Featured Post
নিবন্ধ ।। তা দেওয়া ।। অরবিন্দ পুরকাইত
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
কথাটা বেশি করে মনে আসে প্রুফ দেখার তাড়া থাকলে। সাজসরঞ্জাম নিয়ে বসে নিবিষ্ট হয়ে বসে প্রুফ দেখতে দেখতে যতবার উঠতে হয় প্রায় ততবারই মনে ভাসে তা দেওয়ার কথা! স্নানঘরে ছোট-যাওয়া হোক বা বড়, বাজার-যাওয়া, সংসারের অন্যান্য ছোটবড় কাজকর্ম বা স্নান-খাওয়া – প্রুফ মেলাই থাকে প্রায়, ফাঁকে ফাঁকে কেবলই তার কাছে এসে বসি। তাকে নিয়ে বসি। তাতে তা দিই। তখন আমার পক্ষীমাতার দশা! চোখে স্বপ্ন কিছুদিনের মধ্যে পক্ষীশাবকরূপ পত্রিকা বা পুস্তকের কাঙ্ক্ষিত চাঁদমুখদর্শন।
তো বইপত্র প্রকাশ কোনো একক ব্যাপার নয় সচরাচর, অন্যান্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে। পুরুষ পাখির সঙ্গে মিলনে পাওয়া ডিমে তা অর্থাৎ তাপ দেওয়া থেকে শাবকের জন্ম পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটাই পক্ষীমাতার বলতে গেলে একক প্রচেষ্টা, কৃতিত্ব ইত্যাদি যা কিছু। সাধারণভাবে পক্ষীমাতা নয়, এখানে ফিরে দেখব সেই পক্ষীকুলেরই এক প্রজাতি – কালে যে পোষ্য হয়েছে মানুষের এবং দীর্ঘকাল সহযাত্রী – মুরগির তা দেওয়ার দৃশ্য। হ্যাঁ, দৃশ্য। বস্তুত, তা দেওয়া বা ডিমে তা দেওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন নিছক শব্দবন্ধ বা বাগধারা নয় বরং আরও বহু বাগধারা বা প্রবাদ-প্রবচনের মতো ধৃত দৃশ্যমালা, বিশেষত এই আমাদের মতো লোকের কাছে যাদের বাংলা বা ইংরেজি শতাব্দীর দু-দিকেই প্রায় দু-আড়াই দশক করে বাঁচা হয়ে গেল। কেন এই শব্দবন্ধটি বাগধারা বা প্রবচনের মর্যাদা পেয়ে গেল যুগ যুগ ধরে, তা ধরা আছে আমাদের মন-ক্যামেরায় যারা বছরের পর বছর শীতকালে এক বা একাধিক 'ওজাল' 'ছানা তুলতে' দেখেছে মা-ঠাকুমা, কাকিমা-জেঠিমাদের। মেশিনে ছানা তোলার দিন এসে যাওয়ায় যে দিনের বেশির ভাগটারই অবলুপ্তি ঘটেছে। তবে বিরলদৃশ্য হলেও, গাঁ-গঞ্জে আজও একেবারে বিদায় নেয়নি ঘরোয়া ছানা ফোটানোর পদ্ধতি।
ভবিষ্যতে ফল পাওয়ার আশায় প্রচেষ্টায় একনিষ্ঠ থাকা বা কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিবিষ্ট থাকা কিংবা অপেক্ষা করা। ছেলেমেয়েরা এখন মোবাইলে তা দিচ্ছে, ত্যাগঘরে ছোট-যাওয়া বা বড়-যাওয়াতেও যেন ব্যাজার! চান-খাওয়ার ব্যাপারটা কেন যে ছিল জগতে! লকডাউন তথা বন্ধ-বিদ্যালয় অনলাইন ক্লাসের দিনে অ্যানড্রয়েড ফোন নিয়ে অভিভাবকদের ছুঁৎমার্গতা অন্তত বাধ্যত উধাও অনেকখানি। এই অবসরে উন্মুক্ত হয়ে গেছে নেট-দুনিয়ার বিচিত্র জগৎ! ফলে – আয়, খেয়ে নে – খেয়ে নে। বক্তা বলতে বলতে যত বিরক্ত, ততোধিক বিরক্ত তারা শুনতে শুনতে। অবশেষে একসময় ব্যাজার-মুখে তা (উভয়ার্থেই) ফেলে ঝুপ করে এসে বসে কোনও প্রকারে দুটি গলাধকরণ করে আবার গিয়ে তায় বসা। প্রেমিকা বা প্রেমিকের উদ্দেশে ইট পেতে কেউ কেউ তা দিতে থাকে দিনের পর দিন বা বছরের পর বছর! নির্বাচনে হারলে আগে বহু জনপ্রতিনিধিই পরবর্তী পাঁচ বছর এলাকার মানুষের কাজকর্ম, সেবার মাধ্যমে তা দিতেন পরেরবার জেতার জন্যে। ইদানীং অনেকদিনই সে পাট উঠতে বসেছে। মারুক-ধরুক বা সেবা করুক, করবে ক্ষমতাসীন দলই – বিপক্ষ দলের কাছে সেবা নিতে গেছ কি হয় একঘরে করে দেব – কোনোকিছুতে আর আমাদের পাবে না; আর না হয়, ঠ্যাং ভেঙে দেব। যাক, বিবিধ বিচিত্র তা-প্রকরণের বিন্যাস উদ্দেশ্য নয় এ রচনার। আমরা সেই ডিম আগে না মুরগি আগের চিত্রে আসি।
গত মাঘের আগের মাঘে কইখালিতে গিয়ে মাতলা নদীর তীরে – আয়লা-পরবর্তী তৈরি নদীবাঁধে এক কুক্কুট পরিবারকে দেখলাম। সত্যিই পরিবার। গোটা দশ-বারো রঙিন ছোট ছোট বলের মতো ছানাকে নিয়ে খুঁজে খুঁজে খাবার খুঁটে খাওয়াতে শেখাচ্ছে মা, কখনও নিজেও মুখে দিচ্ছে দু-একটা। দলে রয়েছে একটি মোরগও। অনুমান করা যেতে পারে যে এই-ই শাবকগুলোর জনক। কেন-না নদীবাঁধের এই কুক্কুট পরিবার পার্শ্বস্থ যে মনুষ্য পরিবারের, তাদের থেকে পরবর্তী বাড়িটি বেশ খানিক তফাতে। সে বাড়িতে মুরগি নাও থাকতে পারে বা মুরগি থাকলেও মোরগ নাও থাকতে পারে। ধরে নিতে পারি, পাড়ার মধ্যে যাঁরা বাস করছেন না তাঁরা মুরগির সঙ্গে সঙ্গে মোরগও রাখেন যাতে ছানা তোলার সময় মোরগ আছে এমন বাড়ি থেকে ডিম না আনতে হয়। পোষা মুরগি ডিম তো পাড়বে, কিন্তু মোরগ-মিলনজাত ডিম ছাড়া ছানা হবে না। আর তাই মুরগির চেহারা অনুযায়ী দশ থেকে বিশ-পঁচিশটি পর্যন্ত 'ডিম বসাতে' (কতগুলো ডিম ঢাকা দিয়ে বসে তা দিতে সক্ষম মুরগিটি সেটাই বিবেচ্চ), মোরগ-মিলনজাত ডিম নিজ পরিবারে না মিললে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বা নিজ পাড়া থেকে প্রতিবেশী পাড়া বা গ্রাম থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করতে হত/হয়। কেউ বা অন্যের ছানা তোলার সময় দু-একটি ডিম দিয়ে ছানা নেয় (রং দিয়ে চিহ্নিত করা থাকে)।
যে চিত্রের কথা বলা হয়েছে, সেটা কেমন? মুরগি সাধারণত পরপর দু-চার সপ্তাহ একটানা ডিম পাড়ার পরে (মাঝেমধ্যে দু-একদিন বাদ যেতে পারে) দু-তিন সপ্তাহ 'তা নেয়' অর্থাৎ মুরগির জিরেন। এই তা নেওয়ার সময় ডিম বসাতে হয়। সাধারণত মাটির খুলি মেছলা কিংবা বাঁশ বা বেতের ঝুড়িতে বসানো হয় ঘর, রান্নাঘর ইত্যাদির কোনও নিভৃত নিরুপদ্রপ স্থানে। নিচে পুরু করে খড়কোচা (কুচোনো খড়) দিয়ে তার উপরে ডিমগুলোকে সাজিয়ে বসিয়ে দিয়ে তারপর তাতে মুরগিকে বসিয়ে দেওয়া হয়। এরপর মুরগি নিজেই ডিম সাজিয়ে নেবে তার মতো করে। পা দিয়ে, মুখ দিয়ে – পুরো শরীর দিয়ে। তিন সপ্তাহ ডিমে তা দেয় মুরগি। এই সময় সে নাওয়াখাওয়া ভুলে যায়। অর্থাৎ সে কিছুতেই ডিম ছেড়ে নড়তে চায় না আর তার মালিক এর মধ্যে সচরাচর চান করায় না। তাকে জোর করে ডিম থেকে তুলে বাইরে একটু ছেড়ে দেওয়া হয় চরে খাওয়ার জন্যে। খেতে দেওয়াও হয়। কিন্তু তার তখন খাওয়ায় মন কোথায়! মন তো পড়ে আছে ডিমের উপর! যতবার তাকে 'যা-যা' বলে তাড়া দেওয়া হোক, সে মালকিন বা মালিকের সঙ্গে গজিখেলার (গাদিখেলা) মতো 'ঝুল মেরে' সেই খুলি বা ঝুড়িতেই ফিরতে চায়। এমনও হামেশাই হয় – ঘর, 'কুটুরিঘর' বা রান্নাঘর আদির দরজা বা আগড় বন্ধ করে দিতে হয় যাতে সে খানিকক্ষণ ফিরতে না পারে। বাধ্য হয়ে একসময় এদিক-ওদিক অলসভাবে একটু-আধটু ঘুরেফিরে বেড়াতে হয়। বিশেষ ভঙ্গিতে এবং মুখে মৃদু কোঁক-কোঁক আওয়াজ করতে করতে ময়লা-আবর্জনা ঘেঁটে খাবার মুখে তোলে টুকটাক বা দেওয়া-খাবার চাখে সামান্য। তারপর, যদি কোনোভাবে ফাঁক পায় তো সুড়ুৎ করে ঢুকে বসে যাবে ডিমে! নইলে বন্ধ-দরজার আশেপাশে ঘুরঘুর। তো একটানা একুশ দিনমতো এইভাবে বসে তা দেওয়ার কারণে এমনকি শেষের দিকে অনেকসময় গায়ে গুঁড়ি গুঁড়ি পোকা হয় মুরগির। ঘরদাবা থেকে মানুষের গায়েও বেয়ে বিরক্ত করতে পারে। স্বাভাবিক কারণেই মা-মুরগির ওজনও যায় কমে।
একুশের কাছাকাছি যত আসতে থাকে, ডিমের মধ্যে ছানা ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠে। মুরগি তার শরীরের নিচে ডিমের মধ্যে ছানার নড়াচড়া অনুভব করে এবং খুব মনোযোগ দিয়ে এক-একটা ডিমে কান পেতে পেতে ভিতরের শব্দ শোনে। ছানার নড়াচড়া ডাক ইত্যাদি বুঝে সময়মতো এক-একটা ডিম ঠোঁট দিয়ে সাবধানে ভেঙে ছানাকে বাইরে আনে। এইভাবে এক-এক করে ডিম থেকে ছানা ফুটে ওঠে। দু-চারটে ডিম নষ্ট হতে পারে। কেন-না মুরগির চেহারার তুলনায় বেশি ডিম দেওয়া হয়ে যেতে পারে, তাতে করে সব ডিম সমান তা নাও পেতে পারে। কোনও ডিম মোরগ-সংসর্গহীনও হতে পারে। আবার বসানোর আগে জমানো-ডিমের কোনও কোনওটি পূর্বেই খারাপ হয়ে থাকতে পারে, যদিও তার সম্ভাবনা কম যেহেতু বসানোর আগে ভালো করে দেখেই দেওয়া হয়।
তারপর একদিন রঙিন ফুলের মতো শাবকের দলবল নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে পক্ষীমাতা – থুড়ি, মুরগিমাতা। এবার তাদের চরে-খাওয়া শেখানো থেকে সাবলম্বী করে তোলার পালা। মুরগিকে এবার ভাল করে চান করিয়ে দেওয়া হয়, যাতে গায়ের পোকা দূর হয়। একই মুরগিকে দিয়ে আরও এক ওজাল ছানা তোলার হলে, সদ্য-ওঠা ছানাগুলো শিগগির মায়ের কাছ-ছাড়া করে আবারও ডিমে বসিয়ে দেওয়া হয়, আবারও শুরু হয় তা দেওয়া।
* * * *
অরবিন্দ পুরকাইত
গ্রাম ও ডাক – গোকর্ণী,
থানা – মগরাহাট,
জেলা – দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন