দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। যে দেশভাগ আর জাতিদাঙ্গার যন্ত্রণা আর কালিমা নিয়ে স্বাধীনতা এসেছিল; তা আজো মোছা যায়নি। যে রক্তধারা বয়ে যায় দেশমাতৃকার হৃদয়জুড়ে, তা আজো ভোলা যায় নি। একের পর এক শাসকদল বদলে গেছে। তাদের মুখের ভাষা বদলেছে, কিন্তু চিন্তাধারা খুব কিছু বদলায়নি। আর তা বদলায়নি বলেই স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা আজো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরপর পারমাণবিক বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছিল এশিয়ারই দেশ জাপান। লক্ষ লক্ষ মানুষ মুহূর্তে মৃত্যুপথে ঢলে পড়ে। গবাদি পশু, গাছপালা কিছুই বাদ যায়নি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়। অর্থনৈতিক, সামাজিক সব দিক দিয়েই কোমর ভেঙে পড়ে। সেখান থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে আসে জাপান। আর্থিক, প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে জাপান আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ, অন্যতম শ্রেষ্ঠ। জীবনযাত্রার মান, গড় আয়ুর হিসেবে সবার থেকে এগিয়ে। ভূমিকম্পপ্রবণ, বিশাল সমুদ্রতট, সুনামির ভ্রুকুটি কাটিয়ে আজ এক মহাশক্তিধর রাষ্ট্র। যার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত সদ্যসমাপ্ত অলিম্পিক গেমসের সফল আয়োজন। আর আমরা আজো সেই তিমিরেই। করোনা অতিমারির কথা বাদ দিলেও জিডিপি বৃদ্ধির হার নগণ্য। বাজেটের সিংহভাগই যায় প্রতিরক্ষা খাতে। সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো ক্ষেত্রগুলো অবহেলিত। স্বাস্থ্য সূচকে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশও ওপরে। অধিকাংশ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোন বালাই নেই। মাথাপিছু গড় আয় তুলনামূলক খুব কম। প্রচোর আমদানি করতে হয়- কি প্রতিরক্ষা খাতে, কি কৃষিক্ষেত্রে। অথচ এই বিপুলা শস্য শ্যামলা দেশের খনিজ সম্পদ অঢেল। কৃষিতে এক বিরাট ক্ষেত্র রয়েছে। বিরাট মানবসম্পদ এক কার্যকরী অস্ত্র। কোন কিছুই সঠিক পরিকল্পনামাফিক হয়নি। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বদলে নীতি আয়োগ এল। কিন্তু কাঙ্খিত ফল এখনো অধরা। এ বিষয়ে নীরদ সি চৌধুরীর " ব্যর্থ নেতৃত্ব" র উল্লেখ প্রণিধানযোগ্য। প্রতিবেশী কিছু রাষ্ট্রের লাগাতার উস্কানিতে বিশাল সীমান্ত বরাবরই উত্তেজনাপ্রবণ।
৭৫ বছর পূর্তিতে এসেও তাই স্বাধীনতা প্রাপ্তির মূল্যায়ন করতে গিয়ে থমকে যেতে হয় বারবার। যে বিভেদের বীজ বপন করা হয়েছিল, তা ক্রমশ মহীরুহ হয়ে উঠেছে । আজো অবিশ্বাস, অসহিষ্ণুতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস আজো প্রাণ কাড়ে মাঝেমধ্যেই। ধর্মীয়,সামাজিক, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা চরমে ওঠে কখনো। রাজনৈতিক হিংসা হামেশাই মায়ের কোল খালি করে। আইনের ফাঁক দিয়ে গলে যায় অনেক বেআইনি কারবার। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। বর্তমানে কোভিড মরার ওপরে খাঁড়ার ঘা নিয়ে এসেছে। তবে এত কিছুর মধ্যেও দেশের মানবসম্পদ ও প্রতিভার কোন অভাব কখনো হয়নি। পূর্বে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মর্যাদা পাওয়া, মিসাইল প্রযুক্তি, মঙ্গলাভিযান থেকে শুরু করে হালের কোভিডের টিকা তৈরি করা অবধি তা প্রমাণিত। কিন্তু বরাবর সবকাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সদিচ্ছার অভাব আর সবকিছুর সাথে রাজনীতি মেশানোর চেষ্টা। এখান থেকে সরে এসে রাজনৈতিক সদিচ্ছা গড়ে তুলতে হবে। সবকিছুর সাথে রাজনীতি মেশানোর অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। কৃষি ও শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে হবে। বেকারত্ব দূর করার মাস্টারপ্লান তৈরি করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় দেশব্যাপী এক কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। পরিকাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে।
স্বাধীনতার পূণ্যলগ্নে এসে এই আশাই ধ্বনিত হোক "ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে"। "সারে জাঁহাসে আচ্ছা" হয়ে উঠুক ভারতবর্ষ। প্রকৃত অর্থে, সার্বিকভাবে। যেদিন একটি মানুষও অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না, কোন কিছুর মূল্যেই মনুষ্যত্ব ভূলুন্ঠিত হবে না, কোন অসহিষ্ণুতাই মানবিক ভালবাসার উপরে উঠবে না; সেদিনই আমরা প্রকৃত ও সার্বিকভাবে স্বাধীন হয়ে উঠব।
শত শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে সফল হয়ে উঠবে।
...........০০০...........
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন