কিশোরকবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, জ্ঞান থেকে শুনে আসছি। আমি মনে করি বাস্তবিক ভাবে মননে চিন্তনে পরিণত এক কবি। কয়েকটি কবিতার পংক্তি সবার মুখে মুখে ফেরে। সম্ভবত পাঠ্যপুস্তকে বাধ্য হয়ে পড়ার দৌলতে। অনেক বেশি অপঠিত মূল্যবান লেখার খোঁজ কজন রাখি।
যেমন 'পূর্ণিমা চাঁদ যেন, ঝলসানো রুটি'। 'খাদ্যের খোঁজে এসে, খাবারের টেবিলে খাদ্য হয়ে যাওয়া'। গুরুগম্ভীর অতি রুঢ় বাস্তব লেখায় তুলে ধরেছেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।
কবির জীবন খুব সুখের মধ্যে কাটেনি। তবুও জীবন থেকে হাসি ঠাট্টা রসিকতা শেষ হয়ে যায়নি। সুযোগ পেলে তারাও কবির কলমে প্রাণবন্ত হয়ে ফুটতে থাকে। "মিঠেকড়া" কাব্যগ্রন্থে নিজেকে প্রকাশ করে। তার টুকরো টুকরো অংশ এই লেখায় দেখতে পাবো।
"অতি কিশোরের ছড়া"য় কবি কেমন ছিলো অনেকটা আঁচ করা যাবে। সেটাই শান্ত প্রকৃতির নয়, নিজেই লিখেছেন। আসলে কবিরা আলাদা করে নিজের কথা লেখেন না। সবার মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করে।
কবি মতের বিরুদ্ধে কিছুই গ্রহণ করতেন না। তথাকথিত বুঝদারদের সম্পর্কে অভিমত 'পণ্ডিত এবং বিজ্ঞজনের দেখলে মাথা নাড়া,/ ভাবি উপদেশের ষাঁড়ে করলে বুঝি তাড়া'। পরিস্কার বুঝতে পারছি কতটা সচেতন ছিলো নিজের বিষয়ে।
কবির নজর এড়ায়নি 'মেয়েদের পদবি'তে পুরুষের থেকে আলাদা করা। গুপ্ত হলে গুপ্তা। কবি লিখেছেন 'পালিত পালিতা হলে, পাল হলে "'পালা'/ নির্ঘাৎ বাড়বেই মেয়েদের জ্বালা'। এককথায় তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের বহিপ্রকার ধরা পড়ে কেবল মাত্র নারীর ক্ষেত্রে।
আবার এমন পদবির সমাহার ঘটিয়েছেন, যেগুলো মেয়েদের অচেনা লাগবে। এমন বীরাঙ্গনার বেশে খুব কম পুরুষ ও নারী কল্পনা করে। নারী যেন নিড়বিড়ে রূপে সবাই দেখে অভ্যস্ত। এখানে কী মুন্সীআনায় বলেছেন ' কর যদি করা হয়, ধর হবে ধরা,/মেয়েরা দেখবে এই পৃথিবীটা সরা। নাগ যদি নাগা হয়, সেন হবে সেনা,/ বড়ই কঠিন হবে মেয়েদের চেনা'। কবি বলতে চাইছে সুকৌশলে নারীরা প্রয়োজনে সেনার ভূমিকায় দেখতে পারি। নারীদের দুর্বল ভাবা আদৌ উচিৎ হবেনা।
এবার আসবো 'বিয়েবাড়ির মজা' কবিতায়। কবি মজায় বললেও বাস্তব নিয়ে মজা করেননি। সমাজে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ বিয়েবাড়ির মতো যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে খাদ্যের মহা আয়োজন করে। তবুও আমন্ত্রিতদের কাছে অতিদীনতায় গলবস্ত্রে বলতে শুনি 'আসুন, আসুন -বসুন সবাই, আজকে হলাম ধন্য,/যৎসামান্য এই আয়োজন আপনাদের জন্য'। বিনয়ের অবতার হয়ে পড়েন বাড়ির কর্তা।
অথচ খেয়াল থাকেনা, বা উপেক্ষা করে সরকারি নিমন্ত্রণ বিধি। পঞ্চাশ জনের জায়গায় হাজার ছাড়িয়ে যায়। যেখানে দেশে অন্নের কষ্টে সাধারণ মানুষজনেরা অন্ন কষ্ট দিন কাটাচ্ছে। তাদের জন্য সামান্য চিন্তা মাথায় থাকেনা। বড়মানুষি দেখানোর জন্য বিপুল আয়োজন করে খাদ্যের। না খেতে পেরে পাতের দুপাশে উদবৃত্ত খাদ্যের পাহাড় তৈরি করে। অপচয়ে আভিজাত্য দেখানোর উপায় । কবির দৃষ্টি এড়ায়নি এইসব ব্যপারে।
হঠাৎ বাড়িতে পুলিশের আগমন। গৃহকর্তাকে থানায় তুলে নিয়ে যেতে দ্যাখে। অনাহুতরা বাড়ির বাইরে বসে থাকে দুটো খাওয়া লোভে।তারা কী মনে করছে? শুনুন কবির ভাষায় 'কর্তা হলেন কাঁদো কাঁদো, চোখের জলে ভাসে,/গেটের পাশে জড়ো-হওয়া কাঙালীরা হাসে'।
এই বঞ্চিত মানুষগুলো কেন হাসবে না। তাদের জন্য ডালভাতের আয়োজন করেনি। এমনকি উচ্ছিষ্ট কুড়োতে তাদের বাধা দেওয়া হয়। নোংরা ভিখারি মানুষ নামক প্রাণীগুলো ভদ্রলোকের পরিবেশ নষ্ট করবে। যদি তা না হতো এরাই বাধা দিয়ে গৃহকর্তাকে আটকানো চেষ্টা অন্তত করতই।
'পুরনো ধাঁধা' কবিতার দুটো স্তবক প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে। না বলে পারছিনা ' হিং-টিং- ছট- প্রশ্ন এসব,মাথার মধ্যে কামড়ায়/ বড়লোকের ঢাক তৈরি, গরীব লোকের চেমড়ায়'।
এইসব সৌখিন বড়লোকদের রসবোধ কম যায়না। যতরকম হাসির খোরাক গরিবদের থেকে আসে। দমফাটা হাসিতে বাবুদের জীবনীশক্তি বাড়ে বটে- গরিবরা লজ্জায় মরে যায়। প্রসঙ্গক্রমে বলতে পারি 'খাদ্য সমস্যা সমাধান' কবিতাটির কথা। এক গরিব মানুষ দুমুঠো অন্নের জন্য এক তথাকথিত ধনী লোকের কাছে আসে। কবি সুকান্ত ছোট্ট কবিতায় অল্প কথায় তুলে ধরেছেন 'এই নাও ভাই, চালকুমড়া/ আমার খাতির করো, চালও পেলে কুমড়ো পেলে/ লাভটা হলো বড়ো'। এই অমানবিক রসিকতা কবির ভালো লাগেনি বলে কমল হাতে তুলে নিলেন।
কবি 'রেশন কার্ড়' নিয়ে যেকথা সেই কবে লিখে গেছে কবিতায়। এখনো অনেকেই রেশন কার্ড়ের সমস্যায় পড়ে আছি। রঘুবীর না হয় কার্ড় হারিয়ে ফেলেছে। নতুন কার্ড় তৈরি সময় সাপেক্ষ। এ দেশে অনেকে মরতে বসেছে তাদের রেশন কার্ড় নেই দলাদলির কারণে। তাদের উপায় কী হবে? তাদের তো অন্য দেশ বলে বিকল্প কিছু নেই। রঘুবীরকে রেশন দোকানদার অনুনয় বিনয়ের পরে একটা পথ বাতলে দেছে। কবির ভাষায় বলি 'পয়সা থাকে তো খেও হোটেলে কি মেসেতে/নইলে সটান তুমি যেতে পারো দেশেতে'। যাদের অন্য দেশ নেই শুকিয়ে মরো।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য 'গোপন খবর' কবিতায় মোক্ষম দাওয়াই দিয়েছেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মানুষের শান্তি এনে দিতে পারেনা আর কখনো পারবেও না। যা হয় প্রভুত্বের লড়াই। মুঠোয় রাখার দম্ভ। কবি খুব ভালো ভাবে বুঝেছিলেন।
কবি রুপকের মধ্যে আলোকের দিশা দেখাতে চাইলেন। যুদ্ধ চলাকালীন একটি না ফাটা বোমা গড়ের মাঠে পড়ে থাকে। সবার দৃষ্টি এড়িয়ে মাটি চাপা পড়ে। বর্ষার জলে বোমার গাছের জন্ম হয়। কবি লিখছেন 'বৃষ্টি পেয়ে জন্মেছে এক লম্বা বোমার গাছ,/ তারই মাথায় দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোর নাচ'। চাঁদের আলো স্নিগ্ধতার প্রকাশ। যেমন প্রদীপের আলো, দুই চোখে বুলিয়ে দেয় যেন তৃপ্তির প্রলেপ । যখন কবি বোমার গাছ বলছে তখন তা জীবনের পরিপূরণ হয়ে ওঠে। শাকম্ভরী রূপে প্রতিটি জীবনের রক্ষা করতে রূপ ধরেন।
কবির ভাষায় 'পরের দিন সকালবেলা গেলাম সে ময়দানে,/ হায়রে ! গাছটা চুরি গেছে - -কোথায় কে তা জানে!' কবি এটাই বোঝতে চাইলেন অশুভ শক্তি সে তো মানুষের ভালো চাইবে না। আমারদের উদাসীনতার ফলে গেছটি চুরি গেছে। কবি মজা করে, রসিকতার মাধ্যমে বাস্তব লেখার মধ্যে তুলে ধরেছে।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে নিয়ে বলার শেষ কোনদিন হবে না।
*****************
শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ
গ্রাম:লক্ষ্মীকান্তপুর, ডাক:বিজয়গঞ্জবাজার
জেলা:দক্ষিণ২৪পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ(ভারত)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন