যখন এ শতাব্দীও স্বপ্ন দেখে
'নারী 'আর 'নাড়ি 'শব্দ দুটি ভুলবশত অনেকেই মাঝে মাঝে ,বিশেষত লেখার সময় গুলিয়ে ফেলেন ।কিন্তু তাঁদের সেই ভুলের মধ্যেই থাকে শব্দ দুটির মধ্যে গভীর আত্মীকতার মূল ।মা একজন নারী ,তাঁর সাথে সন্তানের যে নাড়ির টান ।আবার যিনি মা তিনি একধারে কারোর কন্যা ,কারোর স্ত্রী -না জানি আরোও কতো সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ এক অস্তিত্বের অধিকারিণী ।শুধু সন্তানের সাথেই কি তাঁর নাড়ির টান ?আসলে তা নয় ।তিনি বাঁচেন প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর চারপাশের মানুষগুলোর জন্য ,যাদের প্রতি এক অদৃশ্য নাড়ির টান অনুভব করেন তিনি ।ভালোলাগার মানুষগুলোর জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দেবার আগে একবারের জন্যও ভেবে দেখেন না -এমনকি নিজের শখ -আহ্লাদটাও এক নিমেষে বাদের খাতায় লিখে ফেলেন ।কিন্তু সেটা কি তাঁর আশেপাশের ভালোলাগার ও ভালোবাসার মানুষেরা বোঝে ?অনেকের মতেই -''মেয়ে হয়ে জন্মেছিস ।সব পারবি ।''কারোর কারোর বিনামূল্যের উপদেশ -''মানিয়ে নে না একটু ।কথায় আছে যে সয় ,সে রয় ।''বিপরীত স্রোতে যাবার আকাঙ্খা পোষণকারী মেয়েদের সম্পর্কে পুষ্প বর্ষণ -''যত্তসব ন্যাকামো ''।অনেক নারীই আছেন যাঁরা নিজেরা বঞ্চিত হয়েছেন বলে অন্য মেয়ের স্বাধীনতাকেও খোলা মনে মেনে নিতে অপারগ ।
প্রতি বছর ৮ই মার্চ ঘটা করে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয় ।আচ্ছা এই দিনটি যদি নারী দিবস হয় ,তাহলে বছরের বাকি দিনগুলো কি পুরুষ দিবস নাকি অন্যকিছু ?ধরে নিলাম সমস্ত নারীদের প্রতি সম্মান হেতু ''নারীদিবস'' পালন ।কিন্তু শুধুমাত্র একটা দিনের ঘাড়ে সব দায়িত্ব চাপিয়ে কি দায়সারা হওয়া যায় ?
আজও অধিকাংশ পরিবারে (সে কেউ স্বীকার করুক আর নাই বা করুক )নিজেদের ঘরের মেয়েটি মেয়ে ,তাকে মাটিতে রাখলে পিঁপড়ে খাবে আর মাথায় রাখলে উকুনে ।তার শখ -স্বাচ্ছন্দ্য ,ভালোলাগাগুলো চোখের পলকে বসিয়ে রাখার মতো ।কিন্তু ঐ একই পরিবারে যখন বধূ রূপে অন্য পরিবারের মেয়ের প্রবেশ ঘটে তখন প্রবেশের পর থেকেই শুরু হয় তার মানিয়ে নেওয়ার পর্ব ,মনের সাথে ধৈর্যের অবিরাম সংঘাত ।শুরু হয় তার বাপ -মায়ের দেওয়া সংস্কারের অগ্নিপরীক্ষা ।এইভাবে বেশ কয়েক বছর কেটে যায় ,নতুনও পুরাতন হয় ।আর পুরাতন তখন অস্তাচলে ।শুরু হয় সদ্য পুরাতনের জমানা ।কিন্তু যে এতকাল অন্যায় -অবিচার সহ্য করে এসেছে সে-ও কিন্তু তার আগেরজনাদের পথই অনুসরণ করে ।ফলে চলতেই থাকে মানিয়ে নেওয়া আর সহ্য করে যাওয়ার পালা ।একবারও কারোর মাথা ও মনে আসেনা 'ভালোবাসা ','স্নেহ 'ও 'সহমর্মিতা '-র মতো শব্দগুলোর কথা ।
চেনা ছকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ঔদ্ধত্য দেখায় খুব কম জনাই ।সে ক্ষেত্রেও ''যত দোষ নন্দ ঘোষ ''।একটি মেয়ে কোনো কারণে স্বামীর ঘর ছাড়তে বাধ্য হলে সব দোষ চাপে মেয়েটির ঘাড়ে ।প্রশ্ন ওঠে মেয়েটির আচরণ ,নৈতিকতা ও চরিত্র নিয়ে ।
আমরা মাঝে মাঝেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া নিয়ে গদগদ চিত্তে বড়াই করি ।কিন্তু যখনই উদার মানসিকতা পরিচয় দেবার সময় আসে ,তখনই ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ে ।
রাস্তা -ঘাটে কোনো মেয়েকে লাঞ্ছিত হোতে দেখলে বেশিরভাগ মানুষই মহাত্মা গাঁধী উল্লেখিত তিনটে বাঁদরের মতো (চোখে দেখিনি ,কানে শুনিনি ,মুখে বলবো না অর্থাৎ প্রতিবাদ করবো না )আচরণ করেন ।ধরে নিলাম কিছু বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন দায়িত্বশীল নাগরিক প্রতিবাদ করে সেই কীর্তিমানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন ।কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেই সুপুত্রদের হয়ে সমর্থনের গান গেয়ে আগে আসেন সেই জননীরা -''আমার ছেলে কিচ্ছুটি করে নি ।মেয়েটাই নিশ্চয় উস্কেছে ।''এখানে একটি মেয়ের শত্রু যত না একজন পুরুষ তার থেকেও বেশি অন্ধ স্নেহের বশবর্তী আর এক নারী ।
আমরা নিজেরাই বলি নারী -পুরুষ সমান অধিকার ।আবার ঠিক ঠিক সময়ে নারীরা ''অবলা ''বলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংরক্ষণের জন্য ধর্ণায় বসি ।এরূপ পরস্পর বিরোধী চিন্তাধারাও কি নারীর উন্নতির পথের অন্তরায় নয় ?
কোনো পুরুষ যদি তাঁর স্ত্রীর প্রতি যত্নবান না হন বা তাকে যথাযোগ্য সম্মান না দেন ,তাহলে তাঁকে আমরা ''নির্দয় ''আখ্যা দিই ।আবার কোনো পুরুষ যদি তাঁর স্ত্রীর প্রতি অধিক যত্নশীল হন ,তাহলেও সমস্যা ।কারণ বাকিদের চোখে তিনি তখন ''স্ত্রৈণ'' ।এখানেও মূল অসুখ মানসিকতা ।
আমাদের সমাজে আবার বেশ কিছু মহান সমাজ সংস্কারক আছেন ,যাঁরা নারীকল্যাণ ও নারীর সর্বাঙ্গীন উন্নতি নিয়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়ালেও নিজের বাড়ির মেয়েদের ঘরের চৌকাঠ ডিঙানোও পছন্দ করেন না ।এক্ষেত্রে নারীর শত্রু ভন্ডামিপূর্ণ মানসিক বিকার ও সংকীর্ণ মানসিকতা ।
আসলে আমাদের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি যতদিন না উন্নত হবে নারীর উন্নতিও অধরা থেকে যাবে ।নারীকে নিজে সচেতন হোতে হবে ,আর সেইদিন এলে আলাদা করে ''কন্যাভ্রূণ হত্যা '',''পণপ্রথা '',''বাল্যবিবাহ ''-এগুলোর বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর প্রয়োজনীয়তাও থাকবে না ।বছরের একটামাত্র দিনকেও আর'' নারীদিবস''- ''নারীদিবস ''বলে গলা ফাটাতে হবে না ।৩৬৫টা দিনই নারী -পুরুষ সকলেরই হবে -
''একফালি চাঁদ যখন লুকোয় মেঘের আড়ালে ,
ঘুম পাড়ানি গান ভেসে আসে বহু দূর থেকে ।
তুমিও মোহময়ী গহীন রাত্রির আলিঙ্গনে ।
বারবণিতাও আহ্লাদে বিভোর ।
একটুকরো স্বাধীনতার স্বপ্ন ঘোরে নির্ঝরার মনে ।''
=================================