পরিচিতি
পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের আলোর নরম ছোঁয়া ছোটো ছোটো ভুট্টা গাছগুলোর ওপর পড়ছে । সবুজ পাতাগুলি এই আলোতে আরও গভীর জীবন্ত মনে হচ্ছে । গাছগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে সাদেকের জমিতে আসা । গত বছর ভুট্টা চাষ ভালো হয়েছিল । কোনো কোনো গাছের পাতাগুলো উল্টে দেখছে । কোনো পোকা বা অসুখ করেছে কিনা । চাষের জমিতে এলে একটা সুন্দর খুশির অনুভূতি হয় । প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার আত্মোপলব্ধি । কোনো বাধা নেই । নেই কোনো নিয়ম ।আছে শুধুমাত্র জমির সঙ্গে আত্মীয়তা ।সাদেক দিগন্তের দিকে ভাবে ।কত বৈচিত্র্যময় জীবনের গভীরে রয়েছে শক্তি । পৃথিবীর মানুষ এগিয়ে চলেছে নতুন নতুন চিন্তা তথ্য প্রযুক্তি তে ।অন্য দিকে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষ , ভাষার মানুষ , রাজনৈতিক মা্নুষরা নিজ নিজ মতে আনার টানাটানি করছে । মানুষের ইচ্ছা স্বপ্ন অভিরুচি কারোর অমঙ্গল না হলে কেন আমরা নাক গলাব । কালকের রাতের শালিশে মওলানার কথায় প্রায় সবাই মত দিলে ।মরিয়ম আর সায়েমের জীবন কে অভিশপ্ত করে তুলল । সাদেক বলেছিল ," মরিয়ম -সায়েমের মধ্যে কোনো সমস্যা নাহলে আমরা উচিত অনুচিতের বোঝা তাদের ওপর চাপাচ্ছি কেন ? "
মওলানা জোরের সঙ্গে দৃড় আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলল, " ইসলাম কুনো বেদাত নাপাক পছন্দ করেনা ।এটা আমাদের মর্জির ওপর নির্ভর করে না ।সব কিছু হাদিস কু্রআন অনুযায়ী চলতে হবে ।নাপাক কাজ বরদাস্ত নয় । জাহান্নামের আগুনের ভয় মুসলিম উম্মাহর কে করতে হবে । মরিয়ম যে কাজ করেছে তার কুনো নজির নাই। এ সন্তান অবৈধ । সায়েম পিতৃত্বের দাবি করতে পারে না।"
শালিসের মধ্যে থেকে কে একজন বলল, বউ কার ?
লোকজন যেন তেলে ভাজা মুখরোচক খাবার পেল । গুঞ্জন উঠল । চারিদিকে 'কার বউ ?' আওয়াজ উঠল । শালিশী সভা গম গম করে উঠলো । কার বউ ,কার বউ !
মরিয়মের মনে হলো সে যেন বাজারি মেয়ে। বাজারি মেয়ে কেও তো এভাবে তরিয়ে তরিয়ে মানুষ উপভোগ করে না । এতগুলো পুরুষ তাকে এক সঙ্গে লাঞ্ছনা করতে উন্মুখ । সবাই যেন একসঙ্গে ধর্ষণের জন্য হামলে পড়ছে । মানসিক যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে থাকে । তার বলার কিছু নেই ।
সভায় নারায়ন মেম্বার ছিলেন । তিনি মুখ খুললেন । সবাইকে চুপ করিয়ে বললেন, "মরিয়ম সায়েম সুশিক্ষিত ও ভদ্র সন্তান । ঘটনাটির দু রকম অভিমুখ আছে । একটি সরকারি আইনি দিক । তারা একাজ টি করেছে সম্পূর্ণ সচেতন ভাবে । তোমরা যে কেউ জন স্বার্থের মামলা করতে পার । আর একটি মুসলিম সমাজের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার । ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত ।এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। আর আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো , এটা নিয়ে যেন বাড়াবাড়ি না করি । মহাভারতে এ ঘটনা অনেক আছে । "
সভায় কেহ মন্তব্য করল , "আমরা মানব কেন ? "
নারায়ণ বললেন , "আমি তো আগেই বলেছি । এসব তোমাদের ব্যাপার । আমরা যদি বাড়াবাড়ি না করি অর্থাৎ ওরা ওদের মতো থাক ।ওরা আমাদের পাড়ায় থাকে না । কোনো সমস্যা নেই ।"
মওলানার ভালো লাগলো না এ সব কথা । উনি রাগ করে চলে গেলেন । যাওয়ার সময় ক্ষুন্ন হয়ে বললেন , " তোমরা ঠিক কর ,হারাম হালাল মেনে চলবে কিনা ।"
সভা এলোমেলো হয়ে গেল । যারা ভেবেছিল এতদিন সায়েমের বাবা কত জন কে গ্রাম্য শালিশে শাস্তি দিয়েছে ।আজ তার প্রতিশোধ নেবে ।এই দলের একজন বলল, "সায়েমের বাবার মত স্পষ্ট করে শুনতে চাই ।"
অনেকে একসঙ্গে সমর্থন জানালো ।
সায়েমের বাবা লিয়াকত সাহেব বললেন , "শোনো ভাই , ছেলের সঙ্গে আমি সম্পর্ক রাখব না । আমার সম্পত্তি বাইরের কেউ পাবে ,এ হতে পারে না ।"
ঘটনাটি কেউ জানতে পারত না । গত সপ্তাহে মরিয়মের ছেলের বার্থ সার্টিফিকেট নিতে পঞ্চায়েত অফিসে সে নিজেই গিয়েছিল । ছেলের বাবার নামের জায়গায় লিখতে চায় , সোহান । সবাই মরিয়ম কে চেনে লিয়াকত সাহেবের বউমা হিসেবে । প্রধান সাহেব থেমে যান। বলেন, "সায়েমের নাম তো সোহান নয় ,মা । কী ব্যাপার ? "
মরিয়ম বলল, " আমি যা বলেছি তাই লিখুন ।"
মরিয়ম অফিস থেকে ফিরে আসার পর কথাটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে । সোহান তো মরিয়মের আগের স্বামী নয় । এখনো সে সায়েমের স্ত্রী । তাহলে সোহান কীভাবে ছেলের পিতা হতে পারে ? এই প্রশ্ন সবার । লিয়াকত সাহেব ছেলের কাছে জানতে চাইল । সায়েম কে বলল, "পাড়ায় আমার মুখ দেখানো কঠিন হয়ে পড়ছে । তুমি আমার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার কর ।"
সায়েম ভালভাবে জানে এ বিষয়টি ঘরে বাইরে জটিল হয়ে উঠবে । কিন্তু এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা যৌথভাবে ।
এ সিদ্ধান্তে আসার আগে অনেক ঝড় ঝাপ্টা গেছে । গেছে মনের সঙ্গে লড়াই তাদের ।
সায়েমের বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক আগে । ভালবেসে বিয়ে । বাড়িতে জানিয়ে ছিল সায়েম ।ওর বাবা মা মেয়ের পরিচয় নিয়ে যোগাযোগ করেন । শেষে বড়ো অনুষ্ঠান করে বিয়ে দেন লিয়াকত হোসেন। বিয়ের আড়ম্বর ছিল দেখার মতো।এখন বিয়েতে চার চার চাকার গাড়ি আকছার ব্যবহার হচ্ছে ।বরের জন্য নামি কোম্পানির ছোটো লাক্সারি গাড়ি আর বরং যাত্রীর জন্য টাটা সুমো কিংবা বোলোরো । কিন্তু সায়েম বাবার একমাত্র ছেলে । ভালো অবস্থা । এলাকায় নাম ডাক আছে । ভালো চাকরি করে । লিয়াকত সাহেবের ইচ্ছা বর যাবে নবাবি পালকিতে । খোঁজ খবর নিয়ে তিনি জোগাড় করেন পালকি । সাজু গুজু বৌভাত সব কিছু চোখ ধাঁধানো । এলাকাবাসী বাসী মনে রেখেছে সে সব । দেখতে দেখতে সায়েম মরিয়ম পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করল শেষ মার্চে ।
মা বউমাকে বলে, আমি তোমাদের ছেলে মেয়ের মুখ দেখতে চাই । তোমরা সন্তান নাও ।
মরিয়ম রাত্রে সায়েম কে মায়ের কথাটা তুলল ।সেও চায় তাদের কোলে একটা সুন্দর শিশু আসুক । তারা সন্তানের আসা বিলম্বিত করেছে তা নয় । স্বাভাবিক ভাবেই ছলছে তাদের দাম্পত্য । সন্তান লাভের ইচ্ছার প্রকাশ সায়েম আগেই জানতে পেরেছে । তাই বলল, আমাদের গাইনিক দেখাতে হবে । এবার বাঙালুর গিয়ে দেখিয়ে নেব । সে মতো বিখ্যাত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুধা রমেশের চেম্বারে যায় তারা । কতকগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার পর কয়েক বার চেম্বারে যাওয়ার পর ডাক্তার বাবু বললেন , " very sorry .Frankly speaking you have lacking to produce sperm."
মরিয়ম উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছিল, "স্যার কোনো উপায় নেই ?।
" কোনো উপায় নেই ।তা বলতে পারি না। তোমরা যদি IVF কর তাহলে, A donor sperm can then be obtained from semen banks."
মরিয়ম সায়েম ভাঙা মন নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাসায় ফিরল ।পথে কোনো কথা নেই । মরিয়ম ওর হাত ছুঁয়ে বলেছিল , " আমরা লড়াই করব । ভেঙে পড়ব না ।" সায়েম যেন আরও বরফের মত শীতল হয়ে গেল ।
ভেঙে পড়ল রাত্রে ঘুমানোর সময়ে । তার পৌরুষের পরাজয় । দাম্পত্য জীবনের গভীরে অন্তর্লীন অসহায়তা তাকে হতাশায় ডুবিয়ে দেয়। মরিয়ম তাকে টেনে নেয় কাছে ।বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, "না ,তুমি এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল । কত মানুষ আছে , ভেবে দেখেছ ? কোনো ছেলে মেয়ে নেই । তারা তো বেঁচে আছে । "
" তুমি মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছ ,এর জন্য আমি দায়ী । "
" এভাবে ব্যাপারটা দেখছ কেন ? উল্টোটা হতে পারত, তাই না ? আমাদের কোনো হাত নেই । মেনে নাওয়া ছাড়া কী করতে পারি !"
এভাবে সান্ত্বনা দেয়ার পরেও সকাল থেকেই সে চুপ চাপ হয়ে গেল ।কথা প্রায় বলে না । হাসি খুশি ভাব নেই । নিরুত্তাপ ভাবে কাজ কর্ম করতে থাকে । আগের মতো লিভিং স্পিরিট পায়না । একদিন তারা এক সাইকাটিস্টের কাছে গেল । সব শুনে উনি বললেন, " এটা কে তোমরা সমস্যা মনে করছ কেন ? পিতৃত্ব মাতৃত্ব আমাদের হাতে নেই । পৃথিবীতে ভুরি ভুরি নিঃসন্তান মানুষ আছেন। তাঁরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন । জীবন যেমন তেমন ভাবে উপভোগ কর । একই কথা ভাবতে থাকলে অবসেসন হবে । শান্তি নষ্ট হবে ।"
মরিয়ম বলল, " ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না । ও শুধু বলছে , আমাকে ডিপ্রাইভ করছে । আমার মাতৃত্বের যোগ্যতা আছে । পুরুষ হিসেবে সে ব্যর্থ । "
ডাক্তার বাবু বললেন, " কে কবে বিয়ের আগে যোগ্যতার পরীক্ষা করে বলো ? তোমাদের মধ্যে ভাব ভালোবাসা আছে , পারস্পরিক দায়িত্বশীলতা আছে । স্বামী স্ত্রীর এটা বড় সম্পদ । জানো , আমাদের কোনো সন্তান নেই । মনে করো , যে আসবে তাকে এ পৃথিবীতে কষ্ট দেবে না , দেখবে ধীরে ধীরে কষ্ট কেটে যাবে । আর তা না হলে সিমেন ব্যাঙ্ক থেকে সিমেন নিয় আই, ভি এফ করতে হবে ।"
সেদিন সিনিয়ার ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফিরে এলো । তারপর সায়েম এ নিয়ে কথা বলেনি ।
কিছু দিন পর মরিয়মের খালা শাশুড়ি এলো । শাশুড়ির মুখে সব শুনল । মরিয়ম কে শুনিয়ে বলল, "ব্যাটা ছেলের বাঁঝা হওয়ার কথা তো শুনিনি । তোর বউ-ই বাঁঝা ।" সেদিন সায়েম ঘরে ছিল ।তার খালার কথা তার বুকে আঘাত করল । আর তার দুর্বলতার জন্য তার বউ কে অপমানিত হতে হবে । সে অপমান তার নিজের । সংগোপনে পৌরুষের অকারণ বড়াই চলতে থাকবে ।তা তার অসহনীয় হয়ে উঠল । স রাত্রে মরিয়ম কে শান্ত ও স্থির ভাবে বলল , " তুমি আমাকে ত্যাগ কর । নতুন করে সংসার পেতে মা হও ।"
মরিয়ম সন্তান কন্দ্রিক কথা বার্তায় ধৈর্য্য শৌর্য দেখিয়ে এসেছে কিন্তু আজ রুষ্ট হল ; কষ্ট পেল । তার ভালবাসার মানুষের মুখে আজ কী কথা শুনছে ? সে কী বলছে ? মরিয়ম বলল, " তুমি কী এসব বলছ ? আমি মা হতে চাই না । বেশ আছি । তুমি যদি আমাকে আর না ভালবাস, সহ্য করতে না পার ,ত্যাগ করতে পার ।মা হওয়ার জন্য আবার বিয়ে করার দরকার আমার নেই । "
সায়েম এ ব্যাপারে অস্থিরতার পরিচয় অনেক বার দিয়েছে । তার অক্ষমতার কারণে তার স্ত্রী মা হতে পারে নি । অথচ পরিবারের সমাজের মানুষ মরিয়ম কে আড় চোখে দেখে । শুধু মেয়ে হওয়ার জন্য তাকে দোষারোপ করা হচ্ছে । সে বলল, " শোনো মরিয়ম , আমি চাই তুমি মা হও । সিমেন ব্যাঙ্ক থেকে নয় , আমাদের পরিচিত কারো থেকে সিমেন নিয়ে আই. ভি . এফ. করি । পিতৃ পরিচয় আমার থাকবে না ।"
"এর পরিণাম কী হতে পারে ভেবে বলছ ? আমি মেনে নব ,না ; মানব না , তা নির্বাচনের অধিকার আমার তারকবে না ? "
" মা হওয়ার অধিকার তোমার জন্মগত ।বরং আমি তোমাকে বঞ্চিত করছি "
"সিমেন ব্যাঙ্ক থেকে নয় কেন ? নিলে আমরা সেফ থাকব ।"
"সত্য সত্য থাক । আমি মিথ্যা পিতৃত্বের পরিচয় চাই না । আশা করব , আমাকে ভালবেসে তুমি মেনে নেবে ।"
সায়েম বলল, " বাবা, এটা আমার সিদ্ধান্ত ।"
বাবার মুখ থেকে একটা কথা বেরুলো না । বলতে গিয়ে ঠোঁট নড়ে উঠলো কিন্তু মুখটা হা হয়ে গল ।