ভারতের নারী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে
সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের চর্চা
ভূমিকা :
মানব সমাজে সমাজতন্র প্রতিষ্ঠিত হওয়াটা একটা ঐতিহাসিক অবশ্যম্ভাবিকতা বলে মনে করা হয়। আর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রকৃত গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। লিঙ্গগত বৈষম্য দূর হয়। নারী স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই সম্পর্কে জার্মান নারী মুক্তি আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন বলেন যে রুটি রোজগারের লড়াইয়ের সাথে নারী আন্দোলনকে যুক্ত না করতে পারলে নারীমুক্তি আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে না। আর এ লড়াইয়ে পুরুষ নারীর প্রতিযোগী নয় সহযোদ্ধা।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে গণতন্ত্রের আদর্শ নিয়ে আলোচনা নিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এসে পরে সেটা হলো সমাজতন্ত্র কিভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে কারন সমাজতন্ত্ৰ তো সর্বহারার একনায়কত্বের কথা বলে যেখানে মানুষের অধিকার সংকুচিত হয়। সেখানে মেয়েদের গণতন্ত্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? ব্যাপারটাকে স্ববিরোধী বলে প্রচার করে পশ্চিমী ঢঙের গণতন্ত্রের কারবারিরা। তারা শ্রেণী নিরপেক্ষে সব মানুষের জন্য এক অদ্ভুত অবাস্তব গণতন্ত্রের কথা বলে যেটা শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অর্জন করা সম্ভব নয়। বাস্তবে তারা একধরনের শ্রেণী গণতন্ত্রের চর্চা করে, সেটা প্রয়োগের কথাই বলা হয়। সংশোধীয় গণতন্ত্রে ভোট অধিকার প্রয়োগ করে নিজেদের পছন্দের শাসককে নির্বাচন করে বাস্তবে শাসক শোষক সম্প্রদায়ের তৈরী করা সংবিধানকে মানুষের অধিকার রক্ষার হাতিয়ার বলে ধরে নেয়। আর সংবিধানের মাধ্যমে নারী স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করা হয়। অথচ এই সংবিধান মুষ্টিমেয়র সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করে, তাদের সেবা করে। এটা নিয়ে প্রশ্ন তুললে, নিপীড়িত মানুষের অধিকারের কথা বললে, রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করা হয়। রাষ্ট্র হলো নিপীড়নের হাতিয়ার। আর সম্পত্তির মালিকের স্বার্থেই এই তথাকথিত গণতন্ত্রের স্বীকৃতি। আজকের দুনিয়ায় পুঁজিবাদের গর্ভে এর বাস, পুঁজিবাদ এই গণতন্ত্রের রক্ষক, আবার পুঁজিবাদী-ই এই সমাজের ভক্ষক যার প্রতিনিধিত্ব করে সম্পত্তির মালিক। এর যূপকাষ্ঠে বলিপ্রদক্ত হলো গরিব কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্ত এমন কি খুদে মালিক । এই ব্যবস্থায় লিঙ্গগত বৈষম্য, সাম্রদায়িক প্রাধান্যবাদ মানুষকে ভাগ করে শাসন করার হাতিয়ার।
এই প্রসঙ্গে যে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয় সেখানে সমাজতন্ত্র গঠনের সঙ্গে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে বলে মনে করে সেই সমাজতন্ত্র সেই গণতন্ত্রের আলোচনা আমরা এখানে করব কারন প্রকৃত নারীমুক্তির পথে এটা একটা পদক্ষেপ। একে এড়িয়ে নারীমুক্তি সম্ভব নয় । শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শ্রেণীর লড়াইয়ের সঙ্গে এটা যুক্ত। কার্ল মার্কস দেখিয়েছেন যে মানব সমাজের ইতিহাস হলো শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। সমাজ যেখানে শ্রেণীবিভক্ত সেখানে রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগ করে এক শ্রেণী আরেক শ্রেণীর ওপর কর্তৃত্ব করে। সমাজের সব অধিকার ভোগ করে সম্পত্তির মালিক শ্রেণী যারা মুষ্টিমেয় সংখ্যা লঘিষ্ট । সম্পত্তির জোরে এরা রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রই এদের বল। পুঁজিবাদী দেশে পুঁজির মালিক এই বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী । তারা পুঁজির জোরে প্রকৃত উৎপাদনকারী শ্রমিক কৃষককে শোষণ করে। তারা তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়। উৎপাদন শক্তি আর উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে এক শত্রুতামূলক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। আপনা আপনি কোন জাদুমন্ত্রে এর সমাধান হয় না কারন সম্পত্তির মালিক নিজে থেকে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার মানে না, তাদের শোষণ করেই তারা টিকে থাকে। অর্থাৎ পুঁজিবাদ আর তার সঙ্গে তাদের শ্রেণীগণতন্ত্র টিকে থাকা মানে শ্রেণী শোষণ টিকে থাকা। এর বিরোধিতার থেকে শ্রেণী সংগ্রামের উদ্ভব । এই ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখা নয়, একে ধ্বংস করেই শোষিত শ্রেণীর মুক্তি সম্ভব। আর এই শোষিত সমাজের অর্ধেক হলো নারী সমাজ । এই ব্যবস্থার জায়গায় নতুন সাধারণ মানুষের সমাজই হলো সমাজতন্ত্র যা সাম্যবাদী সমাজের ভ্রুন রূপ। রাতারাতি শ্রেণী সমাজ উবে যায় না। সমাজতন্ত্রের প্রথম এই স্তরে শ্রেণী বিভাগ থাকে। এতদিনকার ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত সম্পত্তিবানদের হাত থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। তবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েও পুরোনো শাসক হাল ছাড়ে না, ছলে বলে কৌশলে তারা ফিরে আসার লড়াই চালায়। শ্রেণী সংগ্রাম নতুন রূপ পায়। কোন একটা দেশে সমাজতন্ত্র এলেও তাকে ঘিরে রাখে পুঁজিবাদী দেশগুলো, পিছিয়ে পড়া দেশে সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলো। একচেটিয়া পুঁজিবাদের তথা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে। ঘরের ভেতরে বাইরে তাদের লড়াই । এই লড়াই সাধারণ মানুষের হয়ে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করার লড়াই। সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করে ব্যাপক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার এই লড়াই হলো সত্যিকারের সাধারণ গরিব মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই । এ কোন বিশুদ্ধ শ্রেণীহীন গণতন্ত্র নয় । একে জনগনের গণতন্ত্র বলা হয়। এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে ক্ষমতায় ফিরে আসতে সচেষ্ট পুরোনো শাসক ও শোষক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। এখানেই রাষ্ট্র শ্রেণী দমনের হাতিয়ার। সত্যি রাষ্ট্র দমনমূলক ব্যবস্থা নেয় কোন রাখঢাক না করে কারন মুষ্টিমেয় শোষক সম্প্রদায়ের তথকথিত গণতন্ত্র তথা ফিরে আসার অধিকার সমাজতন্ত্রে স্বীকৃত নয়। এখানে বৃহত্তরের স্বার্থে ক্ষুদ্রতরের স্বার্থ দমন। শ্রেণীসংগ্রামের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্র গঠন ও তার সঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটা কোনো স্ববিরধীতা নয় বরং পরিপূরক। বিপরীতে শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শ্রেণী সংগ্রামকে অস্বীকার করে সবার জন্য গণতন্ত্র তথা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ধারণা কার্যত ভাবের ঘরে চুরি করা, ভণ্ডামি।
ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রশ্ন :
উপরোক্ত শ্রেণী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে নারীমুক্তি আন্দোলন কিভাবে যুক্ত তা এখানে আলোচনা বিশেষ জরুরি কারন মানবী পত্রিকার কর্মীরা নারী অধিকার নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করে। নারী মুক্তি কিভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে শ্রেণী গণতন্ত্র অর্জনের প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত সেই বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা এই প্রবন্ধে জরুরি। ইতিহাসের বাস্তবতা ধরে আমরা নারী আন্দোলনের পর্যালোচনা করলে তার প্রকৃত চরিত্রটা ধরতে পারব। ইতিহাসের দিকে তাকালে নারী নির্যাতনের সঙ্গে শ্ৰেণী শোষণ কিভাবে যুক্ত তা বুঝতে পারব। শ্ৰেণী বিভক্ত সমাজের প্রথম যুগে শ্রমজীবী মানুষ তথা দাসেরা ছিল মালিকের সম্পত্তি। দাস দাসীরা যা উৎপাদন করত তার মালিক হতো দাস মালিকরা। এমন কি দাস দাসীদের সন্তান ছিল প্রভুর সম্পত্তি। দাসীরা ছিল দাস মালিকের ভোগ্য বস্তু। জমি চাষ জঙ্গল সাফাই ঘর তৈরি ঘরের কাজ সবেতেই দাস শ্রমিকের দরকার হতো। শ্রমিকের সংখ্যা বাড়াতে হতো দাসীদের আরো বেশি সন্তান উৎপাদনে বাধ্য করে। নারীরা ছিল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। দাস ফসল ফলালে প্রভু যেমন ফসলের মালিক হতো জমির মালিকানার দাবিতে তেমনি দাস দাসীদের মালিক বলে দাস প্রভুরা ফসলের মত সন্তানের মালিক হত যে বংশপরম্পরায় দাস বা দাসী বলে বিবেচিত হত। দাসদের নিজেদের স্বাধীন পরিবার গড়ার সুযোগ ছিল না। পারিবারিক জীবন বলে যদি কিছু থাকত তা থাকতো দাস মালিকের তত্ত্বাবধানে তার মালিকানায়। এই সমাজে পিতৃপরিচয় ছিল অপ্রাসঙ্গিক। যেমন মা মেরির পরিচয়ে যীশুর পরিচয়, যীশুর বাবার পরিচয় জানা যায় না। দাসদের ঘোড়ার আস্তাবলে থাকতে দেওয়া হতো। দাসীরা প্রভুর ঘরে যাবতীয় কাজ করত। প্রভুর ভোগের উপাদান ছিল। অর্থাৎ নারীরা একই সঙ্গে বিনা মজুরিতে মজুর ছিল। একদিকে শ্রেণী শোষণ, আবার অন্যদিকে নারী নির্যাতন ভোগ করতো।
এরপর সামন্ত ব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে পরিবার নিদৃষ্ট রূপ পায়। দাসরা জমির দাসে পরিণত হয়। দাস রমণীরা অন্তত নিজের সংসার পায়। তবে পরিবারে নারী নির্যাতন বন্ধ হয় না । পুরুষ প্রধান সমাজের বিস্তৃতি ঘটে। সমাজে নানা প্রথা আর ধর্মীয় আচার নারী সমাজকে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। নারীর নিজস্ব অস্তিত্ব লোপ পায়। সে ধর্মগুরু থেকে স্বামী সহ পরিবারের সব পুরুষদের হাতে নির্যাতিত হয়।
পুঁজিবাদের বিকাশ পরিবারের ঘোমটাকে উন্মোচিত করে। নারী পরিবারের চৌকাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসে। মজুরিশ্রমে অংশগ্রহণ করে। পুরুষের মত নারীরাও পুঁজি শোষণে বাঁধা পরে। ঘরে স্বামীর আর বাইরে পুঁজির দাসে পরিণত হয়। ইউনাইটেড নেশনের একটা রিপোর্টে দেখা যায় পৃথিবীর কাজের দুই তৃতীয়াংশ সম্পন্ন করে নারীরা ( ঘরের কাজ ধরে) । মোট খাদ্যের ৪৫ শতাংশ তারা উৎপাদন করে। কিন্তু খাদ্য শিক্ষার বিশেষ কিছুই তাদের জোটে না। আয়ের মাত্র ১০ আর সম্পদের ১ শতাংশ তাদের ভাগে। ভারতের মত আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশে তাদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। তবে পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নারীবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। তাদের আন্দোলন দুটো খাদে প্রবাহিত হয়। কিছু সুযোগসুবিধা গ্রহণ করে পুরুষদের প্রতিযোগী হয়ে ওঠা। এই আন্দোলনে শিক্ষিত উচ্চবিত্ত মহিলারা নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু এই আন্দোলন জীবন জবিকার আন্দোলনের সাথে তেমন ভাবে যুক্ত হতে পারে না শ্রেণী দৃষ্টি ভংগীর অভাবে। তাই শেষ বিচারে এটা নারী মুক্তির আন্দোলনের কথা বলে না। শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না। উচ্চবিত্ত নারীরা শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না।, তারা বরং অনেক ক্ষেত্রে শ্রেণী শোষণের অংশীদার। সেজন্য ক্লারা জেটকিন বলেন শ্রেণীর লড়াইয়ে শোষণ মুক্তির সংগ্রামে একজন একজন গরিব গরিব লড়াকু মানুসবের কাছে একজন শ্রমিক লড়াকু পুরুষ উচ্চবিত্ত নারী থেকে বেশি বিশ্বস্ত বন্ধু। আর একটা ধরন হলো নারী আন্দোলনকে শ্রেণী লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করা l
পশ্চিমী নারীবাদী আন্দোলনের ঢঙে ভারতে নারীবাদী আন্দোলন হচ্ছে যার নেতৃত্বের রাশ উচ্চবিত্ত শিক্ষিত মহিলাদের হাতে। কিন্তু ভারতে এখনো সামন্ততান্ত্রিক ভাবধারায় মানুষ আচ্ছন্ন। তাছাড়া মধ্যবিত্ত মহিলাদের মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের উপস্থিতি কম। তাই এই নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে মানুষের জীবনজীবিকার লড়াই তেমন যুক্ত হতে পারছে না। এই আন্দোলনে পুরুষ প্রধান সমাজে পরিবার ও তার বাইরে নারী নির্যাতনকে উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত বলে ভাবা হয় না। তলার স্তরে অর্থনৈতিক শোষনের সঙ্গে নারী মুক্তি আন্দোলন কিভাবে যুক্ত হতে পারে তা ভাবা হয় না। একে পরিষদীয় রাজনীতির বোতলে আটকে রাখা হয়. আইন পাশ করে কিছু সুবিধা দেওয়া হয়। উচ্চবিত্ত সংখ্যা লঘু মহিলাদের কিছু পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির মধ্যে একে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এই আন্দোলনে শেষ বিচারে পুরুষকে নারী সমাজের প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রু বলে চিহ্নিত করা হয়। একে একধরনের নৈর্ব্যক্তিক লিঙ্গগত বৈষম্যের দিক থেকে দেখা হয়। এক্ষেত্রে দর্শনটা হলো কোন মহিলা প্রথমে নারী তারপর সে মানুষ। নারী ও পুরুষ যেন বিবাদমান দুটো জাত, একে ওপরের প্রতিপক্ষ এমন কি শত্রু। তাছাড়া উচ্চবিত্তরা ( পুরুষ মহিলা উভয়েই) শ্রমজীবী মানুষের সৃষ্ট উদ্বৃত্তে ভাগ পায়। নিজেরা অনেক ক্ষেত্রে মালিক শ্রেণীভুক্ত হওয়ায় শোষনের প্রত্যক্ষ অংশীদার। তাই তারা আন্দোলনকে মেহনতি মানুষের শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে না বরং শোষক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে। শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন উঠলে তারা সরে দাঁড়ায়। তাদের জীবন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারা বিশ্বাস করে যে তারা পুরুষদের তুলনায় কমজোরি, কম সক্ষম। তাই তাদের প্রাপ্য কম। তাদের আন্দোলনকে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। যৌন নির্যাতন যে শ্রেণীশোষণের জন্য তীব্রতা পায় তা ভাবা হয় নাl আর গরিব মানুষের শোষণ মুক্তি নিয়ে ভাবার দায় এদের নেই। সেই আন্দোলনের সঙ্গে নারীবাদী আন্দোলনকে যুক্ত করার কথা ভাবা হয় না। পুঁজিবাদী স্বেচ্ছাচারীতাকে নারী স্বাধীনতার অংগ বলে ভাবা হয়। ফলে নারীবাদী আন্দোলন এক চোরা গোপ্তা পথ ধরে। মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তদের কিছু সুযোগসুবিধা আদায়ের আন্দোলন হিসাবে একে বোতলবন্দী করে রাখা হয়। শোষণ মুক্ত সমাজের খোলা আকাশের নিচে মানব মুক্তির জয়গানে এদের গলা মেলাতে দেখা যায় না। সুতরাং সমাজতন্ত্র গঠন করে নারী আন্দোলনকে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে দেখা হয় না। এই প্রেক্ষাপটেই বিকল্প ধরনের নারী আন্দোলনের বিষয়ে মানবী ও মানবীর সঙ্গে যুক্ত মেয়েরা কথা বলে যেটা নিয়ে আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আসবো। আজ ভারতে আদিবাসী প্রান্তিক অঞ্চলে যেখানে রাষ্ট্রের সহযোগিতায় বিশ্বের তাবড় তাবড় বহুজাতিক সংস্থার স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রত্যক্ষ মদতে লুঠ হয়ে যাচ্ছে সেখানকার মানুষের জীবন জীবিকা দেশের সম্পদ আর নারী ইজ্জত সেটার ওপর আমরা আলোকপাত করবো।
আদিবাসী ভারতে নারী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
জঙ্গল পাহাড়ে ঘিরে থাকা লোকালয়। প্রকৃতির নীলাভ উদাস আকাশ। বিজন জঙ্গলে সুউচ্চ বৃক্ষের মিনারের ফাঁক দিয়ে আলোর চ্ছ্বটা বর্ষিত হয়। উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে জঙ্গল। আলো আঁধারের লুকোচুরি খেলা। প্রকৃতি সেজে ওঠে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন এক শিল্পীর তুলির টানে। প্রকৃতির অপ্রতিহত ক্ষমতার নিদর্শন হলো মুক্ত বাতাসের স্পর্শ, জলের প্রবাহের অবিরাম কলকল রব, জঙ্গলের আশ্রয়, পাহাড়ের প্রত্যয়। প্রকৃতির নিয়ম মেনে মানুষের সঙ্গে তার এক মেলবন্ধন গড়ে ওঠে এই প্রকৃতির জগতে যেখানে আধুনিক 'সভ্যতা'র আলো বর্ষিত হয় না। মানব গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে সমুদ্র তটে পাহাড়ের কোলে জঙ্গলের আশ্রয়ে। নাগরিক সভ্য সমাজের বন্ধন না মেনে এরা যারা এক বন্ধনহীন জীবন যাপন করে চলেছে তারা হল আদিবাসী। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ মানব সম্পদ। পৃথিবীতে অসংখ্য এই মানব গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত হয়েছে মানব সমাজ। অসংখ্য মানব গোষ্ঠীর অন্যতম হলো বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী। তাদের দুর্ভাগ্য তারা জানত না যে প্রকৃতির অকৃপণ দান বর্ষিত হয়েছে তাদের ওপর। তারা শুয়ে থাকে প্রকৃতির এই দান সাগরের ওপর। তাদের নিচে লুকিয়ে আছে অফুরন্ত খনিজ সম্পদ যার সন্ধান করে চলেছে 'সভ্য' শিল্প সমাজ আর তার মালিকরা। সন্ধান পেলেই তারা অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পরে। উৎখাত হতে হয় আদিবাসী সমাজকে। কৃষি জমি থেকে উৎখাত হয়ে তারা আশ্রয় পেয়েছে এই প্রত্যন্ত জঙ্গলে। এখন এখান থেকে আবার উৎখাত হয়ে আশ্রয় হারা হয়ে জীবিকা হারা হয়ে তারা কোথায় যাবে জানে না। বন্দুক হাতে রাষ্ট্র তাদের উৎখাত করে। সম্পদের প্রাচুর্য তাদের কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের বাঁচার তাগিদে হাতে তুলে নিতে হয় বন্দুক।
বিক্ষুব্ধ এই ভারতে :
লোভের সন্ত্রাস দূষণ ছড়ায়
রক্তের কোষে কাঁপন ধরায়,
তুফানের ঘূর্ণিবর্তা বাতাসে বাতাসে
সমুদ্রের গর্জন ঢেউয়ে ঢেউয়ে,
পর্বত চোখ রাঙায়
জঙ্গলের ক্রন্দন শোনা যায়,
ভীত সন্ত্রস্ত লুন্ঠিতা মা আমার,
ভয়ে পালায় কন্যা তার
অস্ত্রহাতে বাস্তুহারা রুখে দাঁড়ায় ।
আদিবাসী সমাজের কাছে উপরোক্ত বাস্তবতাটা নির্মম সত্য বলে আজ প্রতিভাত হচ্ছে। এ যাবৎকাল তারা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে জীবন যাপন করতো। প্রকৃতি তাদের আশ্রয় দিত। তারা খাদ্য সংগ্রহ করতো প্রকৃতি থেকে। জলের কলকল শব্দ বাতাসের মর্মর ধ্বনি পাখির গান তাদের জীবনকে মুখর করে রাখতো। জীবনে অভাব ছিল, অভাব অপুষ্টি নিরক্ষরতা নিত্য সঙ্গী। কিন্তু ছিল না `সভ্যতা`র ক্রন্দন । দাসত্বের শৃঙ্খল। প্রকৃতি উদার হস্তে তাদের দিয়েছে। তারাও তার প্রতিদান দিয়ে গেছে। প্রকৃতিকে সভ্যতার গর্ভে বিলীন হতে দেয়নি। তাকে রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু আজ প্রকৃতির সঙ্গে তারাও উচ্ছেদের মুখে, ধ্বংসের মুখে। তাই নিজেদের জীবন জীবিকার লড়াই একই সঙ্গে প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখার লড়াই। এই লড়াইয়ের কথা বলার আগে আমরা সেই সব লড়াইয়ের অঞ্চলের সঙ্গে একটু পরিচিত হয়ে নিতে পারি। দেখে নিতে পারি প্রাচুর্য আর অভাবের স্ববিরোধিতার ভয়ঙ্কর ধরণটা। আর এর থেকেই উদ্ভব ঘটে আজ এই লড়াইয়ের বাস্তবতা যা পঞ্চাশ বছর আগের নকশালবাড়ির বহমানতা। সেই স্ফুলিঙ্গ থেকে উদ্ভূত দাবানল।
এটা ধরে নেওয়া হয় যে কয়লা লোহা বক্সাইট ম্যাঙ্গানিজ-এর মত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ আর তার সঙ্গে দেশের অফুরন্ত মানব সম্পদ একটা দেশের উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করে। সেদিক থেকে ভারতের খনিজ সমৃদ্ধ দন্ডকারণ্য অঞ্চলকে উন্নয়নের খনি বলে ভাবা যেতে পারে। কিন্তু দুৰ্ভাগ্যের বিষয় হল এই প্রাচুর্য্য আজ এখানকার মানুষের কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই অঞ্চলগুলো দখলে রেখে নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলার এক বাধ্যবাধকতা দেখা দিয়েছে কর্পোরেট দুনিয়ার কাছে। অন্ধ্রপ্রদেশ, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, ছত্তিসগড়, মহারাষ্ট্রের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল ধরে দন্ডকারণ্যের বিস্তৃত অঞ্চলকে আজ শাসক সম্প্রদায় লাল অলিন্দ বা রেড করিডোর নাম দিয়েছে কারণ মাওবাদীদের নেতৃত্বে আদিবাসী মানুষের অভ্যূত্থ্যান ঘটেছে এই অঞ্চলে। কিন্তু কার্যত এই অঞ্চলগুলো নিয়ে ভারতে এক খনিজ অলিন্দ তৈরী হয়েছে যে পথ ধরে লুঠ হয়ে চলেছে আমাদের মাতৃভূমি। এখানকার প্রতিটি বিদ্রোহী মানুষই রাষ্ট্রের চোখে দেশবিরোধী সন্ত্রাসবাদী কারণ কর্পোরেট দুনিয়ার লুঠ আর দখলদারির বিরুদ্ধে এরা অস্ত্র ধরেছে। অবাধ সম্পদ লুঠের পথে এরা কাঁটা। এই অঞ্চলগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো ধরে আমরা আমাদের আলোচনায় প্রবেশ করতে পারি। এই আলোচনাই আমাদের অনুমানের (hypothesis) সত্যতা যাচাই করবে। আর আমাদের সমর্থনে আমরা প্রধানত সরকারি পরিসংখ্যানই ব্যবহার করব যাতে অনুমানটিকে মনগড়া বলে কেউ উপেক্ষা করতে না পারে।
জঙ্গলে ঘেরা আদিবাসী অধ্যুষিত বিস্তীর্ন দন্ডকারণ্য অঞ্চলে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে এক সহজাত পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। প্রকৃতি সেখানকার বসবাসকারী মানুষকে যেমন খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসার উপাদান যোগায় তেমনি সেখানকার মানুষ প্রকৃতি রক্ষার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে পরম শ্রদ্ধা আর যত্নের সঙ্গে। যেহেতু সেখানকার মানুষের জীবনজীবিকার সঙ্গে প্রকৃতি গভীর এক বন্ধনে আবদ্ধ তাই প্রকৃতিকে রক্ষা করার শিল্প তাদের কাছে সহজাত। দেশের জনবন্টনের মানচিত্র থেকে জানা যায় যে ভারতের কেন্দ্র ও পূর্বাঞ্চলে সাতটি প্রদেশ তথা মধ্য প্রদেশ, অন্ধ্র, ওড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্রের দক্ষিণপূর্বাঞ্চল, গুজরাট ধারণ করে দেশের দুইতৃতীয়াংশ আদিবাসী মানুষকে। বিশেষ করে জঙ্গলে ঘেরা এই প্রদেশগুলির গ্রামাঞ্চলে কেন্দ্রীভবন ঘটে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতের মোট ১০.৪ কোটি আদিবাসী উপজাতির মধ্যে ৯.৩ কোটি বাস করে গ্রামাঞ্চলে। বাকি মাত্র ১.১ কোটি বাস করে শহরে। ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে গ্রামীণ আদিবাসীর সংখ্যা ১০.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১.৩ শতাংশ যেখানে শহরে আদিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ২.৪ শতাংশ থেকে ২.৮ শতাংশ। এর থেকে প্রমান হয় গ্রাম থেকে শহরে আদিবাসীদের স্থানান্তর একেবারেই ন্যূনতম। জনবন্টনের এই বৈশিষ্ট্য ধরে আমরা আমাদের আলোচনা সীমাবব্ধ রাখবো প্রধানত ছত্তিশগড় ওড়িষ্যা ঝাড়খন্ড মহারাষ্ট্রের দন্ডকারণ্য অঞ্চলে আজ যেখানে কর্পোরেট দুনিয়ার আক্রমণের মুখে আদিবাসী জনগন রুখে দাঁড়িয়েছে। আদিবাসী মহিলারা যুদ্ধ সাজে।
বিক্ষুব্ধ এ ভারতে আদিবাসী নারী আন্দোলনের ধারা:
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আদিবাসীদের আজকের লড়াই-এ নারী আন্দোলন এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজে নারী আন্দোলনের দুটো মুখ একসঙ্গে খুলে গেছে। তাদের জীবন জীবিকার লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী মুক্তির প্রশ্নটি। জীবনজীবিকার লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে নারী মুক্তি যে সম্ভব নয় সেই সত্যটা উদ্ঘাটিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জীবন জীবিকার লড়াই-এ নারীদের অগ্রণী ভূমিকায়। তাঁরা এই লড়াইয়ের তাগিদে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কুসনংস্কার ভেঙে বেরিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে উপস্থিত। সামরিক লড়াই থেকে উন্নয়নের লড়াই-এ তারা জোটবদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদের জল জমি জঙ্গল লুঠের ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে এ লড়াই যেমন বহমান তেমনি তারা আজ সোচ্চার নারী মুক্তির প্রশ্নে তাদের জীবন জীবিকার উন্নতির প্রশ্নে। তারা পরিবারের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে গেরিলা বাহিনীতে বা গণ মিলিশিয়ায় যোগ দিতে। লড়াইয়ের নেতৃত্বে উঠে এসেছে তারা। আদিবাসী সমাজের কুসংস্কার থেকে মুক্তির বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে। যুক্ত হয়েছে তাদের ক্ষমতায়নের বিষয়টা।
লুঠের বিরুদ্ধে আজকের প্রতিরোধ যুদ্ধে আদিবাসী নারীদের ভূমিকার সঠিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা ২০১০ সালে নারী দিবস পালনের দুটো ধরন তুলে ধরব। একটা হল শহর ভিত্তিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের তাদের দাবি দাওয়ার ভিত্তিতে নারী দিবস পালনের ধরন। আরেকটা হল আদিবাসীদের ব্যাপক সংখ্যায় সাবেকী অস্ত্র হাতে মাঠে নেমে রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে মিছিলের মাধ্যমে নারী দিবস পালন। সেদিন সেমিনারে আলোচনা, এই ব্যবস্থায় কিছু সুযোগ সুবিধা আদায়ের দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল শহর ভিত্তিক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের এই দিবস পালনটি। যেন একটা বার্ষিক উৎসব। এই দিনই ভারত সরকার নারীদের জন্য সংরক্ষণ বিল পাশ করে। একে ঐতিহাসিক বলে চিহ্নিত করা হয় নারীদের মুক্তির প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে। সংরক্ষণ বিল নেহাতই নারী পুরুষকে বিভাজনের মধ্যে রেখে শাসন করার একটা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে বলে আমাদের ধারণা যেমন অন্যান্য ক্ষেত্রে করছে। সেখানে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত নারী সমাজ এর সুযোগ পাবে। কিন্তু গরিব ঘরের নারী সমাজের প্রশ্নগুলো অধরাই থেকে যায়। সেখানে নেতৃত্বে থাকে সুবিধাবাদী একটা ক্ষুদ্র অংশ।
অপরদিকে আদিবাসীদের লড়াইয়ের অঞ্চলগুলোতে দেখা যায় হাজার হাজার আদিদাসীদের মিছিল। শ্লোগানে স্লোগানে মুখরিত সে মিছিল। তারা তাদের চলমান লড়াই-এর সমর্থনে শ্লোগান দেয়। তুলে ধরে তাদের জীবন জীবিকার দাবি। ১৪৪ ধারা বজায় থাকা সত্বেও যৌথবাহিনীর সামনে দিয়েই তারা মিছিল করে যায়। সেই পুরো অঞ্চল জুড়েই তখন নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। তাদের এই প্রতিবাদ মিছিল সংবাদ মাধ্যমে জায়গা পায় নি। সংবাদ পরিবেশনেও রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আজকের মত তখনও বহাল ছিল। ২০১২ সালে ১০-ই জুন ঝাড়খণ্ডের রাঁচিতে রাজ্যপালের ভবনের সামনে দশ হাজার আদিবাসী মানুষের জমায়েত দেখা যায় যেখানে আদিবাসী নারীদের উপস্থিতি বিশাল। তাদের অংশগ্রহণ উল্লেখ জনক (Hindustan Times dated 10.06.2012)। দেখা যায় যে উচ্চবিত্তদের নেতৃত্বে নারী আন্দোলন সংসদীয় দল, সংসদ ও সংবাদ মাধ্যমে বিশাল প্রচার পায়। কিন্তু গরিব আদিবাসী মানুষের লড়াই-এ এরা নীরব। এর থেকে প্রমান হয় যে রাষ্ট্র আজ প্রান্তিক মানুষদের এই নারী অভ্যূত্থ্যানে শঙ্কিত। নারী আন্দোলন শ্রেণী চরিত্র পাক সেটা এরা যেমন চায় না তেমনি উচ্চবিত্ত ঘরের মহিলারাও চায় না। আর এর ওপর আলোকপাত করাটা আমাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য বলে আমরা মনে করি কারণ এ লড়াই একই সঙ্গে মানবতা প্রতিষ্ঠার লড়াই। নারী মুক্তির সঙ্গে মানব মুক্তির প্রশ্ন জড়িত।
নারী আন্দোলনের উপরোক্ত দুটি ধরন দুধরন-এর সংগ্রামের বার্তা পৌছে দেয়। প্রথম ধরনের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে নারী আন্দোলন কার্যত সংসদীয় গণতন্ত্রের বোতলে বন্দি থাকে। এটা আমরা আলোচনা করেছিl এবার আসা যাক নারী আন্দোলনের দ্বিতীয় ধরনটায় যেটা আজ আদিবাসী রমণীরা পরিচালনা করছে ভারতের জঙ্গলে ঘেরা খনি প্রধান প্রান্তিক অঞ্চলে l
১৯৮৬ সালে আদিবাসী মহিলা সমিতি গড়ে উঠেছে ছত্তিশগড়ে। সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তারা উপলব্ধি করে যে তাদের লড়াইকে জীবন জীবিকার বৃহত্তর লড়াই-এর সঙ্গে যুক্ত করে তাকে মুক্তি আন্দোলনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াইটা মর্মবস্তুর দিক থেকে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই যা নারীদের জমির অধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে। একটা বৃহত্তর আদর্শকে সামনে রেখে ক্রান্তিকারী মহিলা সমিতি গঠিত হয়। অরুন্ধতী রায়ের লেখা থেকে জানা যায় যে ২০০৯ সালে এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ছিল ৯০০০০ যা ভারতে যে কোন মহিলা সংগঠনের মধ্যে সর্ববৃহৎ ক্রান্তিকারী মহিলা সমিতি গঠিত হওয়ার পর মাওবাদী দলের নেতৃত্বে মহিলাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। পরিবারের মধ্যে ও বাইরে মহিলাদের অধিকার দাবিতে আদিবাসী সমাজ মুখর হয়ে ওঠে। ঘটুল নামে যে প্রথা আদিবাসী সমাজে চালু ছিল, যা মহিলাদের বাধ্য করত পুরুষদের অধীনে তাদের সেবাদাসী করে রাখতে। সে প্রথার বিরুদ্ধে ক্রান্তিকারি মহিলা সমিতি (KAMS) সোচ্চার হয়। পার্টি কোন নিষেধাজ্ঞা জারি না করে এই প্রথার বিরুদ্ধে বিতর্কের অবতারণা করতে উৎসাহ দেয় যাতে পুরুষ ও মহিলারা পরস্পর বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে ঐক্যমত গড়ে তোলে, এই ব্যবস্থা অবলুপ্ত হয়। বিষয়টাকে জনগনের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা হয়। সমাজ সচেতনতা গড়ে তোলা এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য যা এই ব্যবস্থায় এখনো সম্পূর্ণ উঠে যায় নি। তবে এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে, একটা পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। পরিবারের মধ্যে মেয়েদের সন্মান স্বীকৃতি পাচ্ছে। তারা রজ:সলার সময়কালে বিচ্ছিন্ন থাকছে না, মাঠে ধান বোনার কাজে অংশগ্রহণ করছে। পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াইয়ে অংশ গ্রহন করছে। আপাত দৃষ্টিতে এই আন্দোলনে চমক নেই, রাতারাতি কিছু ঘটছে না। কিন্তু চেতনার জগতে এক জাগরণের সূচনা হয়েছে সন্দেহ নেই। এটা লক্ষ করা গেছে যে সামন্তবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই লড়াই এক কঠিন লড়াই। দলের কৰ্ম্মী সমর্থকদের অনেকের মধ্যে সামন্তবাদী সংস্কৃতি গেড়ে বসায় তাদের কারো কারো তরফ থেকে খোলাখুলি বা চোরাগোপ্তা পথে এর বিরোধিতা আসছে। এই দ্বন্দ্বকে যত্ন ও সাবধানতার সাথে মোকাবিলা করতে হয়। তা না হলে মহিলা পুরুষের মধ্যেকার অশত্রুতামূলক দ্বন্দ্ব শত্রুতামূলক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। এর মূল উৎখাত করতে এক তীব্র দীর্ঘমেয়াদি আদৰ্শগত লড়াই চালাতে হয়।
কৃষি বিভাগকে জনাতনা সরকারের তরফ থেকে অনুমোদন দেওয়া হয় যাতে সংবিধানের ৩সি ধারা মেনে পরিবারের স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের নাম যৌথ পাট্টা বিতরণ করা হয়। বিরোধিতার মুখে পরেও একে কার্যকরী করতে মহিলা সগঠন উদ্যোগী। দেব অনুশাসন মনে করে জমি চাষে মহিলাদের অংশ গ্রহণ পাপ কাজ বলে মনে করার মত কুসংসারকে আদিবাসী সমাজ আঁকড়ে ধরে। অনেক চেষ্টার মধ্যে দিয়ে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম আংশিক ভাবে হলেও সার্থকতা পেয়েছে। বিভিন্ন কমিটিতে পঞ্চাশ শতাংশ মহিলা রাখার সুপারিশ করা হয়েছে যেটা আমরা লালগড় আন্দোলনেও দেখি। গন মিলিশিয়ায় ব্যাপক হারে মহিলা অংশগ্রহণ মহিলাদের ক্ষমতায়নের বিষয়টাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই আন্দোলন সর্বভারতীয় স্তরে লড়াইয়ের অঞ্চলগুলোতে সারা ফেলেছে। এই নারী আন্দোলন মহিলাদের মুক্তির লড়াইকে মানুষের জীবন যাপনের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করছে। নারী আন্দোলনের এই ধারায় লড়াইয়ের দুটি ফলা দেখা যায়। একটা ফলা পুঁজির আক্রমনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় আরেকটি ফলা সামন্ত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই চালায়। এ দুটোই শেষ বিচারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই কারণ রাষ্ট্র এই দুটোকেই টিকে থাকতে সাহায্য করে, রাষ্ট্র হল শোষক শ্রেণীর হাতে শোষণ ও নিপীড়নের হাতিয়ার। পুঁজির বিরুদ্ধে এ লড়াই উচ্চ পর্যায়ের শ্রেণী সংগ্রাম যেখানে আজ নয়া সাম্রাজ্যবাদ মুখ্য ভূমিকা পালন করছে বলে আমরা দেখেছি। সামন্তবাদের বিরুদ্ধে লড়াই না করে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যায় না। সাম্রাজ্যবাদের এই যুগে কোন দেশে আজকে স্বাধীন পুঁজিবাদের বিকাশ হয় না। সাম্রাজ্যবাদ সেটা হতে দেয় না। তাই স্বাধীন পুঁজিবাদের বিকাশের মাধ্যমে আজ সামন্তবাদের অবসান হয় না। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেই এটা করতে হয়। দ্বিমুখী এই লড়াইয়ে একটা আরেকটার পরিপূরক। এই প্রেক্ষাপটে আজ এই নারী আন্দোলনের ভূমিকা অপরিসীম।
সামন্ত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আজকের আদিবাসী সংগ্রাম জীবন জীবিকার স্বার্থে তাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই আজ একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। একচেটিয়া পুঁজিবাদের এই নয়া সাম্রাজ্যবাদের যুগে স্বাধীন পুঁজিবাদের বিকাশের পথ আজ বন্ধ। সুতরাং পুঁজিবাদের পথে ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের আপনাআপনি বিলোপ সম্ভব নয়। তাই সমাজতন্ত্রের জন্য জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেই সামন্তবাদের ধ্বংসাবশেষ অবলুপ্ত করতে হয়। নারীবাদের আন্দোলনকেও সে পথে অগ্রসর হতে হয়। আদিবাসী সমাজে আজ সেই লড়াই আমরা দেখি তাদের উপরোক্ত দ্বিমুখী লড়াইয়ে। উল্লেখযোগ্য যে পিতৃতান্ত্রিক সামন্ত ব্যবস্থায় পুরুষ প্রাধান্যবাদ আশ্রয় পায়। যখন পরিবারের নিষেধাজ্ঞা ভেঙে নারী সমাজ পুরুষদের সঙ্গে ব্যাপকহারে জীবনজীবিকার লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন তাদের সেই লড়াই নতুন মাত্রা পায়। বৃহত্তর সামাজিক জীবনে তাদের সন্মান প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিবারের মধ্যেও তাদের গুরুত্ব স্বীকৃত হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বাঁধন আলগা হয়। তাদের চেতনার মান বাড়ে। কুসংস্কারের বাঁধন থেকে মুক্তির পথ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঘরে ও বাইরে শোষণ বিরোধী লড়াই একটা মোহনায় মেলে। নিপীড়িত নারী পুরুষের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন তৈরী হয়। সমাজের পুরুষরা তাদের সম্মানের চোখে দেখে। এই লড়াইয়ে অংশগ্রহণের আগে দেখা যেত পুরুষ মহিলার মধ্যেকার অশত্রুতামূলক দ্বন্দ্ব শত্রুতামূলক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। নারী নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে পরিবার ব্যবহৃত হয়। মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু হিসেবে কাজ করে। পরিবারে নারী ধর্ষণ, মেয়েদের পুড়িয়ে মারা, ভ্রুনেই তাদের শেষ করে দেওয়ার রীতি প্রচলিত থাকে । আমাদের আলোচিত নারী আন্দোলনের ফলে এ ধরণের নারী নির্যাতন বন্ধ হয়। আজ আদিবাসীদের লড়াইয়ের অঞ্চলে এটা দেখা যাচ্ছে। মেয়েদের মধ্যে এসব অঞ্চলে শিক্ষার প্রসার ঘটছে, মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। মেয়েদের সামরিক লড়াইয়ের অংশ গ্রহণ তাদের পরিবারের বাইরে ও ভেতরে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করে। নক্সালবাড়িতে পঞ্চকন্যাদের সে লড়াই আজ দান্তেওয়ারায় এক উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ লড়াই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, মানুষের জন্য সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। একই সঙ্গে পুঁজির মালিকের শোষণের অধিকার খর্ব করার লড়াই। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ব্যাপক সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে শোষণের অধিকার অস্বীকার করতেই হয়, রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে থাকলে তাকে ব্যবহার করতে হয়। এই মূল লড়াই-ই পারে সমস্ত নিপীড়িত মানুষকে ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে মানবিকতার মোহনায় মেলাতে।
(দ্রষ্টব্যঃ সংকটের সভ্যতা ও বিক্ষুব্ধ এ ভারত: রণেশ রায়)
পশ্চিমবঙ্গে নারী আন্দোলনের বহমানতা
ওপরের আলোচনায় আমরা ভারতের নারী আন্দোলনের দুটি ধারা নিয়ে আলোচনা প্রসংগে বিশেষ করে আজকের ছত্রিশগড়ে নারী আন্দোলন যে দ্বিতীয় ধারাটি তথা শ্রেণীর লড়াই ও নারী মুক্তি আন্দোলন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে সেটা দেখেছি। এখন আমরা পশ্চিমবঙ্গে নারী আন্দোলনের বহমানতার দিকটার ওপর আলোকপাত করব। এই প্রসঙ্গে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত অখন্ড বাংলায় নারী আন্দোলনের বিষয়টা গুরুত্ব পাবে তা নইলে এই আন্দোলনের বহমানতার দিকটা তুলে ধরতে পারব না। দুটি ধারার নারী আন্দোলন আলোচনা প্রসঙ্গে ইতিমধ্যে বলা হয়েছে :
"লুঠের বিরুদ্ধে আজকের যুদ্ধে আদিবাসী নারীদের ভূমিকার সঠিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা নারী দিবস পালনের দুটো ধারা তুলে ধরব। একটা হলো শহর ভিত্তিক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের তাদের দাবি দাওয়ার ভিত্তিতে নারী দিবস পালনের ধরন। আরেকটা হল ব্যাপক সংখ্যায় সাবেকি অস্ত্র হাতে মাঠে নেমে রাষ্ট্রের নিপীড়ণের বিরুদ্ধে মিছিলের মাধ্যমে নারী দিবস পালন।"
আমরা দেখেছি যে নারী দিবস পালনের দ্বিতীয় ধারার লড়াইয়ের দুটি ফলা দেখা যায়। একটা ফলা আজ সাম্রাজ্যবাদের নের্তৃত্বে। সংগঠিত পুঁজির আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় আরেকটা ফলা সামন্তবাদের ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই চালায় I দ্বিতীয় ধারার লড়াইটায় আজ সত্যিকারের কমুনিস্ট পার্টির ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই লড়াইটা শেষ বিচারে নারী মুক্তি আন্দোলনের মুখ খুলে দেয়। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরও এই লড়াইটা চালিয়ে নিয়ে যেতে হয় সমাজ সৃষ্ট অনাকাঙ্খিত লিঙ্গ বৈষম্যের সম্পূর্ণ অবসানের জন্য। আজকের আলোচনায় এই বৃহত্তর পরিপেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের নারী আন্দোলনের এই ধারাটি তুলে ধরব। প্রথম ধরণের নারী আন্দোলন আজ সংসদীয় গণতন্ত্রের বোতলে বন্দী যার নেতৃত্ব দেয় প্রধানত মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত মহিলা সমাজ। উল্লেখযোগ্য যে প্রথম ধারার আন্দোলনটা এককালে বিশেষ করে ইউরোপে পুঁজিবাদের প্রথম যুগে বিশেষ ভূমিকা পালন করলেও আজ সেটা তার গুরুত্ব হারিয়েছে। নারী মুক্তির সামগ্রিক লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দ্বিতীয় ধরনের লড়াইটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। এই স্বল্প পরিসরের আলোচনায় প্রধানত স্বাধীনতার মুখে ও পরে তেভাগা থেকে নকশালবাড়ি ও সাম্প্রতিক লালগড়ে গড়ে ওঠা নারী আন্দোলনের ওপর আনমরা একটা ধারাবাহিক আলোচনা করবো। সেটা করার আগে আজ আমাদের সমাজে নারীর অবস্থানটা জেনে নেওয়া দরকার। আমরা বলি:
এসো পরিচয় করে নাও তার সাথে
যাকে চিনিনি আজও নিজ পরিচয়ে
হতবুদ্ধি আমাদের, চিনেছি তাকে নিজ স্বার্থে।
যে কোন দেশের মত আমাদের দেশেও জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। অর্থাৎ আকাশের অর্ধেকটাই নারী। মোট দেড়শ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০ থেকে 75 কোটি নারী। নারীর অনুপাত অর্ধেকের কিছু কম। আর সেটার পেছনে কারন সমাজটা পুরুষ প্রধান এবং নারী সমাজ নানা আর্থ সামাজিক কারণে পুরুষদের তুলনায় বেশি নিপীড়িত ও তাদের প্রাপ্য অধিকার পুষ্টি শিক্ষা স্বাস্থ্য সব দিক থেকে তারা বঞ্চিত। তাদের জন্মাবার অধিকারটাও স্বীকার করা হয় না আমাদের সমাজে। তাই নারী ভ্রূণ হত্যা আমাদের মত আধাসামন্ততান্ত্রিক দেশে একটা রোজের ঘটনা, সামাজিক আচরণের অঙ্গ। সমাজের 'মনন করন ও ধরম' সবই এই আচরণকে পরোক্ষে আজও সমর্থন করে যদিও সংবিধানে এটা স্বীকৃত নয়। সতীদাহ প্রথা এই সেদিনও ছিল ধর্ম স্বীকৃত একটা আচার যাকে মহিমান্বিত করত সমাজ।
ভারতবর্ষ সাধারণভাবে দরিদ্র নিপীড়িত অপুষ্ট নিরক্ষর মানুষে ভরপুর দেশ। দেশের ব্যাপক সব সস্প্ৰদায়ের মানুষের ওপর এখনও তিন ধরণের শোষনভার চেপে বসে আছে যাকে প্রয়াত সাম্যবাদী নেতা মাওসেতুং তিন শোষণের তিন পাহাড় বলেছিলেন। আমাদের এখানে এখন এই তিন পাহাড় হলো সাম্রাজ্যবাদ, তাদের মদতে মুৎসুদ্ধি পুঁজিবাদ আর সামন্ত বাদ। অর্থনীতি রাজনীতি সংস্কৃতি জীবনের সবক্ষেত্রেই এই তিন পাহাড়ের শোষণ। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সাধারণ সব মানুষই এই শোষণে পিষ্ট। তাই শোষণ মুক্তির লড়াইটা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার কাছেই বাস্তবতা। পুরুষ প্রধান সমাজে নারীদের বিশেষ অবস্থানের জন্য তাদের পুরুষ প্রধান্যবাদের বিরুদ্ধে মুক্তির লড়াইটা সমাজের শ্রেণীসংগ্রামের সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে যুক্ত। তাদের মুক্তির লড়াইটা সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে না যদি না তাকে বৃহত্তর সামগ্রিক মুক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। যেহেতু নারীকে বাদ দিয়ে সমাজ নয় তাই নারী পুরুষের উভয়ের লড়াইকে একযোগে সেই মুক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে মিলতে হয়। পুরুষদের সেইজন্য নিজের মুক্তির স্বার্থেই বুঝতে হয়:
নারীকে বোঝ না পুরুষ তার শক্তিতে
চিনেছ তাকে শুধু নিজ প্রয়োজনে,
যদি সত্যি বন্ধু তার
চিনে নাও তাকে তার সত্তায়
মেটাতে হয় ঋণ যা আছে তোমার
জন্ম থেকে মৃত্যু সতত সে তোমার সহায়,
নহে সে কারও অনুগ্রহের পাত্রী
নিজ বলে নিজ গুনে বলীয়ান সে
আপদে বিপদে সর্বক্ষন সে সহযাত্রী
সে লড়াইয়ের বন্ধু তোমার
মুক্তির লড়াইয়ে সে একই পথের যাত্রী।
আর ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই সোভিয়েত বিপ্লবের কর্ণধার লেনিন বলেন:
------ নারীদের প্রকৃত স্বাধীনতা কেবলমাত্র কমিউনিজমের মাধ্যমেই আস্তে পারে। নারীদের সামাজিক ও মানবিক অবস্থা আর উৎপাদনের উপায়ের উপর ব্যক্তিগত মালিকনার যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক সে কথা দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে হবে। তার থেকেই আমাদের নীতি আর নারীবাদের মধ্যে স্পষ্ট ও মৌলিক পার্থক্য বোঝা যাবে এবং এর দ্বারা নারীদের প্রশ্নকে সামাজিক প্রশ্নের শ্রমিক সমস্যার অংশ হিসেবেই বুঝবার ভিত্তি যোগাবে। সুতরাং এই প্রশ্নকে সর্বহারার শ্রেণী সংগ্রাম ও বিপ্লবের সঙ্গে জড়াতে হবে।কমিউনিস্ট নারীদের আন্দোলনটাই একটা গণ আন্দোলন, সাধারণ গণআন্দোলনের অংশ হতেই হবে।শুধু সর্বহারাদের নয়, সমস্ত শোষিত ও নির্যাতিত তদের---- ধনতন্ত্র বা অন্য ধরনের কিছুর শিকার যারা তাদেরই। তার মধ্যেই আছে সর্বহারা শ্রেণী সংগ্রামের তাৎপর্য এবং তার ঐতিহাসিক সৃষ্টি ---- কমিউনিস্ট সমাজ। আমরা প্রকৃত গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে আমাদের পার্টিতে, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল রয়েছে বিপ্লবী নারীজাতির ফুলগুলি। কিন্তু সে কথাই যথেষ্ট নয় । গ্রাম ও শহরের হাজার হাজার শ্রমজীবী নারীদের ছাড়া কোন সত্যিকারের গণআন্দোলনই হতে পারে না (নারী প্রশ্নে লেনিন, ক্লারা জেটকিন; নারী মুক্তি প্রশ্নে, মার্ক্স-লেনিন-স্তালিন, এন. বি. এ পৃ ৭০-৭১)
২০০৫ সালে প্রকাশিত 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে' নামক একটি বিশেষ ক্রোড় পত্রে লালগরের আন্দোলনে সক্রিয় অণু নামে এক নারী যোদ্ধা বলেন:
"শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজেই কেবলমাত্র নারীরা সমস্ত ধরনের শোষণের জোয়াল থেকে মুক্তি পেতে পারে। তাই নারী আন্দোলনকে সমাজের সামগ্রিক মুক্তির সাথে যুক্ত করুন। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সঠিক বৈজ্ঞানিক দিশায় পরিচালিত করুন।" ( ঐ )
আমরা আমাদের আলোচনায় দেখব পশ্চিমবঙ্গে নকসালবাড়ি থেকে লালগড়, অন্ধ্রে শ্রীকাকুলামে বা আজের ছত্রিশগরে সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে যার বীজ বপন করা হয়েছিল তেভাগা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
দেখা যায় যে আমাদের সমাজে মেয়েরা হলো একদিকে পুরুষদের ভোগ্য বস্তু অন্যদিকে সন্তান উৎপাদন ও তাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা নিজের সত্তা হারানো মানুষ। তারা মানবীর মর্যাদা পায় না। নেহাতই নারী। অথচ সে যে কাজ করে তার দাম দেওয়া হয় না। সংসারের কারায় তাকে বন্দি রেখে ধর্মের অবগুণ্ঠনে রাখা হয় কিছু স্তুতি বাক্য দিয়ে তাকে ভুলিয়ে রাখার জন্য। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন আজ হিসেব করে দেখান যে ঘরে মেয়েরা যে কাজ করে তার জন্য যদি তাকে প্রাপ্য মজুরি দেওয়া হয় তা হওয়া উচিত পুরুষরা যে কাজ করে অফিসে বা কারখানায় তার থেকে অনেক বেশি। একজন নারী সে তার যথার্থ মূল্য পায় না। বাজারে তাঁর কাজের দাম থাকে না। সংসারে সে সামন্ততান্ত্রিক বন্ধনে আবদ্ধ, আবার বাজারে সে মজুরি ব্যবস্থার শিকার। সে সামন্ততান্ত্রিক ও একই সঙ্গে পুঁজিবাদী শোষণে পিষ্ট।
উল্লেখযোগ্য যে শ্রেণিসংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে রুটি রোজগারের আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করে ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের ধ্বংসাবশেষকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে আজ বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না, পুরুষতন্ত্রকে ধ্বংস করা যায় না। নারী আন্দোলন সংসদীয় গণতন্ত্রের বোতলে বন্দী হয়ে পড়ে। মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত নারীদের কিছু সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার মধ্যে সীমিত থাকে। এই ব্যবস্থার অংশীদার সুবিধাবাদী নারীসমাজ এর সুবিধা পায় যারা এই সমাজের পুরুষপ্রধান পরিবার ভিত্তিক সংস্কৃতির অংশীদার। এই প্রসঙ্গে শ্যামল দাস 'অনিক' পত্রিকায় তাঁর লেখা ভারতীয় সমাজ বদলের প্রসঙ্গে নারী ও নারী মুক্তির প্রশ্ন নামক প্রবন্ধে বলেন :
"নারীর যোগ্যতার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা উত্থান পতনের বাঁকে গণসংগ্রাম ও সশস্ত্র সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের অংশগ্রহণের মাধ্যমে, সামাজিক গতিশীলতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে। সর্বহারার আন্দোলন মনে করে সামাজিক শ্রম প্রক্রিয়ায় নারীর যোগদান শুধু এ কারণে আবশ্যিক নয় যে তা নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করার এক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত, এ কারণেও যে তারা এমন এক সমাজ গড়তে চায় যা অবদমনমূলক নারীর বিকশিত ও সৃজনশীল শ্রমকে প্রয়োজনীয় মনে করে। মনে করে যে নারীর সহজাত বহু গুন যা এখন দাসসুলভ গৃহশ্রমে নি:শেষিত হচ্ছে তার সৃষ্টির ব্যবহার মুক্ত ও উন্নত এক সমাজ গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় ।" উল্লেখযোগ্য যে ঠিক এখানেই কমিউনিস্ট পার্টির সঠিক নেতৃত্ব প্রয়োজনীয় ( সেপ্টেম্বর অক্টবর ২০১৩ )।
আরও উল্লেখযোগ্য যে ভারতের বিপ্লবে নারীদের ভূমিকার পথ সুগম হয় যত কমিউনিস্ট পার্টি নিজেও সবরকম সংকীর্ণতার উর্দ্ধে উঠে পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নারী আন্দোলনকে পার্টির মধ্যেও বিস্তৃত করতে পারে। আর নারীদের বিপ্লবী আন্দোলনে যত বেশি টেনে আনা যাবে বিপ্লবী আন্দোলনের তীব্রতা তত বাড়বে। নারীদের উচ্চমাত্রায় অংশগহন বিপ্লবী স্বার্থ সিদ্ধ করবে। এই প্রসঙ্গে সিপিআই এম এল মাওবাদী দল ৮ই মার্চ ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে প্রকাশিত একটি ক্রোড়পত্রে ঘোষণা করে:
" এটা পরিষ্কার যে পার্টি যত বেশি করে পার্টির ভেতরকার পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তত বেশি সংখ্যায় নারীরা বিপ্লবে যোগ দেবেন এবং পার্টির নেতৃত্বের অবস্থানে উঠে আসবেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সামান্য পরিমাণও চোখ ঘুরিয়ে রাখলে নারীদের যোগদানের প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হবে এবং তা বিপ্লবী প্রক্রিয়ার বিকাশ থেকে অর্ধেক সমাজকে দূরে সরিয়ে রাখবে।" এর ফলে নারী মুক্তির পথ যেমন রুদ্ধ হবে তেমনি বিপ্লবী যুদ্ধে জয় দূরে সরে যাবে। আর পার্টির শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ায় এটা বিশেষ দরকার কারন পার্টির ভেতরে পুরুষতন্ত্রের ভাইরাস থাকে।
স্বাধীনতাপূর্ব অবিভক্ত ভারতের অঙ্গরাজ্য অবিভক্ত বাংলার চল্লিশের দশকজুড়ে যে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে ভারতের সামন্ততান্ত্রিক আর সাম্রাজ্যবাদের ভীত কেঁপে ওঠে তার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় রেডিকাল প্রকাশিত সুপ্রকাশ রায়ের 'তেভাগা সংগ্রাম' নামে দলিলে। চল্লিশের দশক জুড়ে সারা বাংলার বিভিন্ন জেলায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই সশস্ত্র সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। এই সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল গরিব কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের উপর অধিকার দাবি। উৎপাদনের তিনভাগ পাওয়ার দাবিতে কৃষকরা শুধু সোচ্চার হয় না, ফসলের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে নিজেরা ফসল ফলার পর তা কেটে নেওয়ার অভিযান চালু করে। ব্রিটিশ রাষ্ট্র ও জমিদার বাহিনী একযোগে এর বিরুদ্ধে দমন নীতি নামালে কৃষকরা তা সশস্ত্র উপায়ে প্রতিরোধে নামে। রীতিমত যুদ্ধ শুরু হয় গ্রাম বাংলায়। সেই সময়ে গান্ধীর অহিংস ও ব্রিটিশ তোসামদের নীতির আন্দোলনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন দানা বাঁধে। এই সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধকে ইংরেজরা সন্ত্রাসবাদ নাম দিয়ে তাকে বেআইনি বলে ঘোষণা করে। কৃষকের সশস্ত্র লড়াই আর সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ একসঙ্গে মিলে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়। কৃষকের এই ব্যাপক অভ্যুত্থানের মুখে ইংরেজদের রাজত্ব আর টিকবে না বলে তারা বোঝে কারণ গ্রামে কৃষকদের অভ্যূথ্যানকে আটকাবার ক্ষমতা শাসক সম্প্রদায়ের নেই সেটা তারা জানে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পরিবেশ দেশে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। তখন বিশ্বাসঘাতক তথাকথিত দেশপ্রেমিক অহিংস কারবারীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে দেশভাগের চক্রান্ত হয়। এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে তেভাগা আন্দোলন তথা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের তাৎপর্য বুঝতে হয়। তেভাগা আন্দোলনে কৃষক রমনীদের ব্যাপক অংশ গ্রহন ভারতের নারী আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দেয়। নারী আন্দোলন আর নেহাৎ মেয়েদের কিছু পাইয়ে দেওয়ার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকে না। নারী মুক্তি আন্দোলনের বৃহত্তর প্রাঙ্গনে সে প্রবেশ করে। নারী আন্দোলন যুক্ত হয় শ্রেণী আন্দোলনের সঙ্গে। আমরা দেখি যেখানেই মানুষের জীবিকার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সেখানেই সংগ্রামের এই সামগ্রিক চেহারা। দুই আকাশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে উপস্হিত। পরবর্তী সত্তরের দশকের নকসালবাড়ি আন্দোলন থেকে আজের ছত্তিশগড় লালগড় ঝাড়খন্ড উড়িষ্যা সর্বত্র যে লড়াইয়ের অভিমুখ তাতে এই সত্যই ধরা পড়ে। আর শাসক সম্প্রদায়ের ভয় এখানেই। সাম্রাজ্যবাদ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি আর সামন্তবাদ একজোট হয়ে এর বিরুদ্ধে দমন নীতি নামায়। আজ সারা বিশ্বের বিপ্লবী লড়াইয়ের তাৎপর্য এটাই। সুতরাং বলা চলে আজকের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই কার্যত তেভাগা আন্দোলনের বহমানতা। এই প্রেক্ষাপটে আমরা গত পঞ্চাশ বছর ধরে ঘটে যাওয়া ভারতের কৃষক সংগ্রামের তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করব। নারী আন্দোলনকে তার সামগ্রীকতায় বোঝার চেষ্টা করব।
১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে নকসালবাড়ি আন্দোলনকে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ বলে ঘোষণা করেন আন্দোলনের নেতা চারুমজুমদার। এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে জোতদার সামন্তবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আদিবাসী অভ্যুথ্যানের মধ্যে দিয়ে যেখানে সশস্ত্র আদিবাসী রমণীরা তীর ধনুক হাতে সামনের সারিতে ছিলেন। রাষ্ট্র জোতদারের পক্ষ নিয়ে সশস্ত্র আক্রমণ নামিয়ে আনলে শহীদের মৃত্যু বরণ করেন আটজন রমণী। পরে অন্ধ্রে বিহারে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। একে আমরা তেভাগা আন্দোলনের বহমানতা হিসেবে দেখি। সম্প্রতি নকশাল বাড়ির স্ফুলিঙ্গ ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র উড়িষ্যা ঝাড়খন্ড পশ্চিমবঙ্গের লালগরে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। নারী মুক্তির আন্দোলন মেলে এসে শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের মোহনার। শহরাঞ্চলে স্কুলকলেজের মেয়েদের সরাসরি পার্টিতে যোগদানে উৎসাহ বাড়ে। তারা যুক্ত হয় স্কুল কলেজ ছেড়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে। শুধু অস্ত্র হাতে নয় বিপ্লবীদের নানা ভাবে সাহায্য করে তারা বিপ্লবী লড়াইয়ে যোগ দেয়। স্কুলে কলেজে লাল পতাকা তুলে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতা করে সংগ্রামে মূল ধারার ব্যবস্থার বিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়। এর সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাভাবনার বিরোধিতা করে, পুরুষপ্রাধান্য বাদের বিরুদ্ধে লড়াই তীব্রতর করে তোলে। দেখা যায় এই শ্রেণীসংগ্রামের লড়াই যখন স্তিমিত থাকে তখন শাসক সম্প্রদায়ের মদতে আবার নারী বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক মনন মাথাচাড়া দেয় যেটা আমরা আজ দেখছি। লালগড় আন্দোলন যখন উচ্চগ্রামে তখন নারীমুক্তি আন্দোলন সেসব এলাকায় কেমন দানা বাধে তা আমরা সেখানকার অংশগ্রহণকারী নারীদের ভূমিকা আলোচনা করলেই জানতে পারব।
উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে আমরা পশ্চিমবঙ্গের নারী আন্দোলনের ধারাটি তুলে ধরব। অবিভক্ত বাংলায় তেভাগা আন্দোলনকে কৃষক আন্দোলনের পথিকৃৎ বলা চলে যেখানে নারীসমাজ বিশেষ ভূমিকা পালন করে, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব বজায় থাকে। সামন্তবাদ এবং একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এ ছিল সসস্ত্র অভ্যুথ্যান। এই আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকা এক নতুন মাত্রা পায় যার সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ভবানী সেন বলেন:
" সবচেয়ে অবদমিত, পশ্চাদপদ ও নিরক্ষর কৃষক রমণী ধান রক্ষায়, তাদের ঘর বাড়ী সন্মান রক্ষায় আর লালপতাকা রক্ষায় এক গৌৱবোজ্জ্বল ভূমিকা গ্রহণ করে। ------ বাংলার নারী সমাজকে এই প্রথম জাগিয়ে তুলেছে তেভাগা আন্দোলন।" পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অস্ত্র হাতে তারা লড়াই করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে, শহীদ হয়েছে। কৃষ্ণ বিনোদ রায় এই আন্দোলনের মূল্যায়ন করে নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন," নারীগণ এই আন্দোলনে যে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন তা ইতিহাসে গাঁথা হয়ে থাকবে। এদের তুলনাহীন সাহসিকতা, প্রত্যুৎপন্নমতি, সংঘব্ধ প্রতিরোধ ক্ষমতা, উন্নততর সাংস্কৃতিক চেতনা সমস্ত নেতা ও কর্মীদের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল।" বীরাঙ্গনা মহিলা বর্গ তথা দীপশ্বরী যশোদা ভান্ডারী অহল্যা কয়েকজন মহিলার ব্যক্তিগত ভূমিকা শুধু নয় এ লড়াই একইসঙ্গে শোষণ নিপীড়ণের বিরুদ্ধে সর্বাত্বক লড়াই আর একই সঙ্গে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জেহাদ। অবিভক্ত বাংলার প্রতিটি জেলায় গ্রামাঞ্চলে এই জেহাদ ছড়িয়ে পরে I মহিলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব।
সুপ্রকাশ রায় তাঁর বইতে দেখান তেভাগা আন্দোলন কিভাবে উত্তর থেকে দক্ষিণ বঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় প্রতিটি জেলা গ্রামে গঞ্জে। জমিদার ও ব্রিটিশ রাজশক্তির যৌথ আক্রমণের মুখে গরিব কৃষকদের এ এক সশস্ত্র অভ্যূথ্যান যার নেতৃত্বে ছিল কমুনিস্ট পার্টি। এই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অবিভক্ত বাংলার মাটিতে জমি পায়। কৃষক রমণীরা এই সশস্ত্র অভ্যূথ্যানে সক্রিয় অংশ গ্রহন করেন। ভারতে কার্যত নারী আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। আন্দোলন বাংলা দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ির ডুয়ার্স, যশোর, খুলনা, ময়মনসিং, দক্ষিণ বাংলার কাকদ্বীপ, সন্দেশখালী, বুরুল, সোনারপুর সর্বত্র এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায়। নারী সমাজ এতে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে নারী আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দেন সেটা আমরা এই সংগ্রামের অন্তর্বস্তু ধরে বোঝার চেষ্টা করব।
অবিভক্ত দিনাজপুরের ত্রিশটি জেলার বাইশটিতে তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ওই এক জেলাতেই চারটি অঞ্চলে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় চল্লিশজন কৃষক। ১৯৪৬-৪৭ সালে তেভাগা আন্দোলনে অবিভক্ত বাংলার উনিশটি জেলার কৃষকরা ব্যাপকহারে অংশ গ্রহন করে। নারীদের অংশগ্রহণ অভাবনীয়। এই আন্দোলনের দাবি তিনটি শ্লোগানের মাধ্যমে মুখর হয়ে ওঠে। এই ধ্বনি তথা শ্লোগানগুলো ছিল: নিজ খোলানে(গোলায়) ধান তোলো, আধি ( অর্ধেক) নাই --- তেভাগা চাই, কর্জা (ধার করা) ধানের সুদ নাই। দিনাজপুরের ঠাকুরগ্রামের সংগ্রামে কৃষক মহিলা রমণী দীপশ্বরীর নাম বিশেষ উল্লেখ যোগ্য। চিরির বন্দ্রগ্রাম এলাকায় আন্দোলনে বন্দুক হাতে নেতৃত্বে ছিলেন রাজবংশী স্ত্রী কৃষক নেতা ভান্ডনী। হিন্দু মুসলমান নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের এই সশস্ত্র সগ্রামে অংশগ্রহণ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। আটোয়ারী থানার রামপুর গ্রামে সশস্ত্র লড়াইয়ের মেয়েদের ভূমিকা প্রকাশ পায় সুপ্রকাশ রায় যখন লেখেন:
" পুলিশদের সঙ্গে কৃষকদের প্রচন্ড সঘর্ষ হয়।পুরুষরা ক্ষেতে নেমে ফসল কাটছিল আর মেয়েরা জমির চারদিকে আলের ওপর দাঁড়িয়ে দা, কুড়াল, বঁটি, ঝাড়ু প্রভৃতি নিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। সশস্র পুলিশ গ্রামে ঢুকে ধান কাটায় বাধা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে।কৃষক মেয়েরা তখন দা, কুড়াল বঁটি নিয়ে পুলিশদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গাইন ( ধান ভাঙার জন্য কাষ্ঠ দন্ড) দিয়ে পিটিয়ে পুলিশদের বন্দুক ভেঙে দেয়। হাজার হাজার মেয়ে ভলিনটিয়ার তখন পুলিশদের ঘিরে ফেলেছে। পুলিশদল ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। এই মেয়ে বাহিনীর নেতা ছিলেন রোহিনী বর্মন আর জয়মণি বর্মন।" ময়মনসিং জেলার হাজং মুক্তি সংগ্রামে নারী যোদ্ধা ও নেত্রী রাসমনির নাম বিশেষ উল্লেখ যোগ্য। এই সংগ্রামে তাঁর ভুমিকা প্রসঙ্গে সুপ্রকাশ রায়ের বই থেকে জানা যায়:
১৯৪৫-৪৬ সাল বাংলার কৃষক সংগ্রামের এক স্মরণীয় অধ্যায়। যুদ্ধোত্তর যুগে সমগ্র ভারতে যে নতুন গণসংগ্রামের জোয়ার বয় বঙ্গদেশের তেভাগা আন্দোলন বিশেষত ময়মেনসিংয়ের এই সীমান্তের হাজংদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম সেই ভারতব্যাপি গণসংগ্রামে নতুন শক্তি যোগায়।--------- এইসব সভা ও মিছিলের পুরোভাগে নারী বাহিনী নিয়ে চলতেন বীরাঙ্গনা মাতা রাসমণি। রাসমণি ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শহীদের মৃত্যু বরণ করেন। মেদিনীপুরে তেভাগা আন্দোলন এক ঐতিহাসিক যুগের সূচনা করে। নন্দীগ্রামে এই আন্দোলন কমিউনিস্ট পার্টির ভীত তৈরি করে। ব্যাপক হারে মহিলারা অংশ গ্রহন করে। বিমলা মন্ডলের( মাজি) মত মহিলারা নেতৃত্বে ছিলেন। সুন্দরবনে তেভাগা আন্দোলন ইতিহাস সৃষ্টি করে। কাকদ্বীপ ছিল আন্দোলনের পীঠস্থান। কংসারি হালদারের নেতৃত্বে ক্ষেত মজুরদের যে জাগরণ ঘটে তা মেদিনীপুর তথা সমস্ত বাংলার আকাশ বাতাসকে মুখরিত করে। ১৯৪৭ সালের কাকদ্বীপ তেভাগা আন্দোলন হয়ে দাঁড়ায় বাংলায় কৃষক অভ্যূথ্যানের মুখ। কাকদ্বীপের লালদনজ হয়ে ওঠে মুক্তাঞ্চল। সেখানে আজকের ছত্তিশগড়ের জনাতনা সরকারের মত এক অস্থায়ী সরকার গড়ে ওঠে যার অধীনে কৃষক দুনিয়ার নিজস্ব আইন ও শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সেখানে জোতদার জমিদারের জমি বাজেয়াপ্ত করে তা সাধারণের জমি বলে ঘোষিত হয়। যে সমান্তরাল শাসন চালু হয় সেখানে কৃষক রমনীদের ভূমিকা বিশেষ মাত্রা পায়। তেভাগা আন্দোলনের আরেক পিঠস্থান হয়ে ওঠে কাকদ্বীপের চন্দনপিরি যে অঞ্চলটা মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলে ব্যাপকহারে কৃষি রমণীরা নেতৃত্ব দেন এবং শহীদের মৃত্যু বরণ করেন। এদের মধ্যে অহল্যা, সরোজনি, বাতাসি, উত্তমি, অশ্বিনী প্রমুখের নাম সবার জানা। আমরা আমাদের আলোচনার অঞ্চল ও নেতা নেত্রীদের নাম করে তেভাগা আন্দোলনকে বুঝব না। এই আন্দোলন ইংরেজদের বিরুদ্ধে আপসপন্থী অহিংস নামধারী এক নির্বিষ আন্দোলনের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষদের সংগ্রামের সূচনা যা আজ কমুনিষ্ট নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পথিকৃৎ। এই আন্দোলনের দিশা অনুসরণ করেই নারী মুক্তি আন্দোলন বৃহত্তর মাত্রা পেয়েছে যেটা সম্পর্কে আমরা বার বার উল্লেখ করেছি। এই আন্দোলনের শিক্ষা হল সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়, দরকার হয় প্রতিরোধ লড়াইকে আক্রমানত্বক লড়াইয়ের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। মেনে নিতে হয় যে এই লড়াইকে সর্বাত্বক রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় নি। তবে প্রমাণিত হয়েছে যে সশস্ত্র লড়াইয়ে সমাজের অর্ধেক মানুষকে বাদ দিলে চলে না। আর এই সশস্ত্র লড়াইয়ে মেয়েরা যথেষ্ট সক্ষম কি নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে কি লড়াকু সৈনিক হিসেবে। এই শিক্ষা নিয়েই আজের ছত্তিশগড় মহারাষ্ট্র বা লালগরের লড়াই গড়ে উঠেছে। পার্টির ভেতরে যে সামন্তবাদী মনন তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শিক্ষা দেয় এই আন্দোলন যা আজ অনুশীলন প্রক্রিয়ার মধ্যে ভ্রুনাকারে হলেও দেখা যাচ্ছে।
এবার আসা যাক লালগড় আন্দোলনে যেখানে নারী আন্দোলন উচ্চতর রূপ পায়, যে দ্বিমুখী আন্দোলনের কথা আমরা শুরুতে বলেছি তার ব্যবহারিক চরিত্র লাভ করে।
তেভাগা আন্দোলন সারবস্তুর দিক থেকে শোষিত উৎপাদনকারী কৃষকদের সঙ্গে জোতদার ভূস্বামীর শ্রেণী যুদ্ধ। নারী পুরুষ নির্বিশেষে শোষিত মানুষের লড়াই। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে এই আন্দোলন অবিভক্ত বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। ১৯৪২ সালের শেষে কৃষকসভার মোট সদস্য সংখ্যা ছিল তিরাশি হাজারের মত। তার মধ্যে মহিলা সদস্যের সংখ্যা ছিল আট হাজার মাত্র। ১৯৪৪ সালে লড়াইয়ের মুখে যে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়ে ওঠে তাতে ৪৩,৫০০ জন নারী সদস্য ছিল যেটাকে অংশগ্রহণের ঠিক থেকে একটা অভ্যুথ্যান বললে ভুল হয় না। এ লড়াই ছিল জমির ও জমির ফসলের অধিকারের লড়াই। মহিলাদের অংশগ্রহণ একে নতুন মাত্রা দেয় যা সামন্ত ব্যবস্থার ভীত ধরে টানে।
এই সময়কালে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে জঙ্গি লড়াইয়ে মেয়েদের অংশগ্রগণ ভারতে নারীআন্দোলনে নতুন দিশা দেখায়। জানা যায় যে কৃষক সমিতিতে অংশগ্রহণের উৎসাহ দেখা দেয় দুর্বার গতিতে। রানী দাশগুপ্তের একটা রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে ১৯৪৪ সালে সেতাবগঞ্জে কৃষক সমিতির একটা সভা চলাকালে মেয়েরা সেখানে জোটবদ্ধ হয়ে দাবি জানায় এই শ্লোগান তুলে : " খালি মরদ গুলাই সমিতির মেম্বার হবেক? মোরা বেটিছোয়ারা মেম্বার হবে নাই ?" তিনি জানান যে এরপর কমরেড ভুতেশ্বরী দলবেধে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সদস্যসংখ্যা বাড়ান। আমরা সাম্প্রতিক লালগড় আন্দোলনে জনসাধারণের কমিটি গঠনের পর একই ঘটনা দেখি। শুধু সদস্য হওয়া নয় প্রতিরক্ষা ও প্রতিআক্রমণের বলয়ে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ দিয়ে তারা রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর মুখোমুখি হন, শহীদের মৃত্যু বরণ করেন।
স্বাধীনতার পরেও রাষ্ট্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরসূরি হিসাবে কাজ করতে থাকে। ২৭শেএপ্রিল১৯৪৯ সালে কংগ্ৰেস সরকারের পুলিশের গুলিতে প্রকাশ্য রাজপথে বৌবাজারে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলিষ্ট্রিট ও কলেজ ষ্ট্রিটের স;যোগস্থলে নিখিলবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির চারজন অগ্ৰণী সদস্যা লতিকা সেন, প্রতিভা গাঙ্গুলি, অমিয়া দত্ত, গীতা সরকার ও এক যুবক বিমান ব্যানারজি শহীদের মৃত্যু বরণ করেছিলেন। সেই সময় সাধারণ মানুষের খাদ্য ও জীবন জীবিকার জন্য সারা রাজ্যে লড়াই আন্দোলন ছড়িয়ে পরে। কৃষক আন্দোলন ও গনতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারন করে। গ্ৰামের কৃষক রমণীরা ও শহরের মধ্যবিত্ত মহিলারা এই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেন। আমরা দেখেছি যে তেভাগা আন্দোলনে কাকদ্বীপ,সাকরাইল, ডোঙ্গাজোড়া প্রভৃতি বিভিন্ন গ্ৰামে পুলিশের ভয়াবহ অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হন অহল্যা, বাতাসী, সরোজিনী, উত্তমা,সূর্যমণি প্রমুখ অন্তত ২৫জন মহিলা। কমিউনিষ্ট দল ও বিভিন্ন গনসংগঠনগুলির শত শত নেতা ও সাধারণ সদস্যদের গ্ৰেপ্তার করে কারারুদ্ধ করা হয়। রাজবন্দির স্বীকৃতি ও দেওয়া হয় না।জেলের মধ্যে পুলিশের গুলি চালাতে ও দ্বিধা করেনি। এই অবস্থায় নিখিল বঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ও মায়েদের সমিতি যৌথভাবে ভারত সভা হলে সাতাশে এপ্রিল এক মহিলা প্রতিবাদ সভা ডাকে। সেই সভার পর১৪৪ধারা অমান্য করে শত শত মহিলার শোভাযাত্রা শুরু হয়। মহিলারা দৃপ্তকন্ঠে বন্দিদের মুক্তির দাবি করতে থাকে। পুলিশের বুলেটে লুটিয়ে পড়লেন লতিকা, প্রতিভা, অমিয়া ও গীতা এবং যুবক বিমান। সাতাশে এপ্রিল দিবসটি আমাদের সকলের কাছে একটি গৌরবময় আন্দোলনের ঐতিহ্যের দিন। আজও আমাদের দেশে গনতন্ত্র রক্ষার লড়াই চলছে। এমন একটা সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি যখন দেশের স;বিধান ওসাধারনতন্ত্র আক্রান্ত। প্রতিদিন অপমানিত হচ্ছেন মহিলারা। ২৭শে এপ্রিলের স্মৃতি আমাদের লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা দেয়। ১৯৪৯ সনের সাতাশে এপ্রিল নারী শহীদ দের অমর স্মৃতিতে চিরভাস্বর।
সেই ঐতিহ্য ধরে পঞ্চাশ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল বাড়িতে আদিবাসীরা সামন্ত প্রভুর সঙ্গে লড়াইয়ে নামেন। রাষ্ট্র জোতদারকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। গুলি চালিয়ে আটজন আদিবাসী কৃষক রমণীকে হত্যা করে যা ইতিহাসে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মহিলা অভ্যুথানের নজির বহন করে। আজ লালগড় ছত্তিশগড় ঝাড়খন্ড সর্বত্র লড়াইয়ের ময়দানে এটা নারী সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি মহিলা গেরিলা বাহিনী গড়ে ওঠে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রীতিলতারা যে উদাহরণ সৃষ্টি করেন, তেভাগা আন্দোলনে গরিব কৃষি রমণীরা যে দৃষ্টান্ত রেখে যান তার পদাঙ্ক আনুসরন করেই আজ সর্বভারতীয় স্তরে নারী মুক্তি আন্দোলন নতুন দিশা ধরে চড়াই উৎরাই পথে এগোয়। আজ ভারতে পশ্চিমবঙ্গসহ সর্বত্র নারী অভ্যুথ্যান ঘটে চলেছে। রাষ্ট্রের সাহায্যে কর্পোরেট দুনিয়ার যে আক্রমণ তার বিরুদ্ধে নারী আভ্যুথ্যান যে নতুন মাত্রা পেয়েছে সে সম্পর্কে আমরা আগের প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তেভাগা আন্দোলন সাঁওতাল বিদ্রোহ নাচাল বিদ্রোহ নকশালবাড়ি লালগড় ধরে নারী মুক্তি আন্দোলন আজ এক বহমানতা। আজের এই বহমান নারী আন্দোলন সম্পর্কে বলা চলে:
বিক্ষুব্ধ এই ভারতে
লোভের সন্ত্রাস দূষণ ছড়ায়
রক্তের কোষে কাঁপন ধরায় ,
তুফানের ঘূর্ণাবর্ত বাতাসে বাতাসে
সমুদ্রের গর্জন ঢেউয়ে ঢেউয়ে ,
পর্বত চোখ রাঙায়
জঙ্গলের ক্রন্দন শোনা যায়,
ভীত সন্ত্রস্ত লুন্ঠিতা মা আমার,
ভয়ে পালায় কন্যা তার
অস্ত্র হাতে বাস্তুহারা রুখে দাড়ায়।
এই বাস্তুহারা কৃষক রমণীকে আমরা যুদ্ধের সাজে দেখি। সাম্প্রতিক নন্দীগ্রাম ও বিশেষ করে লালগড় আন্দোলনে ব্যাপকহারে মেয়েরা সক্রিয় অংশ গ্রহন করে। গড়ে তোলে বিপ্লবী নারী সংগঠন। গণসংগঠনে, বিপ্লবী দলে তারা নেতৃত্ব দেয়। শহীদের মৃত্যু বরণ করে। জনসাধারণের কমিটিতে মোট সদস্যের অর্ধেক মহিলা নির্বাচিত হয়। তারা নীতি নির্ধারণে অংশ গ্রহন করে। পুকুর কাটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালানো, চিকিৎসা সব বিষয়ে শ্রম দেয়, নিজেদের বিদ্যা বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটায়। সামরিক বিপ্লবী বাহিনীর সেনা হিসেবে যুদ্ধ করে। ছত্তিশগড়ের অনুশীলনে নারী সংগঠন গড়ে তোলে। ফলে লালগড় আন্দোলন ভারতে নারী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
বর্তমান শতকের প্রথম দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের রাজত্বকালে প্রথমে সিঙ্গুর তারপর নন্দীগ্রাম লালগড়ে কৃষক অভ্যূথ্যান দুর্বার গতি অর্জন করে। কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন আর্থিক নীতি অনুসরণ করে পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বায়নের কর্মসূচী অনুসরণ করা হয়। এই তিনটি আন্দোলনই শুরু হয় রাষ্ট্রের সাহায্যে কর্পোরেট দুনিয়ার শিল্পায়নের নামে জমি লুঠের বিরুদ্ধে কৃষকের প্রতিরোধ লড়াই হিসেবে। এটা আজ সারা ভারতের চেহারা। বিশ্বায়নের নীতি অনুসরণ করে জল জমি জঙ্গল লুঠের অবাধ নীতি গ্রহণ করেছে সরকার সারা ভারত জুড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে গ্যাট চুক্তি অনুসরণ করে। আফ্রিকা লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার সর্বত্র সাম্রাজ্যবাদ দেশের মুৎসুদ্দি পুঁজির সাহায্যে জমি দখলের নীতি কার্যকরী করতে রাষ্ট্রিয় বাহিনী ব্যবহার করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্রামের বড় বড় জমির মালিকরা যারা জমিকে কেন্দ্র করে ফাটকাবাজিতে লাভ তুলতে চায়। এমনকি কোন কোন দেশে ইউ এন ও'র সামরিক বাহিনী ব্যবহৃত হচ্ছে এই পরিকল্পনা কার্যকরী করতে। তাই কৃষকের এই প্রতিরোধ আন্দোলন শেষ বিচারে প্রতিরোধ যুদ্ধে পরিণত হচ্ছে। যে সব জায়গায় কমিউনিস্ট পার্টি এই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিতে চেষ্টা করছে সেই সব জায়গায় এই যুদ্ধ জনযুদ্ধের রূপ ধারণ করছে। আন্দোলনে যুক্ত বা সমর্থনকারী সবাইকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর নিপীড়ন নামিয়ে আনা হচ্ছে। আর এর সঙ্গে জমি ও জীবিকা বাঁচাবার প্রশ্ন প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত বলে গরিব মানুষের ঘরের অন্তঃস্থলে এই লড়াই পৌঁছে যাচ্ছে যেখানে কৃষক রমণীরা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হচ্ছে এই লড়াইয়ে। তাদের বাদ দিয়ে এই লড়াই যে এগোতে পারে না তাও আজ প্রমাণিত হচ্ছে। আর কৃষক রমনীদের এই লড়াই দ্বিমুখী। পরিবারের মধ্যে সামন্ত সংস্কৃতি ভেঙে তাদের পরিবারের বাইরে লড়াইয়ে যুক্ত হতে হচ্ছে। বাইরের লড়াইএ তারা যত যুক্ত হয় তত সামন্ততান্ত্রিক বন্ধন আলগা হয়। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটা তীব্র হয়। তারা একদিকে জনযুদ্ধের অঙ্গ হিসেবে স্বাস্থ্য শিক্ষা উৎপাদনের স্বার্থে পুকুর কাটা রাস্তা তৈরির কাজে যুক্ত হচ্ছে তেমনি অস্ত্র হাতে লড়াইয়ে নামছে, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ছত্তিশগড়ের অনুসরণে পশ্চিমবঙ্গেও সীমিত পরিসরে হলেও নদীগ্রাম ও বিশেষ করে লালগড়ে এটা আমরা লক্ষ্য করি। আমরা সংক্ষেপে এই সব অঞ্চলে লড়াইয়ের অঙ্গ হিসেবে নারী আন্দোলনের দিকটার ওপর আলোকপাত করব।
২০০৬ সালে মে মাসে সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো নামে ছোট গাড়ি কারখানার জন্য সরকারের জমি অধিগ্রহন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শুরু হয় কৃষকের জমি রক্ষা আন্দোলন। কৃষি আমাদের ভিত্তি আর শিল্প হল প্রগতি এই স্লোগান তুলে সরকার প্রায় এক হাজার একর জমি টাটাকে জলের দামে বিলিয়ে দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নেয় কৃষক পরিবারকে উচ্ছেদ করে। জীবিকা ও জমি থেকে তাদের বলপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়। এর বিরুদ্ধে কৃষকরা গড়ে তোলে প্রতিরোধ আন্দোলন। সরকার ও সরকারি দল নামিয়ে আনে সশস্ত্র অভিযান, কৃষক উৎখাত অভিযান। গড়ে ওঠে কৃষি বাঁচাও সমিতি। এই সমিতি গড়ে তোলে সশস্ত্র প্রতিরোধ। সরকার বিরোধী বিভিন্ন দল এতে যেমন যোগ দেয় তেমনি সংসদীয় গণতন্ত্রে আস্থা নেই এমন দল যেমন মাওবাদী কমিউনিস্ট দল এতে অংশ গ্রহণ করে। কৃষক রমণীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এতে অংশ গ্রহন করে। আইনি ও বেআইনি পথে প্রতিরোধ আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। লাঠি বন্দুকের সঙ্গে নারী ধর্ষণের মত বীভৎস হাতিয়ার ব্যবহার করে সরকার। তাপসী মালিকের মত বিদ্রোহিনী মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। গোটা এলাকাকে অবরুদ্ধ করে রাখে সরকারি বাহিনী আর তার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল। এতে আন্দোলন আরও উত্তাল হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত টাটা পিছু হটে।আন্দোলনের চাপে কোর্টের নির্দ্দেশে সরকার জমি ফেরত দিতে বাধ্য হয়। এর ফায়দা তোলে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। এই সাফল্য পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক জমি রক্ষা আন্দোলনের ভীত গড়ে তোলে। নন্দীগ্রাম লালগড় ভাঙরের পরবর্তী আন্দোলনের আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে সিঙ্গুর। সিঙ্গুর আন্দোলন গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নন্দীগ্রামে সরকার পরমাণু কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে জমি দখলের জন্য। সিঙ্গুরের লড়াই আরো ব্যাপকতা লাভ করে নন্দীগ্রামে। কার্যত এখানেও সিঙ্গুরের মত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলে বিশ্বায়নের নমুনায় শিল্প গড়ে তোলার অপচেষ্টা শুরু হয়। এ ব্যাপারে নোটিশ জারি করার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন সশস্ত্র রূপ ধারণ করে। পুলিশের গুলিতে নিহত ও আহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সামরিক ঘেরাও ও দমন নীতি শুরু হয়। লড়াকু কৃষকরা রাস্তা কেটে অবরোধ সৃষ্টি করে সরকারি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পাল্টা সন্ত্রাস তৈরি করে। শাসক দল তাদের বাহিনী নিয়ে সরকারি বাহিনীর সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কার্যত যুদ্ধ শুরু হয়। এতে মহিলারা সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহন করে। এই সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে মাওদাদী দল প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহন করে। তাদের অংশ গ্রহন এর দরুন এ লড়াই রীতিমত যুদ্ধের আকার নেয়। মহিলারা এই সশস্ত্র লড়াইয়ে যে ভূমিকা পালন করে তা আমাদের তেভাগা আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ধর্ষণ শুধু সরকারি সেনা নয় শাসকদলের আক্রমণের দৈনন্দিন কার্যক্রম হয়ে দাঁড়ায়। মহিলারা ধর্ষণের শিকার হন, তাদের পেটের বাচ্চা নিহত হয়, কারো কারো চোখ শরীরের অঙ্গ জখম হয়। অনেক মানুষের খোঁজ পাওয়া যায় না। মহিলারা এই সংগ্রামে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। নারী মুক্তি আন্দোলন জীবন জীবিকা রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন মাত্রা পায় যা আমরা লালগড়ে আরও উচ্চ মাত্রা পেতে দেখি। শেষ পর্যন্ত নন্দীগ্রাম আন্দোলন জয়যুক্ত হয়। সরকারকে পিছু হটতে হয়। সংসদীয় রাজনীতিতে মমতা এই আন্দোলনকে পুঁজি করতে সফল হয়। তবে আন্দোলনের সশস্ত্র চরিত্রটা উদ্ঘাটিত হয়। তার প্রতি কৃষকদের আনুগত্য বাড়ে যেটা আমরা লালগরে দেখি। তবে এখানে মাওবাদী নেতৃত্বও পরবর্তী সংগ্রামের জন্য তৈরি হতে পারে না। তাদের ওই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয় কারণ তৃণমূল জায়গা দখল করে। রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হয় তারা। তবে এখানে মহিলা অভ্যূথ্যান এক নতুন ইতিহাস তৈরী করে যার উচ্চতর রূপ দেখি লালগরে। কার্যত নন্দীগ্রামের আন্দোলন এই অর্থে ছত্তিশগড়ের আন্দোলনের বিস্তৃতি যদিও তাকে ধরে রাখা যায় নি।
লালগর আন্দোলনের আলোচনায় আসার আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি অঞ্চলে শিল্পপতি জিন্দালের স্টিল শিল্প গঠনের জন্য যে বদান্যতায় সেখানকার বসবাসকারী প্রধানত আদিবাসী মানুষকে উচ্ছেদ করে তাদের জীবিকা অনিশ্চিত করে সরকার জমি দিয়েছে তার ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করতে হয়। কারন জমি দখলের সঙ্গে এই অভ্যূত্থ্যানের একটা সরাসরি সম্পর্ক বর্তমান। আজ যেখানেই সরকার জমি দখলে নামছে সেখানেই অভ্যূত্থ্যান ঘটছে। জীবিকাচ্যুত মানুষরা আর বিনা প্রতিরোধে জমি ছাড়তে রাজি নয়। "যেখানেই আক্রমন সেখানেই প্রতিরোধ" এই শ্লোগানে আজ ভারতের আকাশ বাতাস মুখরিত। জমি দখলকে আজ খনিজ এলাকার লুঠের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে বাঁধতে সমর্থ হয়েছে মাওবাদী দল।
সরকারের হাতে থাকা ( vested ) ৪৫০০ একর বাস্তু জমি সরকার জিন্দাল গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়। ৫০০ একর জমি জিন্দাল বাজার থেকে কেনে। স্টিল প্রকল্পটি ৫০০০ একর জমিতে গড়ে তোলার প্রস্তাব হয়। এই জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে ভূমি সংস্কারের নীতি অনুসরণ করে বন্টন করার কথা ছিল। বাম আমলে সেই নীতি লঙ্ঘন করে এই জমি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি সহজেই অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে এ নিয়ে বিক্ষোভের আগুন চাপা ছিল। এই প্রকল্পকে সেজে-এর মর্যাদা দেওয়া হয়। অর্থাৎ `দেশের মধ্যে একটা বিদেশ` গড়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। জমি থেকে জীবিকা উচ্ছেদের সঙ্গে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি বিশেষ ভাবে যুক্ত এই অঞ্চলে কারণ এখানে যে অসংখ্য স্পঞ্জ আয়রনের কারখানা ইতিমধ্যে পরিকল্পনাহীন ভাবে গড়ে উঠেছিল তা পরিবেশকে ভীষণভাবে দূষিত করে। সেখানে বসবাসকারী মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে। এর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আন্দোলন ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছিল যা নিয়ে অঞ্চলটা অশান্ত হয়ে উঠত। তবে সংগঠিত প্রতিরোধ আগে গড়ে উঠতে পারে নি। সেটা ছিল সিপিআইএমের নেতৃত্বে বাম জমানা।
জিন্দাল প্রকল্প গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এতদিনকার চাপা থাকা বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। অনেকদিন ধরেই মাওবাদীরা তিল তিল করে সংগঠনের কাজ করছিল। পাশের প্রদেশগুলোতে তাদের আন্দোলন অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চলে সংগঠন গড়ে তোলার কাজ গতি পায় । সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সফল আন্দোলন সরকারকে সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। সরকারের পৃষ্ঠপোষক সিপিএমও মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে তাদের সঙ্গে শিল্পপতিদের এক আঁতাত প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে। সরকার শিল্পায়নের এক কল্পিত উজ্জ্বল ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করলেও সেখানকার মানুষের অভাব অভিযোগ নিয়ে নিরুত্তাপ থাকে। ফলে মানুষের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। মাওবাদীরা যে সেখানকার মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে শক্ত সংগঠন গড়ে তুলেছে সেটা দল বা সরকার কেউ আঁচ করতে পারেনি। আর সিপিআইএমের একটা বিক্ষুব্ধ অংশ এবং সরকার বিরোধী সব দলই এই বিক্ষোভ মানসিকতাকে মদত করতে বাধ্য হয় কারণ এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই তারাও জমি পেতে চায় যা ত্রিশ বছর ধরে বামপন্থীরা দখল করে রেখেছিলো।
আনুষ্ঠানিক বিচারে লালগড়ের আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ২০০৮ সালের ২ নভেম্বরে যেদিন জিন্দালের কারখানার উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষ করে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ফিরে আসার পথে তার গাড়িকে লক্ষ্য করে মাইন বিস্ফোরণ ঘটায় মাওবাদীরা। এটাকে কেন্দ্র করে পুলিশী তান্ডব শুরু হয়। বিস্ফোরণের জায়গা থেকে ৩০ কিমি দূরে ছোটপালিয়া গ্রামে পুলিশ তল্লাশির নামে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার নামিয়ে আনে। একজন অন্ত:সত্ত্বা মহিলার ওপর এমন অত্যাচার করা হয় যে তার পেটের বাচ্চা মারা যায়। একজনের চোখ নষ্ট হয়ে যায়। বুড়ো বাচ্চা কেউ অত্যাচার থেকে রেহাই পায় না। গ্রামবাসীরা বিক্ষোভে ফেটে পরে। নন্দীগ্রামের কায়দায় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। একটি স্ফুলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করে। আন্দোলন ছড়িয়ে পরে গ্রাম থেকে গ্রামে জেলা থেকে জেলায়। ব্যাপক হারে আদিবাসী মানুষের অংশগ্রহণে এই আন্দোলন এক বিরাট গণআন্দোলনে রূপ পায়। উত্তাল হয়ে ওঠে পশ্চিম মেদিনীপুর বাঁকুড়া পুরুলিয়া অঞ্চল। মানুষের এতদিনকার বিক্ষোভ অগ্নিগর্ভ করে তোলে আন্দোলনের অঞ্চলগুলোকে। ঘটনার ঠিক পরে ৮-ই নভেম্বর বিদ্যুৎগতিতে গড়ে ওঠে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জনসাধারনের কমিটি যার নাম People's Committee Against Police Atrocities (PCAPA)।
২০০৮ সালের নভেম্বর মাস থেকে মাইন বিষ্ফোরণের পর ছোটপালিয়া গ্রামে পুলিশী বর্বরতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে বাংলার তিনটি জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর বাঁকুড়া পুরলিয়ায় তিনবছর ধরে যে লাগাতার গণ অভ্যুথান দেখা গেছে তা ভারতের মানচিত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আদিবাসী বিদ্রোহ বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। মাও সে তুঙের উক্তি " একটি স্ফুলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করতে পারে" যে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তা এই অভ্যূত্থ্যান প্রমান করে। নভেম্বরের সেই ঘটনার পর পর-ই গঠিত হয় পুলিশি নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনসাধারনের কমিটি ( PCAPA ) যা এই অভ্যূত্থ্যানের নেতৃত্ব দেয়। প্রথম পর্যায়ে সাধারণ সম্পাদক ছত্রধর মাহাতো ও সভাপতি লালমোহন টুডুর নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়। এর পেছনে সরাসরি কোন রাজনৈতিক নেতৃত্ব আছে বলে প্রকাশ্যে আনা হয় না। ১৩ দফা দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলন শুরু হয়। এই দাবিগুলো হল:
১। পুলিশ সুপারকে কান ধরে ক্ষমা চাইতে হবে। তাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এলোপাথারি যাকে তাকে গ্রেপ্তার করা চলবে না। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মহিলাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।
২। অপরাধী পুলিশ অফিসার যারা ৫-ই নভেম্বরে মহিলাদের ওপর অত্যাচারের জন্য দায়ী তাদের নাক খত দিতে হবে।
৩। যে মহিলারা পুলিশি বর্বরতায় আহত হয়েছেন তাদের প্রত্যেককে দুলাখ টাকা করে ক্ষতি পূরণ দিতে হবে।
৪। শালবনি চক্রান্তের নামে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের সবাইকে মুক্তি দিতে হবে।
৫। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে মাওবাদী নামে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে তাদের ওপর থেকে মামলা তুলে নিতে হবে।
৬। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া এলোপাথাড়ি গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে।
৭। কালামুড়ি ধর্মপুর রামগড় ফাঁড়ি থেকে আধাসামরিক বাহিনীর শিবির সরিয়ে নিতে হবে।
৮। শালবনি বিস্ফোরণ মামলা থেকে শশধর মাহাতোর নাম প্রত্যাহার করতে হবে কারণ সে বিস্ফোরণের সময় ব্যাসদেব অঞ্চলে ছিল, শালবনিতে নয়।
৯। ক্লাবগুলোর ওপর আক্রমন বন্ধ করতে হবে।
১০। গ্রামে সন্ধ্যে পাঁচটা থেকে সকাল সাতটার মধ্যে পুলশি নজরদারি বন্ধ করতে হবে।
11. স্কুল হাসপাতালে পঞ্চায়েত অফিসে খুশিমত পুলিশের শিবির করা চলবে না। যেগুলো আছে সেগুলো তুলে নিতে হবে। পরে সিপিএমের সশস্র বাহিনীর আক্রমন নেমে এলে আরও দুটি দাবি যোগ করা হয়।
১২। হুমগড়ে প্রতিবাদীদের ওপর সিপিএমের হামলা বন্ধ করতে হবে। ৩০-টা সাইকেল ২-টো মোটর সাইকেল ১২০০০নগদ টাকা দুটো পাস বই যা মুরাকাটা ও রসকুন্ডের মধ্যে ১৫-ই নভেম্বর এন এইচ ৬০ জাতীয় সড়কের ওপর আক্ৰমণে লুঠ হয়েছে তা মালিকদের ফেরত দিতে হবে। আহত মোহন টুডুর চিকিৎসা বাবদ ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
১৩। যদি আদিবাসী বা সাধারণ মানুষের ওপর সিপিএমের আক্রমন নামে তবে প্রশাসন তার জন্য দায়ী হবে। প্রশাসনকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
সরকার এই দাবিগুলো মেনে নেয় না। সেখানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসতে গড়িমসি করে। ফলে গণরোষ বাড়ে। আন্দোলনের সমাধানে শান্তিপূর্ণ পথের রাস্তা বন্ধ হয়। সারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে দাবি ওঠে সেখানকার মানুষের দাবি দাওয়া মেনে শান্তিপূর্ণ পথে আন্দোলনকে মীমাংসার পথে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু সরকার সেদিকে কর্নপাত না করে একে বলপূর্বক দমন করার পথ গ্রহণ করে। নামানো হয় যৌথ বাহিনী। এখানেও সবুজ শিকারের পথে আক্রমন নামানো হয়। এর ফলে মানুষের প্রতিরোধ আন্দোলন আরও তীব্র হয়। রাস্তাঘাট কেটে পুলিশের গ্রামে ঢোকার পথ আটকানো হয়। গাছ ফেলে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পথ ধরে এই আন্দোলন। গোপনে থেকে মাওবাদী সংগঠন এর মদত শুধু নয় নেতৃত্ব দেয়। সক্রিয় প্রতিরোধে তারা অংশ নেয়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে সামনে আসে না।
এই আন্দোলনে ব্যাপকহারে মহিলাদের অংশগ্রন এক নতুন নজির সৃষ্টি করে। লালগড়ের আন্দোলন এক নতুন মাত্রা পায়। আজকের বিক্ষুব্ধ এই ভারতে মহিলাদের বিক্ষোভ প্রতিভাত হয় নারীমুক্তির নতুন দিশা ধরে। কার্যত ছত্তিসগরে যুদ্ধের অঞ্চলে এই লড়াই বিশেষ ভূমিকা পালন করে। জনসাধরণের কমিটি সহ প্রতিটি সাবকমিটিতেই ৫০% মহিলার অন্তর্ভ্যুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গণমিলিশিয়ায় মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। আন্দোলন এমন মাত্রা পায় যে যে কোন মিছিলে ১০,০০০ মানুষের জমায়েত জলভাত হয়ে দাঁড়ায়। মহিলারা আর পেছনে থেকে লড়াইকে সমর্থন যোগানের মধ্যে নিজেদের অংশগ্রহনকে সীমাবদ্ধ রাখেন না। তাঁরা গড়ে তোলেন এক নারী সংগঠন যে সংগঠন নারীদের নিজস্ব অধিকার নিয়ে লড়াই শুরু করে আবার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে। ব্যাপক হারে মেয়েরা ঘর ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়, মাওবাদী দলের সদস্যপদ গ্রহণ করে। গেরিলা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে অংশ গ্রহন করে। আবার বিরাট সংখ্যক মহিলা সমর্থক জনসাধারণের কমিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাস্তা তৈরি, পুকুর কাটা স্বাস্থ্য শিক্ষা শিবিরে স্বেচ্ছা শ্রম দেয়। শহর থেকে কলেজের মেয়রা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তারা একইসঙ্গে পরিবারের পিছিয়ে পড়া প্রথা ও রীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালায়। পার্টির নেতৃত্বে পার্টির মধ্যেও যে পুরুষতন্ত্রের প্রভাব তার বিরুদ্ধে লড়াই চালায়। অনেকটা ছত্তিশগড়ের ধরণের সংগ্রাম গড়ে ওঠে। মেয়েরা আরো বেশি বেশি পড়াশুনার কাজে যোগ দেয়। কার্যত নারী সমাজে এক নবজাগরণ লক্ষ্য করা যায় যা নারী আন্দোলনের উচ্চতর রূপ।
উপসংহার:
সমাজের অর্ধেক মানুষ নারী। তাদের বিচ্ছিন্ন রেখে সমাজমুক্তির কাজ সম্পূর্ণ করা যায় না। মানব সমাজে নারীকে প্রকৃতির প্রতীক বলে গণ্য করা হয়। প্রকৃতিকে অবহেলা করে তার থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে যেমন এ বিশ্বসংসার টিকে থাকতে পারে না ঠিক তেমনি নারী সমাজকে বাদ দিয়ে তার মুক্তি না ঘটিয়ে সমাজ টিকে থাকতে পারে না। সুতরাং মানবসমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে নারী মুক্তি আন্দোলনকে সর্বাত্বক হতে হয়। তা না হলে যে বিচ্ছিন্নতা সমাজকে গ্রাস করে তা আমরা রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে পাই। সেটা তুলে ধরে আমরা আমাদের প্রতিবেদন শেষ করতে পারি।
ঔপনিবেশিক কোন দেশে সাম্রাজ্যবাদী দখলদারি কিভাবে প্রকৃতির ওপর আঘাত হানে তা আমরা জানতে পারি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার `আফ্রিকা` নামক কবিতায় সে কথাই বলে গেছেন :
হায় ছায়াবৃতা,
কালো ঘোমটার নীচে
অপচরিত ছিল তোমার মানবরূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
এল ওরা হাতকড়া নিয়ে,
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল ওরা মানুষ ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হল ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে,
দস্যু পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়
বীভৎস কাদার পিন্ড
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাস।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার রক্তকরবিতে যে বার্তা রেখে গেছেন তার সারবস্তু হল :
আমরা জানি, "ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়"। তাও আমাদের ভাবায় আজ সমরবাদ ভোগবাদ প্রকৃতি নিধনের এই যুগে কি প্রাচুর্য্যের জগতে দুনিয়া কাব্যময়? না, তাও তো নয়। ক্ষুধার জগতে প্রাচুর্য্যের দ্বীপ। প্রাচুর্য্যের দ্বীপে মধ্যগগনের দহন জ্বালা। সকালের সূর্যের নরম স্পর্শ, সন্ধ্যার স্নিগ্ধতা, রাতের সুখস্বপ্ন কোথায়? সন্ধ্যায় অমাবস্যার অন্ধকার, রাতে বিবরের গহ্বর। মাতৃগর্ভে আগমনির পদধ্বনি শোনা যায় না। পৌরুষের আকাশে প্রকৃতির রোষ। এই `সভ্যতা`র মধ্যগগনে প্রাচুর্যের দ্বীপে অতিপুষ্ট সবাই বিচ্ছিন্ন। শৈশব লুঠ, যৌবন বীর্যহীন, বার্ধক্য কেঁদে ফেরে। প্রেম সঙ্গিহীন। সেখানে ফোটে না রক্তকরবী। শাসক নিজেও শৃঙ্খলিত। এর মধ্যেই রঞ্জন নতুনের বার্তা বয় । নন্দিনী বিদ্রোহিনী। 'সভ্যতা'র রথে রঞ্জন নন্দিনী পিষ্ট। তাদের প্রেমের সরোবরে রক্তকরবীর প্রস্ফুটন। বেঁচে থাকে সে প্রেম। রক্তের কোষে সে প্রাণচঞ্চল । আগামীর বার্তা। অপেক্ষা, ক্ষুধার রাজ্য কবে জাগে। বিদ্রোহিনী নন্দিনী নারী সমাজের মুখপাত্র। তার মুক্তি ছাড়া সমাজের মুক্তি নেই।