সন্ধিক্ষণে
প্রদীপ বিশ্বাস
-এই দাদা, আটটা বাজে - - - কলেজ যাবি না! বোন সুমিতা মাথায় একটা ঝাকুনি দিয়ে, চুলটা একটু টেনে দিয়ে চলে গেল। অন্য দিন হলে অমিত ছুটে গিয়ে সুমির বেণীটা ধরে টেনে দিত, না হয় পিঠে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিত। পিঠোপিঠি ভাই বোনে যা হয় আর কি! কিন্তু অমিত যেন আজ অন্য জগতের মানুষ। কিছুতেই তার আজ মন নেই। বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করছে না। লেপের নীচে মুখ লুকিয়ে যেন সবকিছু থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চায়।
মা একবার এসে উঁকি দিয়ে দেখেও গেল। কপালে হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করল জ্বর টর এসেছে কি না! হাঁক পাড়ল একবার - - - কলেজ টলেজ বন্ধ নাকি রে!
কোন কিছুই আজ কানে যাচ্ছে না অমিতের। গতকাল ঘটনাটা ঘটে যাবার পর থেকে তার সব কিছুই যেন ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে। গতানুগতিক জীবন যেন তার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা হয়ে যাচ্ছে।
সুনীতারা তাদের বাড়ির ভাড়াটে। একতলায় থাকে। সুনীতির বাবার বদলীর চাকরি। দুর্গাপুর থেকে বদলী হয়ে কোলকাতায় এসেছে। সুনীতি সুমিতার সমবয়সী ।সখ্যতা গড়ে উঠতে দেরী হয়নি তাদের। সুমিতার দাদা হিসেবে অমিত বাইরে বাইরে রয়ে গেছে।
সুনীতির এ বাড়িতে নিত্য আসা যাওয়া অমিতের মনে দাগ কেটেছে। অবচেতনে ভালবাসার বীজ রোপিত হয়েছে। কালক্রমে পত্রপুষ্পে সুশোভিত হয়েছে, সংগোপনে বেড়ে উঠেছে। প্রকাশ ঘটেনি। অমিতও জানতে পারেনি সুনীতির মনের কথা।
পাশাপাশি থাকলে যা হয় সেটুকু কথাবার্তা তাদের মধ্যে হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে বোঝা যায় না কারও মনের কথা।
অবরুদ্ধ মনের কথা চিঠিতে লিখে রেখেছিল অমিত। সুযোগ পেলে সুনীতিকে চিঠিটা দেবে। কিন্তু সংকোচের গন্ডি পেরতে পারেনি অমিত।
সুযোগ হঠাৎ এসে গেল। ট্যুইশানি থেকে ঘরে ফিরছিল অমিত। সুনীতি সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল একা। অমিত জিজ্ঞেস করে - - তুমি এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে কেন?
---এমনি, বাবা-মা বন্ধুর বাড়িতে গেছে। দাদাও বাড়িতে নেই। তাই----।
-ও!
এইতো উপযুক্ত সময়! সুযোগ হাতছাড়া করেনি অমিত। চিঠিটা কাছেই ছিল। কোনো কিছু বোঝার আগেই সুনীতির হাতে ওটা গুজে দিল। কোনো মতে বলল, এটা তোমার!
তারপর দ্রুত উঠে এসেছিল নিজের ঘরে ধপাস করে শুয়ে পড়েছিল। ধড়ফড় করছিল বুকটা। ঢকঢক করে জল খেল। তবুও ধড়ফড়ানি কমলো না। হাত-পা অবশ অবশ মনে হতে লাগলো।
পড়াতে মন বসলো না। শুয়ে পড়লো। এপাশ ওপাশ করলো কিছুক্ষন। অস্বস্তি কিছুতেই কাটলো না। মনে হতে লাগলো, এই বুঝি কলিং বেলটা বেজে উঠলো। সুনীতির বাবা আর দাদা বুঝি উপরে উঠে এলো। বাবা-মাকে সব বলে দিল।
রাত দশটা পর্যন্ত এমনই কাটল অমিতের। ভাবল, বাবা যখন এখনও তলব করেনি তখন মনে হয় আজকের মত বিপদটা কেটে গেল। মনটা একটু হল। কিন্তু কাল কি হবে? যদি ওরা সব বলে দেয়!
খাবার টেবিলে অমিতের মনে হল সবাই যেন তাকে আড়চোখে দেখছে, সন্দেহ করছে। বোন সুমিতা রোজকার মত খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে না। বাবা পড়াশোনার খোঁজ খবর জানতে চাইছে না, মাও খাবার নিয়ে পীড়াপীড়ি করছে না। মনটা আবার ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। মাথাটা থালার সাথে যেন মিশে যাচ্ছে। কিছুতেই সোজা করে রাখতে পারছে না। কোনো রকমে নাকে মুখে খাবার গুজে উঠে পড়ল অমিত।
শিউরে ওঠে অমিত, তার এতদিনের সুনাম মিশে যেতে বসেছে। কিছুতেই সে এটা হতে দিতে পারে না।
মনস্থির করল অমিত। ব্যাগটা গুছিয়ে নিল।
রাত থাকতেই উঠে পড়ল অমিত। ব্যাগটা নিয়ে নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে।
চমকে উঠল। সামনে দাঁড়িয়ে সুনীতি।
-জানতাম এমনটাই হতে পারে। তাই আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছি। ভয় নেই। ঘরে যাও।
মুচকি হেসে সুনীতি ঘরের দিকে গেল।
বুকের পাথরখানা নেমে গেল অমিতের।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন