মঙ্গলের খোঁজে
জুলাইয়ের প্রথম দিন।তখনও সূর্য মামার রাঙানো চোখে ঝলসে যায় শরীর।এই দুপুরে দুস্থ হা-অন্ন পরিবারের ছেলে মেয়েদের দুমুঠো অন্নের জন্য পেটে লু বয়ে চলে।অজ গ্রামের দুস্থ পরিবারের ছেলে মঙ্গল।দুবেলা দুমুঠো অন্ন জুটাতে মাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়।শত কষ্টের আবেশেও ছেলেকে একটু শিক্ষিত করার প্রবল অভিলাষ।গ্রামের স্কুলেই মা ভর্তি করেন প্রাণের বাবুমশায়কে।সকাল থেকে দুটো অন্ন তার পেটে যায়নি।পেটে স্কুলের ডিগবাজি চলছে। টিফিন হলে সে ছুটে যায় ন্যাড়া মাঠের শেষ প্রান্তের বাঁশ খড় দিয়ে ঘেরা একচালা রান্না ঘরে।খিদের যাতনায় দ্রুত বেগেই সে রান্না ঘরে পৌঁছে যায়।কিন্তু সেখানে গিয়ে অসহায় ও ক্লান্ত হয়ে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।পা হড়কে পড়ে যায় ফুটন্ত তরকারির কড়াইয়ে।সাথে সাথে স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।সেখান থেকে জেলা হাসপাতালে,তারপর এস এস কেএম হাসপাতাল।কিন্তু লাভ হয়নি দগ্ধ শরীর আর সেরে উঠেনি।মনের গহনে লু আর বাইরে আগুনের দগ্ধতার কাছে হার মানতে হয় তাকে।জবু বিবির কোলে নেমে আসে অমাবস্যা।
শুরু হয় বিক্ষোভ,বন্ধ হয়ে যায় স্কুল।পুলিশ ধরে নিয়ে যায় রাঁধুনিকে।
ছেলেমেয়েদের দেখভালের গাফিলতির দায়ে বদলি হন তিন শিক্ষক।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বভাবিক হয়।নতুন শিক্ষকগণের দায়িত্বে চালু হয় স্কুল।কিন্তু রান্না করবে কে? পুরাতন রাঁধুনির হাতে আর কেউই খাবে
না। নতুন রাঁধুনি পাওয়াও যাচ্ছে
না। তখনই আশু সমস্যার সমাধানের জন্য ছুটে যাওয়া হয় মঙ্গলের মায়ের কাছে। প্রধান শিক্ষক অনেকবার তার বাড়ি গিয়ে কাঠ খড় পোড়ান।কিন্তু তাতেও পোড়খাওয়া মন সায় দেয়নি।অবশেষে একদিন প্রধান শিক্ষক বলেন, তুমি না রাঁধলে আমার স্কুলের বাকি মঙ্গলগুলো খাবে কি? মঙ্গলদের অভুক্ত পেটের কথা বলতেই জবু বিবির জবুথবু অবস্থার অবসান হয়।স্কুলের সকল সন্তানের মধ্যেই নিজের মঙ্গলের সেবা করতে রাজি হয়।
ঢাউস উনুনে চেলাই কাঠ দিয়ে মঙ্গলদের পেটের সেবার ব্যবস্থা নিজেই করে।সবজি কাটা,বাটনা বাটা,বাসন ধুয়া,উনুন ধরানো,খুন্তি নাড়া সবই নিজের হাতে করে মঙ্গলদের সেবা করে চলেন।ক্লাস ছুট ছেলেরা উঁকি দিয়ে বলে,ও পিসি কত দেরি?
পিসির বুক ফেটে যায় কারণ তার মঙ্গলও বাড়িতে রান্না হতে দেরি হলে বলতো মা আর কত দেরি? মা বুঝতে পারত ছেলের খালি পেটে পিঁপড়ের পিলপিল।
পিসি স্বাভাবিক হয়ে বলে,যা শিগগির পালা,কড়াইয়ের আঁচ আছে,যা যা পালা। ছেলেরা ছুটে পালালে বিড়বিড় করে বলে, জানিস
না এই ফুটন্ত কড়াইয়েই তো আমার মঙ্গল গ্রহটা ছিটকে পড়ল।
আমার রান্না হলে তোদের কাছে নিয়ে যাব একদম আসবি না ।
প্রতিদিন রান্না করে ছেলেদের জিজ্ঞেস করে, কেমন হয়েছে
রে বাবারা?
যেদিন বাবারা বলে নূন বেশি বা অনেক ঝাল দিয়েছ পিসি সেদিন মনের কষ্টে বলে, বাবা আজ তোরা একটু কষ্ট করে খেয়ে নে,কাল আর এমন হবে না।
আবার যেদিন রান্না খুব ভালো হয় সেদিন ছেলেমেয়েরা যখন পাত চেটে হাত চেটে পরিষ্কার করে সেদিন তাদের মধ্যে মঙ্গল কে দেখতে পায়।
চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে বারিধারা।ভাবতে থাকে আমার মঙ্গলটাও এভাবেই পাত চেটে খেত।আজ তার জীবনে মঙ্গল নেই, শুধু আছে স্কুলের মঙ্গলরা।স্কুলের ১৩৬ টি পড়ুয়ার সেবার মধ্যেই তার মঙ্গলকে খুঁজতে থাকে। এরাই তার স্বপ্নের উজ্জীবন; এরাই তার বাঁচার আশ্রয়।
---------------------------------------------------------------
প্রশান্ত কুমার ঘোষ
রামজীবনপুর, চন্দ্রকোনা,
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন