Featured Post
গল্প ।। খেয়ালী বনেদিয়ানা ।। দীপক পাল
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
খেয়ালী বনেদিয়ানা
দীপক পাল
বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। এক দুর্গা অষ্টমীর দিন বিকেলবেলা বন্ধু মৃণাল এসে বলে,
- ' চল, তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।'
- ' সেকি রে, আজ এই অষ্টমী পুজোর দিন বন্ধুবান্ধব ছেড়ে কোথায় যাব?'
- ' বাগবাজারের এক বন্ধুর পুরনো বনেদি বাড়িতে আজ আমার নিমন্ত্রণ আছে। আমি বলেছি আমার এক বন্ধুকে নিয়ে আসবো। তাতে তিনি খুব খুশী হন এবং সাগ্রহে আমন্ত্রণ করেন। বন্ধুর নাম জগৎবন্ধু চ্যাটার্জী। তার পূর্ব পুরুষ জমিদার ছিল। এখনও বাগবাজারের পুজোতে ওরা ভালো চাঁদা দেয়। সে দিক দিয়ে জগৎ দা জমিদারের উত্তর পুরুষ।'
জমিদার বাড়িতে কিছুক্ষণ কাটাবার ইচ্ছে থাকায় চটপট রেডী হয়ে যখন বেরোলাম তখন ৪টে বেজে গেছে। যেতে যেতে মৃণালের কাছে শুনলাম বাড়ীর সবাই কাশ্মীর বেড়াতে গেছে, খালি জগৎদা আর জগৎদার পরের ভাই শরৎ, আর দুজন লোক ওই বাড়ীতে থাকে। আমরা যখন বাগবাজারের মোড় পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। জগৎ বাবু সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে উত্তর কলকাতার বাড়ীর বারান্দায় আড্ডা মারছেন। বাগবাজার পূজোর ভিড় ও রাস্তার দুপাশে দোকানিরা নানা পসরা সাজিয়ে বসেছে। একেবারে জমজমাট একটা ব্যাপার। উত্তর কলকাতার বাড়ীর বারণ্ডাগুলোতেও চলছে জমাটি আড্ডা। তারই একটা বারান্দা থেকে ভেসে এলো একটা ডাক।
- 'এই যে মৃণাল এসেছিস, আয় আয় এখানে বস। ইনি তোর সেই বন্ধু বুঝি যাকে নিয়ে আসার কথা বলেছিলি তুই?'
মৃণাল বলে,
- ' হ্যাঁ এর কথা বলেছিলাম, এর নাম দীপ্তেন। দীপ্তেন, ইনি আমাদের সবার প্রিয় জগৎদা।"
আমরা পরস্পর নমস্কার বিনিময় করলাম। জগৎ বাবু বললেন,
-' জানেন দীপ্তেনবাবু, বাবা সবাইকে নিয়ে কাশ্মীর বেড়াতে গেছে। আমাদের দুই ভাইকে জোর করে কাশ্মীর বেড়াতে নিয়ে যাবে। বলুন তো, কলকাতার পূজো ছেড়ে কোথাও যাওয়া যায়? বিশেষত এরকম পাড়া ছেড়ে, বলুন একবার। তাছাড়া ওখানে গেলেই বাবার আন্ডারে বা শাসনে, বলবে এই করিস না সেই করিস না। পুজোটাই হবে মাটি। আমি আর ভাই শরৎ বলে দিয়েছি আমরা এখানেই থাকবো, বাড়ি পাহারা দেব।'
অবাক হয়ে গেলাম ওনার এই অচেনা একজনের কাছে প্রথম আলাপেই এসব কথা বলা। বুঝতেই পারা যায় না তিনি আগেকার সময়কার জমিদারের উত্তর পুরুষ। অতি সরল মানুষ। এরপর মৃণালের দিকে তাকিয়ে বললেন,
- ' জানিস মৃণাল, এই বারান্দায় সকাল বিকাল বসে এই পুজোর দিনগুলোর আড্ডাটা যা জমে না কি বলবো তোকে। এখন চল ভেতরে লোক পাঠিয়েছি বিলিতি আনার জন্য। আজ অষ্টমী সব দোকান বন্ধ বুঝলি? তাই দুজনের বাড়ীতে যাবে বিলিতি আনার জন্য। তারা এখুনি এসে পড়বে।'
সদর পেরোতে দুপাশে সিমেন্টের বসার সিট।ওটা পেরোলে দুপাশে টানা বারান্দা। দুটো করে সিঁড়ি আছে বারান্দায় ওঠার। সামনে মস্ত উঠোন। তারপর অন্দরমহল। আগে জগৎবাবু ও মৃণাল বারান্দায় উঠলো। আমি ও সদ্য পরিচিত বরেন বাবু উঠলাম মামুলি গল্প করতে করতে পেছন পেছন। বরেন বাবু মাঝবয়সী লোক। একেবারে ধব ধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পড়েছেন। জগৎ বাবু সুন্দর কাজ করা রঙিন পাঞ্জাবী মানানসই পাজামা পড়েছেন। একদম শেষ ঘরের দরজা খুলে জগৎবাবু আসতে বললেন। ঘরে ঢুকে একটা কেমন মিষ্টি গন্ধ পেলাম। বোধহয় কোনো দামী সুগন্ধী স্প্রে করা হয়েছে ঘরে। মেঝেতে দামি কার্পেট পাতা, জানলায় দামি পর্দা, একটা মাত্র খাটে দামি বেড কভার পাতা। দেওয়াল আলমারীতে কত রকমের পান পাত্র, সসেজ, কফি কাপ থরে থরে সাজানো। সবই খুব দামী। ড্রেসিং টেবিলে জগৎ বাবু ও তার স্ত্রীর যুগল ফটো, ব্যাক গ্রাউন্ডে সমুদ্রচ্ছাস একটা সুন্দর ফটো এলবাম সাজানো। টেবিলের ওপর 555 ও Wills এর প্যাকেট। সব মিলিয়ে ঘরের কর্তার রুচির একটা ছাপ স্পস্ট বোঝা যায়।
একটু পরে দুজন লোক এসে ' জগৎদা ' বলে ডাকতেই উনি দরজার কাছে গেলেন। তারপর শুনলাম,
- 'দুজনের বাড়ীতেই তালা দেওয়া। এখন কি করবো? বাংলা আনব?' জগৎ বাবু বললেন,
- ' খুব হতাশ করলি তোরা। ওদিকে Statesman এর সাংবাদিকও আসবে। গেস্টদের কাছে আর মান থাকলো না আমার। যা নিয়ে আয়।'
জগৎবাবু ফিরে দাঁড়াতেই বরেনবাবু উঠে পড়লেন। বললেন,
- ' এবার আমাদের উঠে অন্য ঘরে যেতে হবে।'
সবার সাথে আমিও উঠলাম। দরজায় তালা দিয়ে আমাদের উল্টো দিকের বারান্দায় উঠতে হল। বারান্দায় উঠে প্রথম দরজার তালাটা খুলে জগৎ বাবু ও বরেন বাবু ঢুকলেন আগে। আমি ও মৃণাল ঘরে পা দিয়েই হতবাক হয়ে গেলাম। কি বৈপরীত্য দুটো ঘরের মধ্যে। দরজা খুললে প্রথমে চোখে পড়ে একটা বড়ো কালী মূর্তির উপরের অংশ। বাকিটা নিচে। ঘরের এককোনে একটা কাঠের মজবুত সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে। সবাই একসাথে 'জয় মা কালী' বলে জয়ধ্বনি দিল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো একে একে। আমিও নামলাম। 'মা কালী' জয়ধ্বনিতে মুখরিত হলো। নিচে নেমে দেখি দুটো সাধারণ বড়ো শতরঞ্চি পাতা হয়েছে। ঘরের বাম দিকের দরজার গায়ে একটা খুব নিচু টেবিল পাতা, যার তিনটে পায়া থাকলেও একটা পায়া নেই। সেটা একটা আদলা থান ইঁট দিয়ে সমান করা। টেবিলের ওপর দু বান্ডিল বিড়ি, দেশলাই আর আছে কয়েকটা খালি কাঁচের গ্লাস উপুড় করা। এছাড়া আর কোনো আসবাব নেই এই ঘরে। সেই লোক দুটো কাঁধের ব্যাগে করে দেশী বোতলগুলো নামিয়ে রাখলো। আর একটা ব্যাগ না খুলে দেওয়ালের গায়ে নামিয়ে রাখলো। এবার বুঝলাম জগৎ বাবুর স্বাধীন থাকা ও কাশ্মীর না যাওয়ার কারণ। ঘরের বাইরে শরৎ বাবু দাঁড়িয়ে। মৃণাল আমার কানে কানে বললো সে নাকি মদ খায়না। তাই ঘরে ঢোকে না। কিন্তু ওখানে দাঁড়িয়ে কার কি লাগে তার তদারকি করে। জগৎ হঠাৎ বললেন, 'আসুন আসুন এদিকে আসুন। আজ ওদিকে হয় নি। '
দুজন সুশ্রী সুবেশে ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে সবার উদ্দেশ্যে নমস্কার জানালেন। জগৎবাবু বললেন,
- ' সত্যেন বাবু আপনাকে ধন্যবাদ। সব কাজ ফেলে এখানে আসার জন্য। আপনার ও এই দীপ্তেনবাবুর জন্য বেস্ট কোয়ালিটির ইলিশ মাছ এনেছি।'
- ' আর আপনারা কি খাবেন?'
- ' আমাদের জন্য মাটন আছে।'
- ' আর আমরা মাটন থেকে বঞ্চিত?'
- ' আরে আরে তা কেন হবে? মাটন সবার জন্য।'
এদিকে বরেন বাবু সব গ্লাসগুলোতে লিকার ঢালতে লাগলেন। খালি একটা গ্লাসে অর্ধেক ঢাললেন আমার অনুরোধে। কিন্তু তারপরেও আরও চমক বাকি ছিল। বরেন বাবু একটা বোতল থেকে হাতের তালুতে একটু লিকার ঢেলে মা কালীর দিকে ঘুরে ওই কারণবারি মা কালীর উদ্দেশ্যে ছিটিয়ে ছিটিয়ে মন্ত্রচ্চারণ করতে লাগলেন। সবাই হাত জোড় করে আছে। তারপর পর্দাটা পুরোটা টেনে দিলেন। ভাবছি, মা কালী কি খালি ওখানেই সীমাবদ্ধ আছে? তারপর চিয়ারস বলে সবাই গ্লাসে চুমুক দিল। আমি মুখে দিয়েই একটা বিকট গন্ধে গ্লাসটা নিচে রাখলাম। জগৎবাবু শরৎকে একটা কোকাকোলা আনতে বললো। কিন্তু বরেন বাবু বললেন, ' ওসব কিছু লাগবে না। একটা পাতিলেবু আর বিট নুন আনতে হবে। লেবুটা কেটে আনতে হবে।'
শরৎবাবু অন্দরে ঢুকে সব নিয়ে আসলো। বরেনবাবু ওই লেবুটার রস গ্লাসে ঢেলে আর একটু বিট নুন মেশাতে বললেন। আমি তাই করে সবার উৎসাহে মুখে তুললাম এবং দুটুকরো ইলিশ মাছ ভাজার সাথে গ্লাসটা শেষ করে বিদায় নিলাম সবার থেকে। মৃণাল আমার সাথে সাথে বেরবার উপক্রম করতেই জগৎবাবু বললেন,
- ' এই ভর সন্ধ্যায় তুইও চললি নাকি? '
- ' ওকে কথা দিয়েছিলাম সাড়ে আটটার মধ্যে ফিরে আসবো পাড়ায়। এখানেই তো সাড়ে ৮টা বেজে গেল।'
- ' কালীপূজোতে ওনাকে নিয়ে আসবি কিন্তু।'
- ' আচ্ছা চেষ্টা করবো এখন আসি।'
দমবন্ধ পরিবেশ ছেড়ে বড়ো রাস্তায় এসে নামলাম উচ্ছাসিত মানুষের মাঝে। মনটা নেচে উঠলো এবার নিজেদের চেনা পাড়ায় চেনা বন্ধুদের কাছে ফিরে যাচ্ছি বলে।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন