দেশবৈরি
কী
যেন এক হীনমন্যতা গ্রাস করেছে তিরুপতি বাবুকে! কোথা থেকে কী এসে সবকিছু একেবারে
ওলটপালট করে দিয়ে গেল! চিরচেনা চোখগুলো থেকেও আজকাল কেমন যেন অচেনা সব ইঙ্গিত ভেসে
আসে! জানলা খুলে নিকট জনের উদ্দেশ্যে একটু হাত নাড়বেন....সেখানেও সংশয়! এমনকি রাতের
অন্ধকারে একটা জোনাকি জ্বলে উঠলেও তিরুপতি বাবু ভাবেন, ওই বুঝি কেউ চর ছেড়ে দিয়ে
ওয়াচ করছেন তাঁকে! বিশেষকরে ওঁর বাড়ির কাছেই যেদিন কোয়ারেন্টার সেন্টার হল, সেদিন
থেকেই সমস্যাটা আরও জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠল। মনোমোহিনী দেবী হাত জোড় করে গ্রাম
সদস্যা হেমার কাছে অনুরোধ করলেন, "আমাদের বয়েসের দিকে একটু তাকান! এসব এনে
এখানে জড়ো করবেন না প্লিজ!"
হেমা বৌদি হেসে ব্যপারটা হালকাভাবে নিতে চেষ্টা করলেন, "আপনার অসুবিধা থাকলে,
আপনার ছেলেরা যেসব হাই প্রোফাইল দেশে বাস করে তেমন জায়গায় চলে যাচ্ছেন না
কেন?"
কথাটিতে তিরুপতি বাবুর আত্মসম্মানে আঘাত লাগে খুব! উনি উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন,
"হাই প্রোফাইল দেশ মানে?...এ দেশ আমার নয়?"
-"কথা বাড়াবেন না কাকু। মুখ খুললে এখন অনেক দূর অব্দি গড়াবে!"
রাতে মনোমোহিনী দেবী ছেলেদের কাছে ফোন করে কেঁদে ফেলেন। তিরুপতি বাবু ফোন কেড়ে
নিয়ে, ওঁকে প্রেসাসের ওষুধ খাওয়ান। এরপর আলোটা নিভিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বোলাতে
বোলাতে সান্ত্বনা দেন, "ছেলেগুলো কতোটা চাপের মধ্যে কাজ করে জাননা! তুমি মা
হয়ে এমন পাগলামো করলে হয়?"
-"আমাদের প্রতি ওদের এতো আক্রোশ কেন বুঝলাম না!"
-"এটা একপ্রকার তৈরি করা হয়েছে। সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে আসল ইস্যুটাকে হয়ত
চাপা দিতে চাইছেন কেউ কেউ!"
-"মাথাটা চাইল, আর অমনি সেটা বিক্রি করে দিলাম এ কখনো হয়?"
-"ওই জন্যেই তো আমাদের আরও মাথাটা ঠাণ্ডা রাখা প্রয়োজন! তুমি হয়ত বিশ্বাস
করবে না, এ দেশের শতকরা আটানব্বই জন নাগরিকই ওই একই পন্থায় জীবনধারণের রাস্তা
খুঁজে চলেছেন!"
-"আমার ছেলেগুলো তো ওদের কোনও ক্ষতি করেনি!.... তো?"
-"ক্ষতি না করলেও কিছু তো একটা করে! তা নাহলে ছেলেদের শিক্ষিত করে আজ আমরাই
বা এতো গুঁটিয়ে আছি কেন!"
-"দেশটাকে ওঁরা এতটা উচ্চতায় তুলল! তার প্রতিদান এইভাবে....?"
এবার তিরুপতি বাবু আলমারি থেকে অনেককাল আগের জীর্ণ একখানি মানচিত্র খুলে বললেন,
"বলো দেখি, দেশ বলতে তুমি আদতে কতটা নিজের বলে জান?"
মনোমোহিনী দেবী উত্তর দেন না। কেবলমাত্র ওঁর কুঞ্চিত চোখের কোণা বেয়ে ঝরঝর করে ঝরে
পড়ে অমীমাংসিত অশ্রু!
গয়েশপুর জ্ঞানদানন্দিনী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনটিতে এখন রীতিমত হরেক রঙের
মেলা বসেছে! নাগরদোলাটা বাদে এখন প্রায় আর সবই ওখানে পাওয়া যাচ্ছে।
উঠতি বয়েসের মেয়েরা বিকাল হতে না হতেই হুড়ো মেরে ছাদের ওপরে উঠছে কিতকিত খেলতে।
বয়স্ক বুড়ো বুড়িরা কেউ কেউ ব্যাজারমুখে বলেন, "তোদের কী আক্কেল রে বাপু!
এতোটা রাস্তা রোদ গরম ঘাপিয়ে বাছাগুলো এল! এখনই ওদের মাথাগুলো লেথিয়ে না ভাঙলেই
নয়?.. খেলার আর জায়গা পেলে না?"
অন্যদিকে পাড়ার বৌ-ঝিদের উদ্দেশ্যে তিতিবরক্তির স্বরে কারও এক সন্দেহবাতিক শাশুড়ি
বলে ওঠেন, "বাপ্পুরে বাপ্পু! আমাদের কালে বাইস্কোপ দেখতেও এমন হুমড়ি খেয়ে পড়ত না কেউ!" তবু ন'মেসে
পেট নিয়ে একজন পোয়াতি এখন প্রায়শই কনুই ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জানলার ধারে। মাঝে
মাঝে ভেতর থেকে একটা লোমশ হাত বেরিয়ে আসে। পোয়াতি মেয়েটি পেট এগিয়ে দেয়। কখনও বা
লোমশ হাতটি পেটের ওপর আলতো সুড়সুড়ি দিতে দিতে সান্ত্বনা দেয়, "এতো উতলা হলে
হয়! আর মাত্র তো এইকটা দিন!"
বনেদি ঘরের বৌগুলো নাকের ওপর আঁচল মুঠো করে হতাশামাখা মুখগুলো দেখেন আর দুঃখ করেন। অপরপক্ষে একেবারে নিরন্ন হয়ে পড়েছে যেসব ঘর, তাদের মধ্যে কেউ
কেউ শাপ শাপান্ত করেন,"ওই কষাই বাড়ির বুড়োটাকে ধরে যদি ঘা কতক দেওয়া
যেত!"
মহিতোষের মা চোখ গোল্লা গোল্লা করে কথাগুলো গিলতে থাকে,"কে গো কে?"
-"ওই যে বুড়োটা, যার তিনটে ছেলেই চিকাগোয় থাকে!"
-"তিরুপতি বাবু?"
-"আর বল কেন! গত মাসেও শুনি উনার ছেলেরা ঢুকেছে! আর আমাদের বাচ্চাগুলো আসলে
দোষ তাইনা!"
-"তাই তো বলি, নুক্কে নুক্কে আসছে আর রোগ বাইলাই চালান করে চলে যাচ্ছে! না
খেতে পেয়ে লোক মরছে! আর ওনারা মারছেন ফরেনের ফুটানি!"
কে একজন উত্তেজিত কণ্ঠে উস্কানি দিতে দিতে চলে গেল, "দেশের এই দুর্গতি হবে
কেন! ওরাই তো আসল শত্রু! ওঁদের বাইরে টেনে এনে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিলেও মনের রাগ
মেটে না!"
মহিতোষের মা মাস্ক দিয়ে ঘাড়ের ঘাম মুছে বলেন, "ওঁদের আর কী দোষ! হুড়কো খুলে
শুতে গেলে যা হয়, সে তুমিও জান আমিও জানি!"
সেন্টারে এখন স্পেশাল কুপনে চাল আলু আসে। একদিকে অবজ্ঞা অন্য দিকে অভাব। সেইসাথে
এবছর গরমও পড়েছে খুব! খাঁচায় আটকানো ব্রয়লারের মতো পরিযায়ী প্রাণীগুলো হাঁসফাঁস
করে ওঠে! ওদের কষ্টে কানাইবাবুর বিগত যৌবনা মেয়েটারও কান্না পায় খুব! সন্ধ্যার
গা'ঘোর অন্ধকারে সেও আজকাল বুক দিয়ে কল চেপে ড্রাম ভর্তি ঠাণ্ডা করে জল তুলে দেয়।
ছেলেরা হাসে। কেউ বুকের চওড়া ছাতি টান করে হাওয়া খায়। কেউ মোবাইলে নিউজ দেখে।
গাঁয়ের গৌরী সেন তিনিও নিজের গরজে টোটোর পেছনে মাইক খাটিয়ে দিনে দুবার করে
সমাজসেবা দিয়ে যান, "হ্যালো...হ্যালো অনুগ্রহ করে শুনবেন, বাইরে থেকে আগত
শ্রমিক ভাইয়েরা,... সকলেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন! গরম জলে চান করুন। প্রতিদিন
নিয়ম করে সাত থেকে আটবার গারগেল করুন। কিন্তু মনে রাখবেই সবটাই করবেন গরম জলে।
এছাড়া আরও অন্যান্য নিয়মবিধি যেমন, খাবার যতটা সম্ভব গরম গরম খেতে চেষ্টা করুন,
এমনকি বালিশ বিছানাপত্তর... হ্যালো হ্যালো....!"
কিন্তু এতো জ্বালানীর জোগান কে দেবে? এগিয়ে আসেন হেমা বৌদি। দলের ছেলেদের ডেকে
বললেন, "আম্ফানে গাছ পড়েছে খুব। আশাকরি চাইলে কেউ আর না বলবেন না। অনেকেই
আবার শেকড় সুদ্ধ উপড়ে নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন। চল। জ্বালানি কাঠ ম্যানেজ হয়ে
যাবে।"
স্কুলের গায়েই তিরুপতি বাবুর বাড়ি। বিদেশী স্টাইলে এমন সুসজ্জিত আর ছায়াঘেরা বাড়ি
এ গাঁয়ের মানুষ ইতিপূর্বে আর কোথাও দেখেছেন বলে মনে করতে পারেন না। পাহাড়ি ফুল,
ভেষজ পাতা আর নানা জাতের ফলফলারিতে ভেতরটা সবসময় ফুলে ফেঁপে থাকে। ইদানিং বাড়িটা
ভেতর থেকে সবসময় তালা দেওয়া থাকে।
আজ জ্বালানী কাটতে এসে পাড়ার আগাছা পরিষ্কারেও ছেলেদেরকে সমানে উৎসাহিত করতে থাকেন
হেমা বৌদি। প্রথমে তিরুপতি বাবুর বাড়িটাকেই ওরা টার্গেট করল। হেমা বৌদি বাইরে থেকে
দরজায় কাটারির উল্টো পিঠ দিয়ে ঘা মারতে মারতে ডাকলেন, "ও কাকু,.... বাড়িতে
কেউ আছেন?"
উত্তর আসছে না দেখে ওদের মধ্যে একজন খেঁকিয়ে উঠল, "ও বুড়ো.....!" উত্তর
এল না।
এদিক ওদিক দেখে নিয়ে হেমা বৌদি অর্ডার করলেন, "নে কোপা! একেবারে ঝাড়েমুলে
ছেঁটে দে!"
দামী গাছগুলোর অধিকাংশই তখন ভূমিতে লুটিয়ে পড়েছে। হঠাৎ বেরিয়ে এলেন মনোমোহিনী
দেবী। লুটিয়ে পড়া গাছগুলোকে দেখে ইনহেলারটা টানটে টানতে প্রায় কেঁদেই ফেললেন,
"কী সব্বোনাশ করেছ তোমরা!... এমন কেন করলে?"
-"কাকুকে কদিন ধরে দেখতে পাচ্ছিনা কী ব্যাপার?"
-"ওঁর শরীরটা....!" ভালো নেই এই কথাটাও আর বলবার শক্তি হল না মনোমোহিনী
দেবীর।
-"শুনছি আপনার ছেলেরা নাকি এসেছিলেন?"
ছেলেদের প্রতি একপ্রকার ঘৃণা মাখানো মুখভঙ্গি করে মনোমোহিনী দেবী ওদের বোঝাতে
চেষ্টা করলেন,"কে বলেছে তোমাদের? আজকাল কে কার খোঁজ রাখে বলো?"
-"সেই জন্যেই তো বলছি। আপনাদেরও তো বয়েস হয়েছে! দরজার কাছটায় এতো জঙ্গল করে
রেখেছেন! বাইরে থেকে যে একটু খোঁজখবর নেব.....সে উপায়ও তো নেই।...তাই এই গাছগুলোকে
ছেঁটে দিলাম।"
এমনসময় তিরুপতি বাবু একটা পিস্তল হাতে টলতে টলতে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
বললেন,"বেশ করেছ! আজ থেকে আমারও নিশানাটা আর ভুল হবেনা আশাকরি!"
হেমা বৌদি ঘাবড়ে গেলেন, "কাকে মারবেন আপনি?"
-"যাঁদের ভুলের জন্যে তোমরা আজ কষ্ট পাচ্ছ......!"
========000========
উত্তম বিশ্বাস
দত্তপুকুর, ব্যায়াম সমিতি
উঃ ২৪ পরগনা
পিন-৭৪৩২৪৮
Mo-9831359655
Email-ubiswas721@gmai.com
09/05/2020