॥ মৃণালিনী আসার আগে... ॥
আয়নার সামনে এলোকেশী কৃষ্ণকলি স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছে । বাইরে রিমঝিম বৃষ্টি।
আজ ৫, ৫ ই জুলাই । আমাদের বিবাহ বার্ষিকী । কত বছর পূর্ণ হল মনে আসছেনা এখনই । ও বিয়ের কথায় মনে এল আজ তো জন্মদিন । আসলে এত বড় বাড়ির অন্দরমহলে স্বামী সংসার বাদে নিজেকে আর আলাদা করে মনে রাখবার সময় কই ! মাতঙ্গিনী তো নিজেকে ভুলেইছে যেদিন সে কাদম্বরী হলো । বাজার সরকারের মেয়ের আবার জন্মদিন! বিয়ে দিয়ে দায় সারা হলো । বোঝা মুক্ত হয়েছিল বাবা । আমার গান শেখা, খেলার সাথী রবি হয়ে গেল আমার দেবর! স্বামী দাপুটে বাড়ির 'নতুন' । পোড়ামুখীর কপালে শিকে ছেঁড়ায় তার বাবার প্রমোশন হয়েছিল নাকি বেয়াই বাড়িতে থেকে চাকুরী শোভা পায়না বলে গাজীপুর জমিদারী দেখভালের দায়িত্ব তা জানিনে । জানি আমি শ্রীমতী কাদম্বরী জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির মেজ বউ ।
স্বামীর উপযুক্ত নই বলে বড়বৌ থেকে দালান-থাম-দেওয়াল জুড়ে ফিসফাসের ফাঁস গলা টিপে ধরে । আমি বউ, মা হতে পারলাম কই! ঊর্মিলাকে বুকে ধরে সুখ পেতাম । সেও চলে গেলে দেবেন্দ্র-দ্বিজেন্দ্র-সত্যেন্ দ্র-জ্যোতিরিন্দ্রদের ইন্দ্র মহল জুড়ে প্রতিধ্বনি; মেজ বউ ডাইনি । যে ঠাকুর বাড়ির প্রতিটি ইঁটে গান,আঁকা,কবিতা,নারী প্রগতি,উচ্চ শিক্ষা সেই বাড়ির ঝাড়বাতি থেকে হাতা-খুন্তির ঝনঝনানি আমায় ডাইনি বানিয়ে দিল! স্বামী কাজ আর বাইরে থাকা বাদে সুখ-শান্তি খুঁজে পেতেন তাঁর দাদা-বৌঠানের বন্ধ দরজাতেই। জ্যোতি'র বেহালার একটা সুরেও কি সত্যি আমি ছিলাম? সুখী হয়েছিলাম
ঠিকই, খুশি হলাম কই!
আর? এই হতভাগিনীকে বাঁচতে শেখাত ছোটবেলার গানের সাথী রবি। কত কবিতা। আমি নতুন বউঠান। আমিই তার প্রথম পাঠক,আমিই তার প্রথম সমালোচক । হ্যাঁ আমিই প্রথম । উপেক্ষিত
হতে হতে প্রথম হতে শিখেছিলাম । রবির সাথে বুনেছিলাম সাধের 'নন্দন কানন'। আর তা জুড়েই ছিল 'মল্লার' টুকু । তাই সই, ঢের পাওয়া । কালো মেয়ের কালো মেঘের জীবনে রবি তো সত্যি রবি'ই ছিল। প্রাণের রবি। কিন্তু তারও তো বিয়ের বয়স হোল। আবার একাকীত্ব! (বাইরে তখন অঝোর বৃষ্টি, এ কি রবির আদরের বৌঠানের চোখের জল!) এর চেয়ে যে মৃত্যু ভালো। কিন্তু কে বলবে তখন? কেউ বলবেনা;
"কটাক্ষে মরিয়া যায়,কটাক্ষে বাঁচিয়া উঠে,
হাসিতে হৃদয় জুড়ে, হাসিতে হৃদয় টুটে"
==============================
@নিসর্গ নির্যাস