Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

প্রবন্ধ ।। সাহিত্য দলিত ।। জীবনকুমার সরকার




ভারতীয় সাহিত্যে 'দলিত সাহিত্যে'র বয়স বেশিদিনের নয়। আমাদের জানতে হবে কেন এই সাহিত্যের জন্ম হলো? কেন এই সাহিত্যকে অগ্রসর হতে দিতে চায় না ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্য? কেন এই সাহিত্যের কথা শুনলে মূল স্রোতের লেখক ও পাঠকেরা রে রে করে তেড়ে আসেন? 


প্রথমে আমারা জেনে রাখি 'দলিত' শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো যাকে বা যাদেরকে দলন করা হয় বা যিনি  বা যারা দলিত হন। দলন বলতে কেবল দৈহিক দলন বোঝায় না কিন্তু। ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে দলনের অনেক ধরন আছে। নানা ধরনের নিপীড়ন, নিষ্পেষণ, বিদ্বেষ, ঘৃণা, অবহেলা, অবজ্ঞা ইত্যাদি দলনের মধ্যেই পড়ে। মনুষ্য সমাজের সকল ক্ষেত্রে যাদের জীবন পরিসরের অগ্রগমণে প্রতি পদে পদে বাধা দান করা হয়, তারাই দলিত। তাহলে আমাদের দেশে দলিত কারা? ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মে প্রায় চার হাজার বছর ধরে যারা জাত ব্যবস্থার ও বর্ণঘৃণার শিকার। যারা কেবল অস্পৃশ্যতার গ্লানি বহন করে চলেছেন। যারা কেবল ধর্মদাস হয়ে জীবনের সবকিছু রং হারিয়েছেন। ৬৭৪৩টি খণ্ডে বিভাজিত চতুবর্ণের তলানীতে থাকা শূদ্ররাই আজকের আধুনিক ভাষায় দলিত। 


পাশ্চাত্য দেশে কালো মানুষের জীবনযন্ত্রণার ছবি যখন কালো আফ্রিকান ক্রীতদাসরা নিজের কলমে লিখতে লাগলেন ,তখন তার নাম হলো ব্লাক লিটারেচার। ঠিক একই ভাবে ভারতে দলিত মানুষরা যখন নিজেদের সুখ-দুঃখ-বেদনার কথা নিজের ভাষায়, নিজের কলমে রূপ দিতে লাগলেন, তখন তার নাম হলো 'দলিত সাহিত্য'। মেইন স্ট্রিমের লেখক বা পডুয়ারা দলিত সাহিত্য কথাটা মানতে রাজি নন। কেন মানবেন? কারণ, এই দলিত সাহিত্য যে তীব্র জাতপাত বিরোধী সাহিত্য এবং সাম্যবাদী। জাতপাত আর বর্ণবৈষম্যেকে ভেঙে দিয়ে সকল মানুষের সম অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই দলিত সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও একমাত্র লক্ষ্য। সুতরাং, জাতপাত আর বর্ণবৈষম্যের সমর্থনকারী ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্যের উপাসকরা দলিত সাহিত্যকে স্বীকৃতি দিতে চান না। তাদের ভয়, দলিত সাহিত্য অগ্রসর হলে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সামান্য সংখ্যক মানুষের দীর্ঘদিনের একচেটিয়া আধিপত্য নষ্ট হবে। এই আশঙ্কা থেকেই বর্ণবাদীরা দলিত সাহিত্যের বিরোধী।ভারতে চার-পাঁচ হাজার বছরের লালিত বর্ণবাদকে ভেঙে চুরমার করার একমাত্র সাহিত্য হলো 'দলিত সাহিত্য '।


দলিত সাহিত্য হলো ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণ- নির্যাতন থেকে নিপীড়িত,নির্যাতিত, দলিত, অস্পৃশ্য বহুজন মানুষের মুক্তির সাহিত্য। ভারতীয় দলিত সাহিত্য জন্মের একটি ইতিহাস আছে। ভারতীয় দলিত সাহিত্যের জনক মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে। তিনি প্রথম লেখেন ১৮৭৩ সালে 'গোলামগিরি' ও ১৮৮৩ সালে 'কৃষকদের চাবুক দড়ি' দুটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থ দুটিই দলিত সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। এরপর আম্বেদকর ১৯২০ সালের ৩১ জানুয়ারি কোলাপুরের শাহু মহারাজের অর্থানুকূল্যে একটি মারাঠী পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। যার নাম ছিলো 'মূকনায়ক'। পত্রিকার নামকরণেই বোঝা যায়, এটি কাদের কথা তুলে ধরতো। আবার সমকালীন সময়ে দক্ষিণ ভারতে আরও একজন সমাজহিতৈষী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে জোর লড়াই আন্দোলন সংগঠিত করেন। তিনি মাদ্রাজের ই. ভ. রামস্বামী নাইকার। ১৯২৬ সালে তিনি শুরু করেন 'আত্মসম্মান আন্দোলন '। অস্পৃশ্য মানুষের মধ্যে মানবচেতনার আন্দোলন গড়ে তুলতে তামিল ভাষায় প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক পত্রিকা 'কূদি আর্সি'(জনমত)। এরপর আম্বেদকর আরএ তিনটি পত্রিকা প্রকাশ করেন ---- 'বহিষ্কৃত ভারত'(১৯২৭), 'সমতা '(১৯২৯) ও 'জনতা'(১৯৩০)। ১৯৩৫  সালে রামস্বামী নাইকার আবার একটি দৈনিক কাগজ প্রকাশ করেন, যার নাম 'বিদুথালাই '(মুক্তি)। সারা ভারতে এটিই সম্ভবত দলিত মানুষদের জন্য প্রথম প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা। 


এইসব পত্র-পত্রিকা প্রকাশের পর বিভিন্ন দিকে দলিত মানুষদের মধ্যে অসীম কৌতূহল তৈরি হয়। সভা-সমিতি বেড়ে যায়। বিপুল উৎসাহ নিয়ে আম্বেদকর প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধার্থ কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্ররা ১৯৫০ সালে গড়ে তোলেন 'সিদ্ধার্থ সাহিত্য সংঘ'। এর কিছুদিন পর গঠিত হয় 'মহারাষ্ট্র দলিত সাহিত্য সংঘ'। এই সংঘেরই উদ্যোগে মুম্বাইয়ে ১৯৫৮ সালে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় দলিত সাহিত্য সম্মেলন। তবে ১৯৭২ সালে ঘটে ঐতিহাসিক ঘটনা। আমেরিকার ব্লাক প্যান্থার আন্দোলনের অনুকরণে মহারাষ্ট্রে গঠিত হয় 'দলিত প্যান্থার'। এটাকে ঘিরে ওই সালের ৯ জুলাইয়ে সমবেত হন বিখ্যাত দলিত লেখক নামদেও ঢসাল, অর্জুন ডাঙলে, জন. ভি. পাওয়ার, দয়া পাওয়ার, উমাকান্ত রণধীর, রামদাস সোরতে প্রমুখ। তাঁরা সেদিন সম্মিলিত ভাবে ঘোষণা করেন, দলিত সাহিত্য সাহিত্য হবে দলিতদের বিষয়ে, দলিতদের দ্বারা লিখিত। দলিত প্যান্থার হবে এমন একটি সাহিত্য আন্দোলন, যা ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম, সংস্কৃতি,রাজনীতি ও মূল্যবোধকে অস্বীকার করবে। দলিত প্যান্থার সাহিত্য আন্দোলনের কায়দায় বাংলায় দলিত সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৭৫ সালে। যারা বলেন পশ্চিমবঙ্গে দলিত দমন নেই, তারা ভুল বলেন। দলিত দমন আছে বলেই তো বাংলায় সরকারি উদ্যেগে তৈরি হলো 'পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য আকাদেমি'। এটা এক নতুন দিগন্তের সূচনা। নিপীড়িত মানুষের কলম রাজপথ দখলের ইঙ্গিত। যুগে যুগে মানবতার জয় এভাবেই সূচিত হয়েছে। 


দলিত সাহিত্য হঠাৎ কোনো আবেগের বশে তৈরি সাহিত্য নয়। এর আছে একটি দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। অদলিতরা দলিত সাহিত্যের কথা শুনলে বিরক্ত হন। বলেন, সাহিত্যের আবার দলিত অদলিত কী? মজার ব্যাপার হলো, তারাই আবার দলিত সাহিত্য বাদ দিয়ে সাহিত্যের আরও নানারকম নামকরণ মেনে নেন। যেমন, বৈষ্ণব সাহিত্য, রবীন্দ্র সাহিত্য, লোক সাহিত্য, প্রতিবেশী সাহিত্য, প্রগতি সাহিত্য, হাংরি জেনারেশন, আধুনিকোত্তর সাহিত্য, দেশভাগের সাহিত্য , বিজ্ঞান সাহিত্য আরও কত বিচিত্র নামের সাহিত্য চর্চা দিনের পর দিন আমরা মেনে নিয়েছি। সংগীতেও আছে নানা ধারা। তাহলে দলিত সাহিত্য আন্দোলন মেনে নিতে অসুবিধা কোথায়? যারা দলিত সাহিত্যের আত্মপ্রকাশকে মানতে চান না, তারা আসলে মনুবাদী মেইন স্ট্রিমের সাহিত্যের উপাসক। বাইরে যতই বলুক সমতার কথা, ভেতরে ভেতরে তারা বর্ণবাদী। তারা ধর্মান্ধ না হলেও বর্ণান্ধ। ঠিক ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির তলে পৈতা ধারণ করে সাম্যের কথা লিখে যাওয়ার মতো চাতুর্যতা । দলিত সাহিত্য আন্দোলনের গুরুত্ব এখানেই। দলিত সাহিত্যের কোনো মুখোশ নেই। আজ সারা দেশে যেভাবে দলিত সাহিত্য চর্চা হচ্ছে, তাতে আমরা আশাবাদী একদিন এই সাহিত্যই ভারতের মূল সাহিত্য হবে। কারণ, দলিত সাহিত্য বহুজন মানুষের সাহিত্য। মনুবাদী সাহিত্য স্বল্প সংখ্যক মানুষের সাহিত্য। দলিত সাহিত্য মুক্ত। মনুবাদী মেইন স্ট্রিমের সাহিত্য বদ্ধ এবং ধর্মকেন্দ্রিক। তাই, দলিত সাহিত্য দুর্বার ও আপসহীন। দলিত সাহিত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। 


=======================

ড. জীবনকুমার সরকার 
মালদা

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩