যুদ্ধের ডাক এসেছিল।
রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার শিকল
টেনে নিয়ে গেছে তোমাকে।
আমি আছি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহুদূরে
ধানের ক্ষেতের পাশে, জোনাক-জ্বলা রাতে
টিমটিমে প্রদীপ জ্বলা এক স্তব্ধ জনপদে।
তোমার মা এখানে খোলা উঠোনে বসে
আকাশ আর বাতাস জুড়ে
তার অনুভূতির চাদর বিছিয়ে দেয়।
মাঝে মাঝে বলে-
" ও বৌমা, কেন যুদ্ধ করে ওরা?"
এখানে যুদ্ধের দামামা এসে পৌঁছায় না।
বাতাসে পোড়া বারুদের ভারী গন্ধ নেই।
এখানকার বাতাস জুড়ে ভাত সেদ্ধ হবার গন্ধ।
আর গভীর রাতে দমকা হাওয়ায় হয়তো বা
বেলফুলের গন্ধ অথবা হাস্নুহানা...
সেই যখন এমনই কোনো গভীর রাতে
তুমি আমার চুলে সাজিয়ে দিতে গোলাপ!
সুরভিত স্বপ্নের মাধুরীর ভিতর আমি অনুভব করতাম
ইন্দ্রিয়াতীত আকিঞ্চন তোমার!
আজও তেমনি আকিঞ্চনের রাত!
তেমনি আমার বুকের মধ্যে....
তুমি নয়।
তোমার শৈশব।
তোমার স্বপ্ন... আমার হৃদয় জুড়ে।
সে তার ছোট ছোট মুঠিতে চেপে ধরে আমার আঁচল।
আমার বুকের থেকে সে টেনে নেয় মমতা।
আমার কোলে একরাশ জুঁইফুলে গড়া যেন তোমার স্বপ্ন।
তার ঠাকুমা বলে, সে তোমার মতো।
আর কাকা বলে, "কক্ষনো নয়, আমার মতো।"
আর আমার 'তুলসীমালা' সই-
সে চুপি চুপি বলে,
"সব মিছে কথা, এক্কেবারে তোর মতো"!
এখানে বসে তোমার চিঠি পড়ে
যুদ্ধক্ষেত্রকে মনে হয়- ভারী অবাস্তব।
বিপজ্জনক পথ পার হয়ে তোমরা এগিয়ে যাও।
এদিকে স্নান করে উঠে পূজোর ফুল তুলতে গিয়ে
নরম ঘাসের মধ্যে থেকে একটা কাঁটা বিঁধল আমার পায়ে।
তুমি লিখেছো, প্রতিটা বিন্দু জল তোমরা
হিসেব করে খরচ করো।
এখানে ভরা পুকুরে সাঁতার দেবার সময়
হঠাৎ একফোঁটা চোখের জল...
নোনা হয়ে গেলো গোটা পুকুরটাই!
তুমি কিন্তু দুঃখ করো না।
আমি কাঁদছি না।
মন খারাপও করি না কক্ষনো।
শুধু যখন সন্ধ্যা দেবার পর
আয়নায় দেখে কপালে সিঁদুরের টিপটা আঁকি,
হঠাৎ তখন...
কান্না নয়।
উনানের ধোঁয়া বুঝি হবে!
তোমার মা...
আকাশের দিকে চেয়ে থেকে থেকে
অধীর হয়ে প্রশ্ন করে-
"বৌমা, খোকার পেলেন দেখা যাবে না?"
কি খাও তুমি ওখানে?
তোমার মা প্রায়ই বলে-
"ওখানে বাজার বসে?
বৌমা, রবিবারে যুদ্ধ বন্ধ থাকে তো?
আমার খোকা একটু মাছ ভালোবাসে।"
তখন...
তুমি রাগ কোরো না, শুধু তখন...
গরম ভাতের থেকে ওঠা ধোঁয়ার হালকা রেখাগুলোই
আগুনের শিখা হয়ে পোড়ায় আমাকে।
সেদিন খবর এসেছে
ওপাড়ার হামিদদের রেজিমেন্টে নাকি...
বোমার আঘাতে নাকি ওদের কেউ...
হামিদের বৌয়ের কান্না
আকাশ... বাতাস ছাড়িয়ে
কোথায় না জানি মিলিয়ে গেল।
তোমার মা এখনও কিছু জানে না।
আমাকে জিজ্ঞেস করছিল-
"কি হয়েছে বৌমা? কার কি হয়েছে?
এতো কান্না কিসের?"
আমি আর কতো মিথ্যা বলবো?
ছোট্ট তুমিটা আমার মুখের দিকে
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
ও একদম কাঁদে না, জানো!
ওর ফোকলা মুখে খইয়ের মতো সাদা দুটো দাগ।
দাঁত উঠে গেলো।
এরপর টলমল পায়ে চলা শিখে যাবে।
পেরোতে চাইবে তোমাদের এই বিশাল উঠোনখানা।
এখনি আর থাকতে চায় না কোলে।
ও চলতে শেখার আগে অন্তত ফিরে এসো তুমি।
শক্ত মাটি চেনার আগে
একবার অন্তত ওর বাবার কোলটা চিনুক ও!
নরম ছোট্ট হাতটা রাখুক তার শক্ত কাঁধে!
তারপর পায়ের গোছ শক্ত হলে না হয়
উঠে দাঁড়াবে এ দেশের মাটির বুকে।
যখন খইয়ের মতো দাঁতগুলো শক্ত হবে,
দৃঢ় চোয়ালের আর এক 'তুমি'
এই উঠোনটা সহজেই পার হয়ে যাবে।
হয়তো যাবে সেখানেই
ওর বাবা যেখানে গেছে।
জন্মের ঋণ মেটাতে,
রাষ্ট্রের সমস্যার মোকাবিলা করতে
চলে যাবে দেশ মায়ের ডাকে।
পড়ে থাকবে মায়ের আঁচল,
ধানের গন্ধ,
বুড়ি ঠাকুমার রূপকথা,
পড়ে থাকবে আমার জুঁইয়ের গন্ধভরা রাতের স্বপ্ন!
এবারে পনোরই আগস্টের দিনে
স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে
রাজধানী থেকে
হামিদের বৌয়ের নিমন্ত্রণ এসেছে।
হামিদকে নাকি
মস্ত বড় বীরের সম্মানে মেডেল দেওয়া হবে।
সেই মেডেল আনতে যাবে তার বিধবা বৌ।
আমি যদি সেই অনুষ্ঠানে একবার যেতে পারতাম,
তবে মন্ত্রী মশাইকে একটা প্রশ্ন করতাম-
যুদ্ধ কি শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই হয়?
আমরা যুদ্ধ করি না?
এতো কান্না, এতো অপেক্ষা,
যুদ্ধে বিসর্জন দেবার জন্য
এতো যে বীর সাজিয়ে দেওয়া-
এর কি কোথাও কোনো মূল্য আছে?
তোমার মা, আমি, হামিদের বৌ,
আমাদের মতো এরকম আরও যারা
দেশের কোনায় কোনায়,
শান্ত গ্রামে, ব্যস্ত শহরে,
ঘরের মধ্যে নীরবে নিজেদের জ্বালিয়ে
তৈরী করছে তোমাদের-
তাদের বেঁচে থাকা কি যুদ্ধ নয়?
----------------------------
সোমা চক্রবর্তী
Kalikapur, Taki Toad
(near Shanti Bhawan wedding hall)
PO. Barasat, Dist: 24 Pgs (N), WB.
Pin: 700124
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন