরে সমুদ্রের দিকে রওনা দেয়। সমুদ্রের বালুকাবেলায় কত আলো ঝলমলে দোকান বসেছে, ঝিনুকের তৈরী খেলনা, শো পিস কাতারে কাতারে বিক্রী হচ্ছে। পাপানের বাবা পাপান ও তিতলির জন্য ব্যাগ ভরে জিনিস কেনেন। শুধু পাপান কেন, পাপানের বাবা-মায়ের ও অনেক পরিচিত আছেন, অন্ততঃ একটা করে ছোট্ট উপহার তাঁদের না দিলেই নয়। এই ভেবে অনেক কেনাকাটা বেড়ে যায়। ঘুরতে ঘুরতে পাপানরা অনেকদূর এসে যায়, সমুদ্রের ধার ধরে। এবার ফিরে আসার পালা। পাপানের বাবা মা এক জায়গায়, পাপান ও তিতলিকে নিয়ে বসেন। হাতে সাদা ফুলের মালা নিয়ে যেন একের পরে এক ঢেউ ছুটে ছুটে আসছে বহু দূর দুরান্তর থেকে। অবাক হয়ে পাপান তাকিয়ে থাকে, ঢেউ গুনতে চেষ্টা করে। পারে না। রাতের বেলায় সমুদ্রের রূপ যেন আরো অন্যরকম লাগে পাপানের। পাপানরা ঘরে ফিরে যায়, ঘরে গিয়ে নৈশভোজ সেরে, পাপান ঘুমিয়ে পরে।
পরের দিন সকালে পাপান, তিতলি জগন্নাথ মন্দির দর্শন করতে গেল, ওদের বাবা-মার সাথে। পাপানের বাবা পুজো দিলেন মন্দিরে, পাপান, তিতলি খুব আনন্দ করে মহাপ্রসাদ নিলো। ঘুরে ঘুরে বেড়ালো, জগন্নাথ মহাপ্রভুর পাকশাল দর্শন করলো, খুব মজা করলো। পাকশালে নিয়ম করে রোজ প্রভুর নিত্যসেবার জন্য প্রচুর রন্ধন হয়, অগুনতি ভক্তের প্রসাদ কোনো দিনও কম ও পড়ে না, আবার উদবৃত্ত্ব ও হয় না। পাকশালে মাটির হাঁড়িতে একের পর এক রেখে ভোগ রান্না হয়। নীচে কাঠের আগুন ধরানো থাকে, আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, সব চেয়ে ওপরের হাঁড়িতে রান্না হয় সব চেয়ে আগে, আর সব শেষে রান্না হয় নীচের হাঁড়িতে। মন্দিরের পাণ্ডা এসে পাপানদের সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো। আর ঘুরতে ঘুরতে অনেক অজানা তথ্য জানালো। পুরীর মন্দিরে নাকি অনেক রহস্য আছে, যার উত্তর অনেকেরই অজানা। মন্দিরের গম্বুজের শীর্ষে যে পতাকা দেখা যায়, সে টা নাকি বায়ুপ্রবাহের বিপরীতে উড়তে থাকে। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই, পাপানের খুব অবাক লাগে। আর ঐ পতাকা রোজ লাগানো হয়, ঝড়, বৃষ্টি, ভূমিকম্প, যা হোক না কেন, পতাকা সকালে মন্দিরের চূড়ায় লাগাতেই হবে, তাও কোনো যন্ত্রের সাহায্যে নয়, মন্দিরের মাথায় খালি হাতেই গম্বুজের ওপর উঠে পতাকা পরিবর্তন করতে হয়। আর পুরীর মন্দিরের নাকি কোন ছায়া পড়ে না, পাপানের খুব অবাক লাগে ব্যাপারটা। মন্দিরের মাথার ওপর দিয়ে নাকি কোন হেলিকপ্টার যায় না, এমন কি কোন পাখিও ওড়ে না। পাপান এসব শুনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না।
সেইদিন সকালে আর কোথাও যাওয়া হয়নি পাপানদের, মন্দির চত্বরেই ছিল। দুপুরে লজে এসে, লাঞ্চ সেরে, পাপানের একটু চোখ টা লেগেছে, ঘুম ও এসে গেছে, পাপান দেখে, পাপান আর তিতলি সমুদ্রের ধারে ঝিনুক কুড়োচ্ছে, তখন অপরূপা সুন্দরী এক নারী সমুদ্রের জল থেকে উঠে এসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, এর পর পাপান আর তিতলির দিকে চোখ পড়তেই তাঁর মুখ হাসিতে ভরে যায়। তাঁর গায়ের থেকে কি অপূর্ব জ্যোতি বেরোচ্ছে, চারদিকে ফুলের মিষ্ট সুবাসে ভরে গেছে। পাপান চোখ কচলে, ভালো করে আবার দেখে, না, পাপানের কোনো ভুল হচ্ছে না, সত্যি সত্যি জলের থেকে কেউ উঠে এসেছেন, পাপান তখন ভয় কাটিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি কে? চিনতে পারছি না তো! তখন পাপান জানতে পারে, উনি জলপরী, জলের মধ্যেই তাঁর বাস।
জলপরী পাপান তিতলির দিকে এগিয়ে এসে বললেন, তোমাদেরই আমি খুঁজছিলাম, অনেকদিন ধরে। তোমরা পড়াশোনা করো? পাপান বললে হ্যাঁ, আমি নবম শ্রেণী আর আমার বোন দ্বিতীয় শ্রেণীতে।
এরপর, জলপরী এক ডুব দিয়ে জল হতে উঠে এলেন, সাথে প্রচুর বই-খাতা, নিয়ে। পাপান দেখলো, সব বইই নতুন নতুন লেখকের লেখা, এই বই গুলি পাপান এর আগে কোনোদিন দেখেনি। পাপানের খুব ভালো লাগে, তিতলির জন্য ও জলপরী কত রঙিন বই এনেছেন, ছড়া গল্প, খুব খুব মজাদার সে বই। পাপানের খুব আনন্দ হয়, পাপান বই পড়তে খুব ভালোবাসে, সব বইতেই নূতনের গন্ধ লাগে। পাপানের মন ভরে বই গুলির ঘ্রাণ নেয়, কিন্তু পাপানের মনে চিন্তা আসে, এত বই কী করে সে লজে নিয়ে যাবে? কাকে বলবে, ভাবছিল পাপান। এমন সময় জলপরী বলেন, কি চিন্তা করছো? কী করে নিয়ে যাবে? এই তো? তোমরা চলে যাও লজে, দেখবে, তোমাদের বই ঠিক মত পৌঁছে গেছে। পাপান অবাক হয়, আর লজে ফিরে দেখে সত্যি সত্যি টেবল জুড়ে অনেক বই আর বই, সাথে খাতা, পেন, পেন্সিল, রঙ পেন্সিল ও রঙ তুলিও আছে। তিতলি মহা আনন্দে হাত তালি দিচ্ছে। পাপানের বাবা বলছেন, বড় ট্রলিব্যাগ কিনে নিলেই সব বই খাতা চলে যাবে, পাপানদের বাড়ী। কোনো ব্যাপার নয়। হঠাৎ করে পাপানের ঘুম ভেঙে গেলো। আর যখন বুঝতে পারলো, ও স্বপ্ন দেখছিল, তখন সত্যি করে পাপানের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো।
===================
গোপা সোম
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন