google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re নিবন্ধ -- সবিতা বিশ্বাস - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

শনিবার, ১৬ মে, ২০২০

নিবন্ধ -- সবিতা বিশ্বাস


 

মানব-ধর্ম   



“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
 আসে নাই কেহ অবনী পরে
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে” |

কবি কামিনী রায়ের লেখা এই লাইনগুলোর মধ্যেই নিহিত আছে মানবতার ধর্ম | তবুও আরো বিশদে মানবতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই জানতে হবে মানবতা কি ? মানবতা কার জন্য ?
যদিও মানবতা কথাটির গভীর তাত্পর্য আছে তবুও সাধারণ দৃষ্টিতে মানবতা হল মানুষের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য যার দ্বারা একজন মানুষ পূর্নাঙ্গমানুষে পরিণত হতে পারে |
এক কথায় মানবতা হল মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা | সেটা হোক পাশের বাড়ির বা হাজার মাইল দূরের কোনো মানুষ |
এবারে প্রশ্ন আসবে মানবতা কি আপেক্ষিক ? আসলে এটা আপেক্ষিক না হলেও আমরা এটাকে আপেক্ষিক বানিয়ে ফেলেছি | স্থান, কাল, ধর্ম, ইত্যাদির উপর নির্ভর করে মানবতার রূপ ভিন্ন হতে পারে | এই মহাবিশ্বের সমস্ত কিছুর একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম রয়েছে | অক্সিজেনের ধর্ম লোহার সাথে বিক্রিয়া করে মরিচা তৈরী করা, আবার লোহার নমনীয়তা ধর্মের কারণেই তাকে পিটিয়ে পাত করা যায় |

তেমনি মানুষেরও কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম আছে | এই ধর্ম বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলোকেই আমরা মনুষ্যত্ব, মানবতা বা মানবধর্ম বলে থাকি | তবে মনুষত্য বা মানবতার ক্ষেত্রে শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয় | এবং আচরণগত বা মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয় |
অতএব বলা যায় যে, আচরণগত বা মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকলে কোনো ‘Homo Sapiens’ কে মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়, এবং তাকেই মনুষত্য বা মানবতা বলে |
এই বৈশিষ্ট্যগুলো হল ধৈর্য, ভালবাসা, সহনশীলতা, একতা, ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শ বা যুক্তি, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি |

উপরের এই সবকটি গুণ আমরা যার মধ্যে দেখতে পেয়েছি তিনি মানবতার প্রতীক মাদার টেরিজা | সারা বিশ্বের দুঃস্থ মানুষের ভরসার ও মমতাময়ী মায়ের প্রতিমূর্তি ছিলেন যে নারী তিনিই মাদার টেরিজা | তিনি তাঁর জীবন উত্সর্গ করেছিলেন মানব কল্যাণে | মাত্র পাঁচ টাকা মূলধন নিয়ে তিনি যে “মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন তা আজ সারা বিশ্বে সম্প্রসারিত হয়েছে শত শাখা প্রশাখায় |

মাদার বলতেন তুমি যদি মানুষকে বিচার করতে বসো তবে তাকে ভালবাসার সময় পাবেনা | আর ভালবাসতে গেলে সময় দিনক্ষণ লাগেনা | কারণ গতকাল চলে গেছে, আগামীকাল নাও আসতে পারে, আমাদের হাতে শুধুমাত্র আজকের দিনটাই আছে | তাই আজ থেকেই মানুষের সেবার কাজে লেগে পড়ো | আর এই কাজটাই শুরু করতে হবে নিজের পরিবার থেকে  | পরিবারের সকলের প্রতি সমান মানবিক আচরণ করতে হবে তবেই ভবিষ্যতে বিশ্বশান্তির কথা ভাবতে পারবে |

এই কথাগুলোই আমাদের বাংলার কবিরা শুনিয়ে গিয়েছেন তাদের কাব্যে সাহিত্যে | তাইতো চন্ডীদাস বলেছিলেন, “শুনহ মানুষ ভাই সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই |”
সে বাণীর প্রতিধ্বনি তুলে মানব প্রেমিক ফকির লালন সাঁই বলেছেন, “এই মানুষে আছে রে মন যারে বলে মানুষ রতন |”
তাই লালনের সিদ্ধান্ত মানুষের সাধনা হল আসল সাধনা | এই মানবপ্রেমই ছিল রবীন্দ্রনাথের কাব্যচর্চার প্রধান অনুষঙ্গ | তাই তিনি লিখেছিলেন, “মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই |” রবীন্দ্রনাথ মানবমুক্তির বিশুদ্ধ পরিচয়ে বিশ্বমানুষকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন | বিশ্বজোড়া মানবপীড়নের মহামারী থেকে মানবাত্মার অপমান ভুলে মুক্তির গান গেয়েছেন ---

“শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান
সব দুর্বল সংশয় হোক অবসান |”

প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মানবতার মূর্ত প্রতীক | তাঁর সব চিন্তা ও কর্মের কেন্দ্রস্থলের প্রাণশক্তি ছিল মানব কল্যাণ দর্শন |

সাম্যবাদী, মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল বলেছেন----
“গাহি সাম্যের গান ----
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান |
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি |”

মনুষ্যসৃষ্ট নানা বিভেদরেখায় বিভক্ত এই সমাজকে দেখে যারপরনাই বিচলিত ছিলেন কবি নজরুল | এসব থেকে কায়মনোবাক্যে মুক্তি চাইতেন তিনি | সেই কারণেই তাঁর রচিত সাহিত্যের প্রধান উপাদান হয়েছে মানবতাবাদ, সাম্যবাদ আর অসাম্প্রদায়িক চেতনা |

একই পথের পথিক ছিলেন মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী | তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের স্বভাবে শান্তি ও স্বাধীনতার জন্য সহজাত উপাদান রয়েছে | সেগুলোর সদ্ব্যবহারে বিশ্বে শান্তি স্থাপন ও মানুষের মুক্তি অর্জন সম্ভব |
দক্ষিন আফ্রিকার প্রেটোরিয়াতে গান্ধীজির যে মানবাধিকার আন্দোলন তার তুলনা পৃথিবীতে বিরল |
বর্তমান বিশ্বের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ, জীবন, ও শিক্ষা অনুকরণীয় | তাঁর অহিংস আন্দোলন, মানবতাবাদী দর্শন ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা শুধু বাংলাদেশ বা ভারত নয়, সারা বিশ্বের জন্য এক আলোকবর্তিকা |

মানবতাকে কোনো গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখা যায় না | তাই তো কবি জসীমুদ্দিন লিখেছেন—

“আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা
আমি বাঁধি তার ঘর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই
যে মোরে করেছে পর |”

কিন্তু বর্তমানে মানবিকতা কোথায় ? মানবিক মূল্যবোধ কোথায় ? মানবতা কি এখন জীবনানন্দের বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে ?

মানবিকতার মূল্যবোধ জন্মায় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে | এই মূল্যবোধ থেকেই আসে পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, আন্তরিকতা, ধৈর্য, সহ্য ইত্যাদি গুণাবলী |

সেকারণে সাম্যবাদী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন—

“আমাদের থাক মিলিত অগ্রগতি;
একাকী চলতে চাইনা এরোপ্লেনে;
আপাতত চোখ থাক পৃথিবীর প্রতি,
শেষে নেওয়া যাবে শেষকার পথ জেনে |”

কিন্তু বর্তমানে মানবিক গুণাবলীকে বিসর্জন দিয়ে মানুষ মেতে উঠেছে অনৈতিক কাজকর্মে | বানিজ্যিক স্বার্থের কাছে মানবতা বোধ গৌণ বলে বিবেচিত হচ্ছে | প্রকৃতির সন্তান মানুষকে মানব হিসাবে না দেখে ধর্ম, ভাষা,জাতি এবং ভূখন্ডগত ভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হচ্ছে যা মানবজাতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে | মানবসভ্যতার নুতন প্রজন্ম জন্মগত ও পরিবেশগত ভাবেই দীক্ষা নিয়ে বড় হচ্ছে ফলে ভবিষ্যতে মানবজাতির মধ্যে আরো পার্থক্য সৃষ্টি হবে | এবং তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে | এর ফলে মানবতা লাঞ্ছিত হবে |

মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়-দায়িত্ব মানুষেরই | তাই কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলি-

“মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও
এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও, এবং ভালোবেসে দাঁড়াও
মানুষ বড় কাঁদছে তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও |”

                                    -------


সবিতা বিশ্বাস
প্রযত্নে – লন্কেশ্বর বিশ্বাস
গ্রাম + পোস্ট – মাজদিয়া (বিশ্বাসপাড়া)
(শুভক্ষণ লজের পাশে )
জেলা-নদীয়া পিন-৭৪১৫০৭
ফোন-৮৯০০৭৩৯৭৮৮                   
ই মেইল- sraybiswas@gmail.com    
ভারত