Featured Post
নিবন্ধ ।। চিঠিপত্রের ইতিহাস ।। বাণীব্রত গোস্বামী
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
'মনে পড়ে যেন এক কালে লিখিতাম চিঠিতে তোমারে প্রেয়সী অথবা প্রিয়ে।’
সেই চিঠি আজ হারিয়ে গেছে। হলুদ, সবুজ পোস্টকার্ড, অথবা কত যত্নে লালিত বন্ধ খামে ভাঁজ করা কাগজে যে সম্পর্কগুলো বেঁচেছিল, আজকের আধুনিকতা সেইসব আত্মীয়তাকে মলিন করে দিয়েছে। তাতে আঙুলের ছোঁয়া থাকত। কতদিন ধরে কত হাত ঘুরে একটা খবর বা একটু প্রেম, ভালোবাসা, বা শ্রদ্ধা; বয়ে নিয়ে যেত কয়েকটা কালির অক্ষর, তাতে গতির মন্দন ছিল, কিন্তু আবেগ ছিল ভরপুর। কেউ হাতে পেয়ে প্রণাম করতো, আবার কেউ গোপনে রেখে দিত বুকের ভেতর। আজকে বার্তা বহন তরান্বিত হয়েছে, শুধু তার ভেতর কোন প্রাণ নেই।
সেবার হরিদ্বারে গিয়ে পৌঁছোনোর সব খবর জানিয়ে মা চিঠি দিয়েছিল ঠাকুমাকে। সেই চিঠি আমরা ফিরে আসার পর মায়ের হাতেই পোস্টম্যান দিয়ে গেল। এটা খুব ছোট মজা। কিন্তু আজকের দিনে দূর্লভ। মুঠোফোন চিঠিকে হত্যা করেছে।
বিজয়ার পর পোস্টকার্ডের বান্ডিল নিয়ে আসত বাবা। তখন আমার পূজোর লম্বা ছুটি। দুপুরের একফালি রোদে বারান্দায় যেখানে মায়ের বড়ি শুকোতো, তার নীচে মা পিঠে খোলা চুল মেলে দিয়ে, সবাইকে বিজয়ার প্রণাম জানাতে লিখতে বসতো। নীচে একটু জায়গা খালি রাখতো আমার জন্য। আমি আবার দুলাইন লিখে দিতাম। সেটার আবার বেশ একটা মিষ্টি বয়ান ছিল। মা শিখিয়ে দিয়েছিল। এখন হয়তো ভুল হয়ে যাবে। বহুদিন কাউকে চিঠি লেখাই হয়নি। প্রণাম মিষ্টি সবই মুঠোফোনের আন্তর্জালে জড়িয়ে গেছে। ‘এইচ.বি.ডি.’ আর 'আর.আই.পি. । এই দুইয়ের সীমাবদ্ধতায় ব্যস্ত জীবন।
এই চিঠি নিয়ে তো একবার ভয়ঙ্কর কান্ড হয়েছিল। সে একেবারে পত্রবিভ্রাট। আমার মেমারির পিসির, পুকুর, বাগান, গোয়াল, নিয়ে অনেক বড় বাড়ি। হাঁস মুরগি কী নেই! পিসির মেয়ে মান্টি, পিসির হয়ে চিঠি লিখে দিত। তখন বেশীরভাগই এরকম হতো। অনেক মহিলাই ভাল লিখতে পারতো না। সেই সব চিঠিতে কেউ বাদ পড়তো না। শুধু মানুষের খবর থাকতো, এমন নয়। গোরুর বাচ্ছা হলে, কেমন বাচ্ছা? কী রঙ? এঁড়ে না বকনা? হাঁস মুরগির গল্প। পুকুরের মাছের কথা। মাঠের ফলন, গাছের আম, কাঁঠালের বর্ণনা, কিছুই বাদ যেত না সেইসব পত্রসাহিত্যে। আজ সেসব সংগ্ৰহ করে রাখলে, সে এক ঐতিহাসিক দলিল হতো। যাইহোক, পিসির বোধহয় সেদিন কোন কারণে, সংসারের অত কাজের চাপে মেজাজ খারাপ ছিল।
মান্টি জিগেস করেছিল, “ ও…. মা, তোমার কথা কী লিখব?”
পিসি রেগে বলেছিল , “ মা মরে গেছে লিখে দে।”
বুঝতে পারেনি মেয়ে সাতপাঁচ না ভেবে লিখে দেবে।
সেই চিঠি পেয়ে আমরা তো আকাশ থেকে পড়লাম। দল বেঁধে কাঁদতে কাঁদতে পিসির বাড়ি ছুটলাম। দুদিন থেকে হৈ হৈ করে বনভোজন সেরে বাড়ি ফিরলাম। আজ সেসব বিপদের সম্ভাবনা নেই। কিন্ত মনের মণিকোঠায় মান্টির সেই চিঠি, দাগ কেটে দিয়ে গেছে।
কবি’র কথাতেই সে যুগের ছবি ভেসে ওঠে, ‘কত চিঠি লেখে লোকে, কত সুখে প্রেমে আবেগে স্মৃতিতে, কত দুঃখ ও শোকে’। আমরা আমাদের দেশে পত্রপ্রেমের প্রথম উদাহরণ পাই কবি কালিদাসের লেখায়। মেঘের খামে তিনি মনের কথা পাঠিয়েছিলেন। তবে আধুনিক মানুষ চিঠি না লিখলেও, ভাবটা ধরে রেখেছে। তাই তার কথায় এখনও ফুটে ওঠে, ‘ভালো আছি, ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখো’। কিন্তু চিঠি-ও ক্রমশ টেলিগ্ৰামের মত বিলুপ্তির পথ ধরেছে। হয়তো মানুষ একদিন যাদুঘরে কাঁচের ঘরে থরে থরে রাখা চিঠি দেখতে ভিড় করবে।
খ্রীষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয়ান অঞ্চলে প্রথম পিক্টোগ্ৰাম বা ছবির মাধ্যমে খবর আদানপ্রদান করা চালু হয়। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে মিশরীয়রা হায়ারোগ্লিফিক্স লেখন পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এটাও ছবি, তবে প্রতীকী এবং সংক্ষিপ্ত, সাংকেতিক, সময়সাপেক্ষ। এর মাধ্যমে বাক্য গঠন করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এই পদ্ধতিতে সংবাদ প্রেরণ করলে বহুক্ষেত্রেই তা ভিন্ন অর্থ বহন করত। পরবর্তীকালে এর থেকেই দ্রুতগতি সংবাদ প্রেরণ মাধ্যম ‘হায়ারাটিক স্ক্রিপ্ট’ জন্ম নেয়। তবে পৃথিবীর প্রথম প্রেমের চিঠি, খ্রীষ্টপূর্ব ২২০০ সালে ব্যবিলনিয়াতে প্রেমিক ‘গিমিল্’ একখন্ড ইঁটের ওপর ভালোবাসার কথা খোদাই করে প্রেমিকা ‘কাসবুয়া’র কাছে পাঠিয়েছিলেন। আর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পত্রের প্রথম হদিশ পাওয়া যায় প্রায় ৩৩০০ বছর আগে। পাথরে খোদাই করা একটি চিঠি মিশর রাজসভা থেকে ইজরায়েল রাজসভায় পাঠানো হয়েছিল। আমাদের উপমহাদেশে সংবাদ আদানপ্রদানের তখন একমাত্র ভরসা ছিল রাজদূত বা বার্তাবাহক। পরবর্তীকালে পায়রা এই কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এই পায়রার মাধ্যমে ডাকব্যবস্থা প্রথম চালু হয় সিরিয়া ও ইরাণে। পরে মিশর বাগদাদে-ও তা জনপ্রিয় হয়। ভারতবর্ষে এই পায়রার প্রচলন ছড়িয়ে পড়ে চেঙ্গিস খাঁ’র হাত ধরে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার, স্বাধীন ভারতবর্ষেও উড়িষ্যার পুলিশ বিভাগ এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছে। ইবন বতুতার লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, ১২০৬ থেকে ১২১৯ সনের মধ্যে নবার কুতুবুদ্দিন আইবকের রাজত্বকালে তখন ভারতে ঘোড়া এবং মানুষের মাধ্যমে ডাক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। তবে ১৫৩৮ থেকে ১৫৪৫ সালের মধ্যে সম্রাট শেরশাহের আমলে ঘোড়ায় ডাক ব্যবস্থা ভারতবর্ষের ডাকবিভাগের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। তার মধ্যেই জন্ম নিয়েছিল আজকের ভারতের এই আধুনিক ডাকব্যবস্থা। পৃথিবীতে বহু বিখ্যাত মানুষের চিঠি পত্রসাহিত্যের রূপ পেয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে সেসব চিঠি এক অমূল্য সম্পদ। শুধু সেটা নিয়েই একটা আলাদা প্রবন্ধ লেখা যায়। একটা ছোট্ট উদাহরণ, ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫ সালের মধ্যে বিশ্বকবি তাঁর মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরাকে যে পত্রগুলি লিখেছিলেন, তারই অনবদ্য সংকলন ‘ছিন্নপত্র’। এবার একটু নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথায় ফিরে আসি।
আমরা যেহেতু কোলকাতায় থাকতাম। আত্মীয়-স্বজনের থেকে কিছু ব্যাপারে আমরা এগিয়ে ছিলাম। তখন কাগজে পত্রমিতালির বিজ্ঞাপন বেরোতো। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়েদের নাম ঠিকানা দেওয়া থাকতো। ইচ্ছে করলে চিঠি দিয়ে বন্ধুত্ব করা যেত। ওটাই ছিল তখন ফেসবুক। তবে ভাল-মন্দ সবরকমই ছিল। পরমহংসদের অসুবিধা হতো না। রতনে রতন, ঠিক চিনে নিত। আমার এক ইটালিয়ান বান্ধবী ছিল, নাম মারিয়া পাত্রগেলী। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে চিঠি লিখতো। আমার সুবিধেই হত। কারণ আমিও ঐ সরকারি স্কুলে ক্লাস সিক্সে ‘এ.বি.সি.ডি.’ শেখার ছাত্রদলে। তবে লাল-নীল দাগ কাটা সেই খামে একটা সুন্দর গন্ধ ছিল। আর ছিল সমবয়সী একটা মেয়ের স্পর্শ। বয়ঃসন্ধির একটা চাপা উত্তেজনা বন্দী হয়ে রয়েছে দামী বিদেশি নীল কালির অক্ষরের কারাগারে। আমি সারামাস চিঠিটা নাড়াচাড়া কোরতাম। কিন্তু আমি তাকে চিনিনা, কোনদিন দেখিনি। দুটো মহাদেশ, তিনটে মহাসাগর পেরিয়ে সেই এক টুকরো কাগজ ঐ বয়সে অনেক কিছু দিয়েছিল। আজ আমার দামী মুঠোফোনে বৈভব আছে, কিন্ত মনের ভেতর সেই চিঠির মহোৎসব নেই। এখন গড়া আর ভাঙা সবই দ্রুত। সময় কম, সম্পর্ক আরও কম। ভালবাসা পৌঁছতে লাগে এক পল। আর ভাঙতে লাগে একটা ‘ইমোজী’।
এক বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক তার প্রকাশককে একটি সাদা কাগজে শুধু একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন(?) এঁকে দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, নতুন বইটা কেমন চলছে জানার। প্রকাশক-ও বুদ্ধিতে ও রসিকতায় সমকক্ষ। তিনি উত্তরে, শুধু একটি বিস্ময়সূচক চিহ্ন(!) পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটো চিঠি বিনিময়। সারা পৃথিবীর কত বিখ্যাত লোকের পত্রবিনিময় আজ বিশ্বসাহিত্যের ভান্ডারে এক দূর্মূল্য সংগ্ৰহশালা। তবে কোন সময় উড়ো চিঠি, অনেক-কে আতঙ্কিত করতো। এখনকার, উড়ো ফোনের মত। রানার হারিয়ে গেছে। জানিনা, পোস্টম্যান কতদিন বেঁচে থাকবে, কিছু সরকারি অথবা বেসরকারী চিঠির বোঝা আঁকড়ে। কারণ আগামী পৃথিবী হরফের বর্ণমালায় জড়িয়ে থাকবে না, সংখ্যাতত্ত্ব আর কিছু সাংকেতিক চিহ্নেই তার যাবতীয় কর্মযাপন।
আমি শেষ চিঠি পেয়েছিলাম মালবিকার কাছ থেকে। তখন সরস্বতী পূজোয় খুব চিঠি চালাচালি হতো। তবে সেসব চিঠিতে ঠিকানা থাকতো না। লেটার বক্সে ফেলতে হতো না। প্রেরক সরাসরি প্রাপকের হাতে তুলে দিত। বা কারও সাহায্য প্রার্থী হতো। এইসব চিঠির বিষয়বস্তুতে ছিল যেমন খুবই উন্নতমানের সাহিত্য, তেমনি এই চিঠি বিলি করাটাই ছিল আসল কারসাজি। অষ্টমীর অঞ্জলির ফাঁকে, আমি যে চিঠি দিতে পেরেছিলাম, তাতে রবীন্দ্রনাথ ছিল, দু-লাইন সুনীল ছিল, ফুলের কথা ছিল, চাঁদের গল্প ছিল, শুধু আসল কথাটা ছিল না। সেই চিঠির উত্তর পেয়েছিলাম সরস্বতী পূজোয়। তাতে যে হলুদ সংকেতটা ছিল, তার মানে; আমি আজও বুঝিনি।
ভেবেছিলাম, দোলে আবির দেওয়ার ফাঁকে একটা বেপরোয়া চিঠি দেব। দেওয়া হয়ে ওঠেনি। সেই বৈশাখেই আলো ঝলমলে স্বপ্নের হলুদ বাড়িটা থেকে বিসমিল্লার সানাইতে রাগ শ্যাম-কল্যাণ বুঝিয়ে দিয়েছিল, ‘বন্ধু; অনেক দেরি হয়ে গেছে'। শুধু নববর্ষ এলে সে কথা ভীষণ মনে পড়ে। তবু চিঠিকে ভোলা যাবে না। অমলরা চিরকাল বসে থাকবে যদি রাজার ডাকঘর থেকে একটা চিঠি আসে।
=======000=======
বাণীব্রত গোস্বামী
৯/৬ ইস্টমল রোড্, কোলকাতা- ৭০০০৮০
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন