আনন্দবাদী রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুভাবনা
'সুখ-এর বিপরীত দুঃখ, কিন্তু আনন্দের বিপরীত তা নয়, বস্তুত দুঃখ আনন্দেরই অন্তর্ভুক্ত' l
বাইরে কোন দুঃখজনক ঘটনা দেখলে আমাদের চোখে জল আসে l সেখানে কবির প্রতিভার পরিচয় থাকে না l কবি যখন তার অঘটন ঘটান পটীয়সী প্রতিভার বলে তখন সেই লৌকিক 'শোক' আর তার মধ্যে থাকে না l তার দ্বারা তখন পাঠকের হৃদয়-এ অলৌকিক করুণ রসের সৃষ্টি হয় l অলৌকিক করুণরস হয়ে ওঠে আনন্দদায়ক l এভাবেই' দুঃখের তীব্র উপলব্ধি ' হয়ে ওঠে আনন্দকর তা না হলে কেউ 'রামায়ণ' পাঠ করত না, দুঃখের ছায়াছবিও দেখতো না l পাঠক যখন দুঃখের কাব্য পাঠ করে তখন কাব্যের যাদুশক্তিতে একাত্ম হয়ে যায় l পাঠক অনুভব করে এই দুঃখ একই সঙ্গে তার এবং অপরের, আবার তারও নয় অপরের নয়- তখনই আনন্দলাভ ঘটে l করুণ রসের মানবিক উপাদান দুঃখদায়ক হলেও তার পরিনামি রস আনন্দের সামগ্রী l জীবনের পথচলার ক্ষেত্রে দুঃখকে আমরা পছন্দ না করলেও সাহিত্যের ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে আকর্ষণীয় l সাহিত্যের ক্ষেত্রে ট্রাজেডি মনোরঞ্জন করে বলেই তা উপভোগ্য l জীবনের ক্ষেত্রে দুঃখ-বেদনা হলো পরম সত্য l সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই সত্য জীবনের গভীর তাৎপর্যকে অনুভব করতে শেখায় l সার্থক সাহিত্য পাঠ করলে রসিক ব্রহ্মানন্দের মত আনন্দ লাভ করে, মৃত্যুও সেখানে দুঃখ ও বেদনাকে অতিক্রম করে নিত্য আনন্দের লীলা হয়ে ওঠে l জীবনের সত্যতা অনুভব-এর মানদন্ড মৃত্যু, আনন্দবাদী রবীন্দ্রনাথের কাছে l মহান মৃত্যুকে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল মন দিয়েই জয় করেছেন l তিনি জীবনের মহিমাকে প্রকাশ করেছেন মৃত্যুর ভিতর দিয়েই আর এখানে মৃত্যু তথা দুঃখ আনন্দকর হয়ে উঠেছে l
রবীন্দ্রনাথ আনন্দ বলতে সুখকে যেমন বুঝিয়েছেন, দুঃখ কেও তেমনই বলেছেন l
তিনি বলেছেন দুঃখকে বাদ দিয়ে আনন্দ লাভ সম্ভব নয় l এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন ট্রাজিক সত্য হল জীবনের মূল সত্য l রামচন্দ্রের নির্বাসন মন্থরার উল্লাস, দশরথের মৃত্যু - এর মধ্যে ভালো কিছু নেই নিয়ে l তবুও এ ঘটনা নিয়ে কত কাব্য, নাটক, ছবি, গান, পাঁচালী বহুকাল থেকে তৈরি হয়ে আসছে, ভিড় জমছে কত, আনন্দ পাচ্ছে মানুষ l দুঃখের মহনীয়তা মানুষের মহত্বকে উজ্জ্বল করে তোলে l তাই দুঃখের কাব্যকে আমরা সুখের কাব্য অপেক্ষা অধিক সমাদর করি l দুঃখ অনুভবে আমাদের চিত্তে অধিকতর আনন্দ উপস্থিত হয় l ট্রাজেডি মানুষকে বিশেষ সত্যের মুখোমুখি করে আনন্দ দান করে l
অ্যারিস্টটল জানিয়েছেন, লৌকিক জগতের বেদনাবহুল ঘটনা সাহিত্যে অনুকৃতি হলেও আনন্দদায়ক হয় l নিকল বলেছেন, ট্রাজেডির আনন্দ হল শৈল্পিক অনুভূতির আনন্দ l রবীন্দ্রনাথ ট্রাজেডি পাঠ বা দর্শনের সময় পাঠক বা দর্শককে ট্রাজেডির নায়কের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার কথা বলেছেন l নায়ক-এর সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজের সুখ-দুঃখ অনুভব করে পাঠক, দর্শক আনন্দ লাভ করে l এভাবে তারা ক্রমশ চলে যায় লৌকিক মায়ার জগতে, সেখানে দুঃখ আরামবোধের চেয়ে প্রবল হয়ে ওঠে l ট্রাজেডির দুঃখকর ঘটনা তখন আর দুঃখ করে থাকে না l আসলে প্রকাশের আনন্দই হল সাহিত্যের আনন্দ l যা আনন্দরূপে প্রকাশিত হয় তা সবরকম দুঃখ, যন্ত্রণা, মৃত্যুকে অতিক্রম করে যায় l ট্রাজেডি আনন্দ সৃষ্টি করতে সক্ষম বলেই সাহিত্যে এত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে l তথ্যের সীমাকে অতিক্রম করে যাওয়াই হলো কাব্য, সাহিত্য ও শিল্পের লক্ষ্য l আর দুঃখ এখানে আনন্দদায়ক l
শেলী জানিয়েছেন, মানুষের আত্মা জৈবিক সত্তা ও অন্তরতম সত্তা - এই দুই ভাগে বিভক্ত l এই দুইভাগের সামঞ্জস্য দানে আনন্দের সৃষ্টি হয় l গভীর দুঃখ আনন্দের জন্ম দেয় l জীবনের ক্ষেত্রে দুঃখ-বেদনা পরম সত্য l রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর অর্থাৎ চরম দুঃখের ভিতর দিয়ে জীবনের মহিমাকে প্রকাশ করতে শিখেছিলেন উপনিষদের মন্ত্র থেকে - বলা হয়েছে 'মানুষ অমৃতের সন্তান' l অমৃতের জগতে প্রবেশের চাবিকাঠি আছে মৃত্যুর কাছে, দুঃখের কাছে l আনন্দবাদী রবীন্দ্রনাথের কাছে এই-ই জীবনের সত্যতা অনুভব-এর মানদন্ড হয়েছে মৃত্যু এবং দুঃখ l তাই রবীন্দ্রসাহিত্যে মৃত্যুও দুঃখ অধিক আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে এবং পাঠকের অন্তরে তা অপরিসীম আনন্দ প্রদান করেছে l সুখ ও দুঃখের সম্মিলিত রুপই হল রবীন্দ্রচিন্তায় 'আনন্দ' l
রবীন্দ্রনাথের মতে মৃত্যু এই অস্তিত্বের ভীষণ ভারকে সর্বদা লঘু করে রেখেছে আর জগতে বিচরণ করার অসীম ক্ষেত্র দিয়েছে l যেদিকে মৃত্যু সেদিকেই জগতের অসীমতা l আনন্দবাদী রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু তথা দুঃখকে আনন্দেরই পরিপূরক হিসেবে দেখেছেন l রবীন্দ্রসাহিত্যে তাই
মৃত্যু অধিক আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে এবং পাঠকের অন্তরে দায়িত্ব অপরিসীম আনন্দ দান করেছে l এই আনন্দ হল লীলার আনন্দ, বিচরণের আনন্দ l
আর মৃত্যু ও দুঃখ এখানে আনন্দেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় এবং এগুলি আনন্দেরই অপর নাম হয়ে ওঠে l
=====০০০=====
আমি রাহুল পাত্র,
ADDRESS - 128 /A/5 G. T. ROAD (WEST), KONNAGAR, HOOGHLY, WEST BENGAL, INDIA, 712235..
MOBILE NUMBER - 8617719846.
WHATSAPP NUMBER - 8961137783