নিভা মাসীর বয়স এখন একশো তিন বছর। একসময়ের ফরসা গায়ের রঙ আজ কালিবর্ণ। শক্ত পোক্ত গড়ন ছিল একসময় । বাঙলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে দশ বছরের ছোট ভাইয়ের হাত ধরে কলকাতায় যখন এলেন তখন বিধ্বস্ত অবস্হা। 1947 সালে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হল, বাবা মা খুন হলেন, নিভা মাসী ধর্ষিতা হলেন। ভেবেছিলেন আত্মহত্যার কথা , কিন্ত স্কুলের গীতা দিদিমনি র কথা মনে গেঁথে গিয়েছিল, " এ জীবন অমূল্য, জীবনে যাই হোক , যেমন করে হোক, বাঁচতে হবে ! আত্মহত্যা মহাপাপ !" যে মানুষটার সঙ্গে বিয়ের কথা চলছিল সে অস্বীকার করল, ধর্ষনের দায় নিভা কে ই নিতে হল। বাংলাদেশের মাটি ছাড়তে বাধ্য হলেন।
ছোট ভাইটার করুণ মুখ চেয়ে ভাবলেন তাকে নতুন করে বাঁচতে হবে। অনেক ঝড় ঝন্ঝা উপেক্ষা করে বারো বছরের ভাইয়ের হাত ধরে কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশনে এসে পৌঁছলেন। সেখানে সাধু মহারাজদের দয়ায় আশ্রয় পেলেন। বছর খানেক কোনও মতে আশ্রমে দুটো খেতে পেয়ে, মাথা গোঁজার জায়গা পেয়ে , দিন কাটল। ভাইবোন মিলে যে কোনও কাজ করতে লাগলেন আশ্রমের। নিভা মাসী আই এ পাশ করেছিলেন। ভাই এর মিশনের স্কুলে ভর্তির সুযোগ হল। বড় মহারাজ বললেন, " নিভা, আমাদের নারীসেবা মিশন খোলা হয়েছে এন্টালীতে। তোমাকে সেখানে যেতে হবে। সেখানে তোমার জন্য অনেক কাজের সুযোগ আছে। তোমার ভাই আমাদের আশ্রম স্কুলে যেমন পড়ছে, পড়ুক। "
মহারাজের কথা শিরোধার্য করে নিভা চলে গেলেন এন্টালী আশ্রমে।
নিভা এতদিন পরে একটু নিজের দিকে চাইতে শিখলেন। প্রব্রাজিকা মহাপ্রাণা র অনুগত সাথী নিভা বাঁচতে শিখলেন। পুরুষ বিদ্বেষ নিভার মনে যে বিষ জমা করেছিল তা থেকে একটু একটু করে নিস্কৃতি পেলেন। পুরুষের সঙ্গ ছাড়াও জীবন কাটানো যায় । নিপীড়িত, দুস্হ মহিলাদের সহায় হয়ে উঠলেন। মিশনের অফিস চালানোর সব দায়িত্ব নিতে শিখলেন।
ভাই স্কুল পাশ করল, কলেজেও গেল। গ্র্যাজুয়েশনের পরে চাকরী পেল রেলের কম্পানীতে। ভাইয়ের ভাল একটি মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিলেন।
ভাই গড়িয়াতে জমি কিনে যখন বাড়ী করল, দিদিকে এসে বলল, " সারাজীবন অনেক কাজ করেছ, এবার ছুটী নাও। আমাদের সাথে থাকবে চলো।" ভাই এর ছেলে মেয়েরা পিসি কে যেমন ভালবাসে তেমনি ভয় পায়। ভাই এর বউ অনিমাকে বুঝে উঠতে পারেন নি নিভা। সে কি খুশী হবে যদি তিনি ওদের সাথে থাকতে চান?
ভাই কে বললেন, " যতক্ষণ শরীরের শক্তি আছে, মিশনেই থাকব । একেবারে অক্ষম হলে যাব তোদের কাছে।"
আশি বছর বয়স যখন হল, বুঝলেন আর ভাল লাগছেনা । মিশনের পরিবেশ ও আর আগের মত নেই। অনেক নতুন লোক যোগ দিয়েছে। নতুন প্রব্রাজিকা তাকে ছাড়তে পারলেই খুশী হন যেন !
ভাই এর বাড়ীতে এসে উঠলেন। বছর দুই দিব্যি কাটল। হঠাৎই একদিন ভাইয়ের হার্ট অ্যাটাক এবং মৃত্যু হল।
কত ছোট ভাই, বাহাত্তর বছরে চলে গেল। ভাই এর দুই ছেলে আর এক মেয়ে।
এখন এই বাড়ীতে নিভা থাকেন পেছন দিকের একটি ছোট ঘরে। বাড়ীতে লোক অনেক। দুই নাতি, তাদের বউ, ছেলে মেয়েরা দুটো ঘরে থাকে। নাতনি বিয়ের পরে চলে গেছে দিল্লী। ভাই এর বউ থাকে বাড়ীর সামনের দিকের একটা ঘরে, যেটা আগে বসার ঘর ছিল।
নাতিরা ভাল, নাত বৌরা ও তাকে মেনে নিয়েছে। নিভা মাসীর রান্নার হাত খুব ভাল ছিল। এমনকি দশ বছর আগে পর্যন্ত ও বাড়ীর সবাই কে ভাল মন্দ রেঁধে খাইয়েছেন।
ব্যাক্তিত্বময়ী নিভাকে এ বাড়ীর সবাই সমীহই করে।
আজকাল ছোট ছোট কারণে এদের সবার ওপর কখনও অভিযোগ অভিমান করেন। নাত বউ দের রান্না পছন্দ না হলে না খেয়ে থাকেন। কেউ সাধ্য সাধনা করেও খাওয়াতে পারেনা তখন। এখন বৃদ্ধ বয়সে তিনি সত্যিকার কাছের মানুষের অভাব বোধ করেন। জীবনের অনেক অপূর্ণতার জন্য ঠিক আক্ষেপ বোধ করেননা তবে একটা বেদনা মনের গভীর থেকে উঠে এসে বলে, " জীবনে কি পেলে তুমি ?"
নিভা মাসীকে যম দেব দেখতে কেন পাচ্ছেনা, একথা বলতে বলতে নিজের কপাল চাপড়ান। ভাই বউ অসুস্থ হয়েছে, হয়তো সেও তার আগেই চলে যাবে কিন্ত নিভা মাসীর কাছে মৃত্যুর দূত আসেনা। শতাব্দী পার হয়ে যায়।