লিঙ্গ-সাম্য
বর্তমানে লিঙ্গ সাম্য, নারী ক্ষমতায়ন সম্পর্কিত অনেক বিষয় জনমাধ্যম ও সমাজ মাধ্যমের মাধ্যমে প্রভূত আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু লিঙ্গ সাম্য বলতে প্রায় ক্ষেত্রে মানুষ বোঝেন যে একটি নারী পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় একটি নারী ও সুযোগ পেলে যে কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের সমান যোগ্যতা ও সাফল্যের অধিকারিনী হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এই বাক্যটি উদার মনে হলেও এর আড়ালে একটি অপ্রিয় সত্য ধরা পড়ে তা হল স্বাভাবিক ভাবে নারীরা পুরুষের চেয়ে দুর্বল হয়ে থাকে, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সুযোগ দিয়ে তবে ই পুরুষের সমান করা যায়। মেয়েরা স্বাভাবিক ভাবে দুর্বল কারণ তারা প্রাচীনকাল থেকে ঘরোয়া কাজ-কর্ম ই শুধু করে এসেছে বলেই আমাদের সমাজের অনেক মানুষ মনে করেন। আর ঘরোয়া কাজ-কর্ম মানেই তা অগুরুত্বপূর্ণ ও শৌর্য , বীরত্ব হীন। "দুর্বল" মানুষদেরই সমাজে তাদের অপেক্ষা অধিকতর মান মর্যাদার অধিকারী মানুষদের সমকক্ষ হবার চেষ্টা করতে হয়। ঠিক তেমনি যেন সমাজে " দুর্বল "শ্রেণীর মানুষ " নারীদের ," সমাজে "সবল" শ্রেণীর মানুষ "পুরুষ"এর সমকক্ষ হতে হয়। অনেক মেয়ের বাবা মা রা গর্ব করে বলে থাকেন, আমার মেয়ে একটা ছেলের সমান কাজ করতে পারে। এই কথা গুলো আমরা প্রায়ই শুনে থাকি এবং শুনে গর্ব অনুভব করি । মেয়েরা সাধারণত ছেলেদের মতন শৌর্যবীর্য পূর্ণ কাজ কর্ম করতে পারে না এটা কেই আমরা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম বলে মেনে নিয়েছি। পুরুষদের ক্ষেত্রে সাধারণত বলা হয় না একটা মেয়ের সমান হয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে। কোন পুরুষ যদি ঘরোয়া কাজে পটু হয় তাকে সমাজ "মেয়ে ছেলে" উপাধিতে ভূষিত করে ব্যঙ্গ করে থাকে। কারণ মেয়ের সমান হওয়া টা লজ্জার আর পুরুষত্ব থাকাটা অহংকারের। যে মূঢ় পুরুষ এই অহংকার জন্মসূত্রে অর্জন করেও হেলাফেলা করে, দুর্বল নারীকে অনুকরণ করে তার তো অপদস্ত হওয়া ই উচিত।
আমাদের সমাজ বিভিন্ন মহাপুরুষদের বাণী আওড়ে বলে দয়া, করুণা এই সর্বাপেক্ষা মহৎ গুণ পৃথিবীতে। কিন্তূ নারীর ক্ষেত্রে দয়াটা দুর্বলতা বলে মনে করা হয়। শুধু ঘরের কাজ কেন আজ মেয়েরা ঘরে-বাইরে যোগ্যতা ও সাহসের পরিচয় দিলেও দুর্বল লিঙ্গ উপাধি টি মেয়েদের উপর থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলতে পারেনি সমাজ।
কোন পুরুষ যদি স্ত্রীর প্রতি বিশেষ যত্নবান হোন সমাজ তাকে স্তৈন বলে আখ্যা দেয়। অনেক তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ কোন বিবাহিত পুরুষের নাম করে বলে যে অমুক বউয়ের কথায় উঠবস করে।অথচ যে নারী বিয়ের পর নিজেকে সম্পূর্ণভাবে তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের সেবা-শুশ্রূষা নিজেকে নিয়োজিত করে তাকে আমাদের সমাজ পতিব্রতা বলে গরীমান্বিত করে থাকে। পতিব্রতা ও স্তৈণ শব্দের মানে এক হলেও ব্যবহার বিপরীত ভাবে করা হয়। অনেক স্ত্রী যদি বিয়ের পর স্বামীর কথায় বা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কথায় তার চাকরি ছেড়ে দেয় কিংবা আদর্শ নারী সার্টিফিকেটটা কে বেশি প্রয়োজনীয় মনে করে তার এক কালে পাওয়া নাচের ,গানের ,খেলাধুলার প্রতিভার স্বাক্ষর সার্টিফিকেট গুলি শুধু আলমারি বন্দি স্মৃতি করে রেখে দেয় তখন কিন্তু সেই নারীর উদ্দেশ্যে সমাজ বলে না যে অমুক নারী স্বামীর কথায় উঠবস করে। এরকম কথা বলা হয় না তার কারণ নারীর কর্তব্য পুরুষের কথা শুনেই চলা ,তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের সমস্ত ফরমাস খাটা তার কর্তব্য। নারী মানুষ নয় মানবরূপী যন্ত্র , পুরুষের সমস্ত শারীরিক ও মানসিক চাহিদা মেটানোর জন্যই এর জন্ম। পুরুষ সে যন্ত্রের উপভোক্তা । উপভোক্তা কে চাহিদা মতন পরিষেবা দেওয়ার উপর ই তার গুণগত মানের মূল্যায়ন করা হবে। আর পুরুষ সেই যন্ত্রের উপভোক্তা । এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলেই সমাজ তা মানতে পারে না।
আজকাল অনেকে নারী স্বাধীনতা ও অধিকার এর স্বপক্ষে কোন বক্তব্য পেশ করলে তাকে পুরুষ বিরোধী বলে ধরে নেয়া হয়। নারীবাদী আর পুরুষ বিরোধীতা এক নয়। পুরুষতন্ত্র বিরোধিতা আর পুরুষ বিরোধীতা এক নয়।ইতিহাসে আমরা বারবার দেখেছি এবং বর্তমানে দেখছি অনেক পুরুষই নারী উন্নয়নের কাজে, লিঙ্গ সাম্যের জন্য অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন। পুরুষ তন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য মহিলারাও অনেকাংশে দায়ী থাকেন। পরিবারের প্রথম সন্তান মেয়ে হলে ঠাকুর মা তার নাতনির মুখ দেখতে আসে না।কন্যা সন্তান জন্ম দেবার অপরাধে বাড়ির মহিলা সদস্যদের কাছ থেকে মাকে আজীবন গঞ্জনা শুনতে হয়। লিঙ্গ সাম্য মানে কোন নির্দিষ্ট লিঙ্গের অগ্রাধিকার কে মান্যতা না দিয়ে নারী পুরুষের সমান ভাবে বিচার করা দু'জনকেই সর্বোপরি স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখা। কোন নারী স্বাভাবিকভাবেই শৌর্য, বীরত্ব, সাহসিকতার অধিকারি হতে পারে তার জন্য তাকে পুরুষের সমান হয়ে নিজেকে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। কোন দোষ গুণ ই কোন নির্দিষ্ট লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। এই আরোপিত , চাপিয়ে দেয়া দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে মুক্তি দিয়ে নারী ও পুরুষ উভয়কেই স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে, তবেই লিঙ্গ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে তবেই সুস্থ সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে পারব আমরা।
========
অদিতি চৌধুরী।