উপস্থাপনে অনুসরণযোগ্য একটি বই
অরবিন্দ পুরকাইত
সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে মনুষ্যেতর প্রাণী সঙ্গী মানুষের, বনজঙ্গল-নদী-সমুদ্র-পাহাড়-প্রান্তর অধ্যুষিত উন্মুক্ত প্রকৃতির অঙ্গনে বহুতর প্রাণীর সঙ্গে খাদ্য-খাদক সম্পর্ক তথা নানান মাত্রার সহবাস থেকে কতিপয়ের একদা গৃহবাসী মানুষের সঙ্গী হিসাবে। স্বাভাবিক কারণেই তারা মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতা-সংস্কৃতিরও অঙ্গ হয়ে রয়েছে। মানুষের কাহিনির সঙ্গে স্বভাবতই জড়িত তারা। আদিম সঙ্গী সারমেয় 'মহাভারত'-এ পাণ্ডবদের সঙ্গে মহাপ্রস্থানের পথে সঙ্গী দেখি আমরা। পশুপালক মানব থেকে কৃষিজীবী-মানবে উত্তরণে গবাদি পালনের ভূমিকা অশেষ। প্রাচীনকালে তর্কযুদ্ধে গোধন দানের নজির ছিল আকছারই। মানুষের কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রকাশেও তাই মনুষ্যেতর প্রাণীও কমবেশি স্থান করে নিয়ে এসেছে বরাবরই।
বিক্রমজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের 'বাংলা সাহিত্যে মনুষ্যেতর প্রাণীকেন্দ্রিক ছোটগল্পের ধারা' বইটি বিষয়বস্তু এবং বিশ্লেষণে বেশ খানিক বিশিষ্টতার দাবি করে। বাংলা সাহিত্যের অনেক সাহিত্যিকের অতি পরিচিত থেকে তুলনায় অপরিচিত ছোটগল্পে মনুষত্যের প্রাণীর উপস্থিতি, অভিঘাত ইত্যাদি যথাযোগ্যভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে বইটিতে। প্রবন্ধের বই হিসাবে, বিষয়বস্তুর উপস্থাপন তথা বিশ্লেষণে — সূচনা তথা উৎস থেকে বিস্তার হয়ে উপসংহার অবধি বইটির গঠন চমৎকার এবং অনুসরণযোগ্য।
ছোটগল্পে মনুষত্যের প্রাণীর উপস্থিতিতে আসতে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য থেকে সূচনা করে ধাপে ধাপে লেখক সংস্কৃত সাহিত্য, প্রাকৃত সাহিত্য, লোককথা-উপকথা, প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যে মনুষ্যেতর প্রাণীর প্রসঙ্গ হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভকাল থেকে বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভবকাল পর্যন্ত সাহিত্যে মনুষ্যেতর প্রাণীর প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মনুষ্যেতর প্রাণীর অন্বেষণের সঙ্গে অনুসন্ধান করেছেন বাংলা ছোটগল্প ও তার বিষয়কেন্দ্রে মনুষত্যের প্রাণীকে। কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে এবং মানবিক সম্পর্কের আধারে মনুষ্যেতর প্রাণী হয়ে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় মনুষ্যেতর প্রাণীকে দেখেছেন তিনি। মনুষ্যেতর প্রাণীকেন্দ্রিক বাংলা গল্পের করেছেন আঙ্গিক এবং ভাষাবিচারও। প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে পৌঁছেছেন যথাযোগ্য সিদ্ধান্ত বা উপসংহারে।
এমন নয় যে বিষয়টি এই প্রথম পাঠকসমক্ষে এল, বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ বা তাদের অংশ হিসাবে কমবেশি উল্লেখ-আলোচনা নিতান্ত অপ্রতুল নয়। কিন্তু সেসব ধর্তব্যে এনেও, সম্পূর্ণ এই বিষয়টিকে উৎস থেকে মোহনা অবধি একটানা অবলোকন এবং বিশদ সেই দর্শনের সংহত নিটোল রূপদান অবশ্যই একটি বড় মাপের এবং অতি প্রয়োজনীয় কাজ হিসাবেই বিবেচিত হবে। বইটির অন্যতম বিশেষত্ব এইখানে যে মূল গল্পের কাহিনিকে ছুঁয়ে, তাতে মনুষ্যেতর প্রাণীর ভূমিকা তথা গল্পের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে তাদের লগ্নতা নিজস্ব বিশ্লেষণের সঙ্গে সঙ্গে বিশিষ্ট পূর্বমতকে প্রয়োজনে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন লেখক— এইরকম বইয়ের পক্ষে যেটা একান্তভাবেই স্বাভাবিক। বাংলা ছোটগল্পে মনুষত্যের প্রাণী সম্বন্ধীয় আলোচনায় বইটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যতিক্রমী এক সংযোজন। এজন্য শ্রী চট্টোপাধ্যায় ধন্যবাদার্হ হয়ে থাকবেন। বইটি তাঁর থেকে এমন আরও সুচারু প্রবন্ধগ্রন্থের প্রত্যাশা জাগায়।
এই প্রাবন্ধিককে একটি বিষয় জানাতে হচ্ছে। তারাশঙ্করের গল্পে নাগিনীকে মুসলমান চরিত্রের সিঁদুর পরিয়ে নিকা করার বিষয়টিকে তারাশঙ্করের ভুল হিসাবে তুলে ধরেছেন তিনি। এর সঙ্গে গভীর একটি সামাজিক অনুষঙ্গ জড়িয়ে রয়েছে। তারাশঙ্করের কালে কোনও কোনও বিবাহিত মুসলমান মহিলার মধ্যে সিঁদুর পরার প্রবণতা ছিল। আসলে এই মুসলমানরা তো মূলত ধর্মান্তরিত হিন্দু, তাদের অনেকেই পূর্ব অভ্যাস তখনও ত্যাগ করে উঠতে পারেনি। তারাশঙ্করের ছোটগল্পে মুসলমান রমণীর সিঁদুর পরার দৃষ্টান্ত আছে।
পুস্তকের নাম : বাংলা সাহিত্যে মনুষ্যেতর প্রাণীকেন্দ্রিক ছোটগল্পের ধারা
লেখকের নাম : বিক্রমজিৎ চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশকের নাম : বার্তা প্রকাশন
প্রকাশকাল : কলকাতা বইমেলা ২০২৩
মূল্য : তিনশত তিরিশ টাকা
=========================
আলোচক:
অরবিন্দ পুরকাইত
গ্রাম ও ডাক — গোকর্ণী
থানা — মগরাহাট
জেলা — দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন