নারী দিবসে নারী স্বাধীনতা
সোনালী ব্যানার্জ্জী
আজ নারী দিবস। নারীদের স্বাধীনতা নিয়ে কে একজন আবৃতি করছে রেডিওতে ----, কানে এলো নীলার । সকাল থেকে সময় নেই এই সব শোনার।
আজ ঘটা করে ক্লাবে ক্লাবে,মঞ্চে মঞ্চে, পাড়ায় পাড়ায় , প্রভাতী অনুষ্ঠানে, নারী দিবস নিয়ে লম্বা ভাষন দেবে সবাই । কবিতা লেখা হবে নারীদের নিয়ে , বক্তৃতা দেবে শহরে ,গঞ্জে,নারী স্বাধীনতা নিয়ে, অনেক কথা বলবেন নেতা, নেত্রী ও সেলিব্রেটিরা-----------!!
আর রাস্তার ডাস্টবিনে পড়ে থাকবে আধা জ্বলন্ত দেহ! কোথাও বা আধা নগ্ন, লোহার রডে বা ব্লেডের চৌচির করা রক্তাক্ত শরীর নিয়ে! বাচ্চা শিশুরা পড়ে থাকবে কোনো ডাস্টবিনে নাম পরিচয়হীন ভাবে------!!
নারী স্বাধীনতা------!!!
আনমনে এইসব ভাবতে ভাবতে,
হঠাৎ নীলার সম্বিত ফিরে এলো শ্বশুরের চিৎকারে ------
"বৌমা আমার চা কোথায়?''
"বৌমা আমার বাতের ব্যাথার তেলটা কোথায়? দিয়ে যাও না!" শাশুড়ি বলে ওঠেন!
"মা আমার টিফিন রেডি? ''
ছেলে বেরিয়ে আসে।
:স্বামীর জোর তলব ,-----" হ্যাঁগো, আমার টাইটা কই? অফিস যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে !''
তাদের উওর দিতে না দিতেই মেয়ে বলে----, "মা আমার নাচের ড্রেসটা একটু আয়রন করে রাখতে পারোনি!'' চোখে মুখে বিরক্তি ! "কি যে করো সারাদিন।''
"আচ্ছা বৌমা! সবাই কাজে বাইরে থাকে,তুমি সারাদিন করো কি? সব কাজ গুলো একটু গুছিয়ে রাখতে পারো না! সারাদিন এসির মধ্যে বসে ফোন ঘাটবে !'' বলে, শাশুড়ি মুখ বেঁকায়ায়!
একা বৌমা, মা, বউ কোনদিক সামলাবে!
একা হাতে দশভুজা সেজে পড়িমরি করে সবার কাজ করতেই ব্যস্ত। সবার মন রেখে কারো মন সে পায় না।
নিজের কথা নিজের স্বপ্ন, নিজের ভালোলাগা,ভালোবাসা সব বিসর্জন দিয়ে টেনে চলে ক্লান্ত শরীরে সংসারের ভার।
আর ভাবে, নারী দিবস আজ আমাদের সমাজে দমবন্ধ করা এক জ্বলন্ত লাশ হয়ে পড়ে আছে!
নারী যখন মাতৃত্বের স্বাদ নিতে ব্যস্ত তখন গোটা পরিবার ভাবে আমার বংশ রক্ষা পাবে তো? ছেলে হয় যেনো বৌমা!
আমার ঘরে আসবে অমুকের সন্তান!বংশের মুখ উজ্বল করবে, বংশ বাড়াবে।কেনো? কেনো এতো মেয়েদের অসম্মান, পদদলিত ,লেহন ,ঘরে ঘরে ?
মেয়েরাই মেয়েদের শক্রু হয়ে বৌদের প্রতি অন্যায় করে যায় দিনের পর দিন!
এটা কেনো মনে হয়না---- "একদিন উনিও কারো মেয়ে, কারোর ঘরের বৌ হয়ে এসেছিলেন।
" ঠিকই তো বাপু,সারাদিন বসে বসে করোটি কি?''
নিলার চিন্তার ছেদ পরে শাশুড়ির কথাতে। মনের অগোচরে চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো!
তাড়াতাড়ি সে আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছে চারিদিক একবার দেখে নিলো।কেউ দেখছে কিনা।
নিজের অগোচরেও চোখের জল ফেলা মানা।এক্ষুনি হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাঁকে।
"আদিক্ষেতা দেখে আর পারি না বাপু! দেখলে গা পিত্তি জ্বলে যায়। ন্যাকা কান্না বন্ধ করো তো বাপু! ইত্যাদি, ইত্যাদি।
তাই চোখের জল মুছে এক মনে কাজে মনোনিবেশ করে নীলা ।
নারী স্বাধীনতা!
হাসালে---- --- !!
যেখানে কারোর অনুমতি ছাড়া মুখের আলতো হাসিও মানায় না।সেখানে এতো গাল গল্প।
নীলা ব্যালকনিতে এসেছে শুকনো জামাকাপড় তুলতে ।
সামনে সাপের মতো এঁকেবেঁকে সরু রাস্তাটা যেখানে গিয়ে মিশেছে, সেখানে একটা মঞ্চের চূড়া দেখা যাচ্ছে। ওখান থেকে মাইকের আওয়াজ ভেসে আসছে ----- নারী স্বাধীনতার গালভরা সব ভাষন,গান,কবিতা।
নীলার বুকে হাজার সর্প দংশনের মতো যন্ত্রণায় ভরে যাচ্ছে। এইসব কথায়!
কিন্তু তার হাত পা বাঁধা।
নীলা জানে , কারো অনুমতি ছাড়া এক পাও এদিক ওদিক করা মানা। তাই নীলা এই নারী স্বাধীনতার একদম বিরুদ্ধে। জানে তার দৌড় কতোটা--------
শাশুড়ি কে কিছু প্রতিবাদ করতে গেলেই বউ হয়ে যাবে মুখরা,বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে গেলে লোকে বলবে --- বউটা খারাপ, দেখোগা কারোর হাত ধরে বেড়িয়ে গেলো কিনা---- !!
তাঁর পেছনে বদনামের অনেক পালক লাগবে।
যেদিকে যাবে সব সময় মেয়েদেরই বদনাম। সে মুখরা, ব্যাভিচারীণী !মা,বাবা কিছু শেখায়নি ,অনেক উপাধিতে ভূষিত হতে হবে। তাই নীলা নিজের পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। যতটুকু কথা না বললেই নয় তার বেশি কথা প্রয়োজন ছাড়া বলেই না। আর ভাবে,
সত্যি কবে আসবে সেই দিন! যেদিন নতুন প্রভাতে, নতুন সূর্যের আলোয় ফুটে উঠবে সমাজের প্রতিটা ঘরে ঘরে মেয়েদের সম্মান,ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা। সত্যি করে------ , ছেলেদের সাথে সাথে বৌদের ও টেবিলে খাবার সাজিয়ে বলবে, "এসো বৌমা, সারাদিন খেটে খেটে মুখটা শুকিয়ে গেছে! এসো তো এক সাথে বসে আগে খেয়ে নাও ,তারপর কাজ করবে!''
স্বামী বলবে-----, "হলো তোমার? সারাদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছো!সরো আমি বাসনটা মেজে দিচ্ছি। একসাথে দুজনে মিলে কাজ করবো!''
চোখের জল মুছিয়ে হাত ধরে খাটে বসিয়ে বলবে------,"ছি, ছি,হাতের কি অবস্থা করেছো!''
হাতে ক্রিম মাখাতে মাখাতে মায়ায় ভোরে যাবে তার চোখ দুটো।
শাশুড়ি বৌমাকে খাইয়ে দেবে নিজের হাতে নিজের মেয়ের মতো।
নারী নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করবে।ভুলে যেতে পারবে মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা। সেইদিন নারী যোগ্য সম্মান পাবে!
মুখে নয় যেদিন সত্যি করে স্বামীর সাথে ছেলের সাথে মেয়েরা পায়ে পা মিলিয়ে চলার অনুমতি পাবে ।ঘরে ঘরে সমাদৃতা হবে নারীদের সম্মান,ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা। যে নারী ছাড়া বংশ অচল,ছেলে না চেয়ে মন্দিরে মন্দিরে পৃজো দেবে আমার ঘরে মেয়ে সন্তান হোক। ।
আজ কোনো অংশেই মেয়েরা পিছিয়ে নেই।কিন্তু তাও মেয়েরা আজও অবহেলিত,লুণ্ঠিত, ধর্ষিত ।মা দূর্গার মতো নারীরাও সব ঘরে ঘরে পূজিত হবে,সমাদৃতা হবে!!
সেদিন ভাববো সত্যি নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছে।নারীরা নিজেদের যোগ্য সম্মান পাচ্ছে। সেইদিন ঘরে ঘরে,সমাজে নারী স্বাধীনতার দেওয়ালি শুরু হবে-------
"নারী দিবসের দিন বলতে পারবো জোর গলায় আজ নারী দিবস------!!
××××××××××××××
সমাপ্ত
×××××××××××
সোনালী ব্যানার্জ্জী
ধানবাদ, ঝাড়খন্ড,
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন