অপরাজিত
শক্তিশঙ্কর সামন্ত
সইদুল ফিরে আসছিল। হঠাৎ পিছন থেকে
একটা কাতর স্বর— কাকু, আমার বাবাকে একটা কিডনি দিন না। নইলে আমার বাবা মরে যাবে
যে!
কিংকর্তব্যবিমূঢ় সইদুল থতোমতো হয়ে দাঁড়ালো। সে বুঝলো, তার স্বপ্ন, জীবনের প্রতি
ভালবাসা সবই তাহলে মিথ্যে! বারগড়চুমুক থেকে শ্যামপুরে ছুটে আসাটা তাহলে নিতান্তই
নিরর্থক।
দারিদ্র
অনেককেই কষ্ট দেয়— এটা শুধু বইয়ের পাতাতেই পড়েনি সইদুল, সে এটা উপলব্ধি করেছে শৈশব
থেকে জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে। আর দারিদ্রের সাথে তার লড়াইটাও তাই চিরকালীন।
তখন
চল্লিশের কোঠায় পা রাখতে আরও ক’টা বছর বাকি। চাষার ছেলে সইদুল ভাবলো, এভাবে আর
সম্ভব নয়। চাষে যা হ্যাঁপা! দেড়-দু’বিঘের একফসলি জমির উপর নির্ভর করে সংসার
নির্বাহ সত্যিই দুঃসহ। তাই এবার ব্যবসা করবে সে।
ভাবনার সাথে
সাথেই সাহসী সইদুল নেমে পড়লো ব্যবসায়। যেখানে যতটুকু টুকরো টুকরো জমিজমা ছিল,
বিক্রি করে দিল সব। তারপর ধার-দেনা করে আর নিজের পুঁজিটুকু এক করে সে জুতোর দোকান
লাগালো একটা। গ্রাম থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে উলুবেড়িয়া বাজারে।
সহজেই দু’টো
পয়সার মুখ দেখতে শুরু করলো সইদুল। কিন্তু মারে আল্লা— রাখে কে! সইদুলের জীবনে নতুন
করে নেমে এল এক অকাল রাত্রি। এক রাজনৈতিক সংঘর্ষে একদিন পুড়ে ছাই হয়ে গেল সইদুলের
দোকান। পাশাপাশি আরও কিছু আস্তানা। সব খুইয়ে যেন বাজ ভেঙে পড়লো ওদের সংসারে।
সইদুলদের
সংসারে ছ’টা পেট। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী ও দু’টো সন্তান। এই দুর্মূল্যের বাজারে চলবে কেমন করে সংসার?
ভেবে আকুল হল সইদুল। কুলকিনারা না-পেয়ে একদিন শহরে ছুটতে শুরু করলো সে রঙ
মিস্ত্রির জোগাড়ে হয়ে। কিন্তু বিশেষ সুবিধা হল না। নিয়মিত কাজ নেই যে!
অগত্যা কী
করবে সইদুল? সে কি তবে হেরে যাবে? কিন্তু তা কী করে সম্ভব! হেরে যাওয়ার জন্য
অনেকেই জন্মায়, কিন্তু সইদুল কেন ও-পথের পথিক হবে!
এমনি করে
হাজার ভাবনায় তাড়িত হয় সইদুল। হঠাৎই মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় দেখা একটা সিনেমার কথা।
ব্যাস, খুলে যায় তার নতুন ভাবনার জানালা। কাউকে কিছু না জানিয়ে কাগজের বিজ্ঞাপনে
চোখ রাখতে শুরু করে সইদুল।
ক’দিন পরেই
চোখে পড়লো প্রত্যাশিত বিজ্ঞাপন। হাওড়ার শ্যামপুর থানার আঁটলে গ্রামের বাসিন্দা
শ্যামল মুখার্জীর দু’টি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। একটি কিডনির জন্য আবেদন জানিয়েছেন
তিনি খবরের কাগজে।
সইদুল খুব
খুশি। কিডনি বেচে টাকা জোগাড় করে নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে পারবে সে। শুরু হয়ে
যায় নতুন স্বপ্ন-সম্ভাবনা।
সেদিন
রবিবার। চৈত্রের মাঝামাঝি। সইদুল বেরিয়ে পড়লো শ্যামপুরের উদ্দেশে। বাড়িতে কাউকে
কিছু না-জানিয়েই।
শ্যামপুর
পৌঁছলো সইদুল। প্রচণ্ড রোদের তেজ। সকাল দশটাতেই সূর্য যেন মাথার উপর জাঁকিয়ে
বসেছে। তবে এ-গরম এখন সইদুলের কাছে উপেক্ষনীয়। সে ভাবছে তার কিডনির কথা। একটি
কিডনি সে বেচে দেবে। অনেক অর্থ পাবে। সেই টাকায় নতুন ব্যবসা শুরু করবে। সংসারটা
বেঁচে যাবে হয়তো।
খুঁজে খুঁজে
শ্যামলবাবুর বাড়ি পৌঁছলো সইদুল। ঘরের দাওয়ায় একটা চেয়ারে বসতে দেওয়া হল তাকে। সে ভাবতে
থাকলো— কিডনির জন্য কত টাকা চাওয়া যায়? চাইবে নাকি আগেই লাখ টাকার চেক হাতে পেয়ে
যাবে!
কিন্তু না,
স্বপ্নভঙ্গ হল সইদুলের। দু’দিন আগের অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা ভীষণ ভাবে হতাশ করলো
সইদুলকে। এক প্রতারক কিডনি দান করবে জানিয়ে শ্যামলবাবুর কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার
টাকা নিয়ে চম্পট দেয়েছে। একটা ভুল ঠিকানা দিয়ে গেছে সে। তার খোঁজখবরই পাচ্ছে না শ্যামলবাবু।
শ্যামলবাবু
সইদুলকে বললেন— আমি সত্যিই দুঃখিত শ্যামলবাবু। চিকিৎসার খরচটুকু বাদে অতিরিক্ত কোনও অর্থই
আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। হিমঘরে সামান্য চাকরি করতাম। এখন কাজও বন্ধ। সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
পরিবার আমার। কেমন করে আপনাকে
দেব কিডনি কেনার অর্থ!
প্রচণ্ড
হতাশ সইদুল উঠে পড়লো। মন খারাপ করা দুপুরে ফিরে চললো নিজের বাড়ি। কিডনি বেচা তার আর
হল না। নতুন করে ব্যবসার ভাবনাও মাথা থেকে উবে গেল মুহূর্তে।
ফিরে আসছিল
সইদুল। কিন্তু এক কাতর আবেদনে সে ফিরে তাকালো। দেখলো, এক বছর-দশেকের বালিকা ছুটতে
ছুটতে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সইদুল থমকে দাঁড়াতেই মেয়েটি তার হাত দু’টো ধরে
ঝাঁকুনি দিয়ে বলতে শুরু করলো, ও কাকু, আমার বাবাকে দিতেই হবে আপনার কিডনি। বলুন
না— দেবেন তো? আমার বাবাকে বাঁচাবেন না?
মুহূর্তে
দিশেহারা লাগলো সইদুলকে। মনে পড়ে গেল
তার অতীত জীবন। জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাতে সে যে কখনও হেরে যায়নি, সে কথাই কে যেন
চিমটি কেটে তাকে শোনাতে চাইছে এখন।
যে অজ
গ্রামে থাকে সইদুল, সেখানে না-ছিল বিদ্যুতের আলো, না-ছিল স্কুল, চিকিৎসাকেন্দ্র।
আঁকাবাঁকা আলপথের ছোট্ট অজানা গ্রামটি আজ কিছুটা হলেও উন্নত। অনেকটা সংস্কারমুক্তও।
এখন গ্রামে
কাউকে সাপে কাটলে ওঝার কাছে যায় না মানুষ। তারা ছুটে যায় উলুবেড়িয়া স্টেট জেনারেল
হাসপাতালে। মৌলবি সাহেবের জলপোড়ায় আর তেমন বিশ্বাস নেই কারও। বদলে তারা কাছাকাছি ডাক্তার বা চিকিৎসাকেন্দ্র
খোঁজে। গ্রামের মানুষ ধর্মের বেড়াজাল ভাঙতে শিখছে। মানুষজন আমরা-ওরা’র প্রাচীর
ডিঙোচ্ছে যে সইদুলের সৌজন্যে, সেই সইদুল কেমন করে ফিরে যাবে নিজের ঠিকানায়! তাছাড়া
কী কৈফিয়ত দেবে সে নিজের বিবেককে? এমন স্বার্থপর সে তো কখনই ছিল না!
পরমুহূর্তেই
সইদুল সজাগ হয়। নিজের অন্তর হাতড়ায়। বাস্তবের মাটি ছুঁতে চায় তার পা-দু’টো। কী
ভাবছে সে এখন এ-সব! এটা কেমন করে সম্ভব? অদ্ভুত আবেগের বশবর্তী হয়ে কী সিদ্ধান্ত
নিতে চলেছে সইদুল! তার ব্যবসা, তার পরিবার, তার সন্তান সবই তাহলে মূল্যহীন! তার
একটি মূল্যবান কিডনি চলে গেলে সে তো আর এই ধরণের সুযোগই গ্রহণ করতে পারবে না
ভবিষ্যতে।
কাগজে তো আবার
নিশ্চিত ভাবে বিজ্ঞাপন দেখবে সইদুল। অনেক টাকার সুযোগও এসে যেতে পারে। তখন কী করবে সে? তখন
কেমন করে সে নিজেকে বোঝাবে? সে শুনেছে, আবেগনির্ভর হয়ে কবিতা বা গল্প লেখা যায়।
কিন্তু একটা আস্ত জীবন? তার কি অধিকার আছে এ ধরণের হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়ার?
না, কিছুতেই সম্ভব হয়। সে ফিরে যাবেই।
আস্তে আস্তে
বালিকার মুখের দিকে তাকিয়েই মুখটা নামিয়ে নেয় সইদুল। তারপর মাথা নীচু করে ধীরে ধীরে
ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, হ্যাঁগো সোনা মেয়ে, বাবার জন্য কিডনি তো জোগাড় করতেই হবে। চিন্তা
ক’রো না তুমি। আজ আমি আসি কেমন?
সইদুল
পালিয়ে বাঁচতে চেয়ে দ্রুত পা বাড়াতে চায় সামনের দিকে। আর একবার ক্ষণকালের জন্য
পিছন ফিরে তাকায় সে। তারপর বালিকার উদ্দেশে হাত নেড়ে বলে, এখন আসি তাহলে সোনামা?
কিন্তু
পালিয়ে যাবো বললেই কি পালানো যায়! বালিকার অন্তর যে আসন্ন ভবিষ্যতের ছবিটা দেখে
ফেলেছে! সে চিৎকার করে বলে ওঠে, না কাকু না, আপনি চলে যাবেন না। ও কাকু, আপনি
দাঁড়ান। আপনি চলে গেলে আমার বাবা যে বাঁচবে না।
একরত্তি
বালিকার এই হাহাকার তীব্রভাবে আঘাত করে সইদুলের বুকে। সে জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের
মধ্যে দিয়ে হেঁটেছে, অনেক দহন যন্ত্রণা তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, কিন্তু এই নিষ্পাপ
বালিকার কান্না, তার অসহায়তার পাঠটা পড়ে নিতে একটুও অসুবিধা হয় না সইদুলের। সে
থমকে দাঁড়ায়। তার পা আর একটুও এগোচ্ছে না সামনের দিকে।— যেন পায়ের নীচে কেউ বেঁধে
দিয়েছে ভারী দু’টো পাথর।
এবার সোজা
হয়ে দাঁড়ায় পুরনো সইদুল। জীবন-পথের প্রতি বাঁকে মানবিক মূল্যবোধের মণিমুক্তোগুলো
কুড়িয়ে নিতে অভ্যস্ত সইদুল নিজেকে ধিক্কার দেয়। মনে মনে বলে, ছিঃ, এ আমি কী
ভাবছিলাম এতক্ষণ! এই ছোট্ট বালিকার কাছে আমি এভাবে কাপুরুষের মতো হেরে
যাচ্ছিলাম? এরপর আমি কীভাবে দাঁড়াতাম নিজের আয়নায়? আমার অতীত জীবন নিয়ে গর্ব করার
মতো অবশিষ্ট কিছু কি থাকতো আর?
অগত্যা
বালিকার হাতটা চেপে ধরে সইদুল। পিতার স্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরে সে মেয়েটিকে। আদর করে বলে,
চলো মানা, তোমার বাবার কাছে আমায় নিয়ে চলো। আমি দেবো আমার কিডনি।
সইদুল ফিরে
তাকালো। শ্যামলবাবুর ঘরের দালানের সেই চেয়ারটায় বসলো। সব শুনে শ্যামলবাবুর স্ত্রী বললেন, আপনি
চিন্তামুক্ত করলেন আমাদের। ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করবো না। কিন্তু দাদা, একটা প্রশ্ন,
কিডনি তো দেবেন, আমরা হিন্দু— আপনাদের মুসলমান মোড়লরা এটা মেনে নেবেন তো?
সইদুলের
চটজলদি স্পষ্ট উত্তর, কিডনিটা আমার। আমি অন্য কোনও মুসলমানের কিডনি তো আপনার
স্বামীকে দিচ্ছি না। আমি শুধু বুঝি, মানুষের মধ্যেই আল্লার অবস্থান।
তারপর ফিরে
এল সইদুল। বারগড়চুমুক। মাত্র ক’টা দিনের জন্য। মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে চৈত্র-শেষের
নির্দিষ্ট বিকেলে সে রওনা হল হঠাৎ। কাউকে কিছু না-বলে। দক্ষিণ কলকাতার এক নামী নার্সিং হোমে পোঁছলো সে।
প্রথমেই
সইদুলের চোখে পড়লো সেই মেয়েটিকে। ছোট থেকেই সইদুল সব ক্ষেত্রেই অসামান্য সাহসের পরিচয় দিলেও এই মেয়েটির
আবদার উপেক্ষা করার সাহস সে এখনও অর্জন করতে পারেনি। সইদুল অনুভব করলো, না-না, সে
কিন্তু হেরে যায়নি। হেরে যেতে তার
মানা তাই।
এদিকে
বারগড়চুমুকে উৎকণ্ঠার অন্ত নেই। থানায় নিখোঁজ ডাইরি। সইদুলের বাড়ির লোকজনদের টানা
তিন দিন প্রায় উপবাস। অবশেষে পুলিশেরই সহায়তায় যখন হদিশ মিললো, তখন সইদুল নার্সিং
হোমের আই সি ইউ চেম্বারে। স্যালাইন চলছে। সংজ্ঞাহীন।
কিডনি দান
করতে এসে কিডনি দাতারই প্রাণ সংশয় হওয়ার উপক্রম হয়েছিল একসময়। কিন্তু তা তো হবার
নয়। সাহসী সইদুল বেঁচে উঠলো। বাঁচার মতোই। চোখ মেললো সে। হাসি মেলে তাকালো সেই ছোট্ট- মেয়েটির মুখের দিকে। তার শরীরের সব
কষ্ট যেন উবে গেল মুহূর্তে।
অবশেষে
একসময় বাড়ি ফিরে এল সইদুল। যে মানুষগুলো সইদুলের হাত ধরে বড় হতে শিখেছে সেই প্রিয়
গ্রামটায়। সইদুলের একান্ত নিজস্ব
ঠিকানায়।
* * * * *
তারপর এল
পয়লা বৈশাখ। আনন্দের দিন। বারগড়চুমুকে অন্য পরব। সকলের হৃদয় রাঙানো মিলন উৎসব। এই প্রথম। আগে কেউ কখনও ঠিক এরকম আনন্দ-উৎসবে শামিল
হয়নি।
সইদুলের
বাড়িতেও এদিন সাজো সাজো রব। এত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও সকলেরই চোখে-মুখে অন্য খুশির ছটা।
হাজার যন্ত্রণার মধ্যেও এত আনন্দ একসাথে হানা দিতে পারে, ভাবতে পারেনি প্রায় কেউই।
গনগনে দুপুর
গড়াচ্ছে। বিনম্র
ভঙ্গিমায়। স্নিগ্ধ ধূসর-বিকেল উঁকি মারার প্রতীক্ষায়। হঠাৎ সইদুলের বাড়ির দরজায় এসে
দাঁড়ালো অচেনা এক ডাকপিয়ন। একটি বুকপোস্ট করা খাম হাতে।
অনেকদিন আগে
একটা কমপিটিটিভ পরীক্ষা নিয়েছিল রাজ্যের যুবকল্যাণ দপ্তর। আইনি জটিলতায় সে-চাকরির
সম্ভাবনা ছিল না কারোরই। কিন্তু শেষমেষ উচ্চ
আদালতের রায়ে পাল্টে যাওয়া এ এক অন্য ছবি। উৎসব-মুখর রঙিন বিকেলে সবই যেন অলৌকিক!
খামটা হাতে
নিল সইদুল। দেখলো, একটা
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। অপরাজিত সইদুলের উদ্দেশে সযত্নে লেখা।
**************************
শক্তিশঙ্কর সামন্ত
স্মরণিকা, ধাড়সা কাজিপাড়া
জি আই পি
কলোনি, হাওড়া
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন