মূলত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রতিটি মূহূর্তকে যেমন উপভোগ করেছেন, তেমনি তাঁর সৃষ্টিশীল রচনা আমাদের চলমান জীবনে এক অমিত শক্তির রসদ। বাঙালি মনন কিংবা চিন্তার জগতের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে যে ক'জন কবি-সাহিত্যিক শক্তভাবে নাড়া দিতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস বাংলা ভাষায় তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম। আজ যখন সমগ্র জাতি বিমর্ষ, মৃত্যু আতঙ্ক যখন বাঙালি তথা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের অন্তরে, তখন সেই মৃত্যুকে জয় করবার সাহসটুকুর জন্যই কবিগুরুকে দরকার। দরকার রবীন্দ্রনাথের লেখা, দর্শন, চিন্তাচেতনা, আলোকছটার ঔজ্জ্বল্য-কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিভিন্ন লেখায় সৃষ্টি দিয়ে মৃত্যুকে জয় করার কথা বলেছেন।মৃত্যুঞ্জয় কবিতায় তিনি লিখেছেন, যত বড়ো হও, তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও, আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে, যাব আমি চলে।আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, মৃত্যু দিয়ে যে প্রাণের মূল্য দিতে হয়/সে প্রাণ অমৃতলোকে/মৃত্যুকে করে জয়।মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না ও প্রেম-বিরহের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন তিনি। পৃথিবীর আলো-বাতাস-রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ অসাধারণ কাব্যিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যে।জীবনের প্রতি গভীর ভালবাসার কারণে মানুষকে তিনি অকৃত্রিম ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়েছেন। শত পৈশাচিকতা দেখে তিনি শেষ পর্যন্তও মানুষের প্রতি বিশ্বাস অটুট রেখেছেন। তাঁর সুগভীর আস্থা জন্মেছিল মানুষের প্রতি। সভ্যতার সংকটে তিনি বলেছেন 'মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ'। অর্থাৎ মনুষ্যত্ব, মানবতা, মানবধর্ম, মানবতাবাদ সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অনন্য। সাহিত্য সাধনা থেকে শুরু করে আদর্শনিষ্ঠ ব্যক্তি জীবনের প্রাত্যহিকতায় মানবতায় ছিল তাঁর মূলমন্ত্র।জাতির কল্যাণ সাধনে রবীন্দ্রনাথ বহুমাত্রিক চিন্তার অভিনিবেশ ঘটিয়েছেন। তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষা ছাড়া জাতির ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার ব্যাপারে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তা তাঁকে মৃত্যুঞ্জয়ী করেছে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে স্বাধীন পাঠের উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। বাঙালির শিক্ষা ব্যবস্থার বড় ত্রুটি হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন আনন্দহীন শিক্ষাকে। তিনি বলেছেন : 'বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই।' এই আনন্দহীন শিক্ষা বাস্তব জীবনে কোন উপকারে আসে না। ত্রটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার অসারতা দূর করার জন্য তিনি লিখেছেন : 'আমাদের এই শিক্ষার সহিত জীবনের সামঞ্জস্য সাধনই এখনকার দিনের সর্বপ্রধান মনোযোগের বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে।' তিনি মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করে তোলার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধস্বরূপ। বিদেশি ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করলে জ্ঞানের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে না। তাছাড়া দেশের উন্নতির ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রাখা যায় না।ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য রবীন্দ্রনাথ সবাইকে জ্ঞানচর্চা ও সত্য সাধনা দ্বারা সঙ্কীর্ণ মানসিকতার পরিবর্তন করতে বলেছিলেন। ইউরোপের মানুষের মতো সত্য ও জ্ঞান সাধনার দ্বারা সঙ্কীর্ণ চিন্তাচেতনাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারলেই সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হবে বলে রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন : 'এ সমস্যার সমাধান হবে মনের পরিবর্তনে যুগের পরিবর্তনে। ইউরোপ সত্য সাধনা ও জ্ঞানের ব্যাপ্তির ভিতর দিয়ে যেমন করে মধ্যযুুগের ভিতর দিয়ে আধুনিক যুগে এসে পৌঁছেছে। হিন্দুকে মুসলমানকেও তেমনি গন্ডির বাইরে যাত্রা করতে হবে।'বিশ্বমানবের কল্যাণব্রতী এক মনীষী। তাঁর সাহিত্য 'সর্বাপেক্ষা সার্বজনীন ও সর্বজনবিদিত প্রাদেশিকতাদোষবর্জিত।' জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও দেশ-কালের সকল সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে তিনি মানব মহিমার জয়গান করেছেন। সমাজ অভ্যন্তরের নানা শ্রেণীর মানুষের কল্যাণের জন্য চিন্তা-ভাবনা করেছেন।আমাদের শিল্পচেতনা, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাাতিক জীবনের সর্বত্র মৃত্যুঞ্জয়ী রবীন্দ্রনাথের আবেদন সুদূরপ্রসারী। তিনি বাঙালির হৃদয়ে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। তিনি বলেছিলেন – 'আমি তোমাদেরই লোক'। সকল প্রকার সুখে-দুঃখে-সন্তাপে মৃত্যুঞ্জয়ী কালপুরুষ রবীন্দ্রনাথ আমাদেরই লোক হয়ে থাকবেন।তাঁর ঈশ্বর কর্মী ঈশ্বর। তাঁর অবস্থান স্বর্গলোক নয়, মানবের সংসার। তাঁর মূর্তি নেই। মানুষের মধ্যেই তাঁর প্রকাশ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তিনি "রূপসাগরের অরূপরতন"। তাঁর ধর্মও মানুষের ধর্ম। এই ধর্ম মানুষে-মানুষে ঐক্যবন্ধন করতে শেখায়। এই দর্শন সৌভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। রবীন্দ্রনাথ আজীবন ধর্মীয় উন্মাদনার বিরোধিতা করে এসেছেন। যে ধর্ম মানুষে-মানুষে ঘৃণার বীজ রোপণ করে, যে ধর্ম সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে সংঘাত-প্রতিঘাতের বাতাবরণ সৃষ্টি করে, যে ধর্ম আমাদের সামাজিক ঐক্যকে খণ্ডবিখণ্ড করে, রবীন্দ্রনাথ বরাবর সেই ধর্মের বিরোধিতা করে এসেছেন। তাঁর এই দর্শন এক অখণ্ড মানবতাবাদের নিদর্শন। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি মিশতে চেয়েছিলেন মানুষের মধ্যে। সারা জীবন গেয়েছিলেন মানুষের জয়গান, জীবনের জয়গান।১৬২তম জন্মদিনে কবিকে আরো বেশি স্মরণ, অনুসরণ করি কার মানবতাবাদি সৃষ্টি চিন্তাভাবনা দর্শনের জন্য। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আর যখন চারিদিকে কবিকে নিয়ে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের দড়ি টানাটানি, আমাদের কবি বলে তার সাহিত্যকে আত্মসাৎ করা সর্বোপরি গেরুয়া রাঙিয়ে তোলা, তার চিন্তাভাবনা কি উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনায় মুড়িয়ে ফেলা কখন সচেতন মুক্ত চিন্তা উদার ভাবধারার মানুষদের আরো বেশি কবির জীবন দর্শনকে সঠিকভাবে তথ্যসহকারে জনসমক্ষে উপস্থাপিত করতে হবে ও সেই সমস্ত দুরভিসন্ধি বিভেদ সৃষ্টিকারী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদ করতে হবে। আমাদের ভাবি প্রজন্মকে আরো বেশি রবীন্দ্রনাথকে জীবন আদর্শ দর্শনকে পড়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। প্রাণের কবি বাঙালিসত্ত্বার কবি দুই বাংলার চির জাগরণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আজ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আত্মসাৎ করতে চলেছে । সেই শৃংখল থেকে আমাদের সকলকে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মুক্ত করতে হবে। তাকে ধর্মীয় প্রসারে বাধা যাবে না। তিনি চিরকালীন সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন। সমাজ রাজ্য তথা ভারতজুড়ে অশান্তির অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন, ধর্মীয় বিদ্বেষ, বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঠিক সেই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের দেখানো পথ, আদর্শ, মানবতা আমাদের মননে জমে থাকা সমস্ত কুসংস্কার, জাতিবিদ্বেষ, শ্রেণীবিভাজন, ধর্মীয় ভেদাভেদ, বৈষম্য, যাবতীয় শাসন, শোষণ নিপীড়ন, বঞ্চনা, অশান্তিকে দূর করে খুঁজে দিব্যি বেঁচে থাকার নতুন দিশা। তাকে আরো বেশি আঁকড়ে ধরি, গ্রহণ করি মনে প্রাণে, ধারণ করি আমৃত্যু। বাঙালি মানসে জাতিসত্তায় জাগরণে চিন্তনে অনুভব প্রাত্যহিকতায় চির নন্দিত বন্দিত স্মরণীয় বাঙালির প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন