Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গল্প ।। একটি নিরীহ প্রশ্ন ।। সুদীপ পাঠক

 



আপনি কে ? ব্যাস এতেই অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হলো ! বলা বাহুল্য প্রশ্নটি  আক্ষরিক অর্থে নয় , অপরিচিত ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাওয়া । আর যেটুকু উহ্য রয়ে যায় তা হলো ;  কি কারণে কোন সুবাদে তিনি এখানে উপস্থিত হয়েছেন ? অব্যক্ত যা কিছু তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে প্রশ্নকর্তার মুখাবয়বে , অভিব্যক্তিতে । সেটা তো আরো অসহনীয় । সেলিব্রিটি সত্ত্বায় প্রবল ঘা দেয় যেনো । এক লহমায় কাঁচের স্বর্গ চুরমার হয়ে যায় ! ফলস্বরূপ যা ঘটার তাই ঘটলো , রীতিমত কেলেঙ্কারি ।

    ক্ষমতা কুক্ষিগত করা , তার অলিন্দে ঘোরাফেরা এবং তার আস্ফালন ! কর্কট সদৃশ মারণব্যাধি চারিয়ে গেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে । একদল অন্যদলকে টেক্কা দেওয়ার ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে । বাজিমাৎ করতে পেরেছে বলে ধরে নেওয়া গেলে তুরীয় উল্লাসের ফোয়ারা ছোটে যেনো । সত্তরোর্ধ্ব উমানাথবাবু এরকমই একটি ফাঁদে পা দিয়ে ফেললেন নিজের অজান্তে । মূল্যও চোকাতে হলো নেহাৎ কম নয় । শিক্ষক হিসাবে তাঁর সুনাম সর্বজনবিদিত । একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা ও সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে একাধিক উল্লেখযোগ্য পুরস্কারে ভূষিত তিনি । খবরের কাগজে বারকয়েক ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে । গণমাধ্যমের এই বাড়বাড়ন্তের যুগে বোকাবাক্সই বা পিছিয়ে থাকে কেনো ? খুব স্বল্প সময়ের জন্য হলেও তাঁর সাক্ষাৎকার ঝিলিক দিয়ে গেছে বিভিন্ন চ্যানেলে । এহেন প্রবীণ গুণীজনকে সংবর্ধনা দিতে আগ্রহী হলো পাড়ার পুজোকমিটি । আপাত দৃষ্টিতে তারা নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক সংগঠন ।

    অনুষ্ঠানের দিন পনেরো আগে থেকে গোটা এলাকা ফ্লেক্স ব্যানারে মুড়ে ফেলা হয়েছে । দিবারাত্র তারস্বরে মাইকিং চলেছে । কিন্তু কিছুই দৃষ্টি ও কর্নগোচর হয়নি ঐ বৃদ্ধের । হলেও মর্মে প্রবেশ করে নি । উল্টে তিনি উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ জানিয়েছেন , দু'হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন । তিনি নিজে আমন্ত্রিত অথবা সংবর্ধিত হতে চলেছেন বলে নয় । এ সব বিষয়ে তিনি অত্যন্ত নিস্পৃহ ও নিরাসক্ত । বরং প্রশংসা করেছেন এই কারণে যে ; বর্তমান প্রজন্মের ছেলেপুলেদের মধ্যে আদর্শ , সত্যনিষ্ঠা ও মূল্যবোধের শিক্ষা এখনো কিছুটা অবশিষ্ঠ আছে তাই ।

    এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত সন্ধ্যা । পাটভাঙ্গা ধুতি পাঞ্জাবি তার ওপর বাহারি কাশ্মীরি শাল জড়ানো , পায়ে পালিশ করা চকচকে কালো পামশ্যু পরে মাষ্টারমশাই নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে গেছেন । মঞ্চে উঠে উমানাথবাবু প্রথমটায় বেশ থতমত খেয়ে গেলেন । এই এতো মানুষ জড়ো হয়েছেন তাঁর কথা শুনতে ! না না তা নিশ্চই নয় , তেমনটা তিনি প্রত্যাশাও করেন না । নাচ গান ইত্যাদি অন্যান্য চিত্তাকর্ষক বিনোদনের পসরা আছে সে কথা তিনি বিলক্ষণ জানেন । তবু জানুয়ারী মাসের এই শীতের সন্ধ্যায় কনকনে ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে সবাই এসেছে এটা কি কম প্রাপ্তি ! চৌরাস্তার মোড়ে খোলা আকাশের নীচে স্টেজ বাঁধা হয়েছে । চারিদিকে রঙিন আলোর ঝলক ! মুহুর্মুহু ঘোষণা চলছে , অনুষ্ঠান এই শুরু হলো বলে , সঙ্গে মিউজিক বাজছে অবিরাম । উমানাথবাবু দেখলেন দর্শক আসনে অর্থাৎ প্লাস্টিকের চেয়ারে যারা বসে আছে তাদের মধ্যে অধিকাংশই পরিচিত মুখ । নিত্য দু'বেলা যাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় তারাই আজ এসেছে তাঁর সংবর্ধনা চাক্ষুষ করতে । এতদিন বহু বড়সড় প্রেক্ষাগৃহে অথবা সভাঘরে সন্মাননা জ্ঞাপন অথবা পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত হয়েছেন । তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে পুষ্পস্তবক , শংসাপত্র ও স্মারক । তাঁর গলায় পরিয়ে দেওয়া হয়েছে মালা কিংবা মেডেল । জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে হাততালি পেয়েছেন বিজ্ঞ পণ্ডিতকূলের কাছ থেকে । কিন্তু আজকের এই অনুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্যই ভিন্ন । যে সমাজে তিনি বসবাস করেন সেখানকার অতি সাধারণ মানুষেরা যারা কোনো দিন সেই সব উচ্চকোটির মহার্ঘ্য প্রাসাদে প্রবেশ করেনি আর ভবিষ্যতেও করবে না সেই সব পল্লিবাসী আজ সাক্ষী থাকবে তাঁর এই বিশেষ মর্যাদা লাভের দিনে । এ এক অভূতপূর্ব অনাস্বাদিত আনন্দানুভূতি যা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব ।

    ঘোষক বারংবার ঘোষণা তথা দর্শকদের উদ্যেশ্যে অনুরোধ করে চলেছে ধৈর্য্য ধরে বসার জন্য । আজকের অনু্ঠানের শুভ সূচনা হবে যাঁর হাতে সেই তিনি অর্থাৎ বিশেষ অতিথি আর অল্প কিছু সময়ের মধ্যে উপস্থিত হলেন বলে । কে সেই ব্যক্তি ? যার কারণে এই অহেতুক বিলম্ব ? মঞ্চ প্রস্তুত , দর্শক শ্রোতায় পরিপূর্ন পল্লীপ্রাঙ্গণ  , আয়োজনের কোনো ত্রুটি নেই । তবু কেনো এই অহেতুক অপেক্ষা ? উমানাথবাবু এবার বেশ বিরক্ত বোধ করতে শুরু করেছেন । কিন্তু সেটা প্রকাশ করা শিষ্টাচার বিরোধী তাই সংযমের পরিচয় দিচ্ছেন যথা সম্ভব । আজীবন তাঁর নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার জন্য সহ শিক্ষক ও সহকর্মীদের কাছ থেকে সম্ভ্রম আদায় করেছেন তিনি । ছাত্ররা তাঁকে যমের মতো ভয় করেছে চিরকাল । তাঁর ক্লাসে পিন পড়া নৈঃশব্দ্যে সবাই কাঁটা হয়ে থেকেছে । আর আজ সেই তাঁকেই কিনা অপেক্ষা করতে হচ্ছে ! কিন্তু কার জন্য ? কোন সে লাট সাহেব শুনি ?

    অবশেষে তিনি এলেন । তার কেশবিন্যাস থেকে রূপসজ্জা , পোশাক পরিচ্ছদ সব কিছু থেকে যেনো হীরকদ্যুতি ঠিকরে পড়ছে ! উমানাথবাবু দেখলেন তাঁর নাতির সমবয়সী একটি পুঁচকে মেয়ে । তৎক্ষণাৎ তাকে ঘিরে দর্শকদের মধ্যে সেকি সাংঘাতিক আদেখলেপনা শুরু হয়ে গেছে । সংগঠকরা কি করবে যেনো বুঝে উঠতে পারছে না । সাংঘাতিক ধর ধর ঠ্যাকা ঠ্যাকা ভাব । অবাক কান্ড ! তিনি কিছুই ঠাওর করতে পারছেন না । কাকতালীয় ভাবে যুবতীটি তাঁর পাশের আসন অলংকৃত করলো এবং তিনি কৌতূহল দমন করতে না পেরে প্রশ্নটি করেই ফেললেন । একেবারে মোক্ষম সময়ে করেছেন কারণ ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘোষক দ্বিগুণ উৎসাহে তারস্বরে চেঁচিয়ে বলছে "প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে । যাঁর জন্য আপনারা এতক্ষন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন তিনি আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন । নতুন করে যাঁর পরিচয় দেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না । তিনিই সেই জেড বাংলা চ্যানেলের সর্বাধিক জনপ্রিয় মেগা সিরিয়াল 'মন বলে পিয়া পিয়া' খ্যাত অভিনেত্রী তথা নায়িকা মিস্ পাপিয়া ধাড়া । আপনার আমার সকলের ঘরের নয়নের মণি , তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের গৌরবান্বিত করেছে । একবার জোরদার হাততালি দিয়ে তাঁকে সবাই স্বাগত জানান" ।

    একেই বলে চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন । মুশকিল হলো এই জগৎ সম্পর্কে তিনি একেবারেই ওয়াকিবহাল নন । বরং সম্পূর্ন অনভিজ্ঞ কিংবা অজ্ঞও বলা যায় । দিনান্তে নিউজ চ্যানেলের সম্প্রচার যতটুকু চোখে পড়ে অথবা নৈশাহার সারতে সারতে যতটুকু কানে ঢোকে টিভির সঙ্গে তাঁর সংযোগ ঐ ততটুকুই । বিরলতম ঘটনা ঘটে যখন নাতির সঙ্গে বসে ক্রিকেট খেলা দেখেন তখন । তাও টি-টোয়েন্টি নয় , ওয়ান ডে ম্যাচ হলেই তবে । কিন্তু তিনি নিজে যতোই লুপ্তপ্রায় প্রজাতীর মতো জীবন যাপন করুন না কেনো সবাই তো তা করে না । এই সমাজ এই প্রজন্ম ডেলি-সোপ মেখে ধারাস্নান করে । মেগা সিরিয়াল নামক সমুদ্রে অবগাহন করে । ফেনায় ফেনায় ফেনিল হয়ে ওঠে তাদের প্রতিটি সন্ধ্যা । তাই একজন উঠতি বয়সের মেয়ে কিংবা তথাকথিত অভিনেত্রীকে কেন্দ্র করে এই সর্বজনীন হ্যাংলামো তাঁকে পীড়িত করে । কোন যুক্তিতে সে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয় তা তাঁর বোধের অগম্য !

    তিনি যে ইতিমধ্যে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলেছেন সে সম্পর্কেও তাঁর কোনো ধারণা নেই । দিব্যি নির্বিকার চিত্তে বসে আছেন । মিস্ পাপিয়া এক ফাঁকে টুক করে মোবাইলের মাধ্যমে যাবতীয় ক্ষোভ উগরে দিয়েছে তার মায়ের কাছে যিনি ব্যাক স্টেজে বসে আছেন । রিলে রেসের ব্যাটন তুলে দেওয়ার মতো করে সে সংবাদ পৌঁছে গেছে উদ্যোক্তাদের কানে এবং তাদের চোয়াল শক্ত হয়েছে । এরপর সব কিছু খুব দ্রুত ঘটে গেলো । কোনো মতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেই নায়িকা বিদায় নিলেন । তার নাকি হঠাৎ মাথাটা খুব ধরেছে । তবে তার মা গাড়ীতে ওঠার আগে নরমে গরমে সবটুকু শুনিয়ে গেছেন । নেমতন্ন করে ডেকে এনে এহেন অপমান ! এটা তারা মোটেই ভালো ভাবে মেনে নিতে পারছেন না । ছি ছি ছি ... । লজ্জায় মাথা কাটা যাবার জোগাড় । এতো কাঠখড় পুড়িয়ে এতো খরচ করে টিভি তারকার আগমন হলো , অথচ মজলিস জমার আগেই সব ভন্ডুল হয়ে গেল কিনা শুধুমাত্র ঐ ভীমরতিপ্রাপ্ত বুড়োটার জন্য । অসহ্য !

    ক্লাবের সভাপতি , সম্পাদক , কোষাধ্যক্ষ ও আহ্বায়ক যথাক্রমে তাঁর গলায় উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন , হাতে পুষ্পস্তবক দিলেন , স্মারক ও মানপত্র তুলে দিলেন এবং যৎসামান্য মিষ্টি মুখের ব্যবস্থা স্বরূপ মাঝারি আকারের একটি বাক্সও তুলে দেওয়া হলো । পুরো প্রক্রিয়াটি যারপরনাই গোমড়া মুখে যান্ত্রিক কৃত্রিমতায় সম্পন্ন হলো । সেদিকে উমানাথবাবুর খেয়াল নেই বরং তিনি একটি ভাষণ প্রস্তুত করে এনেছেন সেটি পাঠ করতে বেশী আগ্রহী । পাকেচক্রে আজ আশাপূর্ণা দেবীর জন্মদিন । তাই তাঁকে দিয়েই শুরু করে একে একে ব্রিটিশ ভারতে প্রথম মহিলা রাজবন্দী ননীবালা দেবী থেকে প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গাঙ্গুলী শিক্ষাব্রতী বেগম রোকেয়া এমন অনেকের কথা তুলে ধরার একান্ত বাসনা তাঁর ।  ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সেই সব মহীয়সী রমণীদের স্মরণ ও কৃতাঞ্জলি জানানো আজ এই সময়ে খুব জরুরী বলে তাঁর মনে হয় । একদিকে দেবীর আরাধনা অন্য দিকে সমাজে ক্রাইম অ্যাগেনস্ট উওমেনের গ্রাফটা হু হু করে বাড়তে থাকা এহেনো অসহনীয় অবস্থায় এই ঋণ স্বীকার খুব বেশী মাত্রায় প্রাসঙ্গিক বলে তিনি মনে করেন ।

    মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে প্রারম্ভিক সম্ভাষণ শেষ করে পাঞ্জাবির পকেট থেকে কাগজ বের করে যেই না পড়তে শুরু করেছেন অমনি এক কর্মকর্তা ছো মেরে তাঁর হাত থেকে সেটি কেড়ে নিলো । দ্বিতীয় ছোকরা মুখের সামনে থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে বলল "আজ আমাদের সময়ের খুব অভাব , পরপর অনেক প্রোগ্রাম রয়েছে , শিল্পীরা সবাই অপেক্ষা করছে । তাই মাষ্টারমশাইয়ের ভাষণ আপাতত স্থগিত রাখতে বাধ্য হচ্ছি । তবে আমরা কথা দিচ্ছি যে ওনার লেখাটা আমরা সুবেনিয়ারে ছাপাবো ।" এরপর তাঁর নড়া ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে এক প্রকার বলপূর্বক মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া হলো । জীবনে প্রথমবার এই সাংঘাতিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন তিনি । 

    আলো আঁধারি গলিপথ ধরে কোনো প্রকারে টলতে টলতে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন তিয়াত্তর ছুঁইছুঁই বৃদ্ধ । শীতের সন্ধ্যাতেও সর্বাঙ্গ ঘেমে নেয়ে একাকার । রাত বাড়তেই বুকের বামদিকে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয় । সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাঁকে হসপিটালে ভর্তি করতে হলো । কপাল ভালো বলতে হবে ফাঁড়াটা অল্পের ওপর দিয়ে কেটে গেল । ধাক্কাটা বেশ জোরেই লেগেছে বটে , তবে হৃদপিন্ড বেইমানি না করায় এ  যাত্রায় বিপদমুক্ত হওয়া গেছে ।

    এই ঘটনার মাস দু'য়েক পর উমানাথবাবুর নাতি উদ্যালোক বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে অরুণাচল প্রদেশে বেড়াতে গেলো । পাহাড় ঘেরা মনোমুগ্ধকর পরিবেশ ; চারিদিকে সবুজের সমারোহে যেনো তারুণ্যের উৎসব সূচিত হয়েছে । নাগরিক বদ্ধ জীবন থেকে মুক্তির স্বাদ ও প্রকৃতির আশকারা পেয়ে সকলেই শিরায় শিরায় অদ্ভুত উন্মাদনা অনুভব করলো । এ্যাডভেঞ্চারের নেশায় একদিন দল বেঁধে তারা চলে এলো তুলনামূলক ভাবে বেশ একটু দুর্গম অঞ্চলে । সচরাচর শৌখিন শহুরে ট্যুরিষ্ট পার্টি যেখানে আসে না সেইখানে । যে দিকে চোখ যায়  অপরূপ সৌন্দর্য্য , অতুলনীয় দৃশ্য । সকাল থেকে তুমুল হৈ হুল্লোড় , দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে । পথশ্রমের ক্লান্তিতে চলৎশক্তি রহিত হয়ে পড়েছে সবাই । তেষ্টায় ছাতি ফাটছে , খিদেয় প্রাণ যায় যায় ! পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই হুট করে চলে আসা । এখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা !

    হঠাৎ নজরে পড়লো অনতিদূরে ছোট্ট টিলার নীচে গাছতলায় বেশ কিছু সংখ্যক মানুষের জমায়েত । তাদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে । কাছে এগিয়ে যেতে দেখা গেলো হ্যাঁ যা অনুমান করা হয়েছে ঠিক তাই ,  অধিকাংশই কচিকাঁচার দল । একটা বড়সড় মোটর ভ্যানে করে প্রভূত পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী আনা হয়েছে এবং বাচ্ছাদের মধ্যে যথেচ্ছ বিতরণ করা হচ্ছে । খুঁদে গুলো হাপুস হুপুস করে পেট পুরে খাচ্ছে মনের আনন্দে । চারজন লোক নীরবে অতি তৎপরতার সঙ্গে পরিবেশনের কাজটি করে চলেছে । তবে কাজটি হচ্ছে মূলতঃ একজন নারীর নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে । তিনি যে স্থানীয় ভদ্রমহিলা সেটা তাঁর পোষাক পরিধান ও চেহারা দেখলেই বোঝা যায় , আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় না । তারা উপস্থিত হতেই কিছু বলবার আগেই তাদের ধরে পংক্তি ভোজনে বসিয়ে দেওয়া হলো এবং পর্যাপ্ত আহার্য তাদের পাতে বেড়ে দেওয়া হলো । খেতে খেতেই জানা গেলো ম্যাডাম মাঝে মাঝেই এরকম চ্যারিটি করে থাকেন এবং সেটাও লোকজনের চোখের আড়ালে । গুনাক্ষরেও কেউ যেনো জানতে না পারে সে দিকে তাঁর কড়া নজর ও নির্দেশ থাকে । খেয়ে আঁচিয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে সবাই যে যার মতো শ্লথ গতিতে ফিরছিলো । উদ্যালোক কৌতুহল দমন করতে না পেরে ভদ্রমহিলার সামনে গিয়ে বলল

- ম্যাডাম কিছু যদি মনে না করেন তবে একটা ছোট্ট কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি ?

- নির্দ্বিধায় জিজ্ঞাসা করতে পারেন ।

- আপনাকে কোথায় যেনো দেখেছি ! ঠিক মনে করতে পারছি না । আপনি কিছু হেল্প করতে পারেন ?

- বাঙালিবাবু আপনি তো থাকেন কলকাতায় তাই না ? তাহলে আমায় দেখবেন কি করে ?

- না মানে পেপারে বা মিডিয়ায় ...

- হ্যাঁ সেটা হতে পারে , কয়েক সেকেন্ডের ফুটেজ অথবা পাসপোর্ট সাইজের ছবি দেখে থাকতেই পারেন ।

- মানে ? ঠিক বুঝলাম না !

- তবে আমায় যতোই কম দেখে থাকুন অথবা নাই দেখে থাকুন প্রিয়া কাপুরকে নিশ্চই চেনেন ?

- হ্যাঁ চিনি , বলিউড ফিল্ম এ্যাকট্রেস্ !

- ব্যাস শুধু এইটুকু ? বাকীটা বললেন না ? প্রিয়া কাপুর দ্যা ডিভা , গ্ল্যামার কুইন , স্টার , সুপারস্টার আরো কতো কি !

- কিন্তু হঠাৎ তার কথা আসছে কথ্যেকে ?

- কারণ দুধের বদলে পিটুলি গোলা খাওয়ার মতো লোকে আমার নাম করে তাকে দেখেছে কিনা তাই ।

- আপনি কে ?

- আমি জুলি ডং ।

- ওহ্ মাই গড ! 

- ইয়েস , ওয়ার্ল্ড ফিমেল তাই কোণ্ড চ্যাম্পিয়ন । আমার জীবনের কথা দিয়ে তৈরী সিনেমা দেখে মাতামাতি করে সবাই  অথচ জলজ্যান্ত মানুষটা কেউ চেনে না । ঠিক যে কারণে আপনি অসুবিধায় পড়েছিলেন ।

- আই অ্যাম ভেরি ভেরি সরি ম্যাম ।

- নো ডিয়ার , ইউ নিড নট টু সে সরি । দিস ইজ দ্যা রিয়্যলিটি , উই হ্যাভ টু এ্যক্সেপ্ট ইট । ওকে টেক কেয়ার , মে গড ব্লেস্ ইউ । বাই বাই ।

উদ্যালোকের তখন মনে হচ্ছিলো তার ভিতরটা যেনো স্ফটিক পাত্রের  মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে । তার অপ্রতিভ ভাব কিছুতেই কাটতে চায় না । সে অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকে । সেই ভ্যান গাড়ীটি ধুলো উড়িয়ে দূরে দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে যায় , সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । বাকী যে কটা দিন সে ওখানে ছিলো তার মনমরা ভাব কিছুতেই কাটতে চায় না । বন্ধুরা অনেক চেষ্টা করলো বুষ্ট-আপ করার কিন্তু কিছুতেই ভবি ভোলাবার নয় ।

বাড়ী ফিরেই নাতি আছড়ে পড়লো দাদুর কাছে । ইহ জগতে তার সব চাইতে বড় আশ্রয় । পূর্বাপর সমস্ত ঘটনার কথা সে বলে গেলো গড়গড় করে । দাদু অনুভব করলেন নাতির ভারাক্রান্ত হৃদয়ের বেদনা । তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গুণ গুণ করে অস্ফুট স্বরে গাইতে লাগলেন "দোষ করো নয়কো মা , আমি সখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা । দোষ করো নয়কো মা ..." ।

 

===== সমাপ্ত =====

 

SUDIP  PATHAK

Swapno Neer Apartment ,

3rd. Floor , Flat no : 3 ,

321 , Purba Sinthee Road ,

Madhugarh , DumDum ,

Kolkata - 700030.

 

 

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩