মহাকালেশ্বর রহস্য
(একটি স্মার্ট সিটি
বা আদর্শ নগরীর রূপকথা )
১
-দিনকাল আর আগের মতন নেই রে... নগরের গোষ্ঠী
সংঘর্ষ থামবার নাম নেই !
-এমনটা আগে
ছিল না । আমরা শান্তিতেই
থাকতাম !
- আগে আমরা সবাই একসাথে থাকতাম ।
এখন কিছুতেই মন
ভরছে না । মনে হচ্ছে
আরও চাই । এই
বাড়তি চাহিদার জন্য
পরিশ্রম করতেও মন সায়
দেয় না ।
-এটা ইদানীং আমার
মধ্যেও হচ্ছে । কিছু
বুঝতে পারছিস ? আমিতো কিছুই
পারছিনা বুঝতে।
-আমিও ছাই কিছুই
বুঝিনি । আসলে আশ্রমে গিয়েছিলাম
ফল আর যজ্ঞের কাঠ দিতে । দেখলাম
সেখানকার ঋষিরা খুবই
চিন্তায় । তাদের মুখ শুকিয়ে
গিয়েছে । মনে হল কোন
বিপদ আসছে !
-বিপদ !খুলে বল , তুশ ...
-হ্যাঁ । আমি
বটগাছের তলায় কাপড় পেতে
শুয়ে আছি , দুপুরবেলা । কিছুটা
দূরে এক বৃদ্ধ ব্রাক্ষ্মণ আর তাঁর
চার ছেলে বসে গল্প করছিলেন । তাঁদের কথা কান পেতে শুনলাম । কথা খুব আস্তে হচ্ছিল না , তবে হ্যাঁ মুখের
শব্দ থেমে –থেমে আসছিল । তাঁরা বুঝতেও পারেননি , কেউ সেই কথা শুনছে !
-কী
শুনলি ? তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে
খুব চিন্তায় আছিস ।
বিকেল ভেঙে
সন্ধ্যা হচ্ছে । জলাশয়ের ধারে
ওরা দু’জনে বসেছে । তখনই
সূর্য ডুবে গেল ।
জঙ্গলের মাথায় কেউ যেন
চাদর চাপা দিয়ে গেল ! এই জঙ্গলে
অনেকের মতন ওরা
দু’জনেও কাঠ , ফল – সংগ্রহ
করতে আসে । এইসব
কিছু আশ্রমে পৌঁছিয়ে দেয় নিজেদের হাতেই ।
এটা তাদের জীবিকা । এই কাজের বিনিময়ে
তারা খাবার পায় । কাপড় পায় , ব্যবহার করবার জন্য ।
জঙ্গলে বসে , তাদের
ভিতর কথা হচ্ছিল । রোগা দু’জনেই
। যে খুব চিন্তায় রয়েছে ,
অপেক্ষাকৃত দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ; তুশ বলল
-আমি কান পেতে শুনলাম । আমাদের
অবন্তীর অবস্থা বেশ
চিন্তার ।
উল্টো দিকে
বসে থাকা , লম্বা রোগা
আর ভারী গলায় লোকটি
বৃকোদর । বলে উঠল – আরে , অত পুঁথিবাক্য
না ঝেড়ে পরিষ্কার ভাবে বল –
দু’জনেই মধ্যবয়স্ক । সমবয়সী । তুশ বলল -
ওঁরা একটা গল্প
বলল ।
-গল্প !
-মন
দিয়ে শুনলেই সব
পরিষ্কার হয়ে যাবে ।
-থামবি না । বল ...
চারজন পুত্রের মধ্যে
প্রথমে বড় ছেলে বলল -
পিতা , আপনি বলছিলেন , আমাদের
এই নগরটি আগের মতন
সুরক্ষিত নয় । এখানে অনেক
পরিবর্তন আসতে চলেছে ।
এইসব পরিবর্তন গুলো
সম্বন্ধে আমাদের জানাবেন ।
আরেকজন , সে
মেজো ছেলে , বলল - আমরা এত দিন
বেশ শান্তিতেই ছিলাম এখন আবার নতুন
করে কিছু উপদ্রব
দেখা দিচ্ছে । আমরা যে
পরিকল্পনা করেছিলাম তাতে
বেশ সমস্যা ।
এত
কিছু শুনে ছোট ছেলে
বলল – পিতা আপনি জানেন , বেশ কিছু
নিম্ম বর্গীয় মানুষেরা বিক্ষোভ
দেখাচ্ছিল । তাদের বিরোধ ছিল আমাদের
উপর । তাদের কথায় , আমরা তাদের
উন্নতির পথে অন্তরায় । আমরাই তাদের
হত দারিদ্রতার জন্য দায়ী ।এমনটা হলে আমরা
উন্নয়নের কাজ করতে পারব না ?
পিতা বললেন – তারমানে এই সমস্যার
আভাস পেয়ে গিয়েছো । আজ
এখানে আমরা মিলিত
হয়েছি , এই বিষয়টির জন্যই । আমি
তোমাদের একটা ঘটনার
কথা বলব । মন দিয়ে
শুনবে ...
২
সদ্য সূর্য
উঠেছে । খুব ভোরেই নগরের মুখে
যাত্রা শুরু করলাম ।
শুনেছি শিপ্রা নদীতে জল নিয়ে
গণ্ডগোল শুরু হয়েছে । এখনাকার
সমস্যা হচ্ছে , আমরা
সবাই জল পান করি , জমিতে চাষের জন্য
জলের ব্যবহার করি , ফসলের
সবুজ রঙে যখন নদীর
পাশের অঞ্চল ভরে যায় – উৎসব করি । এই
নদীর প্রতি যে আমাদের
মানুষের দায়িত্ব রয়েছে , ভুলেই
গিয়েছি ! ভগবানের প্রতি দায়িত্ব
পালন করছি । শুধু প্রকৃতির ক্ষেত্রেই উদাসীন !
আমার অনুচরেরা এসে খবর
দিয়েছিল , শিপ্রা নদীর
চড় ক্রমশই দূষণে
ভরে উঠেছে । কয়েকদিন
ধরেই , নতুন ফসল উৎপাদনের
জন্য পুজো করা
হয়েছিল । সেই সামগ্রী , ব্যবহৃত
জিনিস – সমস্ত কিছু নদীতে
বিসর্জন করা হয়েছে । সেখান থেকেই এই সমস্যা ।
আমি
খুব তাড়াতাড়ি নদীর দিকে হেঁটে
চলেছি । কেননা এখানকার অবস্থা খুব একটা
ভালো নয় । আমাদের বিরোধী
শিবির যে কোন সুযোগে
ঝামেলা করতে পারে । শুধু ঝামেলা নয় , এই ঝগড়া দেখতে
- দেখতে গোষ্ঠী লড়াইয়ের আকার
নেবে । আমি তাই খুব
দ্রুতই পা চালিয়ে যাচ্ছিলাম ।
নগর
পেরিয়েছি । মাঝে খুব ছোট্ট
জঙ্গলের সরু রাস্তা
ধরেছি , খুব তাড়াতাড়ি যাব বলেই
এই পথে এলাম । আচমকাই তিনজন
আগন্তুক আমার সামনে এসে দাঁড়ালো । আমি বিরক্তই
হলাম ।
তাদের চোখ দেখে
মনে হচ্ছিল , খুব সাধারণ ।
-আপনি মহাকালেশ্বর দর্শন
নিয়ে চর্চা করছেন ?
আমি বেশ কিছুটা
অবাক হয়ে গিয়েছিলাম
! এই চর্চা
আমাদের একান্ত । দীর্ঘ পাঁচ
বছর ধরে গবেষণা
করে আসছি । এর রহস্য
সবটাই এখনো আমাদের কাছে অজানা। তবে এটাও
ঠিক আমাদের অনুসন্ধান
বেশ এগিয়েছে । আর এর সুফল
আমরা পেতে পারি অদূর ভবিষ্যতে ।
আমাদের এই গোপন বিদ্যার কথা , আমাদের
খুব কাছের লোকজন ছাড়া কেউ জানেনা
। এনারা
কোন তরফের ? আমাদের এই দর্শন
এখনো প্রয়োগ করিনি , অথচ এই গুপ্ত বিদ্যা
নিয়ে ইতিমধ্যে যে
বিকল্প শিবির তৈরী
হচ্ছে , টের পেলাম
।
-হ্যাঁ । আপনারা !
আমি জানতাম লুকিয়ে
লাভ নেই । বরঞ্চ এই লোক
গুলোকে চিনবার চেষ্টা
করি । আমার কথা শুনে
তাদের মধ্যে থাকা
একজন যুবক বলল – ব্রাক্ষ্মণ , আমাদের সাথে আসুন ।
-কোথায় ?
-আপনি আমাদের
বিশ্বাস করতে পারেন । আমরা দস্যু নই । আপনার
ক্ষতি করব না । শুধু
চোখ দুটো কালো
কাপড়ে বেঁধে দেব । জঙ্গলের
দূরেই আমাদের রথ । কষ্ট
হবে না । এইবার অনুমতি দিন ।
কিছুটা ঘাবড়ে
গিয়েছিলাম । তাদের গলায় এমন দৃঢ়চেতা
ভাব , মনে হল আমার
অনুমতির অপেক্ষা শুধু মাত্র নিয়ম মাফিক ।
আমি বললাম –এখন আমাকে শিপ্রা
নদীতে যেতে হবে । সেখানে সকাল থেকেই ঝামেলা শুরু হয়েছে ।
-আপনি এত ভাববেন না । সেই ঝামেলা এখন আর নেই । আপনি আমাদের সাথে আসুন ।
-মানে ?
-ঝামেলা আমরাই বাধাই । আবার আমরাই মিটিয়ে
দিয়েছি । আপনাকে অপহরণ করব বলেই
এই সব কিছু আয়োজন । আপনার আশ্রম
থেকে এখানে আসতে
জঙ্গলের পথ রয়েছে , পাছে
আপনি এই পথ দিয়ে আসেন , আমরাও
অপেক্ষা করছিলাম । শিপ্রা নদীর তীরেও
আরেক দল রয়েছে ।
-আমি কিছুই
বুঝতে পারছিনা ! তোমরা নিজেদের
পরিচয় দাও ।
-আমরা অনুচর
দূষণের । এখন আপনি আমাদের
সাথেই যাবেন ।
-দূষণ কে ?
-মাপ করবেন , এই
বিষয়ে আর প্রশ্ন
ক্রা যাবেনা ।
আমার কিছু
বলবার আগেই , একজন কালো কাপড়
আমার দুই চোখের
পাতার উপর রেখে মাথার
পিছনে বেঁধে দিল । আরেকজন
হাত দুটো বেঁধে
দিয়েছে ।
আমি
বুঝলাম এখন আমার কাজ
ওদের অনুসরণ করা ।
চোখ যখন খুলল , মনে হয়েছে
, দীর্ঘক্ষণ
সুড়ঙ্গের ভিতর যে
আলোর খোঁজ চলছিল , তারই
সন্ধান । অনেকক্ষণ আলো
ছিল না । তাই প্রথমে চোখ
ঝাপসা লাগছিল । দু’হাতে চোখ
মুছে দেখলাম , চারপাশটা
অন্ধকার । আমি নিজে সেই
অন্ধকারের ভিতর ছোট্ট
বিন্দু ! বুঝতে পারছিনা , রথের উপর
জখন যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম , টের পাচ্ছিলাম পথ সমতল
নয় । রথ থামল ।
বেশ কিছুটা হেঁটে
এলাম । চোখ
খুলতেই অন্ধকার !
-আসুন ব্রাক্ষ্মণ ...
গলাটা
বেশ ভারী । কানে ছুঁয়ে গেল ! ঘাড় ঘুরিয়ে বক্তাকে খুঁজবার
চেষ্টা করছি । আবার হাসি
শুনতে পেলাম ।
-আপনি আমাকে দেখতে
পাবেন না । আমি অদৃশ্য , এমন ভাবেই আমাদের
মধ্যে কথাবার্তা হবে ।
অসুবিধা নেই তো ?
-না নেই ।
‘না
নেই’ -- , কথাটা বলেও ,
নিজেকে বিশ্বাস করতে পাচ্ছিনা ! এমন পরিবেশ
এর আগে আমি উপলব্ধি করিনি ।
প্রাণের ভয় নেই । একটা
অস্বস্থি ,নাভি থেকে
গলা অব্দি দম বন্ধ ভাব
উঠে আসছিল । নিঃশ্বাস
নিতে কষ্ট হচ্ছে ।
আমি বললাম – আপনি কে ?
এমন ভাবে আড়ালে থেকে
কথা বলবেন !
লোকটির তীব্র
হাসির স্বর শুনতে
পেলাম । মনে
হচ্ছে , বুকে ধাক্কা
মারল ।
আমি
বললাম – আপনি সামনে আসুন । আমি
নিরস্ত্র আর আপনাকে
আক্রমণ করবার সামর্থ্য নেই ।
-থাকলেও মারতে
পারতেন না । আমি গুপ্ত
বিদ্যার চর্চা করি ।
-তাই নিজেকে
আত্মগোপনেই রেখে দেবেন
?
-প্রয়োজনে ।
-আপনার এমন
লুকিয়ে থাকবার দরকার কী ?
-আছে । এর
উত্তর পড়ে দেব ।
তবে আপনার নিজের
জন্যও আমার বীভৎস মুখ দেখার দরকার
নেই । অহেতুক
আতঙ্কিত হবেন ।
-একদম নয় । ব্রাক্ষ্মণরা সহনশীল
হয় । আপনি দেখান , আমার
ক্ষতি হবে না ।
-আমি দূষণ । একটা
বিশেষ কারণে আপনাকে এখানে
নিয়ে এসেছি , এমন ভাবে নিয়ে আসবার জন্য
, পারলে ক্ষমা করবেন ।
আমি
খানিক অবাক হয়ে
গেলাম । বললাম – আপনি
কোথায় ?
-এই
গুহার ভিতর এমন
জায়গা রয়েছে , আমি আপনাকে
দেখতে পাচ্ছি । আপনি আমার গলার
স্বর শুনলেও । দেখতে পাবেন না ।
-এই লুকোচুরির দরকার
আছে ?
-এটা ভবিষ্যৎ
বলবে । এখন এই নিয়ে সময়
নষ্ট করে লাভ
নেই । সময় আপনার কাছেও দামী । আমার কাছেও । আসুন আমরা
আলোচনা করি ।
-কোন বিষয়ে ?
-আপনি অবন্তী নগরকে
আদর্শ নগর হিসেবে
গড়ে তুলতে চাইছেন ।
এখনাকার অধিবাসীদের বিদ্রোহী করে
তুলছেন । আপনার নগরে শুধু ব্রাক্ষ্মণ নয় ক্ষত্রিয় , শূদ্ররাও রয়েছে । এদের
ভিতর থেকে আপনি
ভয় , নিয়ম তুলে দেবেন
?
-আমি বুঝতে
পাচ্ছিনা । আমার
নগরে সব শ্রেণীর
মানুষ নিজের মতন
থাকেন । তাদের একত্রে থাকবার
কোন সমস্যা নেই । থাকলেও খুব
সামান্য । আমি তাদের সকলকে
নিয়ে শুধুমাত্র গবেষণা করছি ।
বলতে পারেন অবন্তী
নগরকে মানব সম্পদের উন্নয়নের
জন্য পরীক্ষাগার হিসেবে
ব্যবহার করা হচ্ছে ।
-এখানেই আমার আপত্তি । আমি চাইছি আপনি এই কাজ থেকে দূরে থাকুন । এইধরনের পরীক্ষা
বেশ বিপদজনক ।
-কেন ?
-দীর্ঘদিন যে
ব্যবস্থায় মানুষ বসবাস করে , সেই ব্যবস্থাই তার
নিজের । সেখানে সে
সবচেয়ে বেশী মানিয়ে
নেয় । স্রোতের বিপক্ষে
সাঁতার দিতে গেলেও ,
স্রোতের খানিক সহযোগিতা দরকার ।
-
দক্ষ সাতারুর আত্মবিশ্বাস থাকলে
বিপক্ষ স্রোতকেও , নিজের
জন্য ব্যবহার
করা যায় ।
- ব্যবহার ! আমি এই কথাই বলছিলাম । মানুষকে ব্যবহার
করছেন ভালো , তবে নিজের
উন্নতির জন্য করাটাই
বুদ্ধিমানের কাজ ।
-আমি নিজের স্বার্থেই তাঁদের ব্যবহার করছি । দেখুন
আদর্শ নগরীর স্বপ্ন
সফল হলে , আমাদের
পরের প্রজন্ম সুস্থ থাকবে
। এটা আমাদের কাছে বড়
পাওনা । ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষা
করতে পারাটাই আমার স্বার্থ ।
-আপনি আমাদের হয়ে কাজ
করুন । নদীর জলে
সকলের উপর অধিকার
ঠিকাছে । তাইবলে নিঃশুল্ক করে
দেওয়া ঠিক নয় ।
-একটা আদর্শ
নগরীতে জল আর খাদ্য
সকলের কাছে পৌঁছাতে
হয় । শিশু মৃত্যুর হার যেন কমে ।
অপুষ্ট শিশু যেন
না জন্মায় । আমি সেই চেষ্টাই করছি । এই সব
কিছুর আগে দরকার শ্রেণীমুক্ত
সমাজ । এখন সমাজে যারা পিছনে
রয়েছেন তাদের ভর্তুকি দিয়ে
একটা নির্দিষ্ট সময়ের
মধ্যে তাদের মধ্যে
আর্থিক বৈষম্য মিটিয়ে দেব । এরজন্য অবশ্য নগরের
প্রাকৃতিক উপাদান গুলোর
দায়িত্ব নগর প্রধানের
হাতেই । সেই উপাদান সকলের
জন্য ব্যবহার করা
হবে । নির্দিষ্ট
সময়ের জন্য সকলকে
সুযোগ দেওয়া হবে ।
এর বদলে অবশ্য
নগরের জন্যও নাগরিকদের সেবা দিতে
হবে । এমন ভাবেই দেওয়া
-নেওয়ার মাধ্যমে চলবে
সমাজ ।
-এই
ব্যবস্থায় যদি কেউ
ভালো কাজ করে ।
-নিঃসন্দেহে সে
এগিয়ে থাকবে ।
-তাতে শ্রেণী বিভাজন
কমবে ?
-যদি আপনি
নিজের দু’ হাতকে ব্যবহার করতে না
পারেন , পিছিয়ে
পড়বেন । প্রতিযোগিতা হবে নিজের
সামর্থ্যের সাথে অন্য
সামর্থ্যের । সমাজ
কোন স্তর আরোপিত
করবে না । এটাই আমার
শ্রেণীমুক্ত সমাজের পদ্ধতি
।
-আমি প্রকৃত অর্থে এমন নগর তৈরী করতে
চাই , যেখানে নগরের হাতে
কোন দায়িত্ব থাকবেনা প্রাকৃতিক
সম্পদ ব্যবহারের । নাগরিকরা
অসীম সুখ ভোগ
করবে । তারা স্বাধীন । যে যেমন ভাবে
নিজেদের দায়িত্ব নেবে
। নগর কোন
কিছুতেই মাথা গলাবেনা ।
-এমন ভাবে
ক্ষতি শুরু হবে ।
এক পক্ষের হাতে
প্রচুর সম্পদ আর
অন্য পক্ষ সমাজের প্রান্তিক
সীমায় থাকবে ।
-তাইতো বলছি ,
সভ্যতা কখনই শোষণ মুক্ত
হবে না । কেননা মানুষের
ভিতরে অন্যের উপর কর্তৃত্ব করবার যে
প্রবণতা , তা শাশ্বত । শোষণ থাকলেই শ্রেণী সৃষ্টি
হবে । শ্রেণীহীন সমাজের
কল্পনা অলীক , মিথ্যা
চিন্তা ।
-আমি শ্রেণী বিলুপ্ত সমাজের
কথা বলিনি । আমি বলেছি
মানুষ যেন নিজের সামর্থ্যেই সমাজের
শ্রেণীগত অবস্থানের পরিবর্তনে
সক্ষম হয় ।
-দেখুন , নগরের শাসক
নিজের স্বার্থেই এমনটা হতে
দেবেনা । কারণ
যে সমাজে শ্রেণী থাকেনা
, সেখানে শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই
সরাসরি করা যায় । এটাই মহাকালের
বিধান ।
-খুবই বিপদজনক ।
এই বিধানে আদর্শ
সমাজ তৈরী হতে পারেনা ।
-মানে ? আদর্শ
সমাজ বলে কিছুই নেই !
যা অনেক সময় পর্যন্ত টিকে
থাকে , তাই আদর্শ হয়ে
ওঠে । আমরা দু’জনে
মিলে একটা নতুন
নগরের নির্মাণ করব ।
-সেই নগর
পরিচালনার দর্শন কী হবে ?
-আমি যেই দর্শন
এতক্ষণ আপনাকে বললাম ।
অবাধ ভোগ –বিলাসে দিন
কাটানো ।
-আপনি আদর্শ
সমাজ বলতে এমনটাই বোঝেন ?
-যেখানে , মানুষের চাহিদা শাসকের উপর নির্ভরশীল না
থেকেও নির্ভর করবে । এমন
স্বাধীনতা দেওয়া হবে , যাতে নিজেদের চিন্তার আর
মুক্তির পরিসীমা যাবে !
সে ভুলে যাবে
কতটুকু তার চাহিদা
। এই কৃত্রিম আকাঙ্খাই
, চাহিদা আর লোভের জন্ম দেয় ।
আমরা কেউই ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে
পারিনা । নাগরিকদের চাহিদার দিকে তাকিয়ে কখনোই
শাসক চলতে পারবে না। কেননা
চাহিদাকে কখনই একটি নির্দিষ্ট সীমায় আটকে
রাখা সম্ভব নয় । তাই তাদের নিজেদের
ভিতরেই নিজেদের আটকে রাখতে হবে । ভেদাভেদ
সেই অমোঘ অস্ত্র – যা ব্যবহার
করলে নাগরিকরা নিজেদের সাথে নিজেরাই বিবাদে মত্ত থাকে । শাসকের সুবিধা হয় । আমি
এই দর্শনেই ভরসা
রাখছি ।
-এই চিন্তা অসুর চিন্তা । নাস্তিক
চিন্তা । যা প্রকৃতির বিপরীত , তাকে নিয়ে
সমাজে মানব সম্পদের
উন্নয়ন সম্ভব নয় ।
-কেন সম্ভব নয় ? আমাদের পথ আলাদা । আমি কখনই বলিনি
নাগরিকদের বিকাশের থেকে সরে আসব । আমি
বলছি , তাদের উন্নয়নের পরিমাপ হবে শাসকের
পারগতা । সে অপারগ হলে
শাসন চলবে কেমন
করে ? অনেকে অনেক কিছু চাইবে , সমস্যা হচ্ছে সেই
চাওয়ার নিয়ন্ত্রণ নাগরিকদের হাতে থাকবার
দরকার আছে কি ?
-আকাঙ্খার গোলক ধাঁধায় ঘুরবে !
-মানুষের ভূমিকাকে স্বীকার না করলে ,
মনের বিকাশ ঘটবে না । সৃষ্টি থেমে যাবে ।
মহাকালেশ্বর তথ্যে – পৃথিবীর সেই
বিপদের কথাই বলতে চেয়েছি ।
-আমি সব জেনেছি , তাই আপনাকে আমার
দলে আসবার জন্য অনুরোধ করছি ।
-মানে ?
-আপনি খুব
বিদ্ব্যান আর পণ্ডিত
। এত গুপ্ত বিষয় নিয়ে
গবেষণা করে চলেছেন । সফল
হয়েছেন , এইটুকু অন্তত বুঝে
গিয়েছেন যে আপনার এই
গবেষণা আমার কাছে
স্বর্গরাজ্য দখলের চেয়েও
বেশী গুরুত্বপূর্ণ । কেননা ,
মানুষের মধ্যে কর্তৃত্ব
করবার মজাই আলাদা ।
আসল কথা হচ্ছে , আমি চাইব আপনি
এই গবেষণার প্রয়োগ না
করেন । কেননা আপনার শাসন
করবার পদ্ধতি মানুষ
গ্রহণ করবে দ্রুত । আর এমনটা
হলে , কেউ আমাদের গুরুত্ব দেবে
না । শুধু তাই নয় তাদের
দখল করতে পারব না । এমনটা
মানা যায়না । তারা বিদ্রোহ করতে পারে ।
-জনগণকে নিজের
সুবিধা দেখতে দেবেন না !
-সবাই নিজেরটা
দেখে , আমিও দেখব ।
-আমিও দেখছি...
কিছুক্ষণ দু’জনের
কণ্ঠস্বর থেমে গেল ।
আমি কিছু
বুঝতে পারছি না । এতটুকু টের পেলাম
, এতক্ষণ যে
আমার সাথে কথা
বলছিলেন । তিনি কিছুটা হলেও
রেগে রয়েছেন । আমাকে বললেন – দেখুন
, আপনাকে এইকথা গুলো
বলবার জন্যই এখানে
আনা হয়েছিল । চিন্তা নেই
নিরাপদেই যেখান থেকে নিয়ে
এসেছিল , সেখানেই আপনাকে
ছেড়ে দেওয়া হবে
। তবে আজকের
পর থেকে নিজের
নগরের দায়িত্ব আপনি
নিলেন । আমি কিন্তু আপনার
দর্শনের বিকল্প রাখব ।
তখন আমাকে দোষ
দিতে পারবেন না।
চোখ
দুটো কেউ পুনরায় বেঁধে
দিল ! আমাকে নিয়ে যাবে ।
গল্প শেষ হতেই ,
পিতা পুত্রদের উদ্দেশ্যে
বললেন - আমাদের সজাগ
হওয়ার সময় এসেছে । কোন ভাবেই
দূষণের পরিকল্পনাকে সফল হতে
দেওয়া যাবে না
।
ছোট
ছেলে বলল – পিতা আপনি
বলুন আমরা কেমন
ভাবে আদর্শ নগরী
নির্মাণ করব ? জনগণের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য
দিতে হলে কোন
পথ গ্রহণ করতে হবে ?
পিতা হাসছেন ।
বললেন - পুত্র , জনগণের
জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে
গিয়ে কোনদিনই সফল
হবে না ।
কেননা বিনাপরিশ্রমে কিছু
পেলে , মানুষ অকর্মণ্য হয়ে
ওঠে । সে সমাজকে কিছুই দিতে পারেনা
। মনে
রেখো আদর্শ নগরী ,
আদর্শ নাগরিক তৈরী
করে । যে নিজে স্বনির্ভর ।
তাদের ব্যবহারের জন্য
উপযুক্ত বাসস্থান , পোশাক
, খাদ্য দিচ্ছ , অথচ তাদের
জীবিকার দিকে খেয়াল
নেই , এমন উন্নয়ন শুধু মাত্র
শাসকপন্থী উন্নয়ন । দূষণের
পরিকল্পনা এমনটাই ,
জনগণকে কর্মবিমুখ উন্নয়নের
স্বপ্নে বিভোর করে ,
নিজেদের ক্ষমতা কায়েম রাখা । এটা
সুস্থ সমাজের জন্ম দিতে
পারেনা ।
৩
গল্প থেমে
গেলে । যিনি এতক্ষণ
পিতা আর পুত্রদের গল্প
শোনাচ্ছিল , তুশ থেমে
গিয়েছে । পাশে বসে থাকা
উল্টো দিকের লম্বা , রোগা লোকটি
বৃকোদর । ভারী
গলায় বলে উঠল - তোমার
গল্প শুনলাম । বেশ
ভালো ।
-শুধু ভালো ?
-না
এটা ঠিক , কাজ
না করলে মানুষ
অলস হয়ে ওঠে । আমি তাই সবসময় কাজের
পক্ষে ।
-অবন্তী নগরীতে
খুব ঝামেলা চলছে । যারা
এতদিন পরিশ্রমের পক্ষে ছিল , আজ
তারাই বিদ্রোহ করছে ! তাদের কথা
নগরের প্রধানরা তাদের
পরিবারের দায়িত্ব নিক ।
এতদিন দেওয়া -নেওয়ার মাধ্যমে পরস্পরের
উপর নির্ভর করতাম । এখন বিদ্রোহীরা
বলছে সম্পূর্ণ জীবন
ধারণের দায়িত্ব নিতে
হবে । শুধু তাই নয়
তারা ক্রমশই নগরী
ত্যাগ করছে ।
বৃকোদর বিশেষ কিছু
বলল না । হাই তুলল । মাথা চুলকিয়ে বলল
-ভাই , আজ উঠছি ।
জানিনা আবার কবে
দেখা হবে ?
তুশ
বেশ কিছুটা অবাক
হয়ে বললেন - কেন ?
ইতস্তত মুখ
নিয়ে বলল -
আসলে , কাল খুব
ভোরেই পরিবারকে নিয়ে
অবন্তী ত্যাগ করব ।
-কেন ?
- পাহাড়ের ওইদিকে
এক নতুন নগর তৈরী
হচ্ছে । সেখানে নাগরিকদের সব
দায়িত্ব নগর প্রধানের । নাগরিকদের
কোন পরিশ্রম করতে হবে
না ।
-তাহলে এমনি
-এমনিই ...
-না , মানে বদলে নগর
প্রধানের কথা শুনে
চলতে হবে ।
নিজের স্বাধীনতা থাকবে , সেই স্বাধীনতার
পরিমাণটাও অবশ্য শাসকই নির্ধারণ
করবে । এই অনেক রাত
হল আসছি...
তুশ
দেখছে , হেলতে -দুলতে
তার বন্ধু ক্রমশই
জঙ্গলের ছায়া মাখা পথ
ধরে এগিয়ে
চলেছে ।
ছোট্ট
নিঃশ্বাস ছেড়ে তুশ
বলল - মানুষ শত
চেষ্টা করলেও নিজের
প্রবৃত্তির কাছে হেরে
যায় !
=========০০০==========
পিনাকী চক্রবর্তী
যাদবপুর, কলকাতা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন