নবদ্বীপের রাস : মহাপ্রভু চৈতন্যদেব থেকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র
বারিদ বরন গুপ্ত
ঠাকুরদা ঠাকুরমার মুখে ছোটবেলায় থেকেই নবদ্বীপের রাসের নানান গল্প শুনেছি! শুনেছি মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের এই লীলাভূমি নবদ্বীপ! কত মঠ মন্দির রয়েছে, সারাদিন কৃঞ্চ ভজনা চলছে! তেঘরি পাড়ার অধিকারীদের বাড়িতে বেশ কয়েক বার গেছি, ওদের জমি জায়গা দেখভাল সূত্রে বাবার সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল! কিন্তু ছোটবেলায় রাসে কখনো যাওয়া হয়নি, তাই একটা আক্ষেপ থেকেই গেছে। রাস এলেই ঠাকুরমা বলতেন --
"শান্তিপুরে করবো বাস
নবদ্বীপে দেখবো রাস"
পরে জেনেছি শান্তিপুর এবং নবদ্বীপ পাশাপাশি দুই শহরের রাস খুব বিখ্যাত! দুই জায়গায়ই বৈষ্ণব এবং শাক্ত রাসের প্রাধান্য থাকলেও, শান্তিপুরে এখনোও বৈষ্ণব মধুর রাসের যথেষ্ট কদর রয়েছে যেটা নবদ্বীপে আর তেমন নেই।
প্রাচীন বঙ্গ সংস্কৃতির পীঠস্থানের ঐতিহ্যবাহী রাস উপলক্ষ্যে নানান গল্পগাথা একসময় প্রবাদে পরিনত হয়েছিল। নবদ্বীপ যেমন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলা ভূমি, তেমনি এখানকার রাস উৎসব ও জগদ্বিখ্যাত। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রাচীন ধর্মীয় নগরী আজ মেতে উঠেছে, মণ্ডপে মণ্ডপে রকমারি প্রতিমা এবং আলোর রেশনায় ভরে উঠেছে, তবে একথা অনস্বীকার্য এই প্রাচীন উৎসবের শুরুটা মহাপ্রভু আড়ম্বরপূর্ণ বৈষ্ণবীয় মাধুরী মিশিয়ে রাঙিয়ে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে করলেও শেষ করেছেন কিন্তু নদীয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্র, বৈষ্ণবীয় ভাবধারার বিপরীতে শক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে।
গৌড়ের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে, যখন সমাজ সংস্কৃতির প্রচন্ড টানাপোড়েন চলছে সেই সময় এই নবদ্বীপ নগরে মহাপ্রভুর আবির্ভাব ঘটে, একেবারে সমাজ দার্শনিক ভঙ্গিতে তিনি সমাজের এই টানা পড়েন লক্ষ্য করলেন, কার্যকারণ ভিত্তিতে তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা করলেন, সত্যি কথা বলতে কি তুর্কি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে যখন সমাজের ভিত নড়ে গেছে, দীর্ঘ দিন সমাজের তথাকথিত উচ্চবর্ণের অনাদর অবহেলায় তিতিবিরক্ত হয়ে যখন তথাকথিত নিম্নবর্গ একে একে ইসলামের পদতলে আশ্রয় নিচ্ছে, দিশেহারা পথে সমাজ ছুটছে, সেই দিশেহারা সমাজ কে পথ দেখাতেই তার আবির্ভাব ঘটল এই নবদ্বীপ নগরীতে। সত্যি কথা বলতে কি চৈতন্যদেব যুগ সত্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো বুঝতেও পেরেছিলেন যে সমাজের বৃহত্তম অংশের যে ভাঙন দেখা দিয়েছে তাকে রোধ করতে হলে এমন একটা মতবাদ প্রচার করতে হবে যা সর্বজন গ্রাহ্য এবং সকলের আচরণীয় হয়ে উঠবে, সকলের সাথে মিলেমিশে প্রেম ধর্মের প্রচারই তার লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল, সমাজের সব শ্রেনীকে নিয়েই তিনি ভক্তি রসে মজে গেলেন, তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিম্ন বর্গ ছুটে এল, ধর্মান্ধকরণের স্রোত অনেক খানি বন্ধ হয়ে গেল, পাঠান সুলতানি শাসনে ধর্মীয় আচরণে যে বিধি নিষেধ ছিল তা অনেকখানি মুছে যাওয়ায় অনেক শাক্ত এবং তান্ত্রিকরা ও তার ধর্মের অনুরাগী হয়ে উঠেছিল! তবে এ কত সত্য যে শ্রীচৈতন্য এবং নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর পরবর্তীকালে বৈষ্ণব ধর্মেরও কিছুটা গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল যার প্রভাব হয়তো নবদ্বীপ রাসেও পড়েছিল! তাই সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই নবদ্বীপ ধীরে ধীরে শাক্তদের দখলে চলে আসতে থাকে!
নবদ্বীপে শাক্ত রাসের অন্যতম কারিগর ছিলেন নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র! অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই তিনি বাংলায় শাক্ত আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন, বাংলার নবাবদের সাথে এই রাজ পরিবারের সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না, রাজা রামকৃষ্ণ থেকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পর্যন্ত বেশ কয়েকবার রাজস্ব সংক্রান্ত বিবাদে জড়িয়ে পড়েছেন, আসলে বাংলার নবাবদের তাবেদারি এই রাজ পরিবার সহ্য করতে পারতেন না, তাই তাকে দু-দুবার মুর্শিদাবাদের নবাবী জেলে বন্দী থাকতে হয়েছে, নবাবদের সেই অনাচার অত্যাচারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গোপনে ইংরেজদের সাথে শালা পরামর্শ করেছেন, বলতে গেলে তখন বহু রাজা বা জমিদার নদীয়া রাজাদের অনেকখানি ভরসা করতেন এবং পরামর্শ নিতেন। যাহোক ১৭৫৬ সালের পর বাংলার শাক্ত আন্দোলনের তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, অগ্রদ্বীপ পাটুলি সহ বেশ কয়েকটি সমাজের তিনি সভাপতি ছিলেন, এই সময় পর্বে তিনি কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজো এবং নবদ্বীপের রাসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন, জামালপুরের বুড়োরাজ বা ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যার তিনি অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন! ঠিক এই সময় থেকেই নবদ্বীপের রাসের চরিত্র বদল হতে থাকে! বৈষ্ণব ভাবধারা ক্ষুন্ন হতে থাকে, তিনি রাধা কৃষ্ণের পূজার কোন আপত্তি না করলেও, চৈতন্যদেবের আরাধনা বা ভজনার বিরোধিতা করেছিলেন, যার ফলে চৈতন্য অনুরাগীরা তার সাহায্য বা সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল! অনেকেই বলবেন কেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র চৈতন্যদেবের আরাধনার বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ একটাই তখন নবদ্বীপ চৈতন্যদেব না থেকেও ছিলেন! এবং রাসে নিশ্চয়ই তার প্রভাব পড়েছিল! সবাই চৈতন্য দেব নিয়ে মেতে ছিলেন, এটা তার কাছেই বিরক্তির বা ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠেছিল, সবাই তার নাম করুক, তার মত এবং আদর্শ প্রচার করুক, এটাই তিনি চেয়েছিলেন, তাই মহাপ্রভুর শক্ত ঘাঁটিতে এসে, ভাগ বসাতে না পেরে চৈতন্য অনুরাগীদের বিরোধিতার নেমেছিলেন।
অনেকের মতে নয়টা দ্বীপের সমষ্টি নবদ্বীপ! অন্তদ্বীপ, সীমান্ত দ্বীপ, গোদ্রুমদ্বীপ, মধ্যদীপ, কোলদ্বীপ ঋতুদ্বীপ, জহ্ণুদ্বীপ, রুদ্রদ্বীপ, এই দ্বীপগুলো হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, ভাগীরথীর ভাঙা গড়ার খেলায়, বারে বারে দিক পরিবর্তনের ইতিহাসে, হয়তো ভৌগোলিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, গড়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন নামের জনপদ। মহাপ্রভুর জন্মস্থান বর্তমানে ভাগীরথীর গর্ভে, তা না থাক! অন্তদ্বীপ কিন্তু নবদ্বীপ কে বাঁচিয়ে রেখেছে, যদিও ভাঙা গড়ার খেলার হাত থেকে পুরোপুরি রক্ষা পায়নি! নবদ্বীপ
যেমন বৈষ্ণব তীর্থের লীলাভূমি তেমনি তান্ত্রিক ও শক্তি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে একসময় বিশেষ পরিচিত ছিল এই অন্ত দ্বীপেই এক সময় তাবড় তাবড় তান্ত্রিক, ন্যায় ও স্মৃতি শাস্ত্রের পন্ডিতদের বাস ছিল। সেন যুগের পরবর্তীকালে বাংলার তান্ত্রিক ন্যায় ও স্মৃতি শাস্ত্রের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল প্রাচ্যের এই অক্সফোর্ড! তার প্রভাব তো পড়বেই রাসের মতো বড় মাপের অনুষ্ঠানে!
রাস মূলত রাধা কৃষ্ণের ব্রজলীলার বৈষ্ণবীয় ভাবধারার এক ধর্মীয় উৎসব, বলা যায় ভক্ত ও ভগবানের মিলন উৎসব। শ্রীচৈতন্যদেব প্রেমের ঠাকুর কৃষ্ণের সাথে ভক্তদের মধুর সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন রাধা ও কৃষ্ণের মধুর সম্পর্কের সাথে ভক্তরাও মেতে উঠুক, বৃন্দাবনে কৃষ্ণ ষোড়শ গোপীনির সাথে যে রসো লীলা উৎসবে মেতে ছিলেন তাহাই হয়তো রাস উৎসবের পটভূমিকা তৈরি করেছিল! অনেক পন্ডিতের মতে নবদ্বীপে ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে এই উৎসব সূচনা করেছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। তাই শ্রীচৈতন্যের সময়কালে বা তার পরবর্তী সময়েও এই রস যা থেকে রাসের উৎপত্তি তাই ছিল নবদ্বীপের রাসের অন্যতম বিষয় । তবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর তিরোধানের পর রাসের জৌলুস কমতে থাকে! হয়তো চৈতন্যদেবের পরবর্তী কালে এক সময় বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধের বা মতবিরোধ দেখা যায়! তবে এ কথা সত্য শ্রীচৈতন্যদেবের সময় পর্ব থেকেই নবদ্বীপের বিভিন্ন মন্দির, মঠ, আখড়াগুলিতে কৃষ্ণ রাধার লীলা সম্পর্কিত নানা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হতে থাকে, নানান রকম পট মঠ আখড়া মন্দিরগুলিতে শোভা পেত, কখনো কখনো বড় কাঠের চাকার চারপাশে সখি বেষ্টিত হয়ে কৃষ্ণ রাধা শোভা পেত, এই চাকা কে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দৃশ্যপট দেখানো হতো, তাই একে চক্র রাস বলা হয়।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে নবদ্বীপ যেমন বৈষ্ণবতীর্থের লীলাভূমি ছিল, তেমনি শাক্ত তান্ত্রিক ধর্মের ও যথেষ্ট প্রভাব আগাগোড়া ছিল,প্রাক চৈতন্য পর্বে বিশেষ করে সেন যুগের মধ্যভাগ থেকেই তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম বিকশিত হতে থাকে! নবদ্বীপ দাঁইহাট কাটোয়া সহ ভাগীরথী বিধৌত অঞ্চল গুলিতে তান্ত্রিক এবং কাপালিকদের প্রভাব বাড়তে থাকে! তাই চন্ডী মনসা রুদ্ররূপী ভৈরব, আদ্যা শক্তির উপাসনার ক্ষেত্রে হিসেবে এসব অঞ্চল গুলি পরিচিত হতে থাকে! তাই প্রাক চৈতন্য পর্বে নবদ্বীপ দাঁইহাট প্রভৃতি অঞ্চলগুলিতে এর প্রভাবকে কোনমতেই অস্বীকার করা যায় না! আমরা মধ্যযুগের অন্যতম কবি চৈতন্য জীবনীকার চৈতন্যভাগবত প্রনেতা বৃন্দাবন দাসের কাছ থেকে প্রথম এই সংবাদটা পাই! "ধর্ম কর্ম লোকে এইমাত্র জানে, মঙ্গলচন্ডীর গীত করে জাগরণে!' কিছু নাহি জানে লোক ধন পুত্ররসে, সকল পাষন্ড মেলি বৈষ্ণবেরে হাসে!" এই পাষণ্ড, পাষন্ডীরা শক্তির উপাসক ছাড়া আর অন্য কেউ নয়, এটা ধরে না যেতে পারে। তাই চৈতন্য এবং চৈতন্য পরবর্তী কাল শাক্তরা নবদ্বীপে বৈষ্ণবীয় ভাবধারাকে কোন ঠাসা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি চৈতন্য মহাপ্রভুর তিরোধানের পর শাক্তধর্মের প্রাধান্য বাড়তে থাকে, কমতে থাকে বৈষ্ণবীয় ভাবধারা। কথিত আছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র শাক্তধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তার পৃষ্ঠপোষকতার ফলে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে নবদ্বীপে শাক্ত রাসের প্রাধান্য বাড়তে থাকে এবং বৈষ্ণবীয় ভাবধারা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে, তবে এখনোও প্রাচীন মঠ মন্দিরগুলোতে চক্র রাস দেখতে পাওয়া যায়, হয়তো আগের চেয়ে সংখ্যা ও অনেক কমে গেছে!
উল্লেখ করা যায় যে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার টোল সংখ্যা বাড়তে থাকে, প্রথিতযশা সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতের পীঠস্থান হয়ে ওঠে নবদ্বীপ, পুরোহিত স্মৃতি -ন্যায় ,তন্ত্রের চর্চা বাড়তে থাকে, শোনা যায় এই সমস্ত স্মৃতি ন্যায় তন্ত্রের পারদর্শী পণ্ডিতেরা মহালয়ার পর বেরিয়ে পড়তেন সম্পন্ন যজমান, জমিদার গৃহে দুর্গাপূজা কালীপূজা ইত্যাদি করার জন্য, ফিরতেন একেবারে কার্তিকের শেষ পর্বে, তারপর বাড়ি ফিরে কালী শিব প্রভূতি দেবতার ঘটে পটে পূজা সারতেন, ধীরে ধীরে তাদের এই পূজা অর্চনা উৎসবে রূপ নেয়, এই উৎসবের কথা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কানে পৌঁছায়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র শাক্তধর্মের অনুরাগী ছিলেন, তিনি তাদের মূর্তি তৈরি করে উৎসব করার অনুপ্রেরণা দেন, এমন কি পৃষ্টপোষকতা করেন বলে জানা যায়,এই সময় থেকেই রাসে বাড়তে থাকে কালী মহামায়া প্রভৃতি শাক্ত দেবী! সেই শুরু বর্তমান শাক্ত রাসের আধিপত্যের পটভূমিকা!
শোনা যায় এই সময় পর্বে তাঁর সভা পন্ডিত শংকর নাথ তর্কবাগীশ নবদ্বীপের দেয়ারা পাড়ায় তান্ত্রিক মতে এলানিয়া কালী পূজা শুরু করেন, মনে করা যেতে পারে যে এই পূজা থেকেই বর্তমান রাসে কালী প্রতিমার সূচনা, তাছাড়া মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নবদ্বীপের চরিচারপাড়ার ভদ্রা কালী পূজার সূত্রপাতের সাথে জড়িয়ে ছিলেন, এই উদ্দেশ্যে তিনি বেশকিছু জমি দান করেন বলে জানা যায়। আসলে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আসল উদ্দেশ্য ছিল নবদ্বীপে প্রশ্ন তথা চৈতন্যদেবের ভাবধারাকে কোণঠাসা করে তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করা, সেই জন্যই তিনি বৈষ্ণবের বিপরীতে শাক্ত আন্দোলনকে নবদ্বীপে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। যার প্রভাব আমরা আজকে নবদ্বীপের রাসে দেখতে পাচ্ছি, যে মধুর রস থেকে রাসের উৎপত্তি, তার ছিটেফোঁটাও নেই আজ নবদ্বীপে।
উল্লেখ করা যায় যে প্রথম দিকে রাসের প্রতিমা বাসের মঞ্চে তৈরি করা হতো, শোনা যায় সেই সময় পর্বে শোভাযাত্রা সহকারে সমস্ত মূর্তি পোড়ামা তলায় আনা হতো, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন, মৃৎশিল্পীদের পুরস্কার এবং উৎসাহ দিতেন বলেও জানতে পারা যায়। আজ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নেই, কিন্তু আছে কার্নিভাল অনুষ্ঠান, সরকার এবং পৌরসভার উদ্যোগে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
আজ নবদ্বীপে প্রায় ছয়শোর কাছাকাছি রাসের প্রতিমা হয়, বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বৈষ্ণবীয় রাসের প্রাধান্য ছিল! তারপর ধীরে ধীরে কমতে থাকে! স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে রাসে উৎসবে রঙ চড়তে থাকে, উৎসব ধীরে ধীরে বারোয়ারি রূপ নেয়, মনে করা যেতে পারে যে এভাবেই পোড়ামা তলা, তেঘরিপাড়া, বিন্দুবাসিনী পাড়া, মালঞ্চ পাড়া, রাম সীতা পাড়া, বুড়োশিবতলা প্রভৃতি জায়গায় বারোয়ারি রাস শুরু হয়। এইভাবে ধীরে ধীরে প্রায় গোটা নবদ্দীপ জুড়ে রাসের আয়োজন চলতে থাকে, বাড়তে থাকে প্রতিমার সংখ্যা এবং আনুষঙ্গিক উপকরণ।
তবে একথা সত্য যে স্বাধীনতার পরবর্তীকালে রাসের চরিত্রের বদল ঘটতে থাকে, রাসে শুরু হয় আধুনিকতার ছোঁয়া, সাবেকি ধ্যান ধারণা বদলাতে থাকে, মূর্তির আকার বাড়তে থাকে। উল্লেখ্য এই সময় পর্বে বেশকিছু ক্লাব এবং সংঘ গড়ে ওঠে, পূজার দায়িত্ব পড়ে তাদের উপর, স্বাভাবিকভাবে নতুন প্রজন্মের হাতে রাসের আচার অনুষ্ঠান, প্রতিমা, কারুকার্য সবেতেই আধুনিকতার রূপ ফুটে ওঠে, রাস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়! কিন্তু প্রাচীন বৈষ্ণবীয় মধুর রস নবদ্বীপের রাসে আর কতদিন টিকে থাকবে তা হয়তো ভবিষ্যতেই বলবে! সবশেষে বলি বেঁচে থাক প্রাচীন বাংলার লোকসংস্কৃতি রাস উৎসব এবং তাকে ঘিরেই সামনের দিকে এগিয়ে চলুক এই প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত শহর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নবদ্বীপ।।
===============
বারিদ বরন গুপ্ত, মন্তেশ্বর, পূর্ব বর্ধমান, সমাজ সংস্কৃতির গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন