(দ্বিতীয় পর্ব )
সামাজিক বন্ধন বজায় রেখে
নতুন সমাজ গড়ে তুলুন
উপস্থাপনা
করোনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আবার দেখিয়ে দিল নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার লড়াই ছাড়া কোন বিকল্প নেই। শ্রেণী সংগ্রাম সমর বাদ বিরোধী লড়াই আর পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে লড়াই আজ এক বিন্দুতে মিলেছে। একটা আরেকটার পরিপূরক। তাই একজোট হয়ে লড়াইয়ের মঞ্চ গড়ে তুলতে হয়। কেউ কাউকে অচ্যুৎ করে রাখা মানে যুগের দাবি অস্বীকার করা। মার্কসবাদীদেরও সেটা বুঝতে হয়। সঙ্কীর্ণতাবাদ মানে পরাজয়বাদ। একটা আরেকটা থেকে ভিন্নমুখী সংগ্রাম নয়। সবকটা সংগ্রামকে একটা মোহনায় এসে মিলতে হয়। সেটা হলো মানবতার মোহনা। সমাজবিদদের দায়িত্ব এ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা চালিয়ে যাওয়া। কোন অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলে না। লড়াইটা লড়তে হয়। দূষণমুক্ত শোষণ মুক্ত সমর মুক্ত পৃথিবীর দাবিকে সামনে রেখে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হয়। বন্ধুকে চিনতে হয় শত্রুকে শনাক্ত করতে হয়। শত্রু ঘরে বাইরে। বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে নিজের ভেতরের শত্রু তথা আত্মস্বার্থ ভোগবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা লড়তে হয়। আজ করোনা যেন আমাদের বলছে:
শুনেছ কি নি:শব্দের বিস্ফোরণ
অকাল বৈশাখীর তান্ডব
ক্ষুদ্র সে অণুর ভয়ংকর গর্জন
সভ্যতার বুকে বর্বরের প্রলয় নাচন
সে মানে না ভেদ বিভেদ
মানে না ধর্ম বর্ণ বিদ্বেষ
ধ্বংসের মধ্যে তার সৃষ্টির বার্তা
শোন ওই নবজীবনের স্পন্দন
ভাঙি এসো দাসত্বের শৃঙ্খল
গড়ে তুলি সে পৃথ্বী নতুন।
বাংলাদেশের নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুস ৭ ই মে ২০২০ সালে Deccan Herald পত্রিকায় সম্প্রতি ‘Let‘s not go back to the pre-approval Covid world,let us redesign it‘ শিরোনামে লেখা একটা প্রবন্ধে যে সত্যটা তুলে ধরেছেন সেটা আমরা একটু দেখে নিয়ে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারি।উনি প্রবন্ধের শুরুতেই বলেন যে করোনা ভাইরাস আজ মানুষের কাছে সুযোগ করে দিয়েছে পৃথিবীটাকে নতুন করে গড়ে তুলতে, আমাদের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনের পছন্দ গুলোকে এমনভাবে সাজাতে যা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করবে বৈষম্য দুর করে সব মানুষের স্বার্থ রক্ষা করবে মানুষের জীবন জীবিকা নিশ্চিন্ত করবে।এর জন্য দরকার করোনা মোকাবিলা করে পূরোণ পথে ফিরে যাওয়া নয়, অর্থনীতিকে নতুন করে গড়ে তোলা। আর সেটা করতে পারলেই সমাজে শোষণ ও নিপীড়নের অবসান ঘটবে। মানুষের অধিকার স্বীকৃতি পাবে।তবে কিভাবে সেটা ঘটবে সেটা তিনি তুলে ধরেন নি। সেখানে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই তিনি বোধহয় স্বীকৃতি দেন। এর মধ্যেই একটা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কথা ভাবেন। তবে তাঁর লেখায় চলতি অর্থনীতির ব্যাবস্থার যে পরিবর্তন দরকার সেটা তিনি স্পষ্ট তুলে ধরেন। আজকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তথা কর্পোরেট অর্থনীতি ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া যে ভয়ংকর সেটা বলতে উনি দ্বিধা করেন নি। উনার ভাষায়:
"পৃথিবীজুড়ে একটা সহজ সহমতই পারে আমাদের এই সংকটের মুখে সাহায্য করতে ----- সেটা হলো একটা নির্দিষ্ট নির্দেশ যে আমরা আর পুরোণ পৃথিবী যেখান থেকে এসেছি সেখানে ফিরতে চাই না। আমরা তথাকথিত পুনর্গঠনের নামে সেই পুরোণ পঁচা গলা জায়গায় ঝাঁপ দিয়ে পড়তে চাই না।
সরকার যেন কাউকে উদ্ধারের নামে এক ডলারও খরচ না করে যদি না কেউ অন্যান্য বিকল্পের বদলে পরিবেশ রক্ষার মত সামাজিক সুবিধার জন্য ব্যবহার না করে।সমস্ত পুনর্গঠনের কাজ যেন সমাজের প্রয়োজনে সারা দুনিয়ার স্বার্থে একটা পরিবেশ সচেতন অর্থনৈতিক সচেতন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়।'' তাঁর ভাষায়:
‘‘One simple unanimous global decision will help us tremendously----- a clear instruction that we don’t want to go back to where we came for. We don’t want to jump into the same pan in the name of jump-starting the so called ‘recovery process’. ----------
Government must guarantee that not a single dollar would be offered to anyone, specially for a bailout, unless they are they are sure that it will bring maximum social and environmental benefit to society, compared to other options. All the reconstruction related actions must lead to creation of a socially, economically and environmentally conscious economy for the country, as well as for the world.‘‘
যদি এটা করা না যায় তবে যে ভয়ংকর অবস্থার আমরা সন্মুখীন হব সে সম্পর্কে লেখক বলেন:
"আমরা যদি সামাজিকভাবে ও পরিবেশগতভাবে সচেতন একটা পরিকল্পনাকে কার্যকরী করতে না পারি, তবে নিশ্চিতভাবে আমরা ধ্বংসের সন্মুখীন হব যা আমরা অতীতে দেখি নি। এটাই এখন নেতৃত্বের কাছে পরীক্ষা কিভাবে পৃথিবীটাকে নতুন করে সাজানো যায়, যে পৃথিবীটাকে এখনও আমরা চিনি না।" ( অনুবাদ লেখক)
আমরা এই পর্যন্ত লেখকের সঙ্গে একমত।কিন্তু এর সঙ্গে একটা আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে যুক্ত হতে হয় যেখানে রাষ্ট্র তার ভূমিকা পালন করতে পারে। সেইজন্য দরকার সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যেটা এনে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে নিশ্চিত করা সম্ভব।আর সমাজবিপ্লবের মাধ্যমেই সেটা সম্ভব। তাই শ্রেণী সংগ্রামকে কেন্দ্র করে সমাজ বিপ্লবের লড়াই এর সঙ্গে সমস্ত বিষয়টা জড়িত। একান্ত প্রয়োজনে এই লেখায় আগের লেখার কিছু পুনরাবৃত্তি দরকার। তবে সামগ্রিক ভাবে এখানে করোনা পরবর্তী সময়ে নূতন সমাজ গড়ার প্রশ্নটা গুরুত্ব পাবে।
দ্বিমুখী এ সংকট:
আজ কভিড ১৯ ও অর্থনৈতিক সংকট মানব সভ্যতাকে এমন এক পরস্পর বিরোধী সংকটের সন্মুখীন করেছে যার থেকে উদ্ধার পেতে সব দেশের শাসক সম্প্রদায় হিমসিম খাচ্ছে।একটার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে আরেকটা বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সংকটকে ঘনীভূত করে তোলা হচ্ছে। কোন প্রতিষেধক ওষুধ না থাকায় এই ভাইরাস সম্পর্কে তেমন ধারণা না থাকায় অথচ এটা একটা ভয়ানক সংক্রমক রোগ হওয়ায় 'সামাজিক দুরত্ব' বজায় রেখে লক ডাউন করে গত ১৫ বছর ধরে বিশ্বায়নের আওতায় থেকে বিশ্ব অর্থনীতি যে সংকটে নিমজ্জিত সেই সংকটকে আরো ঘনীভূত করা হয়েছে । আবার এই অর্থনীতির সংকটের মোকাবিলা করতে গিয়ে ভাইরাস সংকট ঘনীভূত হবে বলে ভয় হচ্ছে। এ এক উভয় সংকট।এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পাচ্ছে না কোন রাষ্ট্র। এই অবস্থায় ভাইরাস দূর হলেও পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা দীর্ঘকালের প্রেক্ষাপটে মানব সভ্যতাকে নিশ্চিত ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে মনে করা হচ্ছে। তাই দরকার নতুন এক পৃথিবী গড়ে তোলার ভাবনা যা শোষণ প্রকৃতি নিধন যুদ্ধ ও ভোগবাদ থেকে মুক্ত।পুঁজিবাদকে ফিরিয়ে আনা নয় তাকে ধ্বংস করে বিকল্প এক অর্থনীতি গড়ে তোলা যা শিক্ষা স্বাস্থ্য মানুষের রুটি রোজগার নিশ্চিত করে মানবতার ধর্ম পালন করে। এর জন্য রোগ প্রতিরোধে 'সামাজিক দুরত্ব দাবাই' যেমন আত্মঘাতী তেমনি পুনর্গঠনের নামে পুঁজিবাদের ওপর আস্থা রাখা তেমনি বিপজ্জনক বলে মনে করা হচ্ছে যার ওপর আমাদের এ আলোচনা গুরুত্ব পাবে।
আমরা আমাদের আগের লেখায় দেখেছি যে মানব সভ্যতার অগ্রগতির পথে ভাইরাসের আক্রমণ নতুন কিছু নয়। এই ধরণের ভাইরাস বার বার মানুষের অর্থনীতি রাজনীতি সাংস্কৃতিক জীবনকে আক্রমন করেছে, আজও করে চলেছে। করোনা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকদের যে ধারণা ছিল না তা নয়। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে সরকারের ভূমিকা সীমিত, বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ সামান্য। সমর খাতে ব্যয় বহুগুণ বেশি। বেসরকারি বিভাগের কাছে স্বাস্থ্য খুব বড় ব্যবসার জায়গা। তার রোগ প্রতিষেধকের ওপর তাদের গবেষণা খুব কম। এই অবস্থায় অজানা আক্রমণের মোকাবিলায় দেশের প্রস্তুতি থাকে না। ভোগবাদ ও পরিবেশ দূষণের জন্য মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা তলানিতে পৌঁছেছে। সুতরাং ভাইরাসের আক্রমণের মুখে রাষ্ট্র আজ দিশা হারা। আমি এই ভাইরাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানি না। তাই নীচে সব শেষে একটা সংযোজনী তুলে দিলাম পাঠকের জন্য।
পুঁজিবাদী এই কাঠামোয় অর্থনীতি বার বার মন্দার সম্মুখীন হয়েছে। অর্থনৈতিক ভাইরাস শুধু অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে নি মানুষের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক জীবনকেও বিপর্যস্ত করেছে। অর্থনীতির সংকট দূর করতে গিয়ে সমরবাদ ভোগবাদকে মদত করে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা চলেছে। তৈরি হয়েছে উপনিবেশবাদ যা সামরিক আগ্রাসনকে মদত করেছে, স্বাধীনতার স্বার্থে মুক্তিকামী মানুষের প্রতিরোধকে অনিবার্য করে তুলেছে। দেশের সঙ্গে দেশের যুদ্ধ ঘটে চলেছে। একই সঙ্গে কর্পোরেট স্বার্থে ভোগবাদকে মদত করা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে শ্রেণী যুদ্ধ বার বার মাথা তুলেছে।প্রযুক্তি বিনিয়োগ সবই সেভাবে প্রবাহিত হয়েছে। কর্পোরেটদের মুনাফার স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা চলেছে। মানুষের জীবন জীবিকা অনিশ্চিত হয়েছ, বন্টন বৈষম্য বেড়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা স্বাস্থ্য আজও অনিশ্চিত থেকে গেছে। অর্থনীতির এই সংকটের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। কর্পোরেট অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকাকে তেমন স্বীকার করা হয় না। চাহিদা যোগানের সমবেত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া উপকরণের বিভিন্ন উৎপাদনে বণ্টন থেকে ভোক্তার ভোগ উৎপাদিত পণ্যের ব্যবহার থেকে কর্ম সংস্থান মানুষের আয় নির্ধারণ সব সমস্যার সমাধান স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সম্ভব বলে মনে করা হয়। তবে অর্থনীতি সংকটে পড়লে বা কর্পোরেট সেক্টরের প্রয়োজনে পরিকাঠামো তৈরিতে সরকারের ভূমিকা স্বীকার করা হয়। আর দুনিয়ার বাজারে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে সমস্ত অর্থনীতিকে নৈপুণ্য বাড়িয়ে টিকে থাকার জন্য বিশ্বায়নের ছত্রছায়ায় আসতে বলা হয়। সেইভাবে অর্থনীতির অভিমুখ ঠিক করা হয়। কিন্তু দেখা যায় বণ্টন বৈষম্যের জন্য কর্মসংস্থানের অভাবের দরুন বা শ্রম সঞ্চয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য মুনাফা ভিত্তিক বাজারি অর্থনীতিতে চাহিদা যোগানের সঙ্গে তাল রাখতে পারে না। দেশ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। আর এই ধরনের অর্থনীতিতে যাদের বাজারে বেশি ক্রয়ক্ষমতা থাকে তাদের প্রয়োজন মেটাবার জন্য উৎপাদন হয়। আজ করোনা ভাইরাস অর্থনীতিতে চাহিদা অভাবের ভাইরাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অর্থনৈতিক সংকটকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ভারতের অর্থনীতি সহ বিশ্বের তাবর তাবর অর্থনীতি তার সঙ্গে রাজনীতি ও সামাজিক জীবন এই দ্বৈত ভাইরাসের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পড়ে তার থেকে বেরোবার পথ পাচ্ছে না।
'সামাজিক দূরত্ব' ও লক ডাউন
করোনা এই ভাইরাস যাকে COVID 19 বলা হচ্ছে তা এক মানব দেহ থেকে অপরদেহে সরাসরি সম্পর্কে খুব দ্রুত সংক্রমিত হয়। তাই কোন ওষুধ বা টিকা এখনো আবিষ্কৃত না হওয়ায় এর সমাধানে বিকল্প কোন প্রতিষেধক না থাকায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে শারীরিক সম্পর্ক স্থগিত রেখে এই সক্রমন রোধের একমাত্র উপায় বলে মনে করা হচ্ছে। এর জন্য সবরকম যোগাযোগ বাজার স্কুল কলেজ দোকান পাট বন্ধ রেখে লক ডাউনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে যদিও এতে দেশের অর্থনীতি স্তব্ধ হয়ে যায় মানুষের রুটি রোজগার বন্ধ হয়। তাও স্বল্পকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই সংক্রমণ রোধ করা আশু দরকার। চীন বা ভিয়েতনামের মত দেশ দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়া ইরান এই পদ্ধতিতে সাফল্য পেয়েছে। সময়মত আমেরিকা ইতালি বা স্পেন সেটা করে নি বলে তাদের ভুগতে হচ্ছে বলে খবর। এই অবস্থায় সারা পৃথিবী শুদ্ধ ভারতেও এখন পূর্ণ মাত্রায় লক ডাউন চলছে। এটা সমস্যা সমাধানের আশু ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু আমাদের আপত্তি 'সামাজিক পার্থক্য' কথাটা ব্যবহারে। এটা কার্যত শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপার তবে কেন সামাজিক দূরত্ব? আমরা বরং বলি সামাজিক সংহতি বাড়িয়ে পরস্পর সহমর্মিতা বাড়িয়ে সমাজিক নৈকট্য ও বন্ধন বজায় রেখে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা থুতু ফেলার মত বদ অভ্যেস দূর করার কথা বলার দরকার। সমাজের ভালোর জন্য যা নিজেকেও ভালো রাখে তার কথা বলা। এর জন্য সামাজিক দূরত্ব কেন? সমাজ বলতে নেহাৎ কিছু মানুষের জমায়েত বোঝায় না। এটা একটা সংখ্যা নয়। এক একটা বিচ্ছিন্ন মানুষের যোগফল নয়। সমাজ একটা গুণগত ধারণা যা মানুষের সাথে মানুষের মননের কথা পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতার কথা বলে। সেখানে সামাজিক দূরত্ব কথাটা ব্যবহৃত হল কেন? সেটা জানতে এই কথাটা আনুষ্ঠানিকভাবে যারা চালু করেছে তাদের কথাই নিচে তুলে দিচ্ছি:
"the practice of maintaining a greater than usual physical distance from other people or of avoiding direct contact with people or objects in public places during the outbreak of a contagious disease in order to minimize exposure and reduce the transmission of infection
San Francisco issued recommendations for social distancing on Friday, advising residents to stay home as much as possible and avoid congregating in large groups."
— Taryn Luna and Melody Gutierrez (collected from Google)
পশ্চিমী জগতের সংস্কৃতি অনুসরণ করেই কথাটা এসেছে। সেখানে করোনা আসার বহু আগে পুঁজিবাদের সংস্কৃতির ধারা অনুসরণ করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জীবন যাপন করা হয়। খুব অল্প বয়স থেকে ছেলে মেয়েকে বাবা মায়ের থেকে আলাদা করা হয়। বাবা মার শেষ জীবনে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয়। বাড়িতে নয় ক্লাবে সামাজিক সমাবেশ। মদের বোতলে আড্ডা। বর্তবানে পরিবারের কাঠামো ভেঙে ভারতের মত দেশেও এই সংস্কৃতি চালু হয়েছে। আর এই সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে আজ কিছু মানুষের অমানবিক কাজ ঘটে চলেছে। বাড়িওয়ালা ডাক্তার নার্স ভাড়াটেকে বাড়ি ছাড়া করছে। পরিযায়ী শ্রমিককে কিছু লোক গ্রামে ঢুকতে দিচ্ছে না। এর পর দেখব সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অজুহাতে কোন আক্রান্ত বৃদ্ধ দম্পত্তিকে ঘর ছাড়া করে বাড়ি ছাড়া করে তার দখল নিচ্ছে কোন স্বার্থ গোষ্ঠী। আর আমরা পাশের বাড়িতে বারান্দা থেকে সেটা দেখছি। নেমে প্রতিবাদ করব কি করে আমাদের যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। আমিতো আজ বিচ্ছিন্ন একা। আমার আবার সামাজিক দায়িত্ব কি? সামাজিক বন্ধন সেখানে দুর্বল। দুজনের বেশি এক গাড়িতে যাওয়া যাবে না। তাই পরিবারে প্রতি দুজনে একটা গাড়ির প্রয়োজন। যে বাসে যেত তার সক্রমন ঘটবে তাই তার গাড়ির দরকার। এক বোনের কাপড় বা জামা আরেকজন পড়লে সংক্রমনের ভয় তাই আলাদা বেশি কাপর দরকার। গরিব ঘরেও প্রত্যেকের আলাদা মোবাইল। একজনকে আরেকজনের ভয়। একে অপরে অবিশ্বাস। এই ফাঁকে নতুন করে বাজার গঠন চাহিদা তৈরি যাতে পুঁজিবাদ বাঁচে। এক বিচিত্র সংস্কৃতি বিচিত্র জগৎ। এই হল সামাজিক দূরত্বের মুক্ত আকাশ মুক্ত অর্থনীতি বিচ্ছেদ বিভেদের সংক্রমিত দুনিয়া। বিষয়টা আমরা কয়েক ছত্রে তুলে ধরতে পারি:
আজ এ সুন্দর সকাল
পাখি ওড়ে ওই নীলিমায়
দিনের শেষে সন্ধ্যা নামে
চন্দ্রিমা সেজে ওঠে জ্যোৎস্নায়।
আমরা বন্দী ঘরে
কোন এক কৃত্রিম আত্মীয়তায়
তালাবন্দী আজ সামাজিক দূরত্বে
ভয়ঙ্কর পরস্পর বিচ্ছিন্নতায়।
রোগের সঙ্গে লড়াই দরকার
সামাজিক দূরত্ব নয় নয় ঘৃণা চেতনায়
মননে পারস্পরিক বন্ধন তোমার আমার
শারীরিক দূরত্ব সময়ের চাহিদায়।
মনে রাখা দরকার এটা নেহাৎ ভালো মন্দের ব্যাপার না। পুঁজিবাদের দর্শনে গলাকাটা প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেকে টিকিয়ে রাখার দর্শনের প্রতিফলন ঘটে এই 'সামাজিক দূরত্বে'র সংস্কৃতিতে। এটাকেই অর্থনীতিবিদ স্মিথ বলেছেন survival of fittest। অন্যকে মেরে নিজে টিকে থাকা। একটা গালভরা অভিজাত কথা যেটা আমরা বুঝে না বুঝে অহরহ ব্যবহার করি। এই সংস্কৃতিকেই বহন করে 'সামাজিক দূরত্ব' বা social distancing কথাটা। অথচ আমরা এই ধরণের সংকটের মুখে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টা সম্পর্কে জানি। সেটাতে বহুকাল ধরেই অভ্যস্ত।
বিষয়টা নতুন কিছু নয়। নতুন হল এমন একটি শব্দের আমদানি যেটা উচ্চারণ করে আমরা তৃপ্তি পাই, নিজেদের বুদ্ধিমান মনে করি। মনে রাখা দরকার এই প্রতিটি কথা ব্যবহার করার উদ্দেশ্য আছে। কারণ ব্যতীত এই শব্দ এত ঘটা করে চালু হয় না। অন্য অর্থে নেহাৎ প্রয়োজনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বহু প্রচলিত। তবে সেটা কোন অর্থেই সামাজিক দূরত্ব নয়। এই শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেও সামাজিক নৈকট্য বজায় রেখে কি অপরিসীম যত্ন আমরা পরিবারের মা বোনদের থেকে পেয়েছি আজও পেয়ে থাকি সেটা আমরা জানি। তার জন্য সামাজিক দূরত্বের দরকার হয় না বরং সামাজিক বন্ধন নৈকট্যই এর শর্ত।
যেমন আমরা দেখেছি পক্স হলে বা কলেরা ম্যালেরিয়া হলে রোগীকে রোগীর ব্যবহার্য দ্রব্যকে আলাদা করে সরিয়ে দেওয়ার বিধান আমাদের পরিবারের মধ্যেই ছিল। মা বোনেরা সামাজিক দূরত্বের অজুহাত দিয়ে নিজের কর্তব্য থেকে সরে যেত না। তাদের যত্নে ই আমরা সেরে উঠতাম। আর যারা একটা ঘরে গাদাগাদি করে থাকত তাদের মধ্যে রোগের সক্রমন ব্যাপক ছিল। কারণ সেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা অসম্ভব। এটা আজও গরিব মানুষের বাসস্থানে আমরা দেখি। পর্যাপ্ত সরকারি ব্যবস্থা না থাকলে গরিবদের মরণ। যেটা আমরা পরিযাত শ্রমিকদের মধ্যে আজ দেখছি।
আজ আমরা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সামাজিক দূরত্ব কথাটা এই ব্যবস্থায় মান্যতা পাচ্ছে। প্রয়োজনে রোগ যাতে না ছড়ায় রোগ থেকে মুক্তি পেতে শারীরিক দূরত্বের কথা বলা হচ্ছে না। এই ব্যবসস্থার ধারক বাহকরা প্রচারে নেমেছে মানুষকে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বজায় রেখে সামাজিক বন্ধন ভেঙে নেহাৎ প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে। প্রতিটি ব্যক্তি যেন বিচ্ছিন্ন একক হয়। মানবিক সম্পর্ক যেন ছেদ হয়। অর্থাৎ সমাজ বলে কিছু থাকবে না। পরিবারের বন্ধন আলগা হবে। কার্যত পরিবার ভেঙে যাবে। কিন্তু আমরা জানি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ সর্ব ক্ষেত্রে পরস্পর নির্ভরশীল। সামাজিক সম্পর্কে আবদ্ধ। শুধু মানুষ নয় প্রাণী জগতের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। প্রাণীজগতে প্রতিটি উপজাতি নিজেদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। সন্তানের জন্ম হলে স্তন্যপায়ী সবপ্রাণী জগতে মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম হওয়া সন্তান মায়ের কোলে পিঠে বড় হয়। মানব সমাজে বাবা মায়ের হাত ধরে সন্তান বাইরের জগৎকে চেনে। ভাই বোনের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে এই সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার মধ্যে থেকেই স্নেহ ভালোবাসা মান অভিমানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিবারের বাইরে বন্ধু বান্ধব সহকর্মী সকলের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমার জীবন যাপন অন্যের শ্রম ঘামের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে সম্পর্ক যুক্ত।একজনের শ্রম আরেকজনের জীবনধারণের সঙ্গে যুক্ত যা কেবল মজুরি সম্পর্ক নয় একটা সামাজিক সম্পর্ক। এসব নিয়েই জীবন। জীবনের এই অপরিহার্য উপদানগুলিকে অস্বীকার করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এক অদ্ভুত জীবনের কথা বলা হচ্ছে যে জীবনে আর যাই থাক প্রানের স্পন্দন উবে যায়। অথচ প্রাণিজগতের আবির্ভাবের পর থেকে বন্যা মারি মহামারি দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করেই প্রাণী সমাজ টিকে থাকে। আর মানুষ সচেতন প্রাণী, যুক্তি বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে বাঁচে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঁচে। এই অবস্হায় করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ের কথা জোর দিয়ে বলা হচ্ছে না। বিশেষ করে যেখানে করোনার চেয়েও ভয়ানক আক্রমণকে মানুষ মোকাবিলা করে এগিয়েছে ইতিহাসে। এই সমাজ ব্যবস্থার ধারক বাহকরা নিজেদের ব্যবস্থার অপ্রতুলতাকে ঢাকা দিতে বিকল্প ব্যবস্থার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করার জন্য সামাজিক দূরত্বের মত একটা অমানবিক শব্দকে আমাদের জীবনের অঙ্গ করে তুলছে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলছে না। রোগের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ নয়। রোগীর বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ। মানুষকে মনুষ্যবৃত্তির থেকে বিচ্যুত করাই তার উদ্দেশ্য। অবসাদগ্রস্ত অসামাজিক দাস মানুষই তার মুনাফাভিত্তিক সমাজের জন্য দরকার। করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে ভোগবাদ থেকে বিরত থেকে একটা শোষণ মুক্ত সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত সমাজ গড়ার কথা বলে হচ্ছে না যার প্রাথমিক শর্ত হল সামাজিক বন্ধন মানুষের প্রতি প্রেম ভালোবাসা অহিংসা ও যুদ্ধ বিরতি। যদি সত্যি সমাজ বিচ্ছিন্নতা জীবনের নিয়ম হয়ে দাঁড়ায় তবে সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কঙ্কালসার নগ্ন পুঁজিবাদের চেহারাটা আমরা দেখব। কার্ল মার্ক্স পুঁজিবাদের মধ্যে এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার চেহারাটা দেখেছিলেন। সেটারই চূড়ান্ত রূপ হল আজকে এই ব্যবস্থার ধ্বজাধারীদেরদের এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বজায় রেখে বাঁচার দাবাই। সেইজন্যই আমরা নতুন এক পৃথিবী গড়ার কথা বলছি যার সম্পর্কে মহম্মদ ইউনিস বা অরুন্ধতী রায় বলেন।
আমরা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হলে কোন পথে মানব সভ্যতার এগিয়ে যাওয়া কাম্য তা নিয়ে অরুন্ধতী রায়ের বক্তব্য তুলে ধরতে পারি যা আমাদের উপরোক্ত প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্ত সার বলে বিবেচিত হতে পারে:
"আর যাই হোক না কেন মানতেই হয় করোনা ভাইরাস আজ সভ্যতার অহং ভেঙে দিয়ে তাকে নতজানু হতে বাধ্য করেছে, পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়েছে যা আর কেউ করতে পারেনি। তাও আমাদের পেছন ফেরার তাগিদ। সব ঠিক হয়ে গেলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কাঁদুনি। মানুষের ভবিষ্যতকে পরিত্যক্ত অন্ধকার অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেখানে তাকে বেঁধে দেওয়া যেখানে শুধু এই ভয়াবহতা ফিরে আসার আতঙ্ক। অস্বীকার করা এই ধ্বংসলীলা। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দরকারকে বাতিল করা। অথচ এই ধ্বংস লীলাটা বাস্তব সত্যি। এটাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছে যে আমাদের অবিমিশ্রকারিতাই আজ আমাদের এই সর্বনাশ ডেকে এনেছে। ধ্বংসের এই হাতিয়ার আমাদেরই সৃষ্টি। তথাকথিত ‘স্বাভাবিকতা‘ তথা ভারসাম্য ফিরে আসার থেকে খারাপ আজ আর কিছু হতে পারে না। ইতিহাসে দেখা যায় করোনা ভাইরাসের মত ভয়াভয়তাই মানুষকে বার বার অতীত ভেঙে নতুনের পথে এগোবার স্বপ্ন দেখায়। এক পৃথিবী থেকে নতুন এক পৃথিবীতে প্রবেশের পথ খুঁজে বার করতে বাধ্য করে মানুষকে। পূরোণ বাতিল হওয়া পথে আবার আমরা ঘৃণা শোষণ কুসংস্কার মৃত ভাবনা রাশি রাশি বস্তাপচা তত্ত্বের ও তথ্যের ভার বহন করে বিচরণ করতে পারি।সঙ্গে থাকবে মজে যাওয়া স্রোতহীন নদী, ধোয়াচ্ছন্ন আকাশ। সেক্ষেত্রে অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলবে। অথবা আমরা ধীর প্রত্যয়ী পায়ে অল্প রসদ নিয়ে নতুন পৃথিবীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পারি। নতুন পৃথিবী গড়ার যুদ্ধে নামতে পারি।" ( অনুবাদ লেখক)
সংকট সমাধান ও নতুন বিশ্বের সন্ধান:
আজ ভাইরাসের সংকটের বিরুদ্ধে এ লড়াই একটা সর্বাত্মক লড়াই।এমন লড়াই যা অর্থনৈতিক সংকটকে বাড়তে না দিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণ দূর করতে পারে। স্বল্পকালে লকডাউনের মুখে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মিটিয়ে তাকে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিতে হয়। কার্যত আজ মানুষ একটা টিকে থাকার অর্থনীতির স্তরে জীবন যাপন করছে। এই অবস্থায় অপ্রস্তুত থাকা উপেক্ষিত ব্যবস্থার জায়গায় নতুন করে এক জন স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হয়। সরকারের বাজেট সম্পূর্ণভাবে জনমুখী করে তুলতে হয়।সঙ্গে দেশের নিজেদের সম্পদ ও প্রযুক্তির সাহায্যে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক স্বাধীন আত্মনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার লড়াই চালানোর সময় এসেছে, বলা চলে এটাই উপযুক্ত সময়। বিশ্বায়নের ভাওতা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। পরিবেশ দূষণ বন্ধ করতে হয়। ভোগবাদ থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করতে হয় কারণ পরিবেশ দূষণের জন্য, ভোগবাদের দরুন মানুষের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমেছে। সমরবাদকে অস্বীকার করে সরকারি বাজেটে স্বাস্থ্য শিক্ষার ওপর খরচ বাড়াতে হয়। সাম্রাজ্যবাদের তাবে থেকে দেশকে বার করে নিয়ে আসা দরকার।তবেই আমরা স্বাধীন ভারত স্বপ্নের ভারত গড়ে তুলতে পারব। স্বাধীনতার পর থেকেই এ কাজটাকেই প্রাথমিক কাজ বলে গণ্য করা দরকার ছিল। সেটা না করে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশের সঙ্গে গাঁটছড়া আরও শক্ত করা হয়েছে। দেশটাকে বলতে গেলে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিজেদের দেশেই কমছে। তার ওপর এই ভাইরাসের সংকট। এই সুযোগটা নিয়ে নিজেদের উদ্যোগে নিজেদের সম্পদে দেশের আত্মনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার সুযোগ নেওয়া দরকার। তবে সাম্রাজ্যবাদ সহজে সেটা হতে দেবে না। তবে বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে সবার সহযোগে এই লড়াইটা লড়তে হয়। এর জন্য জনগণকে মূল্য দিতে হবে। আর মানুষতো এই সংকটের মুখে মূল্য দিচ্ছেই। মরণের সামনে এ লড়াইয়ে মানুষ চিরকাল মূল্য দিয়েছে। আজও দিতে রাজি হবে বলে আমার ধারণা। আর এ লড়াইয়ের মধ্যে থেকেই নেতৃত্ব উঠে আসবে। পথই পথ চেনাবে। সুভাষ বোসের ডাক রক্ত দাও স্বাধীনতা দেব আজ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তার সাথে যোগ হয়েছে রক্ত দাও রুটি রুজি দেব।
যারা বাজার অর্থনীতির প্রবক্তা তারা এখনও বলে চলেছেন বিনিয়োগের উদ্যোগ সৃষ্টি করে বিনিয়োগ বাড়াতে পারলে নিয়োগ বাড়বে ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে চাহিদা বাড়বে যা অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে সাহায্য করবে। আবার সব ঠিক ঠাক চলবে। অথচ গত ১৫ বছর ধরে করোনা ভাইরাসের অনুপস্থিতিতেও চাহিদা ভাইরাস বিশ্বের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। ভারতের অর্থনীতি কি জাতীয় আয় কি কর্মসংস্থান সব দিক থেকেই গভীর সংকটে। এটা আর লুকোনো যাচ্ছে না উন্নয়নের যতই ঢক্কানিনাদ শোনা যাক। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা ভাইরাস যা রোখাটা আজ সবচেয়ে জরুরী। এর থেকে রক্ষা না পেলে অর্থনীতিও বাঁচবে না। রুটি রুজির সুযোগ কমতে থাকবে বিনিয়োগের উদ্যোগ কমবে অর্থনৈতিক কাজকর্ম স্তব্ধ হয়ে যাবে। এই নতুন করোনা ভাইরাস অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেরামিটার হয়ে গেছে যা চাহিদাকে তলানিতে ফেলে দিয়েছে। আজ রিজার্ভ ব্যাংক রেপ রেট কমানোয় কোন কোন অর্থনীতিবিদ একে উৎসাহ সঞ্চারি কার্যকরী ব্যবস্থা বলে উৎসাহ প্রকাশ করছেন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রভাবের কথা তাদের আলোচনায় নেই। এই ভাইরাস দূর না করতে পারলে বাজার অর্থনীতির চলতি ইতিমধ্যে ভোতা হয়ে যাওয়া হাতিয়ারগুলো যে কাজ করবে না সেটা তাদের মাথায় নেই। আজকের এই সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য অর্থনীতির গতিমুখের ব্যাপক পরিবর্তন করা দরকার যা অর্থনীতির পুনর্গঠনের সঙ্গে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারকে অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়। নিয়ন্ত্রনকে কঠোর করতে হয়। দাম ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনীতির শক্তিকে ক্রিয়াশীল করার চেষ্টার মধ্যে সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। সমস্যা সমাধানের জন্য বিনিয়োগকে কাঙ্খিত খাতে প্রবাহিত করতে হয়। সাধারণ মানুষের আয় বজায় রেখে আয়ে সমতা এনে পণ্য সামগ্রী ন্যায্য দামে পৌঁছে দিয়ে মানুষের টিকে থাকাকে নিশ্চিত করতে হয়। আপদকালীন জরুরী অবস্থায় অর্থনীতির গতিপথ বদলে কিভাবে সমস্যার মোকাবিলা করা যায় তা বিশ্ব মন্দা কালের পরবর্তী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে সোভিয়েত রাশিয়ায় স্ট্যালিনের নেতৃত্বে দেখা গিয়েছিল। আজ সেটা স্মরণ করাটা বিশেষ প্রাসঙ্গিক। এতে কমিনিষ্ট বিরোধিতার ফোবিয়ায় যারা ভোগেন তাদের গোঁসা হতে পারে। তাও আমাদের এখানে সেটা উল্লেখ করতেই হয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার স্বার্থে।
কিন্তু চলতি কর্পোরেট অর্থনীতিতে কর্পোরেটের মুনাফার দর্শনে অর্থনীতিকে নতুন ভাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আর আজের এই দ্বিমুখী সংকটের সন্মুখীন হয়েছে দেশ এ ধরনের অর্থনীতির কল্যাণেই। কাজেই এর মধ্যেই যেখানে সংকটের কারণ নিহিত সেখানে এই ব্যবস্থাটা উপড়ে না ফেলে এই সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। সেজন্যই পূরোণ ব্যবস্থায় ফেরা নয় নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ডাক এসেছে যা নিয়ে আমরা ওপরে আলোচনা করেছি।
আজ অর্থনীতির কাঠামো পরিবর্তন করে উৎপাদনের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হয়। অর্থিনীতিকে জনতার অর্থনীতি হিসেবে গড়ে তোলা দরকার যার উদ্দেশ্য হবে টিকে থাকার জন্য মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত করা। করোনা সংকট কেটে গেলে জনগণের রুটি রোজগারের সুযোগের দিকে লক্ষ্য রেখে অর্থিনীতির নবজাগরণের পথ প্রশস্ত করা। মনে রাখা দরকার যদি দেশের মানুষ কঠিন লড়াইয়ের মাধ্যমে একটা জাতীয় সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে তবে সেই জনগোষ্ঠী প্রত্যয়ে ইস্পাত কঠিন হয়ে ওঠে। যদি অর্থনীতির কাঠামো সহায়ক হয় তবে পুনর্গঠনের কাজে সে সম্পদ হয়ে ওঠে। আজকে ভিয়েতনাম কিউবা চীন এর উদাহরণ। জারের অন্ধকার দিনের অবসানের পর বলশেভিক অভ্যুত্থান তার উদাহরণ। অন্ধকারচ্ছন্ন মধ্যযুগের অবসানের পর ইউরোপের দেশগুলো সেই উদাহরণ রেখে গেছে । প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতি তথা পুঁজিবাদ সে দৃষ্টান্ত রেখে গেছে যেটা কার্ল মার্ক্স কমিউনিষ্ট ইশতেহারে লিখে গেছেন। শোষণ নিপীড়ন বজায় থাকলেও ইতিহাসে এটা সত্যি। আজ একচেটিয়া বিশ্বায়নের যুগে পুঁজিবাদের সে ক্ষমতা নেই। তারা সমরবাদ ভোগবাদ আর প্রকৃতি নিধনকে হাতিয়ার করে টিকে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে জনতার ইচ্ছা অনিচ্ছা তার উদ্যোগ সম্ভবনার সম্পর্ক থাকে না। তাই আমরা নতুন এক পৃথিবী গড়ে তুলতে চাই।
আমরা করোনা আক্রমন প্রতিহত করে যে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে চাই সে সম্পর্কে বলি:
নির্ঘুম চোখে ঘুম আমার
অচলা পৃথ্বী চলা শুরু করে
নির্বাক রাতের শেষে সবাক সকাল
কর্মের চাঞ্চল্য নিষ্কর্মের ঘরে
নিঃশব্দ জীবনে শব্দ ডেকে ফেরে
শীতের ঠান্ডায় পাতা ঝরে
নতুন কিশলয় জড়ায় বৃক্ষরে
স্রোতস্বিনী নদী আবার বয়ে চলে
জীবন ফেরে নিজ ছন্দে
আকাশ মুখর পাখির কলোরলে।
সংযোজনী
COVID-19 বিশ্বমহামারী আটকাতে WHO যেক'জন বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চে (IISER, kolkata) কর্মরত এসোসিয়েট প্রফেসর ডক্টর পার্থসারথী রায়। ডক্টর রায় IISC বেঙ্গালুরু থেকে মলিকিউলার ভাইরোলজির উপর তার PhD করেন এবং বর্তমানে তিনি ক্যান্সারের জিন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করছেন। COVID-19 নিয়ে তার দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন ভারত এই ভাইরাসটির বৈশিষ্ট্য বুঝতেই পারেনি এবং সম্ভাব্য আক্রান্তদের পরীক্ষা করার দিক দিয়ে এখনও শতযোজন পিছিয়ে রয়েছে। এই একুশ দিনের লকডাউন পরিস্থিতি শুধুমাত্র চরম অজ্ঞানতার ফল। দা উইক নামক অনলাইন পত্রিকায় দেওয়া তার সাক্ষাৎকারটি এখানে রইলো।
প্র: COVID-19 এলো কোথা থেকে? এব্যাপারে কিছু নিশ্চিত করে বলা যায় কি?
উ: এটি একটি জুনোটিক ভাইরাস। মানে প্রাণীদেহের ভাইরাস। সংক্রমণের উৎপত্তি চীনের উহান প্রদেশের বন্যপ্রাণী শরীর। কোভিড ১৯ জেনেটিক মিউটেশন* করতে পারে। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ি নিজেকে পালটে পালটে নেয়। তাই শুধুমাত্র একটি নয়, বিভিন্ন আলাদা আলাদা প্রজাতির প্রাণীদের সংক্রমণের ক্ষমতা রাখে। এক্ষেত্রে ভাইরাসটি এমনভাবে নিজেকে পালটেছে যে, মানবদেহের নির্দিষ্ট কোষের প্রোটিনের সাথে আবদ্ধ হতে পারে। ফলে মানুষকে সংক্রমিত করতে পারছে।
প্র: কোন কোন প্রাণীর COVID-19 সংক্রমন হতে পারে?
উ: গবেষনা বলছে মানবদেহে সংক্রমণকারী ভাইরাসের সঙ্গে বাদুড় সংক্রমণকারি ভাইরাসের জিনগত মিল ৯৬%, আর প্যাংগোলিন সঙ্গে মিল ৯৯%। বলা যায় এই ভাইরাস বাদুড় থেকে প্যাংগোলিন হয়ে মানুষের দেহে এসেছে। এরপর এই ভাইরাস আর কাকে কাকে আক্রমণ করবে সেটা জানতে আরও গবেষণা দরকার।
প্র: WHO কেনো এটাকে বিশ্বমহামারী বলছে?
উঃ কোনো একটি অসুখের মারণক্ষমতা এবং সংক্রামক ক্ষমতা দুটো আলাদা জিনিস। সাধারণত যে ভাইরাসের মারণক্ষমতা অত্যন্ত বেশি সেই ভাইরাস বিরাট একটা সংক্রামক হয় না, অপরপক্ষে যে ভাইরাস অতিরিক্ত সংক্রামক তাতে আবার খুব বেশি মানুষ মারা যায় না। যেমন ২০০৩-এর সার্স ভাইরাসে মৃত্যুর হার অনেক বেশি ছিল। বেশি মানুষ সংক্রামিত হননি। উল্টোদিকে এই ভাইরাস বিশ্বব্যাপী সকলকে সংক্রামিত করার ক্ষমতা রাখে।
প্র: তাহলে আপনি বলতে চাইছেন, করোনা (কোভিড ১৯) মারন ভাইরাস নয়?
উ: একদমই না। কেবলমাত্র বয়স্ক মানুষ এবং আগে থেকে অন্য গুরুতর অসুখে ভোগা মানুষের জন্যই মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
প্র: WHO তো বলেছে আমাদের এই ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
উ: একদমই তাই। আমরা কি আমাদের চারপাশে টিবি বা ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে বেঁচে নেই? এ হল Attenuation প্রসেস। হীনবল হতে হতে টিকে যাওয়া। যেসব মানুষ সংক্রামিত তাদের মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসটাও মারা যায়। ফলে অন্যদের সংক্রামিত করার ক্ষমতাও আর থাকে না। তাই ভাইরাসও সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের পরিবর্তন (মিউটেশন) করে টিকে থাকে কিছু কেমন জায়গায়। একে Endemic* বলে। মাঝে মাঝে এটি আবার ফেটে পড়ার মতো বেশ খানিকটা ছড়ায়। তখন কম ইমিউন, খেতে না পাওয়া, অসুস্থ, অপুষ্টিতে ভোগা মানুষদেরই কেবল মারা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ভাইরাসগুলোর মারণক্ষমতা কম কিন্তু ফিরে আসার ক্ষমতা প্রবল। আমার প্রশ্ন হল, মানুষ কেন আজও না খেতে পেয়ে অপুষ্টির জন্য মরবে? সরকারগুলি অপুষ্টি আটকাতে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?
প্র: আচ্ছা আপনি কিভাবে WHO কে সাহায্য করেছেন?
উ: উহানে যখন ছড়াতে শুরু করল হু পৃথিবীজুড়ে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছে।
প্র: কী বুঝতে চাইছিল হু?
উ: অসুখটার গতিপ্রকৃতি মূলত। কতগুলো রকমফেরে নিজেকে ছড়াতে পারে। যদি মিউটেট করে তাহলে কেমন আকার নেবে, একে বলে জিনোটাইপ সংক্রান্ত বোঝাপড়া।
প্র: জিনোটাইপ জানার দরকার পড়ে কেন?
উ: গোটা পৃথিবীতে COVID-19-এর টীকা আর ওষুধ তৈরি করার চেষ্টা চলছে। মুশকিল হল নির্দিষ্ট টীকা বা ওষুধ কেবল নির্দিষ্ট জিনোটাইপ* এর ওপরেই কাজ করতে পারে, অন্যান্যদের ক্ষেত্রে নয়।
প্র: কতগুলো COVID-19 জিনোটাইপ এখনো পাওয়া গেছে?
উ: গোটা পৃথিবীতে মোট উনত্রিশটা। দুর্ভাগ্যবশত ভারতে আমরা মাত্র দুটো পেয়েছি বাকি জিনোটাইপগুলো খোঁজার চেষ্টাও হচ্ছে না ঠিকমতো। এখানে শুধু মানুষের মুখে লকডাউনের মতো মুখরোচক কথার ফুলঝুরি ছুটছে।
প্র: এই দুটো জিনোটাইপ নিয়ে যদি একটু বলেন--
উ: আমরা অনেক পিছিয়ে আছি, যেখানে WHO সারা বিশ্বের একটা বড় অংশ থেকে নমুনা পরীক্ষা করে উনত্রিশটা করোনা ভাইরাস জিনোটাইপ খুঁজে পেয়েছে, ভারতে আমরা মাত্র দুটো নমুনা থেকে দুটোই মাত্র জিনোটাইপ পেয়েছি। ভারতে এই ভাইরাস সম্বন্ধে বোঝাপড়া এখনো সেভাবে কিছুই গড়ে ওঠেনি ফলে এই সংক্রমণকে আটকানোর ব্যাপারেও একেবারে বিশবাঁও জলে পড়ে আছি আমরা।
প্র: তাহলে কী মলিকিউলার বায়োলজিস্টরা এই লকডাউনকে সাপোর্ট করেন না?
উ: আমি শুধু আমার কথাটাই বলতে পারি। আমার মতে এই লকডাউন পিরিয়ডকে কাজে লাগিয়ে যদি সংক্রমণ খুঁজে পাওয়ার কোনো চেষ্টাই না করা হয়, যদি সম্ভাব্য আক্রান্তদের পরীক্ষাই না করা হয় তাহলে কোনো লাভ নেই। আমরা কি করছি? না, আক্রান্তদের বাড়িতেই আটকে রেখে দিচ্ছি, তাতে তাদের বাড়ির লোক আক্রান্ত হচ্ছেন। যদি অসুস্থতার লক্ষ্মণগুলো দেখা যায় তবেই হাসপাতালে যাচ্ছেন। কিন্তু 65% লোকের তো কোনো রোগলক্ষণই দেখা দেবে না। লকডাউন শেষ হলে এই লোকগুলোই বয়স্ক এবং অন্যান্য রোগে ধুঁকতে থাকা মানুষদের সংক্রামিত করবে আর ভাইরাসটি আবার মাথা চাড়া দেবে।
1918 সালে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারিতে ঠিক এইভাবে দ্বিতীয় বারের সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়।
প্র: তাহলে সরকার কেন লকডাউন ঘোষণা করলো?
উ: সেটা তো সরকারই জানেন। হয়তো খানিকটা ভয় থেকে আর খানিকটা টেস্ট এড়াবার জন্য। WHO বারবার জোর দিয়েছে যত বেশি সম্ভব টেস্ট করা যায় তার ওপর। ভারতের উচিত ছিলো এই রোগের ফাউন্ডার পপুলেশন* ( যারা প্রথম এই রোগকে এদেশে নিয়ে আসে) কে আলাদা করে আইসোলেশনে রাখা।
প্র: তাহলে স্পেন, ইতালি আমেরিকা নিয়ে কী বলবেন?
উ: না না ইতালি, আমেরিকা বা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে ভারতবর্ষকে এক করে ফেলবেন না। ওই দেশগুলোর বেশিরভাগই বয়স্ক মানুষ। ইতালির ৬৫℅লোক ষাটোর্ধ্ব। তাই মৃতের সংখ্যাও ওই দেশগুলোতে বেশি। এছাড়াও ইতালির বর্ণাঢ্য টুরিসম ব্যবসার ক্ষতি হবার কথা ভেবে ওরা বিদেশি টুরিস্টদের আটকায়নি।
প্র: কিন্তু ওরাও তো এখন লকডাউন ঘোষনা করেছে--
উ: সেটা টেস্টিং এর জন্য। ওরা সাময়িক লকডাউন করেছে সন্দিগ্ধ আক্রান্তদের টেস্ট করার জন্য। আর হাসপাতাল, বেড ভেন্টিলেশন এই ব্যবস্থাগুলো ঠিকঠাক করে গড়ে তুলতে, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য দরকারি সুযোগসুবিধা দিতে। লকডাউন আসলে সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু দেয় যাতে ঠিকঠাক টেস্টিং আর এই স্বাস্থ্যসেবার পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়।
প্র: আপনার কি মনে হয় ভারত এগুলি কিছুই করেনি?
উ: একদমই করেনি। ইতালি প্রতি দশ লক্ষে পাঁচ হাজার জনের টেস্ট করিয়েছে ভারত মাত্র আঠারো। যদি আমি টেস্ট না করাই, ঠিকঠাক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, আই সি ইউ-এর ব্যবস্থা না করি, স্বাস্থকর্মীদের বন্দোবস্ত না করি তাহলে লকডাউনের লাভটা কি?
প্র: কিন্তু আমাদের হাতে তো প্রয়োজনীয় সংখ্যায় টেস্ট কিট নেই?
উ: এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না। আমাদের দেশে দশ হাজার এরকম ল্যাব আছে যেখানে টেস্টিং সম্ভব।
প্র: এটা কীভাবে সম্ভব?
উ: আক্রান্ত হয়েছে এমন একজনের রক্তের নমুনা লাগবে আমাদের আর যাদের সম্ভাবনা আছে হবার তাদের রক্ত লাগবে। আমরা জিন মিলিয়ে দেখে নিতে পারব। এটা হাজার টাকা বা তারও কমে হতে পারে। ঘটনাচক্রে দু'সপ্তাহ আগেই আমরা IISER এ এই টেস্টটার খরচ হিসেব করছিলাম, যা দেখলাম তাতে মোটামুটি সাতশো টাকার কাছাকাছি লাগবে।
প্র: কিন্তু এই টেস্ট কতটা ভরসাযোগ্য?
উঃ মার্কেটে যে ভুলভাল অনিশ্চিত কীট চলছে তার থেকে অনেক বেশি। আমি শুনে অবাক হলাম সরকার টেস্টের প্রতি সাড়ে চার হাজার টাকা ঠিক করেছে। আর কিছু নির্দিষ্ট কোম্পানিকেই এর বরাত দেওয়া হয়েছে। ভেবে অবাক লাগে এই দুর্দিনেও কিছু কেমন লক্ষকোটিপতিদের পয়সা কামিয়ে নেবার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
প্র: আপনারা সরকারের দ্বারস্থ হয়েছেন?
উঃ সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় এটাই। আমাদের ল্যাবগুলো বিশ্বের অনেক দেশের ল্যাবের চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। এমনকি WHO আমাদের রিসার্চএর ওপর ভরসা করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত না কেন্দ্র না কোনো রাজ্য সরকার, কেউ আমাদের সাথে আলোচনা করেনি।
প্র: কিন্তু ভারত তো WHO এর গাইডলাইনই ফলো করছে--
উ: WHO বলেছে আইসোলেটেড রাখো এবং টেস্ট করো। কোত্থাও বলেনি লকডাউন করতে। ভারত লকডাউন করেছে কিন্তু টেস্টিং করছে না। যদি টেস্ট না করা হয় আমরা ভাইরাসের আলাদা আলাদা ভ্যারাইটি আর আলাদা আলাদা মিউটেশনগুলোর কথা জানতেই পারব না।