শীতের সূর্য যেমন টুক করে ঘুমের দেশে যায় কিম্বা পর্ণমোচীরা যেভাবে নিঃশব্দে পাতা ঝরায় , সেভাবেই কটা মাস পেরিয়ে গেল। মনে হয় এই ত সেদিন।
হাতে চিঠিটা নিয়ে পাগল করা আবেগ আর বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিলাম। প্রতিদিন ক্যাম্পাসিং এ সবাই মাইক্রোসফট, টিসিএস, উইপ্রোর মত বড় বড় কোম্পানিতে চাকরি পাচ্ছে। রোজ ট্রিট দিচ্ছে। অন্যের টাকায় রোজ রোজ মহাভোজ খেতে খেতে ভাবতাম আমিও কবে কিস্তিমাত করে দেব ।
রুমমেট সঞ্জীব দা , বর্তমানে এস এন ফিল্মসের ডিরেক্টর, বলল " দেখ খুলে কোথায় পেলি ? "
"আলিপুর। "
"তবে তোর আর চিন্তা কি ? "
সত্যি চিন্তা নেই,
আমি থাকি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে, নিউ পিজি কাম আর এস হোস্টেলে । এখান থেকে আলিপুর এই ত ক মিনিটের পথ। বাসে বা অটোতে টালিগঞ্জ, তারপর বজবজ ট্রেনে নিউ আলিপুর।হোস্টেলের বডারশিপ শেষ । চিন্তা নেই। দিন কতক কারোর গেস্ট হয়ে থাকব , তারপর খাঁচাময় কলকাতায় একটা না একটা খাঁচা ঠিক পাবো।
আনন্দ আর ধরে না। জোয়ারের জল নেমে গেলে নদী যেমন শীর্ণকায়া হয়ে আসে, মনে হয় সব প্রাণশক্তি হারিয়ে কোনোভাবে টিকে আছে । সেভাবে হঠাৎ করে সব উচ্ছ্বাস হারিয়ে গেল !
আছিপুর কে এতখন ভুল করে আলিপুর পড়েছিলাম। এবার আমার চিন্তা , আছিপুর সে আবার কোন গ্রহে?
" কোথায় বাড়ি কেউ যানে না , কোন সড়কের মোড়ে!"
কেউ বলতে পারছে না আছিপুর কোথায়?
রুমমেট কে নিয়ে গেলাম তিন নম্বর গেটের কাছে যাদবপুর পোস্ট অফিসে । পরিচিত একজন জানালেন একেবারে শেষে সেই হুগলি নদীর পাড়ে। ধর্মতলা থেকে 77 নং বাস ছাড়ে । তারাতলা , সন্তোষপুর , জিনজিরা বাজার, বজবজ , চড়িয়াল, পূজালী হয়ে বড়বটতলা স্টপেজ । ক পা হাঁটলেই মহানদী । ও পারে উলুবেড়িয়া- হাওড়া।
যেখানেই হোক যেতে ত হবে ।সে সাপের মুখে হোক আর বাঘের মুখে হোক । চাকরি পাওয়া নিয়ে কথা।
যাহোক পরে জানলাম শিয়ালদা - বজবজ ট্রেনে আছিপুর দূরে নয় ।
রোজ ডাল সিদ্ধ , আলু সিদ্ধ ভাত। কোন দিন ভাগ্য ভালো থাকলে মাছ ভাজা পেতাম । তাই সই।
দশটা দশের আগে ঠাকুর ভাত দেবে না। সারারাত সব বাওয়াল করে রাত দুটো, তিনটের দিকে কে পড়তে বসছে, কে ঘুমানো উচিত কিনা ভাবছে ...... কেউ দূরে কোন জানালার মুক্ত আলোয় জীবনের ধ্রুবতারা কে দেখতে চাইছে।
আরো সব বিচিত্র কারবার ।
সকাল সকাল বাজার আনলে তবে ত রান্না।
8B থেকে অটো ধরে টালিগঞ্জ। ওখান থেকে ট্রেনে বজবজ। তারপর অটো করে আছিপুর বড়বটতলা । এরপর হেঁটে আমার কর্মক্ষেত্র- রাজীবপুর হাই স্কুল।
প্রথম দিন পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা দেড়টা বেজে গিয়েছিল। গ্রামের নাম আছিপুর। টং অছু সাহেব অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে নদী পাড়ে এক পান্ডব বর্জিত গন্ডগ্রামে আসেন ।উদ্দেশ্য এ দেশে ব্যবসা করা । তিনিই প্রথম চিনির কল স্থাপন করেন ।1718 সালে আছিপুর চিনেমানতলায় গড়ে তোলেন চিনা মন্দির। তারই নাম অনুসারে গ্রামের নাম আছিপুর।
একে একে কলিগদের কাছ থেকে এলাকার ইতিহাস ভূগোল জানতে পারলাম। প্রথম প্রথম একটু কেমন লাগত।সবাই সিনিয়র কলিগ ।অধিকাংশই স্থানীয় ।
আমাকে নিয়ে দুজন মাত্র এস এস সি দিয়ে আসা টিচার। একসময় 'কালো রাতি গেল ঘুচে , আলো তার দিল মুছে'।
দ্বিতীয় দিনে অনেক টা ভালো লাগছে। সেকেন্ড পিরিয়ডে টেনের ক্লাসে গেছি, একটি মেয়ে উঠে এসে বলল " স্যার আমি কাল আসিনি। আপনি নতুন এসছেন!"
বলেই সে দেখি হ্যান্ডশেক করতে এল ।
যাদবপুরের ছেলে আমি । এতটা আনস্মারট নই । হাত টা বাড়িয়েও দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যের নীতি পুলিশ চোখ পাকাতে লাগলো।
অন্যরা কি ভাববে!
কিছুটা গম্ভীর ভাবে বললাম " নাম কি ? বাড়ি কোথায় ? স্যারকে প্রণাম করতে হয় জানো না ।"
মেয়েটি সরি বলে এগিয়ে আসতে আমি সরে গেলাম।
" ঠিক আছে, ঠিক আছে থাক , মন দিয়ে পড়াশোনা করবে "।
আরো একজন দেখি উঠে আসছে। ব্যাপারটা ছোঁয়াচে হয়ে ওঠার আগে বললাম এখন প্রণাম করতে নেই । যেদিন রিটায়ার করব তখন সবাই প্রণাম করবে ।
শান্ত নদীতে ছোট ঢেউ গুলো যেভাবে খেলে বেড়ায়, বর্ষায় গাছ গাছালিতে যেভাবে সবুজের বন্যা আসে, সেভাবেই দিন গুলো ফুর ফুর করে কেটে যাচ্ছে। একদিন, টালিগঞ্জ স্টেশানে হঠাৎ অর্ণার সঙ্গে পরিচয় হলো। ওর সঙ্গে ট্রেনে আসা যাওয়ায় জীবনের দাবদাহের মাঝেও বেশ কাটছে।
আমার যা কিছু একান্ত আলোচনা সন্দীপ দার সঙ্গে। কিছুটা বয়সের কারণে বোধহয় অন্য সিনিয়র কলিগদের সঙ্গে সম্পর্কটা তোলা কাপড়ের মত । খোলা মেলা হয়ে ওঠেনি। একদিন দুজনে বাথরুমে যাচ্ছি, কটা ছেলে মাঠে নেমে এসেছে। ওদিকে থেকে টি আই সি বলছেন " তোরা মাঠে কেন ? কার ক্লাস? "
লাল্টু নামের ছেলেটি বলল " এই ত ছোট স্যারের"।
চট করে থেমে বললাম " কি বললি ? "
" না স্যার আপনার ক্লাস।" মুহুর্তে মাথাটা গরম হয়ে গেল। অনেক কষ্টে
নিজেকে সংযত করে বললাম , " শোন বাবার চেয়ে কারো কারো ছেলে দেখবি লম্বায় অনেক বড় হয়ে যায়। সে কি তার বাবাকে ছোট বাবা বলে ডাকে ? "
" না স্যার , না স্যার , কান ধরছি । ভুল হয়ে গেছে ।"
তারপর থেকে লাল্টু কেমন যেন আমাকে বেশি সম্মান করত । আমাদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।
নদীর প্রায় পাড়ে স্কুল , খুব বেশি হলে দুশ মিটার দূরে নদী ।
টিফিনে চলে যেতাম নদী পাড়ে । একদিন দীপক দা বলল, " রণজিত্ একটা জিনিস দেখবে "?
বলেই দূরের একজন কে ডাকল " এই কালো এই ... মাছ আছে ? এপারে নৌকা নিয়ে আয় দেখি ।
সেই প্রথম আর সেই শেষ জ্যান্ত ইলিশ মাছ হাতে নিয়ে দেখেছিলাম ।
হোস্টেলের জীবন শেষ ।এবার রুম ছাড়তে হবে ।
শ্রদ্ধেয় কলিগ মাননীয় কৃষ্ণ মুখার্জি চড়িয়ালে একটি ঘর দেখে দিলেন। থানার সঙ্গে একই পাঁচিলের অপজিটে বাড়ি। গৌরাঙ্গ আশ্রমের একেবারে গায়ে ।নদীর পাড় থেকে কুড়ি ফুট তাও দূর নয়। সারাক্ষণ নদীর জল ছলাক ছল । দূরে আই ও সির বটলিং প্লান্ট, আর ওদিকে সি এস সির তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। একের পর এক কার্গো শিপ আসা যাওয়া করছে । মাঝে মাঝে আন্দামান গামী বা ফেরতা জাহাজ দূর থেকে চলে যায় । জোয়ারের জল কমে গেলে বা সিগন্যাল না পেলে জাহাজ গুলো বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে পড়ত । জাহাজের আলোয় ঘর আলো হয়ে থাকত। কখনো মাঝ রাতে নোঙর তোলার শব্দে ঘুম ভাঙত। চাঁদ তার সব আলো ঢেলে দিত নদীর জলে । মোটা শিকল অটোমেটিক গুটিয়ে নোঙর উঠে আসছে। তার ধাক্কায় ঘুমন্ত জল জেগে উঠছে ।যেন মুঠো মুঠো সোনা ছড়িয়ে পড়ছে।
সময় পেলে খোলা জানালায় বসে দেখতাম নদীর ঢেউ ভাঙা, জেলে নৌকার আনাগোনা, নদীর বুক চিরে সাদা বালি তুলে আনা আর ঝাপসা হয়ে থাকা ওপার ।
একাই থাকতাম । তাই এমন রোমান্টিক জায়গায় মনের রোমাঞ্চ ক্রমশ হারিয়ে যেতে লাগল ।
আরো বিরক্ত লাগত নিজে রান্না করতে । মাঝে মাঝে সন্দীপ দা আসত ।দুজনে মাংস ভাতের ফিস্ট হত ।
একদিন বৃষ্টির দিন ।স্কুল এক পিরিয়ডের পর ছুটি হয়েছে। বাসায় ফিরে দেখি রান্নার মত তেমন সব্জি নেই। ঝুড়িতে দেখি একটা বড় শাঁকালু রয়েছে। তাই আদ্ধেক কেটে প্রেশারে বসিয়ে দিলাম । দশটা সিটি হবার পর নামিয়ে দেখি শক্ত। আবার বসিয়ে পনেরোটা সিটি দিলাম ।
নীচে থেকে বৌদি জিজ্ঞাসা করলেন , কি রান্না করছ ?
সব শুনে সবাই কি হাসতে লাগল ।কলিগ রা বললেন আপনার দ্বারা রান্নার এক্সপেরিমেন্ট হবে না।
সকালে রান্না করতাম না । সন্দীপ দা থাকত সুভাষ উদ্যানে। ও চড়িয়ালে নামত , তারপর দুজনে উড়ের হোটেলে খেয়ে স্কুলে যেতাম।
অর্ণার সঙ্গে খুব কম কথা হয় । একদিন ভয়েস মেসেজ এল । কি সুন্দর রবীন্দ্র সংগীত।
" আমার ও পরাণ ও যাহা চায় তুমি তাই ,,,,,,,,,,,"
আমি উত্তর দেবার সাহস পাইনি।
মাসখানেক বাদে ও ফোন করে বলল " কিছু মনে করবেন না ওই মেসেজ টা ভুল করে আপনার নাম্বারে ভাইপো পাঠিয়েছে। ছি ছি আমার কি খারাপ লাগছে। "
সন্দীপ দা এইচ এম হয়ে চলে গেল ।কিছু ভালো লাগছে না ।অর্ণা শিলিগুড়ি ফিরে গেছে। সি অফ করতে গিয়ে একসময় জিজ্ঞাসা করলাম। মেসেজ টা কি সত্যিই ভুল করে এসেছিল!
তার দুচোখ ভরে জলের ধারা নামে ।
"যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙল ঝড়ে"।
চড়িয়ালে আর ভালো লাগল না ।চলে গেলাম কালিপুর । স্কুলে অলোক দা , গৌরীদি , বাসন্তী ম্যাডাম, নীলু দার সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে । একদিন বললাম এবার চলে যাব ।
অলোক দা বলল, " কি গো রণজিত্ এত যাই যাই করছ কেন!"
যেতে যে আমাকে হবেই।
আসার দিন ফেয়ার ওয়েল অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে ।ছাত্র- ছাত্রীরা কাঁদছে। কলিগদের অনেকের চোখের কোন চিকচিক করছে। যে কান্না বুকে নিয়ে অর্ণা চলে গিয়েছিল সেই কান্না আমার বুকে বাঁধছে। কচি কাঁচাদের উপহারে দু হাত ভরে গেছে। বুঝলাম কতটা তারা আমায় ভালোবাসে ।ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে বললাম "সবাই কে ভালো রে।"
আজও নদী দেখলে মনটা কেঁদে ওঠে।মনে হয় এক ছুটে চলে যাই । জীবনের প্রথম প্রেম কেউ ভুলতে পারে না । বার বার স্মৃতি পটে ভেসে ওঠে । সেভাবেই আমার, আমার রাজীবপুর স্কুল মন জুড়ে রয়েছে। ভালো থেকো।
==============
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন