"রিমঝিম, কোথায় তুই?" ডাক দিল জয়িতা।
"এই তো মা আমি।" রিমঝিম ছুটে এলো।
"একটা কাজ করতো।"
"কি কাজ?"
"তোর বাবাকে খেতে দিয়ে তৈরি হয়েনে।"
"তৈরি হবো? কোথায় যাবো?"
"আমার সাথে শহরে যাবি।"
"শহরে? কেনো?"
"উফ! এত প্রশ্ন করিস কেনো? আজ নারীদিবস। তাই শহরে অনেক জায়গায় অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেসবই দেখতে যাবো।"
"আমাকে নিয়ে যাবে তুমি?"
"কেনো রে পোড়ারমুখী, তুই যাবি না?"
"না না তা কখন বললাম?"
"তাহলে যেটা বললাম সেটা করে আয়।"
"আচ্ছা মা আসছি।"
রিমঝিম ফটাফট ওর বাবাকে খেতে দিয়ে ওর প্রিয় চুড়িদারটা পড়ে নিল। আজ প্রথম ওর সৎ মা ওকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চেয়েছে। জন্মের সময়ই মাকে হারানোর পরে ওর বাবা যখন দ্বিতীয় বিয়ে করে সৎ মাকে ঘরে এনেছিল তখন ওর আনন্দের সীমা ছিল না।
"আজ থেকে আমিই তোর মা রিমঝিম।" বাবার সামনে ছোট্ট রিমঝিমকে বলেছিল জয়িতা।
রিমঝিমও খুব আনন্দে নিজের সৎ মাকে আপন মায়ের জায়গা দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সবটাই যে জয়িতার নাটক ছিল তা বুঝতে দেরী হয়নি ওর। বাবার আড়ালে জয়িতা রিমঝিমকে দিয়ে সব কাজ করাতো আর অত্যাচারও করতো।
প্রথম যখন জানতে পারে রিমঝিমের বাবা তখন জয়িতার গায়ে হাত তুলেছিল রাগে। তাতে জয়িতার রাগ আরোও বেড়ে যায় রিমঝিমের উপরে। আস্তে আস্তে রিমঝিমের বাবাও প্রতিবাদ করা ছেড়ে দেয়।
এইভাবেই দশ বছর কেটে গেছে। এখন রিমঝিমের বয়স পনেরো। ওর স্কুলের পাট চুকে গেছে দুই বছর আগেই।
"মা আমি তৈরি।" রিমঝিম জয়িতার সামনে দাঁড়িয়ে বললো।
জয়িতা রিমঝিমকে ভালো করে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "সাজগোজ করিসনি কেনো?"
"কি সাজবো?"
"আমার ঘরে গিয়ে টেবিলে দেখ একটা ঝোলানো কানের দুল আছে, ওটা পড়। আর আয়নার সামনে গেলে টিপ আর লিবিস্টিক পাবি। সেজে আয়। কেমন লাগছে! শহরে কেউ এভাবে যায়?"
"মা আমি তোমার কানের দুল পড়বো?"
"আরে বাবা তাড়াতাড়ি কর তো।"
রিমঝিম আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। যে মা একদিন রিমঝিম ছোটবেলায় একটা চুড়ি দেখে নিজের হাতে পড়ায় বেধড়ক মেরেছিল। আজ সেই কিনা বলছে নিজের জিনিস দিয়ে সাজতে!
রিমঝিম তৈরি হয়ে এলো। তারপর জয়িতা ওকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। ট্রেনে করে ওরা পৌঁছালো শহরে। রিমঝিম এই প্রথম শহরে পা রাখলো। এত মানুষজন, বড় বড় বিল্ডিং দেখে ওর চোখ একদম জুড়িয়ে গেল। জয়িতা রিমঝিমকে নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছালো একটা বাড়িতে।
"এটা কার বাড়ি মা?"
"বেশি কথা না বলে চুপচাপ চল আমার সাথে।"
রিমঝিম আর কিছু বললো না।
"কর্তামা আমি এসে গেছি।" একজন মধ্যবয়স্কা মহিলার ঘরে ঢুকে দরজায় দাঁড়িয়ে বললো জয়িতা।
রিমঝিম জয়িতার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে জয়িতা থাকায় ও ঘরের ভেতরের কিছু দেখতে পাচ্ছে না।
"আরে আয় আয়।" কর্তামা বললেন।
রিমঝিমের হাত ধরে নিয়ে জয়িতা ঢুকলো ঘরে। জয়িতা বসলো কর্তামায়ের পায়ের সামনে। রিমঝিমও বসলো জয়িতার পাশে।
"তা এই সেই মেয়ে?"
"হ্যাঁ কর্তামা, এই হলো আমার সৎ মেয়ে।"
কর্তামা রিমঝিমের দিকে তাকালেন। চোখাচোখি হতেই রিমঝিম মাথা নীচু করে নিল। জয়িতা ওকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বললো, "পেন্নাম কর।"
রিমঝিম কর্তামায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।
"থাক থাক! তা কত নিবি?"
"আপনি বলুন কত দেবেন? আমার আস্পর্ধা কোথায় নিজের ইচ্ছে মতো চাওয়ার?"
"আরে একটা দাম বল। তারপর তো দর করা যাবে।"
"আপনিই বলুন কর্তামা।"
"দশ হাজার।"
"বারো হলে ভালো হতো। একটা ব্যবসা খুলবো ভেবেছিলাম।"
"আচ্ছা ঠিক আছে।" বলে কর্তামা নিজের বটুয়া থেকে পাঁচশো টাকার নোটে বারো হাজার টাকা দিয়ে দিলেন জয়িতাকে।
"ধন্যবাদ কর্তামা। একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন। ওর বাবা জানে না। নাহলে আমিই কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে আনতাম। ওর বাবা সন্দেহ করলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত।"
"সে এক রাত গেলেই সব শিখে যাবে।"
"একদম। আমি তাহলে আসি।"
রিমঝিম এতক্ষণ জয়িতা আর কর্তামায়ের কথা শুনলেও বুঝতে পারেনি যে সৌদাটা ওর হলো। জয়িতা কর্তামাকে প্রণাম করে চলে যেতে নিলে রিমঝিমও উঠে দাঁড়ালো।
"তুই কোথায় চললি? আজ থেকে এটাই তোর ঘর।" বলে জয়িতা চলে গেল।
রিমঝিম পেছন পেছন ছুটে যেতে গেলে ওখানে উপস্থিত দুইজন মহিলা ওকে আটকে ধরলো।
"আজ থেকে তুই এখানেই থাকবি।" কর্তামা বললেন।
"আমি এখানে কেনো থাকবো?"
"কারণ তোর মা তোকে আমার এই বেশ্যালয়ে বেচে দিয়েছে।"
রিমঝিমের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। "বেশ্যালয়" কথাটার সাথেও ঘরোয়া রিমঝিম পুরোপুরি ওয়াকিবহাল না। শুধু জানে যে এখানে এলে আর কেউ ফিরতে পারে না।
রিমঝিমকে ওই দুইজন মহিলা টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। আর বাড়ির বাইরে কোনো এক নারী দিবস মিছিলে স্লোগান চলছে,
"বন্ধ হবে কবে ধর্ষণ, অত্যাচার?
নারী পাবে কবে অন্যায়ের বিচার?
থাকবে না যেদিন আর বেশ্যালয়,
নারীরা সেদিনের অপেক্ষায় রয়।"