প্রায় আশি বছর আগে ১৯৪১ সালের ১৬ই জানুয়ারির রাতে বাঙালির অন্যতম আইকন সুভাষচন্দ্র বোস ভারতবর্ষকে ইংরেজের শিকল থেকে মুক্ত করার জন্য জন্য যখন কলকাতার এলগিন রোডের বাড়ি থেকে মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে মহানিষ্ক্রমণ করেন, তখন তাঁর জীবনের একটাই উদ্দেশ্য ছিল - বিদেশীদের প্রভুত্ব নাশ করা। অথচ ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্টের পর যখন ইংরেজরা ভারত ছাড়লো, তারপর ভারতীয় রাজ-নীতির রাজন্যবর্গ সেই জীবন বাজি রাখা মানুষটাকেই বিভিন্ন ভাবে কলঙ্কিত করে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতার ফানুসটাকে ভাসিয়ে রেখেছিল।
সুভাষচন্দ্র বোস, যাকে ভারতবাসী এবং বিশ্বের মানুষ নেতাজী নামে চেনেন, বৃটিশরা যদি তাঁর চরম শত্রু হয়ে থাকে, তবে নিজের দেশের মানুষরাও কি তাঁর সঙ্গে খুব বন্ধুর মত আচরন করেছিল?
সুভাষচন্দ্র বোস ভারতবর্ষ থেকে বৃটিশদের তাড়িয়ে দেশকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন আর তাঁর দেশের রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে খোলা তলোয়ার বা বন্দুক নিয়ে অভ্যর্থনা করার কথা বলেছিলেন, কেন? কেনই বা ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নেহেরুর নির্দেশে আই বি নেতাজীর পরিবারের উপর নজরদারি চালিয়েছিল? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে কখনও? শেষ প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন।
২০১৫ সালে ন্যাশানল আর্কাইভে থাকা দু'টো চিঠি সামনে আসে, একটার তারিখ ১৯৪৭ সালের ৬ অক্টোবর আর অন্যটার তারিখ ১৯৫৭ সালের ২৬ নভেম্বর। প্রথম চিঠিটা আইবি আধিকারিক বালকৃষ্ণ শেঠি লেখেন দিল্লিতে বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এম আই ফাইভের লিয়াজঁ আধিকারিক কে এম বোর্ণকে। আর দ্বিতীয় চিঠিটা স্বয়ং নেহরু লিখেছিলেন টোকিওর ভারতীয় দূতাবাসের বিদেশ সচিব সুবিমল দত্তকে। নেতাজীর ভাইপো অমিয়নাথ বসুর গতিবিধি নজরে রাখার নির্দেশ ছিল নেহরুর, কারণ এই সময় অমিয়নাথ টোকিওতে ছিলেন।
কেমন ছিল নেতাজী নেহরুর সম্পর্ক? এই প্রশ্নের জবাবে প্রথমেই বলতে হয়, এই দুই ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক কখনোই একমাত্রিক ছিল না, আর সম্পর্কের বহুমাত্রিকতার জেরেই জাতীয় কংগ্রেসের এই দুই ব্যক্তিত্বের মধ্যে মতানৈক্য, দ্বন্দ্ব এবং পথ-পার্থক্য তৈরি হয়েছিল।
১৯২৮ সালের কলকাতা কংগ্রেসের সময় পর্যন্ত নেহেরু-নেতাজী প্রায় একই পথের পথিক ছিলেন। তাঁরা দুজনেই প্রগতিশীল এবং বিদ্রোহী যুব-সমাজের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন, সুভাষের মত নেহরুও একটা সময় পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী নীতি-আদর্শের বীজ রোপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লাহোর কংগ্রেসের পর নেহরু গান্ধীজীর দিকে ঝুঁকে পড়েন। চিরকালই আবেগপ্রবণ, অস্থিরমতি নেহরু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অপারগতাবশতঃ দু-নৌকায় পা দিয়ে চলেছেন। চারিত্রিক দৃঢ়তা যদি নেতাজীর বর্ম হয়, তবে নেহরুর জন্য সেটাই ছিল মস্ত বড় দুর্বলতা। আবার নেতাজীর স্বাধীনতা যুদ্ধের মূখ্য উদ্দেশ্য যদি দেশকে পূর্ণ-স্বরাজ এনে দেওয়া হয়, তবে নেহরুর জন্য সেটা ছিল ক্ষমতা দখলের লড়াই। আর এখানেই নেতাজী পিছিয়ে পড়েছিলেন, পিছিয়ে পড়েছিলেন রাজনৈতিক কৌশলে। নেতাজীর নীতি, আদর্শ এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল সর্বোতোভাবে দেশ- এর জন্য নিবেদিত, কখনোই নিজেকে ভারতের বিভাজনের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর পদে দেখতে চাননি, যদিও জন-সমর্থনে তিনি এগিয়ে ছিলেন অনেকটাই। স্বাধীনতার আগে নেতাজীই ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের একমাত্র নির্বাচিত সভাপতি, কিন্তু এই জয়ই তাকে গান্ধী-নেহরু গোষ্ঠীর থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল, এই ত্রিপুরী কংগ্রেসে সুভাষের সভাপতি পদে নির্বাচনের পর এবং পট্টভি সীতারামাইয়ার পরাজয়ের পর গান্ধীজী প্রকাশ্য বিবৃতিতে বলেন, পট্টভির পরাজয় আসলে তাঁরই পরাজয়।
১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনার খবর- এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল না তা নয়। ডোমেই নিউজ এজেন্সির খবরে প্রকাশিত এই মৃত্যুর খবর যে বৃটিশ এবং ভারতের অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করতে পারেনি, তারও ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। যে কোন কারণে এখনও পর্যন্ত জাপান, আমেরিকা বা ব্রিটিশ সরকার কেউই সেদিন বা আজো সরকারি ভাবে নেতাজীর মৃত্যু ঘোষণা করতে পারে নি। ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্তও, অর্থাৎ তথাকথিত তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার প্রায় আড়াইমাস পরও ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা সুভাষচন্দ্র বোসকে কী শাস্তি দেওয়া যায় বা কোন ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে বিষয়ে চিন্তিত ছিল।
নেহরু নিজেও নেতাজীর মৃত্যুর খবর বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। ১৯৪৯ সালের ৬ ই অক্টোবর ইউনাইটেড প্রেস অব আমেরিকার কলকাতার এক সংবাদদাতাকে নেতাজীর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু বলেছিলেন, -" ভারত সরকারের কাছে নিশ্চিত খবর আছে যে, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস কমিউনিস্ট চীনে আছেন। "
আরো একটা আশ্চর্যের বিষয় হল এই, যে দিন নেতাজীর বিমান দুর্ঘটনার কথা বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার খবরটা প্রকাশিত হয় তার চারদিন পর! কিন্তু কেন? আর এই মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হলে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের মুখ থেকে স্বস্তির কথা শোনা গেছিল -- " যদি সেই সংবাদ সত্য হয় তবে এটা একটা বিরাট স্বস্তির কারণ হবে! "
কিন্তু যে প্রশ্নটা এই ঘটনা পরম্পরা থেকে উঠে আসে তা হল নেহরু এবং জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ কেন বারবার নেতাজীকে "মৃত" প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন? আর কেনই বা অন্তর থেকে এই ঘটনা বিশ্বাস করতে না পেরে স্বাধীনতার পরেও বিভিন্ন ভাবে তাঁকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন? ১৯৫৬ সালের শাহনওয়াজ কমিটি, ১৯৭০ সালের খোসলা কমিশন, ১৯৭৮ সালের একটা সরকারি ঘোষণায় গ্রহণযোগ্যতা হারায়, ঘোষণাটা করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক কমিশন গঠন হয়েছে, যদিও শেষ কথাটা এখনো কেউ বলতে পারে নি।
জাতীয় কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ উভয়েই "সুভাষচন্দ্র বোস" নামটাকে যে ভয় পেত, আজ আর তা গোপন নেই। কংগ্রেসের নেতাদের ক্ষমতা পাওয়ার লোভ এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই এর অক্ষমতা যখন চরমে পৌঁছেছে তখনই নেতাজীর মুহুর্মুহুঃ আঘাতে "আই এন এ"-র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ব্রিটিশ শক্তি পর্যুদস্ত, আবার ১৯৪৬-৪৭ এ "আই এন এ"-র প্রভাবে ভারতীয় সেনাদের মধ্যে যে ব্রিটিশ বিরোধিতা শুরু হয়েছিল, তার সুদূর প্রসারী ফল বুঝতে ব্রিটিশ বা জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের খুব একটা অসুবিধা হয় নি। এ্যাটলির কথা অনুসারে বোঝা যায় নেতাজীর প্রভাব ভারতবর্ষে তখন এমনই ছিল, যে ব্রিটিশ শক্তির বাঁধন ধীরে ধীরে সব আলগা হয়ে আসছিল, যদিও জাতীয় কংগ্রেস এবং নেহরু প্রভৃতিরা শুধু ক্ষমতার মুখ চেয়ে ব্রিটিশের সঙ্গে নেতাজীর ব্যাপারে সহমত হয়ে তাকে দেশান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। দেশভাগ হয়ে যখন ক্ষমতা এল, নেতাজীর ভয় তখনও তাদের পিছু ছাড়েনি। কারণ জনমতের ভিত্তিতে যে নেহরু নির্বাচিত নন, এবং জনমতের দিক থেকে সুভাষ যে অনেক এগিয়ে ছিলেন, সে কথা নেহরু এবং জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা ভালোই বুঝেছিলেন। ফলে নেতাজীর জন্য একদিকে যেমন ব্রিটিশরা ভারত ছাড়তে একরকম বাধ্য হয়েছিল, অন্যদিকে নেতাজীর জন্যই ব্রিটিশের কাছ থেকে খন্ডিত ভারত ভিক্ষা পেয়ে ক্ষমতায় বসা নেহরু ও তাঁর অনুগামীরা শঙ্কিত ছিলেন, ফলে পরিস্থিতিতে নেতাজীর সম্পর্কে তাঁদের খোঁজখবর নেওয়া বা তাঁকে সম্পূর্ণ ভাবে ফাইলবন্দী করা একান্ত দরকার হয়ে পড়েছিল। হয়ত এই আশঙ্কা, ক্ষমতা হারাবার ভয় আর নেতাজীর আসমুদ্রহিমাচল জন-সমর্থন তাঁদেরকে ভয় পাইয়ে ছিল।
=============================
অনিন্দ্য পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন