প্রথম
দিনটা জানুয়ারির একটি রৌদ্রোজ্জ্বল দিন এর সকাল। গত চারদিন ধরে রোদের দেখা ছিল না ,আজ সকাল থেকে মেঘ কেটে রোদ হেসেছে । স্বভাবতই লোকজন চারদিনের শীতঘুম কাটিয়ে আলস্য ঠেলে কাজে বেরিয়েছে। এখন সকাল দশটা বেজে পাঁচ। বাবুঘাটের পুকুরের দক্ষিণ পাশে একটা পুরনো বাড়ি । ওটা বাবুদের বাড়ি, যদিও আজ আর বাবুয়ানার কিছু মাত্র অবশিষ্ট নেই । কালের নিয়মে সব গেছে শুধু বর্ষ প্রাচীন এই বাড়িটা অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। গাঁটের টাকা শেষ হলেও সম্মানটা বাড়ুজ্যে মশাইরা এখনো ধরে রেখেছেন। এখনো নিয়ম মেনেই পুকুরে বড় মন্দিরের প্রতিমা বিসর্জন হয়। তা সে যাই হোক, আজ এই দিনে সকাল সকাল পুকুরে নেয়ে এসে রোয়াকে মাদুর পেতে গায়ে তেল ঘসছেন এই বংশের সপ্তম পুরুষ শিবরাম বাড়ুজ্যে। তাঁর বয়সও কম হয়নি। নয় নয় করে ৮২টা বসন্ত পের করেছেন।
কিছুক্ষণ পরে কাশতে কাশতে পাশে এসে বসলেন ও পাড়ার নিবারণ ঘটক। এই দুই বুড়োর খুব মিল। সকালে না হয় বিকেলে দুজনের একবার না একবার দেখা করা চাই-ই চাই। কিন্তু এই চারদিন ওদের দেখা হয়নি। নিবারণ খুড়োর বাতের ব্যথা, তায় আবার শীতকাল । ব্যথাটা কয়দিনের শীতে এত বেড়েছিল যে ও বুড়োর আর চলার ক্ষমতা ছিল না। আজ সকালে রোদে কিছুক্ষণ পা সেঁকে এসেছে প্রাণসখা-র বাড়ি। গল্পও শুরু হয়ে গেছে দুজনের।
বেশ কিছুক্ষণ পর নিবারন লক্ষ্য করে যে পুকুরের পূর্ব দিকটায় ঘাটের কাছে কিছু মানুষের জটলা । সবাই কি দেখছে আর মুখে বিড়বিড় করতে করতে চলে যাচ্ছে --- "কি ব্যাপার!!" নিবারন উত্তেজিত হয়ে উঠল । মনে হল এক ছুটে গিয়ে দেখে আসি কিন্তু ,পা যে 5।
ওদিকে শিবরামের ও নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা নেই ।সে ততক্ষণ তেল মাখা শেষ করে বিড়ি ফুঁকছে । ওদিক দিয়ে যমুনার মাকে আসতে দেখে নিবারণ হেঁকে বলল ——"ও বউ! কি হয়েছে গা ও কেনে..??"
—ও কিছুনা খুড়ো। ঐ জাতমাতাল টা মদ গিলে পড়ে রয়েচে।
শিবরাম একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বাঁকা মুখে বলে উঠল-- "বুঝলি নিবু, শালার বাপডা নাম একখান দিয়েছিল মাইরি!!.. সুবোধ.. তার শালার বোধ যে কবে হবে কেডা জানে..!!"
দ্বিতীয়
সুবোধ দের বাড়ি ওপাড়ায় বড় মন্দির এর ডানপাশের সোজা রাস্তা দিয়ে একটু গিয়ে বাঁশ বাগানের কোলে। দুটো ঘর, কালচে টালির ছাওনি, পলেস্তারা খসা অর্ধনগ্ন দেওয়াল আর একটা ভাঙ্গা রান্নাঘর নিয়ে ওর সংসার । সংসারে ওর একটা বউ আর একটা ছেলে কমল।
সুবোধ বলতে গেলে এক প্রকার বেরোজগেরে লোক। বাপের রেখে যাওয়া এক কাঠা জমিতে বছরে দুবার চাষ করে আর বাকি সময়টা অন্যের জমিতে কাজ করে খায়। বউটা কাম সেলাই করে আর ছেলেটা ক্লাস ফাইভে পড়ে। পড়াশোনায় খুব ভালো ছেলেটা । এরকম গোবর গাদায় কিভাবে পদ্ম ফুটল কে জানে..!!
সুবোধের বাপ মরেছে তখন ওর বয়স ১২। বয়স বেশি হয়নি, মোটে ৪০। একদিন রাত-ভোরে মদ গিলে বড় রাস্তা দিয়ে টলতে টলতে বাড়ি আসার সময় পা হড়কে রাস্তায় পড়ে গেছিল। আর ওঠেনি। সকালে গিয়ে ওরা গিয়ে দেখে ততক্ষণে বাপের সাঙ্গ শেষ । সেই থেকে ওদের সংগ্রাম শুরু। মা টা কোনোরকমে লোকের বাড়িতে খেটে দুটো চাল-ডালের জোগাড় করতো । কিন্তু সেই সুখ ও ওদের সহ্য হলো না । বাপ মরার তিন বছরের মাথায় ওর মা-র ধরা পরল ক্যান্সার.। দিন দিন শরীর শুকোচ্ছিল । হায় ঈশ্বর !..ঈশ্বর ও বোধহয় ফিরে চান না গরিবদের প্রতি ।
তার মা মরল ক্যান্সার ধরা পড়ার দু'বছরের মাথায়। মরার সময় দুই হাত ভরা আশীর্বাদ এর বদলে রেখে গেল বাক্স বোঝাই ঋণ। সেই ঋণ শোধ করতে বাপের রাখা দু কাঠার মধ্যে এক কাঠা বন্ধক রাখতে হয়েছিল। আর ছাড়াতে পারেনি। এখন ওর ঐ ১ কাঠাই ওর সম্বল।
তৃতীয়
সুবোধের বাপ মদ খেত। সুবোধ ও মদ খায়। বলতে গেলে ওদের মতো লোকেদের কাছে ওটা একটা ঐতিহ্যবাহী খাবার। ওদের মদ খেতেই হয় , না হলে বাঁচবে কি করে!!.. কি করে ভুলবে সংসারের জ্বালা !!...সকাল হতেই কমলের মা-র কাঁদুনি... ঘরে চাল নেই.. কি খাবে??. ছেঁড়া শাড়ি ওর মা আর কতদিন সেলাই করে পড়বে??. সেই সুতো ও তো কিনতে হয়.. ওটাও তো মাগনা নয়। তারচেয়ে দু-তিন পেগ মেরে কিছুক্ষণের জন্য নেশার ঘোরে পড়ে থেকে এ জ্বালা জয় করলে তাতে মন্দটাই বা কি !!
কাল থার্টিফাস্ট ডিসেম্বর গেছে। ওই রাতে সব বাবুরা প্রাণভরে মেয়ে নাচিয়ে মদ গিলেছে । সুবোধ-ই বা বাদ যায় কেন!!...গরিব বলে কি সাধ নেই ওর!..তবে ওর হাতে এবার অত টাকা নেই । অকাল বর্ষণে মাঠের সবকটা আলু পচেছে ..ব্যাংকে ঋণ রয়েছে তাও পঞ্চাশের কাছাকাছি ।কিভাবে শোধ করবে ও ?.. তবে ও যে গরিব সেটা স্বীকার করতেই হবে... ওর বাপ হলে এই দিনে বিদেশি মদ গিলত কিন্তু, ওর সাধ্য নেই বলে ও বাংলা খায় ।এদিক দিয়ে ও স্বদেশী বলতেই হবে।
কতবার ভাবে আজকেই শেষ আর খাবে না কিন্তু, ছাড়া যায় নাকি ঐ সুধারাসের টান ! কালকেও তাই হয়েছিল। খাবে না খাবে না করে কাল ৫ পেগ মেরেছে। শেষে জয় মা.! বলে আর এক পেগ গিলিয়েছে ওর বন্ধু নরোত্তম । আর যায় কোথায় ..ওই ফাঁপা শরীর কি এত নিতে পারে নাকি!!.... বাড়ি আসার সময় বাবুঘাটের কাছে ওই জাম গাছ তলায় পড়ে গিয়েছিল আর উঠতে পারেনি । কিছু আগে এখান দিয়েই শিবু খুড়ো নাইতে নেমেছিল কিন্তু ওকে দেখতে পায়নি। আর বয়স হয়েছে । চোখে কি আর অত ঠাউর হয় !
চতুর্থ
বেলা এখন সকাল ১২ টা । সূর্য পুরো মধ্যগগনে। এক বুড়ো ঘুমোচ্ছে আর নিবারণ খুড়ো লাঠির মাথায় মাথা রেখে ঢুলছে । ততক্ষণে লোকেদের জামতলার থিয়েটার দেখা শেষ। মাতাল মদ গিলে পড়ে রয়েছে তাতে আবার এত দেখবার কি!!.. শুধু তিনটে শালিক বাড়ির ভাঙ্গা কার্নিশে বসে ঝগড়া করছে।
হঠাৎ একটা শিশু কন্ঠের ডাকে ওদের ঘুম ভাঙ্গে।
——বাবা ওঠ ! ঘরে চলো। এত কেন খেতে গেলে ?.....ওঠো বাবা! মা বসে আছে....
শিবু খুড়ো চোখ না খুলেই বলল—"কেডা রে নিবু ?"
নিবারণ খুড়ো তন্দ্রামাখা চোখে আলতো তাকিয়ে বলল––"ওই মাতাল টার ছেলে এয়েচে বাপরে নিয়ে যেতি...শালার মরণও হয় না...পথের মধ্যিখানে পড়ে রয়েচে।"
নিবু চোখ বুজলো।
ছেলের ডাকে সুবোধের ঘুম ভেঙেছে। মুখ দিয়ে মদের কড়া গন্ধ বেরোচ্ছে । মোট ৬ পেগ পড়েছে । এত সহজে নেশা কাটে নাকি ! তবুও ও টলতে টলতে উঠলো। ছেলে একটা হাত ধরে রেখেছে..."চলো বাবা....আমাকে ভালো করে ধরো ..পড়ে যাবে তো.....দেখো দেখো গর্ত ওখানে....."
সুবোধ কয়েক পা গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো ।
—— কি হলো বাবা চলো..!
এই নেশাতেও সুবোধের পিতৃসত্ত্বা মরেনি ।হোক সে মাতাল, হোক সে গরিব কিন্তু, সে যে আসলে বাপ । সুবোধের নাল ভেজা গাল দিয়ে বেরিয়ে এলো পিতৃসত্ত্বার লেশ।
—— খোকা তুই বাড়ি যা নয়তো, লোকে খারাপ বলবে.!
কমল বাবার মুখের দিকে তখন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে.....
====================
Md Zahid ali
Vill+ post-- balisha
Ps... Ashok Nagar
Dist--- north 24 pgs
Pin---- 743702
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন