ছুঁয়ে-দে দেবী
তখনো পাড়ার হাবু-কাকা ভোরের কাশিটা ঝেড়ে কাশেনি, তাই বিনদ-দাও হাঁড়িভর্তি
গাড়ীর জোঁয়াল গরুর কাঁধে দেওয়ার সাহস এখন দেখায় নি।
সবেমাত্র পাড়ার ভাদীখুড়ী ভোরের উনোন ধরাবে বলে বিছানায় গা'মোচড় দিয়েছে।
আর রাত নেই। রাত শেষে জগৎ যে ভোরে প্রবেশ করেছে তা এক প্রকার নিশ্চিৎ।
তবে সব ভোরকে তো আর ভোর বলা যায় না, কিছু ভোর আছে-- যে ভোরে জাগলে গা
ছম্-ছম্ করে, যে ভোরে জাগলে গা' ছ্যাক্-ছ্যাক্ করে এটা সেই ভোর।
গরমে এমনেতেই ঘুম হয়নি, তারপরে গ্রীষ্মকাল-- ফেসবুক ঘেঁটে ঘেঁটে রাতের
বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি, তাই বলে যে খুব বলমান বা গর্ব বোধ করছি তা-না,
দেহটা টলমল করছে, গরমে যে চ্যাট-চ্যেটে ভাবটা ছিল এখন আর তা নেই।
হিম্ হিম্ মন্দপবনের ভিতর দিয়ে কে যেন তুলার ন্যায় ঘুম্ ঘুম্ কোমল শিকড়
সর্বাঙ্গে বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছ।
ভাবলাম, বিধাতাপুরুষের দান, অবহেলা করলে অমান্য করা হবে। তাই দান গ্রহণ
করে পুনরায় নিজেকে বিছানায় নিক্ষিপ্ত করে দিলাম।
শুতে শুতে চোখটা গেল লেগে।
সহসা স্বপ্নে দেখছি-- কালের স্রোত নিংড়ে কারা যেন বলে যাচ্ছে--"ছুঁয়ে দে
ছুঁয়ে দে, যাকে পাবি তাকেই ছুঁয়ে দে।"
কলির জীবকে উদ্ধারের জন্য মহাপ্রভূর পিছনে যেমন অগণিত মানুষের ঢল, তেমনি
--খোলকরতাল লয়ে ঐ দেবী দুটির পিছনেও সহস্র ভক্তবৃন্দের ঢলছিল। এই
দেখেশুনে আমিও অস্হির হয়ে উঠলাম, এবং উনাদের পিছনে ছুটতে ছুটতে সুরে সুর
মিলিয়ে উচ্চৈস্বরে বলে উঠলাম--- ছুঁয়ে দে ছুঁয়ে দে, বড় লোকের মেয়েগুলোকে
ছুঁয়ে দে,-- কোনো গল্প দিয়ে নয়-- কোনো লালসার বিষদন্ত দিয়ে নয়, এক অাকাশ
হৃদয় দিয়ে ছুঁয়ে দে!।
হঠাৎ কপাট খোলার শব্দে ঘুমটা গেল ভেঙ্গে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি-- প্রায়
সাড়ে-আট'টা। মা'য়ের বকুনি খেতে হবে এই ভেবে তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে
বারান্দাতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখি-- ছলছল চোখে আঙিনার মাঝে মা'যেন
বর্ষণোন্মুখ মেঘের ন্যায়-- আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ
হো--হো করে কেঁদে উঠল।
সে কি কান্না-- ললাটে হাত রেখে বিলাপ করে কাঁদতে লাগল এই বলে---"কোন
হতভাগী আমার ছেলাটাকে ছুঁয়ে দিয়েছে গো,--ও-- ও
আমার ছেলাটাকে কে পাগল করে দিল গো--ও--ও- -।"
আমি সহজেই বুঝতে পারলাম-- মা'য়ের শব্দ-বিলাপের সাথে-- আমার স্বপ্নে দেখা
"ছুঁয় দে দেবীর মিল রয়েছে।
মনে হয় আমার স্বপ্নের চিৎকার মা' পরিষ্কার শুনতে পেয়েছে। যাক সে কথা,
মা'য়ের কান্না যেন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে লাগল।
ধীরে ধীরে পাড়ার মাসী-পিসিরা পরিষ্কার তকতকে উঠোনে ভীড় জমাতে লাগল।
প্রথমটাতে ওরা কিছুই অনুমান করতে না পেরে হতভম্ব হয়ে-- মা'য়ের ও আমার
দিকে তাকাতে লাগল।
পরিস্হিতি ক্রমাগত ঘোরাল হতে লাগল।
তাই আর বিলম্ব না করে আমাকেই হাল ধরতে হল।
আগতাদের বোঝাবার চেষ্টা করলাম এই বলে-- আমি নাকি স্বপ্নে কাকে কি বলেছি,
তাই শুনে- - আমার কথা শেষ হতে না হতেই
মা'যেন রণমূর্ত্তি ধারণ করে আমার দিকে দু'পা এগিয়ে বলল ----"খালভরা, কোন
মেয়াটা তোখে ছুঁয়েছে বল্ আমি তার সব্বনাশ করে আসবো--গো --ও-- ও- আমি তাখে
জমের হাতে দেবো, বাব্বা আমার এতোটুকু ছেলাকে ছুঁয়া! -- - আজকাল আবার
ছুঁয়া-ছুঁয়ি খেলা কি বাবা- ও-- হো-- হো--, হে ভগবান! এতুমি কি কল্লে গো-
ও-ও-!"।
মায়ের কান্না-বিজড়িত কণ্ঠে এই বিলাপ শোনার পর, জানতে কারু বাকি রইল
না,--নিশ্চয় আমি কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েগেছি।
আমি মা'কে বোঝাতে লাগলাম-- মা' তুমি অাগে শান্ত হও, আমাকে কেউ ছুয়েনি
তুমি বিশ্বাস করো- -,। মা' পুনরায় দু'পা এগিয়ে দু'চোখ রাঙিয়ে আবার চার
পা' পিছনে পিছিয়ে পাড়ার ভাদী-খুড়ীকে যাচায় করে বলতে লাগল ----" বল্ ভাদী
তুই-এই বল্, ইটা ভোরের সপুন কখনও কি মিছা হয়!?"।
মায়ের কথা,- 'মিথ্যা' বলে আগত নর-নারীকে যতই বোঝাবার প্রয়াস করি না কেন, নিজেকে কখনও ঠকানো যায় না।
মা'য়ের অনুভূতি সীমাহীন! -সে টের পেয়েছে,-"নিশ্চয় আমি কোনো এক মেয়েকে মন দিয়েছি, আমি স্বপ্নে তাকে ছুঁয়েছি!"
মা'য়ের মুখহতে বেরিয়ে আসা,--"ভোরের সপুন কি কখন মিছা হয়!"
এই কথাটি পাথেয় করে- তার স্বপ্ন দেখার এক নেশায়, আমি নতুন করে নতুন এক জীবনে পা বাড়ালাম!।
------------------সমাপ্ত---------------
শ্যামাপদ মালাকার
চন্দনপুর, জোড়দা, বাঁকুড়া।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন