শীতঘুমে শঙ্খ ঘোষ
কাঠখড় গুছিয়ে রাখার মতো সন্ধ্যা হলে
এই একলা মহল্লায়
শীতঘুম মেলা বসে
মেলার দেওয়াল জুড়ে ম্যুরাল শঙ্খ ঘোষ
বিজ্ঞাপনের কবির মতো লাগে।
দশচক্রে রাসচক্র, শো পিস ভগবান
বাঁশেদের অভিকর্ষজ টান, পুতনা - নন্দলাল
বিষ দিয়ে নিকেশের
কূটনৈতিক সূত্র লিখে গেলে
নিউটনই হ'ত এ মেলাকাব্যের কবির সারথী।
গতিজাড্যে টমটম, নটরাজ সার্কাস
স্মোক ক্যান, হলুদ আবীর, মৃত্যুকূপ
দিক ভুলে বনবন হাওয়ার মোরগ
লাল ঝুঁটি হাওয়াই মিঠাই
স্বাধীনতার সাত-পাঁচের মতো লাগে।
ক্রুশ পিঠে উড়ে আসে পেরেকের দিন
জেরুজালেম আকাশ জুড়ে
ইজরায়েল, প্যালেস্তাইন
যুদ্ধদের মনে হয় বায়োমেট্রিক উপনিবেশ
এক ছাপে মনুসংহিতা নিকেশ।
কাঠখড় গুছিয়ে রাখার মতো সন্ধ্যা হলে
এই একলা মহল্লায়
শীতঘুম মেলা বসে
নাগরদোলা তানাশাহির মতো ঘোরে
ঘুরে চলা শঙ্খ ঘোষ যীশুর মতো লাগে
কবিতার অস্থি-মজ্জা, শিরা-ধমনী ধরে চলতে চলতে আদৌ কি কবিতার হৃদিতে পৌঁছাতে পারি! হয়ত পারা যায় না, তবুও সেই অভিমুখে হেঁটে গেলে যে অভিজ্ঞতাটুকু লাভ হয়, সেটুকুই আমার মতো একজন সাধারণ পাঠকের অমূল্য সঞ্চয়। প্রথম কবিতার শুরুতে কবি লিখছেন-
'কাঠখড় গুছিয়ে রাখার মতো সন্ধ্যা হলে
এই একলা মহল্লায়
শীতঘুম মেলা বসে
মেলার দেওয়াল জুড়ে ম্যুরাল শঙ্খ ঘোষ
বিজ্ঞাপনের কবির মতো লাগে'
অত্যন্ত মেধাবী এবং বুদ্ধিদীপ্ত উচ্চারণ। কবির যাপনের সাথে ওয়াকিবহাল এবং কবিতা সম্পর্কে যাঁদের সামান্য ধারণা আছে তাঁরা জানেন কবির কবিতা কতটা স্ট্রিটস্মার্ট। কারণ এ কবিতার কাছে থামতে হয়। আমরা বাধ্য হই থামতে৷ ঘাড় ঘুড়িয়ে চোখ রাখতে হয় কবিতার চলনে৷
'শীতঘুম মেলা', ' বিজ্ঞাপনের কবি', ' শো পিস ভগবান', 'বায়োমেট্রিক উপনিবেশ'... ধারালো ভাষা, আয়রনি এবং স্যাটায়ারের উন্নত নিদর্শন। শুরু থেকে শেষ অবধি স্বকীয়তার ছাপ৷ জোর করে abstract করা নয়, হাতের পাঁচ আঙুল থেকে বেরিয়ে আসা দ্বিধাহীন সমান পাঁচলাইন। যেন শেডস্ অব গ্রে। রীনা সাহার কবিতার চিত্রকল্প এবং প্রতীক কবিতায় উঠে আসে সময়ের দাবি মেনে ; নিজে থেকে।
রীনা সাহার কবিতা কখনোই art for art's sake র কথা বলে না৷ তাঁর শব্দচয়ন, শব্দবন্ধ উদ্ভাবন এবং তার প্রয়োগ বারংবার মনে করিয়ে দেয়, সৃজনশীল প্রতিটি মানুষ এই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ।তাই 'কাঠখড় গুছিয়ে রাখার মতো সন্ধ্যা' নেমে আসার আগে কিংবা 'কূটনৈতিক সূত্র' লিখিত হয়ে যাবার আগে অথবা সব আকাশ ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের ধূসরে কবলিত হবার আগে আরো একবার আমাদের আশ্রয় হোক কবি শঙখ ঘোষ৷
"একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
… তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।"
'শীতঘুমে শঙ্খ ঘোষ' কবিতার আবহে প্রতিধ্বনিত হওয়া বরেণ্য কবির কালজয়ী উচ্চারণ অনুভবী কবি রীনা সাহাকে ব্যথিত করে। নতুন করে কবির উচ্চারণের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজতে গিয়ে সবটাই কেমন যেন সাত-পাঁচে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখার মতন বলে পরিলক্ষিত হয়৷
উন্নত বোধের যথাযথ উত্তরণ, চোখ কান খোলা রেখে নিজস্ব মানসচক্ষু দিয়ে সবকিছু যাচাই করা, হাতের খুব কাছাকাছি ঘূর্ণনরত যে সংস্কৃতির ছোঁয়াচ তাকে কাব্যে দক্ষতার সাথে প্রয়োগ এবং পরিশেষে পাঠককে উপলব্ধির অতল খাদে ঠেলে দেওয়াই কবি রীনা সাহার কবিতার শ্রী হিসেবে ধরা পড়ে৷
আরো একটি কবিতা পড়ে নিই চলুন-
চক্রব্যূহ...
সততার আস্তিনে
আমাদের একটাই পতিত পাবন
তোর্ষা ----
ফ্লাইওভার হীন লেভেল ক্রসিং
তোর্ষা ব্রীজ ,
হাজার কিসিম গাড়ির ভিড়ে
অনন্ত থেমে থাকা
ভোঁতা মানুষের গাদাগাদি
লাশ হওয়ার লম্ফঝম্ফ।
রোজকার বেকার ঘাম
চুল বেয়ে বুক ছুঁয়ে
দুপায়ের ফাঁক গ'লে
চুপচাপ টুপটাপ
মহানগরীর বাতিল করা
লরঝরে গাড়ির গরমে
বাষ্প হয়ে উড়ে যায়
মহাকাশের মাঠে ----
মাঠের গায়ে বিন্দু বিন্দু
মাথার ঘামের ইকোসিস্টেম।
শুরু হয় দল বদলের ঋতু
আমরা যারা নিত্যযাত্রী
পারাপার গাড়ির আড়ালে
প্রকৃতির ডাক সেরে
ইকোসিস্টেমে গচ্ছিত রাখা
ঘামের সুদের ওম মেখে
নিজ নিজ বাহনে
দাঁড়িয়ে কিংবা বসে
দলাদলির দাড়িয়াবান্ধা খেলি -----
খেলতে খেলতে উন্নয়নের ফারেনহাইট
ফুসমন্তর ঘাম এবং হিসু হয়ে
নিশ্চিন্তে ঢুকে যায়
বায়ো- টয়লেট রেল ব্রীজের নীচে
বালিখাদানের আখড়ায়
মাফিয়া বালির চরে।
যদি কোনদিন হুটার মাথায়
নেতাদের বোলেরো বুলেটপ্রুফ
আর আমাদের টাটা বাস
টক্কর হয় , ঠিক ওইখানে
যেখানে লেভেল ক্রসিং
খেলা হবে তাবড়তোড় ----
আমরা- ওরা দুমরে মুচড়ে
উড়ে গিয়ে ওই তোর্ষায়
ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে
আধখাওয়া নদী ধরে
সাঁতরে উঠতে পারি যদি
দেখা হবে আলবাত
চুরি হয়ে যাওয়া ছোটগল্পের রায়ে
ঝুরঝুরে বালিঘড়ির অজরামর চক্রব্যূহে।
কবির মূল্যায়ন করছি না। তবে প্রচলিত অতীত বা বর্তমানের ছাঁচ বা ধাঁচে এই কবিকে দাঁড়িপাল্লায় বসানো অর্থহীন। এ যেন এক প্রতিষ্ঠান বিরোধী কথা বলা অথচ কোনো রূপ আতিশয্য নেই৷ আপামর জনগণের কাছে যা খুব সাধারণ কিছু ঘটনা, রীনা সাহার কাছে তা জোরালো দাবি। আঙুল নামিয়ে নয়, রীতিমতো ভৎর্সনা করে আগুন জ্বালিয়েছেন কবিতায়৷
সাধাসিধে কবিতার শেষে আমাদেরকে এনে দাঁড় করালেন এক ইউটার্ণ এর কাছে৷ দ্বিতীয় কবিতাতেও কবি একবার মাটির দিকে তাকিয়েছেন আর একবার তাকিয়েছেন মানুষের দিকে৷ নিত্যদিনের যাত্রী যারা তারাই তো 'ভোঁতা মানুষ'। 'ঘামের সুদের ওম মেখে' কবি অক্লান্ত তাকিয়ে থাকেন 'পতিত পাবন তোর্ষা'র
দিকে৷
'মহানগরীর বাতিল করা
লরঝরে গাড়ির গরমে
বাষ্প হয়ে উড়ে যায়
মহাকাশের মাঠে ----
মাঠের গায়ে বিন্দু বিন্দু
মাথার ঘামের ইকোসিস্টেম '...
'চক্রবুহ্য' কবিতাটি রাজ্যের দ্বিধাবিভক্ত মানচিত্রকে ইঙ্গিত করে৷ প্রতিবাদ আবারো এই কবিতার সুষুম্নাকাণ্ড। মঞ্চে উঠে মিনমিনিয়ে পাঠ করার জন্য এ কবিতা নয়৷ এ শুধু কবির ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি নয়৷ এ কবিতা কোথাও গিয়ে যেন সাধারণতন্ত্রের মাউথপিস৷
'যদি কোনদিন হুটার মাথায়
নেতাদের বোলেরো বুলেটপ্রুফ
আর আমাদের টাটা বাস
টক্কর হয় ' -
অপ্রাপ্তি, হতাশা, অবহেলিত চেতনা, দুঃখবোধ, গভীর কষ্ট বারবার উঁকি দিয়েছে কবিতায়৷ আমরা এমন একটা সময় দাঁড়িয়ে আছি যখন আমরা নিজেদের দাবিটুকু গলা ছেড়ে বলতে ভুলে গেছি, সেখানে কবি রীনা সাহার কবিতায় ' আমি ভয় করব না, ভয় করব না... '- এর অমোঘ গুঞ্জরন৷
'চক্রবুহ্য' কবিতায় যে চিত্রকল্প, তা নেহাতই আম আদমির রোজকার ধারাভাষ্য। হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। লক্ষ্য একটাই - চোখের পাতায় ক্লিপ পড়িয়ে দেওয়া। ব্যাকরণের চালাকি, অপ্রয়োজনীয় কাঠিন্য, দূরাগত প্রতীকি অভিসারকে অনায়াসেই পৃষ্ঠদেশ দেখাতে পারেন কবি৷
এমন কবিতাকে টেবিল থাপড়ে আদালতে নেওয়া যায় না। যৎসামান্য বুঝতে হয়, বার কয়েক পড়তে হয় আর ছড়িয়ে দিতে হয় মোবাইল থেকে মোবাইলে, দেওয়াল থেকে দেওয়ালে৷ ঠিক মুহূর্তে আমি যেটা করলাম৷
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন