পদক্ষেপ
দীপান্বিতা রায় পাল
দিনের শুরুটা বেশ ব্যস্ততার মধ্যে দিয়েই কাটে উমার। ঘড়ির কাঁটার সাথে দৌড়াতে থাকে সে।সাতটায় দূরের সাইরেনের সাথে মালতী এসে যায় সারা পাড়ার খবর নিয়ে বক্ বক্ করতে করতে।সকালে রান্নার কাজ ওকে সঙ্গে নিয়ে করে উমা। এরপর ববিকে স্কুলের জন্য রেডি করা, বাসে করে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, বাড়ি ফিরে ঘরের বাসি কাজ সেরে ছুটির সময় আবার তাকে নিতে আসা, সন্ধ্যায় ছেলেকে নিয়ে পড়তে বসা সব একার হাতে সামলায় উমা।তার উপর ছেলের নিত্যদিনের বায়না তো লেগেই আছে।সব নিয়ে মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে ও। নীল যদি স্কুলে আসা যাওয়ার খাটুনিটা একটু ভাগ করে নিত তাহলে এতটা ক্লান্তি লাগত না ওর। বাড়ি ফেরার পথে বাসে কাটানো ত্রিশ মিনিট উমার একান্ত নিজের সময়। ঐ সময়ে যত হাবিজাবি চিন্তা মাথায় তার ভিড় করে।নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ হয় সকলের আড়ালে।"আজ বাড়ি ফিরে নীলকে বলব ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য"মনে মনে সে বলতে থাকে।দুপুরে দোকানের পর নীল অনায়াসেই ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে। অথচ আজ প্রায় তিনবছর হতে চলল, নীল হাতে গুনে আট দশবার এসেছে স্কুলে, উমার শারীরিক অসুস্থতার জন্য বাধ্য হয়ে। কোনোদিনই সে এই দৈনিক দায়িত্ব পালনে উৎসাহ দেখায়নি।শ্বশুরের মৃত্যুর পর থেকে সকাল সন্ধে নীল ওর বাবার শাড়ির দোকানে বসে।কর্মচারীদের চেষ্টায় দোকানটা টিকে আছে কোনো মতে।দোকান আর বাড়ি ভাড়া থেকে যা আয় হয় তাই দিয়ে সংসার চলে একপ্রকার।নীলের তরফ থেকে পৈতৃক ব্যবসাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো তাগিদ উমা লক্ষ্য করেনি আজ পর্যন্ত। সব ক্ষেত্রেই তার পরিশ্রম না করার অজুহাত। বিয়ের আগে উমাকে পাবার জন্য যে সময় আর পরিশ্রম সে ব্যয় করেছিল তার এক শতাংশ যদি বিয়ের পরবর্তীকালে ব্যয় করত তাহলে উমা এতটা হতাশ হত না ওদের সম্পর্ককে নিয়ে। সবসময় নীলের মুখে একই কথা। "কিছু হবে না" "করা অসম্ভব" "আমি পারব না"শুনতে শুনতে এইদশ বছরে উমার আত্মবিশ্বাসও টলে গেছে বেশ কিছুটা। নীলের আজকের এই পরিনতির জন্য যিনি একমাত্র দায়ী, তিনি আর কেউ নন, নীলের মা, এটা উমার অজানা নয়। বিয়ের পর থেকে উমা শুনে আসছে তার শাশুড়ির একমাত্র ছেলেকে বড় করার গৌরবগাঁথা।ছেলে মানে বংশ রক্ষার মেসিন।তাকে খুব যত্নে রাখতে হয়। তাই ছেলেকে দিয়ে সংসারের মেয়েলি কাজ কোনো দিনই করান নি তিনি। কথাটা প্রথম শুনে উমা হেসেছিল খুব। নীল কে ঠাট্টা করে বলেছিল , "কাজের আবার স্ত্রী লিঙ্গ, মেয়েলি কাজ!" প্রথম প্রথম যাও বা উমার কথা নীল গায়ে মাখত,ববি হওয়ার পর কেমন যেন নিস্পৃহ হয়ে গেছে সবদিক থেকে। বাসের হর্নে হঠাৎ সম্বিত ফিরল উমার, বাড়ি ফিরতে এখন মিনিট খানেক বাকি।বাজার থেকে কি কি কিনে নিয়ে ফিরতে হবে তা চট করে ভেবে নিল সে। " না! , এবার নীলের সাথে কথা বলতেই হবে। আর কতদিন এইভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে থাকবে ও? " কথাটা মনে মনে বলে বাজারের দিকে এগিয়ে গেল ও। রাতে খাবার টেবিলে ইচ্ছে করেই শাশুড়ির সামনে নীলকে কথাটা পাড়ল উমা। ববি তখন পাশের ঘরে টিভিতে কার্টুন দেখতে ব্যস্ত। উমার কথা শুনে নীলের আগে ওর মা চোখ পাকিয়ে বলে উঠলেন, "কি বলছ বৌমা?দোকান সামলে এত ধকল কি নীলু বইতে পারবে?"শাশুড়ির কথা শুনে রাগে উমার শরীরে আগুন জ্বলে উঠলো। সংযত হয়ে সে বলল, " কেন পারবে না মা? দোকান সামলানোর জন্য তো কর্মচারীরা আছে।এমনিতে সকালের দিকে তো ওরাই সামলে নেয় প্রায় দিন।আজ পর্যন্ত ববির কোন ঝক্কি তোমার ছেলে পুহিয়েছে বলো?। বাবা হয়ে এটুকু দায়িত্ব নিতে পারবে না?"কথা গুলো যে শাশুড়ির মনে ধরে নি তা বুঝতে উমার সময় লাগে নি। মুখে কিছু না বললেও নীলেরও উমার বক্তব্য যে মনঃপুত হয়নি সেটা ওর শরীরী ভাষা দেখে বুঝেছিল উমা। সেদিনের পর থেকে নীল উমার সামনে ব্যস্ততার মিথ্যে নাটক করত সারাক্ষণ। আর ওর এই মিথ্যে অভিনয়ের সঙ্গী হত ওর মা। ক্রমে উমা বুঝতে পারল অলসতা আর অসত্যের যে নোংরা জাল নীলের শরীর ও মনে বিস্তার করেছে তা উমার ভালোবাসার ছোঁয়ায় দূর করা অসম্ভব। উমা এখন ওর শাশুড়িকে ঘৃণা করে। কারণ ধ্বংসের বীজ তিনিই নীলের মধ্যে গেঁথে দিয়েছিলেন অনেক আগে যার মাশুল উমা গুনে চলেছে এখনও। উমা মনস্থির করল, যে ভুল নীলের সাথে ওর মা ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে এ যাবৎ করে এসেছেন,সেই ভুল কখনো ববির সাথে পুনরাবৃত্তি করবে না সে।যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোনো উমা ওর ভুলের শিকার না হয়। লিঙ্গ বৈষম্য ভুলে ববিকে সে প্রকৃত ভালোমানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। ঘোর কাটিয়ে স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়াল উমা।ঘড়িতে তখন দুপুর ৩:৫০। ক্লান্তি কাটিয়ে স্কুলে ছুটির বেল পড়ল আর পাঁচটা দিনের মত একই নিয়মে একই ভাবে।
============
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন