বাংলা সাহিত্যে সব শাখায় অসামান্য অবদানের জন্য গতকাল সৃজনী ভারত এ বছর সাহিত্য প্রভাকর পুরস্কারে সম্মানিত করল কথাসাহিত্যিক সিদ্ধার্থ সিংহকে। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' বইটির জন্য।
এই পুরস্কার বহু দিন আগে ঘোষণা করা হলেও অতিমারির কারণে স্থগিত রাখা হয়েছিল।
এ দিন 'আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে' গান গাইতে গাইতে প্রদীপ জ্বালিয়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিদ্যানগরের জেলা গ্ৰন্থাগারে 'সৃজনী ভারত সাহিত্য উৎসব ২০২১'-এর সূচনা হয়।
বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, অধ্যাপকদের উপস্থিতিতে সিদ্ধার্থ সিংহের হাতে 'সাহিত্য প্রভাকর' পুরস্কার তুলে দেন বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক এবং গবেষক পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য।
এর আগে ২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। পরে এই গল্প নিয়ে শিশির মঞ্চে মঞ্চস্থ হয় নাটক--- বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল।
ছোটদের জন্য যেমন মৌচাক, শিশুমেলা, সন্দেশ, শুকতারা, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চিরসবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য।
লেখেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত মুদ্রিত এবং অন্তর্জাল পত্রপত্রিকায়।
'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। 'রিয়্যালিটি উপন্যাস'-এরও প্রথম প্রচলন করেন তিনিই। বাংলা সাহিত্যে অণুগল্পের যে রমরমা শুরু হয়েছে তার পিছনেও রয়েছেন তিনি। তাঁর এবং বিশিষ্ট লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যৌথ সম্পাদিত 'শত লেখকের শত অণুগল্প' সংকলনটি এর সূচনা করেছিল। এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যে তিনি সংযোজন করেছেন আরও একটি নতুন শাখা--- 'ঝলক-গল্প'। যেগুলোকে নিয়ে ইতিমধ্যেই হিন্দি, ওড়িয়া, মালয়ালাম, তামিল এবং তেলুগু ভাষায় ছোট্ট ছোট্ট 'স্পার্ক ফিল্ম' তৈরি হয়েছে। হয়েছে বাংলাতেও।
তাঁর এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো সাতান্নটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। ষোলোটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন তিনি এবং লিখতেও পারেন।
এ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যৌথ ভাবে পাঁচশোর ওপর সংকলন সম্পাদনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য লেখক লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। এই মুহূর্তে সম্পাদনা করছেন 'বেঙ্গল ওয়াচ'-এর সাপ্তাহিক পত্রিকা 'সাহিত্যের পাতা'। যেটি প্রকাশিত হয় প্রত্যেক রবিবার।
আমেরিকার 'উড়ালপুল' পত্রিকার কলকাতা সম্পাদক।
বিশ্ববঙ্গ টিভির সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক।
ভারত, বাংলাদেশ এবং নরওয়ে থেকে প্রকাশিত একমাত্র বাংলা পত্রিকা 'সাময়িকী'-সহ মোট চারটি মুদ্রিত এবং ওয়েবজিনে প্রত্যেক দিন একটি করে দৈনিক কলাম লেখেন।
যুগশঙ্খ পত্রিকায় প্রায় প্রতি রবিবারই দেখেন একটি করে নিবন্ধ।
বিশ্ববঙ্গ টিভির ইউটিউব চ্যানেলের রবিবারের 'ভিডিও সাহিত্য'র সম্পাদক এবং পরিচালক। এ ছাড়াও প্রতি শুক্রবার সকাল ৮টায় সেলিব্রেটিদের সঙ্গে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করছেন।
তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর শ্রুতিনাটক নিয়মিত করেন জগন্নাথ বসু থেকে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়রা। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে।
তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। লিখেছেন বেশ কয়েকটি ছায়াছবির চিত্রনাট্য। তিন-তিন বার রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়া এই মুষ্টিযোদ্ধা এক সময় আনন্দবাজার সংস্থায় নিয়মিত মডেলিংয়ের কাজও করেছেন।
আশির দশকের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই সব্যসাচীর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের এক তারিখ থেকে একত্রিশ তারিখের মধ্যে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, মুক্তগদ্য, প্রচ্ছদকাহিনি মিলিয়ে মোট তিনশো এগারোটি লেখা প্রকাশিত হওয়ায় 'এক মাসে সর্বাধিক লেখা প্রকাশের বিশ্বরেকর্ড' অর্জন গড়েছেন তিনি।
২০২১ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে মাত্র 'সাত দিনে পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস' লিখে এবং সেই পাঁচটি উপন্যাস একই সঙ্গে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি দেশের নামিদামি পত্র-পত্রিকা এবং ওয়েবজিনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হওয়াটাও বাংলা সাহিত্যে একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
আনন্দবাজার পত্রিকার এই প্রাক্তনী ইতিমধ্যেই পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।
এ বার তাঁর মুকুটে সংযোজিত হল আরও একটি পালক।
--সুরিন্দর সুরাইয়া।
------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন