করোনাভাইরাস অভিশাপ নয় আশীর্বাদ
দিনে দিনে পৃথিবীর অসুখটা বেড়েই চলেছে, বাড়ছে গৃহবন্দি মানুষগুলোর চরম উদ্দীপনা।
লোকালয়ে ফিরছে জঙ্গলের জীবজন্তু। চেনা পৃথিবী, চেনা পরিবেশে আজ বড্ড অচেনা। সত্যি প্রকৃতি এভাবে তার বদলা নিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সৃষ্টিতে সবুজ সতেজ পরিবেশে ছিল অফুরান জীবন বাঁচার রসদ। পৃথিবী ছিল জীবজন্তুদের দখলে। ধীরে ধীরে সেই পৃথিবীর বুকে মানব সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। সেই সভ্যতা শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে থাকে। আধুনিক থেকে আধুনিকতর হওয়ার লক্ষ্যে সবুজ সতেজ জঙ্গল কেটে গড়ে তোলে কংক্রিটের আবদ্ধ জঙ্গল, অবাধে ঘুরে বেড়ানো জীবজন্তুদের সীমানা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশে থাকা শালিক চড়ুই কাক বাবুই, ফিঙে সহ নানান পাখিদের অস্তিত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাদের জায়গা দখল করতে থাকে আধুনিক মনস্কতা দু_পেয় জন্তুরা। তার উপর সভ্য সমাজের দুই পেয় জীব গুলোর অসচেতনতার ফলে, অ্যামাজন ও অস্ট্রেলিয়ার মত দুটি জঙ্গল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শুধু তাই নয় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৫০,০০০ হাজারের ও বেশি জীবজন্তু, সেইসঙ্গে জঙ্গল থেকেও আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। তার ওপরে কমিউনিস্ট চীন দেশের উহান প্রদেশে জীবজন্তুদের প্রতি অমানবিক অত্যাচারের ভিডিওগুলি প্রকাশ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।আধুনিক হওয়ার লক্ষ্যে মানুষ পরিবেশের সঙ্গে যে চরম বেঈমানী করেছে, তার ফলাফল করোনা ভাইরাস। ভাইরাসের আতঙ্কে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ কার্যত গৃহবন্দি। ইতালি, আমেরিকা,ফ্রান্স,রোম,স্পেন,চীন সহ বহু সমৃদ্ধশালী দেশ মৃত্যুর মিছিলে হাঁটছে। দিনে দিনে মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়া তো,এই সমস্ত উন্নত দেশগুলোতে বাড়ছে কফিনের চাহিদা।সমগ্র বিশ্বের মানুষের চোখেমুখে আতঙ্কের ছায়া। ইরাক,ইরানের মতো দেশগুলোতে গণ কবর খোঁড়া হচ্ছে। তাতেও হুঁশ ফেরেনি ভারতবর্ষের মানুষগুলোর। তার ফলে ভারতবর্ষের গতি পথ সেই দিকেই মোড় নিচ্ছে ধীরে ধীরে। অসচেতনতা ভারতবর্ষ ধ্বংসের একমাত্র মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হবে সে বিষয়টি কিন্তু পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষ আর্থিক দিক দিয়ে তেমন সচ্ছল নয়। তা সত্ত্বেও দেশের সরকার জনগণের কথা ভেবে লকডাউন এর দ্বিতীয় পর্যায় ঘোষণা করেছেন। ক্ষতি হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। ধীরে ধীরে নিঃশেষের পথে ভারতের রাজকোষ। তবুও এই লড়াই থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে ভারত সরকার কোন ত্রুটি রাখছে না। কিন্তু জনগণ সবকিছু জেনে-শুনেও লগ ডাউন কে উপেক্ষা করে বাইরে বেরিয়ে এসে জমায়েত হচ্ছেন।এতে শুধুমাত্র ভারত সরকারের নয় সমস্ত জনগণের ক্ষতি হচ্ছে। দেশের কিছু বিবেকহীন অপদার্থ মানুষগুলোর জন্য সারা ভারতবর্ষের মানুষ আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বর্তমান সময়ে বিশ্বের বুকে করোনা অভিশাপ রূপে বয়ে চলেছে অবিরত আপন ধারায়।
কথায় আছে মন্দের ও কিছু ভালো দিক আছে। মানুষ সেই আশা নিয়ে বাঁচে যে গহীন আঁধারের বুক চিরে সূর্য আবার উঁকি দেবে পূব আকাশে। গৃহবন্দী মানুষজন গাড়ি, কলকারখানা বন্ধ।বিজ্ঞানীরা বলছেন এই কদিনে বিভিন্ন জায়গায় আংশিক বা পূর্ণ লকডাউনে পরিবেশ দূষণের মাত্রা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে কমেছে, আকাশের দৃশ্যমানতা বেড়েছে, গঙ্গা যমুনা ফিরছে স্বমহিমায়। সমুদ্রের ধারে অনেক দিন পর আবার ডলফিন দেখা গেছে, শালিক,চড়ুই,বাবুই,কাক ফিঙে সহ পরিযায়ী পাখিরা আবার ফিরে আসছে। বহু যুগ পর মানুষজন আবার পাখির কিচিরমিচির গান শুনছে মন প্রাণ ভরে। হিমবাহের বরফের গলন কমেছে। প্রকৃতি আবার একটু শ্বাস নিতে পারছে।কর্মব্যস্ততা, বন্ধু বান্ধব, পার্টির জন্য আমরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিলাম। ভুলতে বসেছিলাম পরিবারের লোকজনর কথা। আজ পরিবারই সবার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছে। আমরা ভুলতে বসেছিলাম যে আমরা একে অপরের পরিপূরক। একে অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকারের কথা অসহায়,আর্তপীড়িত মানুষগুলোর স্বপ্নগুলোকে পদদলিত করতে শিখেছিলাম। করোনার প্রকোপে জাতপাত ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে সবার পাশে দাঁড়ানোর আকুল আর্তি নিয়ে হাজির হচ্ছে দুয়ারে দুয়ারে। আমরা বই পড়তে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই আলমারির ধুলো ঘেটে না পড়া বইটা বা ভালোলাগার গল্প গুচ্ছ সমগ্রটা স্পর্শ করে দেখতে শুরু করেছে অনেকেই। যারা ধর্ম ধর্মের বেড়াজালে হত্যা লীলায় মেতে উঠেছিল, যারা সমাজের ভীরু দুর্বলদের উপর নিজেদের জোর জুলুম অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল, আবার আত্মঘাতী সন্ত্রাসবাদীরা,এই মুহূর্তে সবাই ভয় পেয়ে গেছে।পারমাণবিক বোমা, মিগ বা রাফায়েল বিমান দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে মানুষের প্রাণ নেওয়া যে অনেক সোজা কাজ কিন্তু মানুষের প্রাণ বাঁচানো যে অনেক কঠিন কাজ সেটা আজ অনেক রাষ্ট্রনায়করাও বুঝতে পারছেন সেটা প্রমাণ হয়ে গেল। তার সঙ্গে প্রমাণ হয়ে গেল শুধু অর্থ দিয়ে শ্রেণী বৈষম্যের ভেদাভেদ করাটা ভুল। কারণ এই মুহূর্তে টাটা বিড়লা আম্বানির যে জায়গায়় দাঁড়িয়ে, একটা সাধারণ নিম্ন পরিবারও সেই জায়গায়় দাঁড়িয়ে। অর্থ আজ মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। যারা সমাজে নোংরা অপকর্মম করে বেড়াতো, সমাজের হায়নাা নামক ধর্ষকরা, আজ ভয় পেয়ে গেছে, নারীরা কিছুটা হলেও এ সময় নিরাপত্তা বোধ করছে। বিশ্বের পানশালা,মদের আসর,জুয়ার আসর,হোটেল-রেস্টুরেন্ট,সহ বহু কিছুু বন্ধ হয়ে গেছে, করোনা প্রমাণ করে দিয়ে গেল এই সমস্ত আমোদ প্রমোদ ছাড়াও মানুষ বাঁচতে পারে,জন্মনিয়ন্ত্রণের অভাব বোধটা এসময় বেশ বুঝতে পারছে সবাই, সঞ্চয় করাটাও খুব জরুরী তা প্রমাণ হয়ে গেল, আর মানুষ সীমিতভাবে ও জীবন যাপন করতে পারে, সেটাও করোনা বুঝিয়ে দিয়ে গেল। দুঃশাসন দের বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে অভিযোগ জানানোর লোক এখন নেই, কারণ দুঃশাসনীয় এখন ভয়ে সিটিয়ে গেছে। পুলিশ রা ঘুষ খাওয়া ছেড়ে অকাতরে দিন রাত কর্তব্য পালনে ব্যস্ত। এই মুহূর্তে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী দের মারার কথা বলছেনা,তাদের সুস্থতা কামনায় সবাই ব্যস্তত হয়ে উঠছে।
জ্যোতিষী,তান্ত্রিকরা এখন নিজেদের ভাগ্য গণনায় এ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।ঘৃনা নয় ভালোবাসার জয়গান চারিদিকে বিরাজ করছে।মন্দির মসজিদ চার্চের মুখে মাক্স পরিয়ে দিয়ে গেছে করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাস প্রমাণ করে দিয়ে গেল ধর্ম নয়, প্রাকৃতিক শক্তি হলো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তি। তাকে উপেক্ষা করার মত দুঃসাহস বোধহয় আজ কোন ধর্মের কাছে নেই।এর থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় বিজ্ঞান।তাই বিজ্ঞানকে প্রয়োজনে ব্যবহার করুন। করোনাভাইরাস আরো প্রমাণ করে দিয়ে গেল, বিশ্ব পরিবেশের বিশ্রামের প্রয়োজন। আর তাতে লাভ মানব সভ্যতার। এই মুহূর্তে করোনা র আতঙ্কে সারা বিশ্ব মাসের-পর-মাস লকডাউন মেনে নিচ্ছে। হয়তো আজ নয়তো পরশু পৃথিবী আবার শান্ত হবে, তখন নিয়ম করে বছরে মিনিমাম ১০ টা দিন পরিবেশের জন্য লকডাউন বাধ্যতামূলক করা হোক। মানবিক আবেদন করাটা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব ও নৈতিক কর্তব্য মধ্যে পড়ে। করোনা র প্রভাবে হয়তো আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি, কিন্তু আন্তরিকতার সাথে ভেবে দেখার অনুরোধ রইলো, যে হারানোর থেকে অনেক বেশি আমরা ফিরে পেয়েছি শুধু মাত্র করোনা র জন্য।তাই করোনা অভিশাপ নয় আশীর্বাদ হয়ে নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে, সে বিষয়টা কিন্তু পুরো পরিষ্কার। তবে এটা লক্ষণীয় বিষয় যে, করোনা আমাদের যে শিক্ষা গুলো দিয়ে গেল, সেই সুশিক্ষার ধারা সমাজের বুকে কতটা প্রভাব ফেলবে, বা করোনা আতঙ্ক কেটে যাওয়ার পর সেই শিক্ষার ধারা আমরা কতদিন কাঁধে করে নিয়ে বয়ে বেড়াতে পারব, সেটাই দেখার বিষয়।