অশ্বক্ষুরাকৃতি একটি নিরেট পাহাড়কে কেটে কেটে মোট ৩০টি গুহা। গুহার ভিতরে ও বাইরে চিত্রকলা ও ভাস্কর্য শিল্পকর্ম দেখতে দেখতে যখন একটু লম্বা শ্বাস নেওয়ার কথা মনে হবে তখন বাঁ-পাশের পাথুরে রেলিং-এ হেলান দিয়ে বসে উল্টোদিকে তাকালে দেখা যায়, দুটো পাহাড়ের সরু বাঁক দিয়ে কোনো এক অজানা ঝর্ণার জল কুলুকুলু শব্দে পাথুরে পথ বেয়ে একেবারে সামনে দিয়ে এগিয়ে চলেছে -- যেন সেই নিজের উত্থানকাল ২০০ খ্রী-পূর্ব থেকে ৫০০ খ্রীষ্টাব্দ এর প্রাচীন কোনো সময়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক অনুভূতি ছুঁয়ে যায়।
মনে করা হয় যে, সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব যখন ভারতে কমতে শুরু হয়েছে তখন এই জনপদ জনশূন্য হতে শুরু করে। ১৮১৯ -এ ব্রিটিশদের হাত ধরেই এর খোঁজ পাওয়া যায়। তখন এটি ঘনকালো জঙ্গল ও বন্য পশু পাখির আস্তানা ছিল। পরবর্তীকালে এঁর রক্ষনাবেক্ষন শুরু হয়। এই হাজার বছরের অযত্নের প্রভাব এখানে প্রতি পদে পদে চোখে পরে। এই অসীমসুন্দর কারুকার্য বেশিরভাগই নষ্ট হয়েছে। চিত্রগুলোর রঙ উঠে গেছে - বদলে গেছে। এখন ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট থেকে এঁর উপর কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট এর কাজ শুরু করিয়েছে, ফলে চিত্রগুলি স্পষ্টতর হয়েছে। হলুদ, সবুজ, সাদা, মেটে, নীল, সোনালী রঙ গুলো সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে।
গাইডের থেকে জানা গেলো, প্রধানত হীনযান ও মহাযান প্রভাবই প্রাধান্য পেয়েছে। গৌতম বুদ্ধের জীবনী, পূর্বজন্ম, জাতক কাহিনী, বিভিন্ন রূপে বুদ্ধের চিত্র, অপ্সরা, নারীমূর্তি, পশু-পক্ষী, লতা-পাতা, ফুল-অলংকার এর অতিউত্তম ও সুক্ষ চিত্রকলার উদাহরণ এখানে পাওয়া যায়। গৌতম বুদ্ধের রাজবেশ, ব্রাম্ভনবেশ এর চিত্র অন্য মর্যাদার জায়গা করে নিয়েছে। উপরের ছবিটি পৃথিবীতে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী, প্রথমটি মোনালিসা।....বলা বাহুল্য যে এই চিত্রটি তে মুখের অভিব্যেক্তি-তে, দৈহিক-ভঙ্গিমায় মোনালিসাকে অনেক পিছনে ফেলে। চিত্রকলার গুণগতমান প্রকাশ পায় এঁর থ্রি-ডি প্রভাব থেকে। বুদ্ধ এখানে দেওয়াল-এর চিত্রপট থেকে এগিয়ে এসেছে, চিত্রটি কে ডানদিক ও বাঁদিক থেকে দেখলে আলাদা আলাদা দেহভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। দুটো কাঁধের উপর-নীচ ও চোখের চাহনীর পরিবর্তন পরিষ্কার নজরে আসে। কিন্তু যেহেতু এর খোঁজ মোনালিসার প্রকাশকালের পরে পাওয়া গেছে তাই এর স্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয়। এই চিত্রটি 'পদ্মপানী' নামে খ্যাত।
আর একটি বিখ্যাত চিত্র হলো 'বোধিসত্ত্ব বজ্রপানী'। চিকন দেহভঙ্গিমায় এক সুপুরুষ, যার মাথায় রত্নখচিত মুকুট, দেহে অলংকার, কোঁচানো রঙিন ধুতির বৈশিষ্ট লক্ষণীয়। কি নিখুঁত অলংকরণ .... সোনালী রং এতো উজ্জ্বল আর তাঁর সূক্ষতা ছবিতে দেখে তাঁর বিচার সম্ভব নয়। সামনে থেকে দেখলে অবাক হতে হবে যে হাজার বছর আগে কিভাবে এই নিপুনতা পাওয়া সম্ভব ! মনে হবে, এখনকার সময়ের কোনো ছবি হয়তো। এঁর যে এতো বয়স তা অবিশ্বাস্য। আসেপাশের সব চরিত্র গুলোর অভিব্যক্তি ও অভূতপূর্ব। একটা সম্পূর্ণ গল্প বলে দেয়।
গাইড লক্ষ্য করালো যে একটি বিশেষ গুহায় ছাত-টিতে 'সামিয়ানা ধাঁচ' তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য। পুরো ছাত জুড়ে নিখুঁত বুননে চিত্রায়ণ। চাঁদোয়া -এ হাওয়া লাগলে যেমন ঢেউ খেলানো ভাব লক্ষ্য করা যায় তেমনি ভাব আনা হয়েছে চিত্রে রঙের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। আরো বেশ কয়েকটি ছবি তে থ্রি-ডি এফেক্ট দেখা যায়। গ্রাম্য জীবন-শৈলী বর্ণন চিত্রগুলি জ্যামিতিক প্রভাব বিশিষ্ট। একটি চিত্রের কথা বলতেই হয়, চারটি হরিনের একটি-ই মাথা।.... চারদিক দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলে প্রত্যেকটা ছবিই সম্পূর্ণতা পায়। আর একটি উন্মক্ত দাঁতাল হাতির চিত্র ও তারিফ করার মতো... নিখুঁত চিত্রণ ও রঙের সামঞ্জস্য অতিসুন্দর। অন্য একটি গুহায় গৌতম বুদ্ধের একশো টি রূপ বর্ণনা করা হয়েছে।
এক অপ্সরার চিত্রের কথা না বললে বাকি থেকে যায় ... মাথায় আলংকারাচ্ছাদিত পাগড়ি, গলার নকশা কাটা রঙিন পাথরের হার, বাজুবন্ধ, চুড়ি, কানের এর সুন্দর মেলবন্ধন। এখনকার স্টাইল স্টেটমেন্ট এর মতন বলা যায়। এই ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল যে, আমরা একুশ শতকে দাঁড়িয়ে নিজেদের সিভিলাইজড মনে করি। ভাবি মানবসভ্যতার উৎকৃষ্টতম সময়ে আমরা বসবাস করছি কিন্তু ইতিহাসের পাতা ওল্টালে হয়তো এই চরম সত্যটাকে আর একবার ভেবে দেখতে হয়। আমরা জানিনা বা তার প্রমান নেই বলে সেগুলো সত্য না বা অস্তিত্বহীন হয়ে যায় না। কতটা উন্নত উপকরণ আর কতটা নিপুনতা না থাকলে এমন অমোঘ সৃষ্টি করা সম্ভব.... ভাবার বিষয়।
কিছু গুহা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, কিন্তু অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো গুহাগুলির ভিতর শিল্পসৃষ্টির কোনো ফাঁক নেই। সমস্ত দেওয়ালজুড়ে তো বটেই, ছাত আর স্তম্ভ গুলোতেও সূক্ষাতিসূক্ষ চিত্রপট। যেন শিল্পী-সন্ন্যাসী নিজের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব এখানে প্রদর্শন করছেন।
সবশেষে বলা যায়, অজন্তা প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য-ভাস্কর্য শিল্পের এক অমর উদাহরণ... যেখানে পাথর ও কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে ।।
-------০০০-------
Shrabani Roy
Serampore
Mob: 9883206783