মাসি
মাস পয়লা পেরিয়ে দু-চার দিন গড়াতেই সুজয়ের মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। অস্থির হবারই কথা । lockdown এর জন্য আজ প্রায় দিন পনেরো সে ঘরবন্দি ।ও দিকে স্কুলবন্ধ, তাই বাড়ি থেকে ১৮০ কিমি দূরের কর্মস্থলে যাবার ও সেখানে আর থাকার কোনো কারন নেই।কিন্তু সমস্যা হলো, ঐ খানের বাড়িভাড়া ও বিশেষত তাকে ১৫ বছর ধরে মাতৃস্নেহে আগলে রাখা দুঃস্থ, সহায় সম্বলহীন ও ৬৫ বছর বয়সেও রীতিমত খেটে খাওয়া মাসির মাস মাইনের বকেয়া টাকাটা পাঠানো হয়নি ।
সুজয় মনস্থির করে , না আর দেরি নয় । যে করেই হোক আজই তাকে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। একটু ভেবে নিয়ে সুজয় তার যথেষ্ট সচ্ছল retired bank officer বাড়িওয়ালা কে ফোনে ধরে। " হ্যালো রমেন বাবু , আমি সুজয় বলছি । আপনারা সবাই ভালো আছেন তো ? " ও পাশ থেকে একটু থেমে ভারী গলায় উত্তর আসে - " হ্যাঁ , আছি । আপনি ? " সুজয় বলে " হ্যাঁ , আমিও একপ্রকার আছি। বলছিলাম যে, আপনি যদি আপনার account no টা পাঠাতেন - তো আমি বাড়িভাড়া টা পাঠিয়ে দি । সুজয়ের কথা শেষ হবার আগেই গদগদ গলায় রমেন বাবু - হ্যাঁ হ্যাঁ পাঠাচ্ছি, এখনই what's app করে দিচ্ছি।
মেঘ কেটেছে এই আশায় , সুজয় এবার তার মনের কথাটা রমেন বাবুর কাছে পারে - " হ্যালো রমেন বাবু , বলছি আপনার বাড়ি ভাড়ার সাথে আমি মাসির টাকাটাও পাঠিয়ে দিচ্ছি কেমন । আপনি আপনার সুবিধে মতো সময় বলুন, আমি মাসিকে তা জানিয়ে দিচ্ছি , উনি না হয় যথা সময়ে এসে আপনার বাড়ির দরজার বাইরে থেকেই নিয়ে যাবে " । এবারও প্রায় সাথে সাথে - "না , না আপনি আমার টাকাটাই পাঠান " । ও পাশ থেকে লাইনটা কেটে যায়।
ঘর দুয়ারে মুখের উপর দড়াম করে কেউ যেন দরজা বন্ধ করে দেয় । একরাশ হতাশা, বিরক্তি ও যারপরনাই মনকষ্ট নিয়ে , সুজয় মাসিকে ফোন করে - "হ্যালো মাসি , কেমন আছেন ? " ও পাশ থেকে কেউ যেন হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে পায়, অভিমানের সুর ভেসে আসে - " এই দ্যাখো বাবা, এতদিনে তোমার মাসিকে মনে পড়লো ?" আমতা আমতা করে সুজয় বলে " না মাসি, আসলে ফোন করা হয়নি , মানে " । যাক বেশ করেছ বাবা - আগে বলো দেকিনি কেমন আছো , বউমা , দাদু ভাই কেমন আছে , বলি বাড়ির সবাই ভালো আছেন তো ? কি সময় পরলো গো, এতো বাপের জন্মেও দেকিনি " । বহুদিনের চেনা , মাসির সেই বকুনি, হাল্কা মেজাজ ও অকৃত্রিম ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়ে সুজয় মনে বল পায় । সে বলে " মাসি আপনার টাকাটাও তো এখনো পাঠাতে পারলাম না " । মুখের কথা প্রায় কেড়ে মাসি বলে ওঠে - " হায় দেখো, এই বিপদের দিনে তুমি এই সব ভাবছো ? আমাকে নিয়ে তোমার এত চিন্তা করতে হবে নে । তুমি বরং তোমার বাড়ি ওয়ালার খবর নাও । বলেই সেই পরিচিত খুনসুটি মার্কা হাসি । সুজয় বলেই চলে " মাসি বলছি , আমার মতো আরও একজন মাস্টারমশাই এর ও তো আপনি রান্নাবাড়ি করতেন, তিনিও বাড়ি চলে গিয়েছেন না ? ধমকের সুর উল্টো দিক থেকে " হ্যাঁ গিয়েছে , তো তোমার কি ? না, বলছিলাম , এই দুর্দিনে আপনার হাত তো প্রায় ফাঁকা । যদি আপনি আপনার bank এর নম্বর টা দিতেন তো আমি এখনই টাকাটা পাঠিয়ে দিতাম । এবার বিরক্তির সুরে " ধুর-ধুর , আমি ও সব জানি গা । আরে বলছি তো, আমি ঠিক চালিয়ে নেব- তোমরা আগে সাবধানে থাকো দেকিনি। ঠাকুর ঠাকুর করে সব ভালো হয়ে যাক, সবাই ভালো ভাবে ফিরে এসো- তারপর না হয় হবে"। শেষের কথাগুলো বলতে বলতে মাসির গলাটা কেমন যেন কেঁপে গেল।
হ্যাঁ, মাসি আপনিও সাবধানে থাকবেন।
বুক ফেঁটে বেরিয়ে আসা প্রবল বাষ্প চাপ কোনো রকমে সামলে সুজয় ফোনটা ছেড়ে দেয়। তার ঝাপসা চোখের সামনে তখন কেবলই দাড়িওয়ালা , বিস্ময়ের বিস্ময় সেই মানুষটার মুখ। যিনি বলেছিলেন " ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত, পাঠায়েছ বারে বারে দয়াহীন সংসারে...."
=============
সন্তু চ্যাটার্জী
আসানসোল