ভেসে আসে সুদূর স্মৃতির সুরভি
অফিসের পালদা বলেছিলেন—স্মৃতি খুঁজতে যেতে নেই । কথাটা সব সময় মনে রাখতে পারি না । কোন্ সেই কৈশোরবেলায় বন্ধু টুকুর দাদার বাড়ি গিয়ে আদরযত্নের এক খনি আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম। সেই দাদার নাম অলক । সুন্দর গান করত । আবার নিজে গান লিখতও । ওর লেখা ও সুর করা গানও শোনাত সে সময় । বাড়িতে অলকদা আর ওর মা । আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না । সেটা বুঝতে পারতাম । তবু ওরই মধ্যে অলকদার মা লুচি তরকারি করে খাওয়াতেন । কখনো মিষ্টি আনাতেন । নিজেকে মনে হত যেন অলকদার নিজের ভাই । মা নামক বস্তুটি যে স্নেহের খনি তা বেশ অনুভব করতে পারতাম । মা'রা যতই ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে কাটিয়ে দেন না কেন, আতিথেয়তার প্রশ্নে তাঁরা সব সময়ই বিপ্লবী । কোনো অভাব কারোর কোনো আপত্তি তাঁরা কানে তোলেন না । অলকদার বাড়ির কাছেই ছিল আমার পিসির বাড়ি । অনেক সময় আমার পিসতুত দাদা কাঞ্চনও সঙ্গে থাকত । অনেকখন আড্ডা দিয়ে আমি আর কাঞ্চনদা এসে দাঁড়াতাম শালনদীর ব্রিজের ওপর । ঝির ঝির করে নদীর জল বয়ে যেত । স্বচ্ছ জলে খলসে চাঁদা মাছ লাফিয়ে বেড়াত । দিনের শেষে কমলারঙের আলো মেখে আদিবাসী নারীরা ঘরে ফিরত । মাথায় গাছের শুকনো ডাল । কাঁঠাল পাতা ছাগলের খাবার জন্য । পুরুষদের কারো কারো কাঁধে এক দুটো মরা কাঠবিড়ালি বা মেঠো ইঁদুর । অলকদার গানের রেশ ধরেই আমাদের ঘরে ফেরা শুরু হত—আমি চলতে চলতে থেমে গেছি , আমি বলতে বলতে ভুলে গেছি ।
এর পর শালনদীর ব্রিজের নীচ দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে । আমার আর ওদিকে বড় একটা যাওয়া হয়নি । তরুণী আদিবাসী কন্যা যারা ঠোঙায় করে বনের গাছ থেকে পাকা পিয়াল এনে দিত তাদের মেয়েদেরই হয়তো এতদিনে বিয়ে হয়ে গেছে । অলকদার কথাও প্রায় ভুলতে বসেছিলাম । একদিন অফিস থেকে ফিরেছি । আমার স্ত্রী বলল -- জানো এ পাড়ারই এক বয়স্ক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হল । পরিচয় দিতে গিয়ে তোমার নাম বলতেই চিনতে পারলেন । তোমার দাদার নাম বলাতে বললেন—তাহলে তো আর কথাই নেই । ওই হবে । ওকে একদিন নিয়ে এসো তো । এ পাড়াতেই যখন থাকো । ঐ সপ্তাহের রবিবারটায় আমরা মাসিমার বাড়ি গেছিলাম । অলকদা কোথায় যেন বেরিয়েছিল । এত বছরের ব্যবধানে সেই পুরোনো স্নেহময়ী জননীকে আমি আর খুঁজে পাইনি । লুচি খাওয়ানোর প্রশ্ন উঠছে না , আমরা ঐ পাড়াতেই থাকি । কিন্তু যখন অলকদাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসতে বললাম , খুব উৎসাহ দেখলাম না । বললেন—ও তো খুব টিউশনি করে গানের । একদম সময় পায় না । ভেবেছিলাম আমার লেখা গান অলকদাকে দেব সুর করার জন্য । তা আর হল না । শান্ত গ্রামীণ পরিবেশ থেকে এই কলকারখানার শহরে এসে মাসিমা অহঙ্কার আভিজাত্য সবই বোধহয় খুইয়ে ফেলেছিলেন । অফিসের পালদা বলেছিলেন—স্মৃতি খুঁজতে যেতে নেই । কথাটা সব সময় মনে রাখতে পারি না । এখন মনে হয় ওদের সঙ্গে আর দেখা না হলেই ভালো হত । কই অলকদা তো একগাল হেসে এগিয়ে এসে বলল না—শোনো একটা গান এখন খুব গাইছি—এক তাজমহল গোড়ো হৃদয়ে তোমার আমি হারিয়ে গেলে ।
অলকদার সঙ্গে যখন প্রথম আলাপ আমি তখন স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র । আমাদের স্কুলে দুটো মুখোমুখী বিল্ডিং ছিল । অফিসঘরের দিকে নীচু ক্লাসের ঘর আর খেলার মাঠের দিকে উঁচু ক্লাসগুলো । অফিসঘরের সামনে যখন আমাদের হেডমাস্টারমশাই এসে দাঁড়াতেন আমাদের দোতলা বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রাণ উড়ে যেত । এমন রাশভারী ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর । তাঁর ছেলে আমার সঙ্গে প্রায় পুরো স্কুলজীবনটাই পড়েছে । আমার খুব বন্ধু ছিল সে । বহু বছরের বন্ধু । তারপর একদিন খুব তুচ্ছ কোনো কারণে তার সঙ্গে একটা মনোমালিন্য হল । সেই যে বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে গেল বেশ কয়েক বছর তা আর চালু হল না । জীবনের নানা রঙ্গরসের কথা , অনেক অ্যাডভেঞ্চার অভিযানের গল্প তার সঙ্গে বাটোয়ারা করে নিতে ইচ্ছে করত কিন্তু অচলায়তন কিছুতেই ভাঙছিল না । একবার হেডস্যার ছুটিতে তাঁর বাড়ি গিয়ে অনেক রসগোল্লা নিয়ে এলেন । স্যার তাঁর ছেলে কালীকে বললেন—মিষ্টিগুলো বন্ধুদের খাইয়ে দাও । কালী কয়েকজন বন্ধু নিয়ে টিফিনের সময় তাদের বাসার দিকে পা বাড়াতেই স্যার আমাকে দেখিয়ে কালীকে জিজ্ঞেস করলেন—ওকে নিলি না ? একটি ছেলে তখন সাহস করে এগিয়ে এসে বলল—স্যার অনেক বছর হয়ে গেল ওদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ । হেডমাস্টারমশাই শুনে বললেন -- সে কী , এই বয়সেই রেষারেষি ! যাও ওকে নিয়ে যাও আর গিয়ে ভাব করে নাও । আমার মতোই কালীও কিন্তু ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছিল । সেটা বুঝলাম সবাইকে সে দুটো করে মিষ্টি দিল । আমাকে দিল তিনটে । তারপর সময়ের নদী বয়ে চলে গেছে অনেকদূর । আমাদের স্কুলের মাঠের আকাশমণি গাছের কত পাতা ঝরে গেছে আবার কত নতুন নতুন পাতা বেরিয়েছে । আমরা যে যার নিজের রাস্তা তৈরি করে নিয়েছি । জীবনের পড়-বেলায় একদিন খবর এল কালী আমার শহরেই একটা অফিসের প্রধান হয়ে এসেছে । যেখানে তার অফিস সেটা আমার বাড়ি থেকে খুব দূর নয় । একদিন ফোন করে পৌঁছে গেলাম তার কাছে । তার অফিস তখনও ছুটি হয়নি । কাজও করছে, আমার সঙ্গে কথাও বলছে । এর মধ্যে চা আনাল । সৌজন্যেরও একটা সীমা থাকে । এক সময় উঠলাম । তাকে বারবার আমার বাড়ি আসার কথা বলে এলাম । কালী বলল ও জায়গাটা খুব ভালো মতোই চেনে । আশা করলাম ত হলে নিশ্চয় সময় করে একদিন আসবে । আসেনি । তেত্রিশ বছর কেটে যায় । কেউ কথা রাখে না । হয়তো ইচ্ছে থাকলেও হয়ে ওঠে না । স্কুলে আমরাই আমাদের প্রভু ছিলাম । যখন যা মনে আসত তা-ই করতাম । এখন জীবনের অবস্থান বদলেছে । পেশা সংসার সবার দাবি মিটিয়ে নিজের জন্য তলানিতে যা পড়ে থাকে তা দিয়ে নিজের সব শখ আহ্লাদ মেটানো যায় না। তার পর থেকে আমাদের আর দেখা হয়নি । কখনো কখনো স্বপ্নের ভিতর দিয়ে স্কুলের খেলার মাঠের ওপর বয়ে যাওয়া পলাশফাগুনের হাওয়া আমাকে ছুঁয়ে উড়ে চলে যায় । আমার চোখের সামনে একটা মৃত সময় যযাতির নতুন দেহের বিকাশমানতায় ফিরে আসে । এক একবার মনে হয় কালী যদি আমার কাছে একদিন দেখা করতে আসতও আমি কী তাকে খেলার মাঠের সেই ধুলোজড়াজড়ি জীবন ফিরিয়ে দিতে পারতাম ? সময় বোতলের ছিপির মতন । এক বোতলের ছিপি আর এক বোতলে ফিট করে না । এক সময়ের খাপে অন্য সময়কে বসানো যায় না। তার থেকে পালদার কথাটাই বড়ো বেশি করে মনে ধরে--স্মৃতি খুঁজতে যেতে নেই ।
তখন আমি চাকরিতে ঢুকেছি । বাসে যাতায়াত করি । কম্পানির বাস । বাসে অনেকেই যায় । সবার সঙ্গে আলাপ না হলেও মুখচেনা তো হয়েই যায় । একদিন ফেরার সময় সবে বাস থেকে নেমেছি ঐ রকম একজন মুখচেনা লোক এগিয়ে এসে বলল—আপনার কাছে পাঁচটা টাকা হবে ? একটা জিনিস কিনছিলাম , একটু টাকা কম পড়ে গেল । কাল অফিসে দিয়ে দেব । আমি বেশি কিছু চিন্তা না করেই তাকে পাঁচটা টাকা দিয়ে দিলাম । মানুষটির নাম আমি জানি না । বিশ্বাস রাখলাম যে পরদিন অফিসে দিয়ে দেবে । এ গল্প শুনে এখনকার ছেলেমেয়েরা ভাববে কী ভারী পাঁচটা টাকার গল্প শোনাতে বসেছে । তাদের জন্য বলি , যে সময়ের কথা বলছি তখন দু'টাকায় চারটে দেশি হাঁসের ডিম বা চারটে রাজভোগ পাওয়া যেত । কাটা পোনার দর ছিল কুড়ি টাকা কিলো এবং খাসির মাংস এগারো টাকা কিলো । অতএব পাঁচ টাকা নেহাত ফেলনা ছিল না সে সময় । যাই হোক্ পরদিন অফিসের কাজের চাপে ঘটনাটা ভুলে গেছিলাম । মনে পড়ল একজনের কথায় । অফিসে আমারই টেবিলের কাছাকাছি দুজন কথা বলছিলেন । তাঁদের বক্তব্যও একই । কেউ একজন হাতের মধ্যে কয়েকটা টাকা দেখিয়ে কিছু টাকা ধার নিয়ে গেছে । আমি তখন আমার অভিজ্ঞতাও বললাম । ওঁরা জিজ্ঞেস করলেন যে নিয়েছে তার নাম কী নীতিশ । বললাম –নাম তো জানি না , তবে ওকে এই অফিসে আমি দেখেছি । দেখলে চিনতে পারব । অফিস ছুটির পর ঐ ভদ্রলোক দুজনের সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছি দেখি সেই নীতিশ । একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে গা ঘেঁষে চলে গেল । তখন আমি আমার সঙ্গীদের বললাম—এ যে দেখি চিনেও চেনে না । নীতিশ আমার কথাটা বোধহয় শুনতে পেয়েছিল । যেতে গিয়ে ফিরে এসে বলল—কাল আপনিই আমাকে বাজারে পাঁচ টাকা দিয়েছিলেন, না ? আমি বললাম -- মনে পড়ল তা হলে ? নীতিশ এর পর আমাকে পাঁচটা টাকা দিয়ে দিল । আমার সঙ্গী বললেন—আর আমারটা ? সে তখন এক গাল হেসে বলল—আপনার সঙ্গে তো আমার অন্য সম্পর্ক, দাসদা । আমি মাইনে পেয়েই আপনারটা দিয়ে দেব । তখন দাসবাবু আমাকে বুঝিয়ে বললেন—ও যে অভাবে অমন করে তা কিন্তু নয় , ওটা ওর স্বভাব । এর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওকে শোধ দেবে , আবার আর এক জনের কাছ থেকে নিয়ে অন্যজনকে দেবে । এই অঙ্ক খাটিয়ে ও সারা মাস চালিয়ে দেয় । ওর নিজের মাইনেতে হাতই দিতে হয় না । জীবনের পথে চলতে চলতে যে কত বিচিত্র রকমের মানুষের দেখা পাওয়া যায় তার ইয়ত্তা নেই ।
যে দাসবাবুর কথা বলছি তিনি খুব গুণী মানুষ । দারুণ ছবি আঁকতেন । আমাকে একটা মা দুর্গার মুখ এঁকে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন । বেশ বড়ো ছবি । বহু বর্ণে উজ্জ্বল । আমার সদর দরজার মাথায় শোভা পেয়েছিল বহুদিন । ছবি তোলাও ছিল তাঁর নেশা । সে যুগে যখন দেশে ভালো ক্যামেরা পাওয়াই যেত না তখন তিনি বিদেশি ক্যামেরার জন্য হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতেন । একবার দাসবাবুর তোলা ছবি দেখতে ওঁর বাড়িতে গেছি । অনেকখন ধরে ছবি দেখলাম। এটা সেটা নানা জিনিস খাওয়ালেন । পরে যখন ফেরার সময় হল নিজেই একটা রিক্সা ডেকে আনলেন । বাড়িতে নেমে যখন ভাড়া দিতে গেলাম রিক্সাওয়ালা নিল না । বলল—দাদা তো ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন । এমন সজ্জন মানুষ যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি নিঃস্বার্থ মানুষও । আমার পুত্রের জন্ম হয়েছিল আমাদের কম্পানির হাসপাতালে । ডেলিভারির পর হাসপাতাল থেকে জানায় এক বোতল রক্ত দেওয়া হয়েছে । সেটা আনিয়ে দিতে হবে যাকে বলে রিপ্লেসমেন্ট । আমার তো তখন শহরের ব্লাডব্যাঙ্ক ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই । সে সময় আমার কাছে একটি তরুণ ছেলে কোনো কাজে এসেছিল । সে পেশায় ড্রাইভার । সে সব শুনে বলল—দেখি আমি কোনো ব্যবস্থা করতে পারি কী না । সেই ছেলেটি এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এল । সঙ্গে আর একজন তরুণ । বলল—এ দেবে রক্ত । ভালোয় ভালোয় রক্ত দেওয়া হয়ে গেল । রক্তদাতার জন্য এক প্যাকেট ফলের বরাদ্দ ছিল । ছেলেটা সেটা নিতে চায় না । আমি জোর করাতে অবশেষে সেটা নিল । এর পর আমি তাকে কিছু টাকা দিতে গেলাম । সে সেটাও নিল না। অনেক বোঝানোর পরেও না । ছেলেটি কিন্তু বেকার ছিল । আমার চেনাও নয় । শুধুমাত্র নিজের বন্ধুর কথায় এক অচেনা লোকের জন্য এ রকম নিঃস্বার্থ সেবা করে চলে গেল । আমরা যারা কথায় কথায় স্বার্থের গন্ধ পাই তাদের মুখের ওপর কেমন নিঃশব্দ কৌতুক করে চলে গেল ছেলেটি ভাবলে এখনও আমি তাকে কুর্নিশ করি । সে ও তার বন্ধু আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে কিন্তু ছেড়ে রেখে গেছে এক অজানা জ্যোতিষ্কের উজ্জ্বল আলো ।
একজন লেখকের জীবনে মানুষের ভূমিকা থাকবেই । কত মানুষের সঙ্গে তাঁর আলাপ পরিচয় হবে । কত মানুষ তাঁকে সঙ্গ দেবে , সময়ে সময়ে দেবে বেদনাও । তবু মানুষের ছবি দেখা , মানুষের ছবি আঁকা থেকে লেখকের মুক্তি নেই । তাঁর দেখা মানুষদের যাপনচিত্র নিয়েই তাঁর স্মৃতির সঞ্চয় । তাঁর সৃষ্টি করা চরিত্রগুলো তাঁর সংসারেরই অংশ । আমি বা আমার সমসময়ের মানুষ যাঁরা তাঁদের পথচলার বয়স অনেক লম্বা হয়ে গেছে । আমরা এক যুগসন্ধিক্ষণের মানুষ । সদ্য পাওয়া স্বাধীনতার সমস্ত রকম দৈন্য আমাদের ওপর দিয়ে গেছে । দেশভাগজনিত উদ্বাস্তুসমস্যা থেকে শুরু করে খাদ্যসংকট , একাধিক বৈদেশিক আক্রমণ ইত্যাদি নানা কিছু আমাদের সময়ের ওপর দিয়েই গেছে । আমাদের ছোটোবেলায় মানুষের জীবনে পাওয়ার থেকে নেই-এর তালিকাটাই ছিল অনেক লম্বা । আমরা যে সময়টায় জীবন শুরু করেছিলাম তখন গ্রামের পর গ্রাম অন্ধকারে ঢাকা । কুপি-লন্ঠনের দিনগুলি চলে গিয়ে এখনকার এল ই ডি বাতির যুগকে বড়ো সমৃদ্ধ লাগে । ক্ষীণ ট্রানসিস্টরের যুগ পেরিয়ে বর্তমান স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেটের প্রসাদগুলিও পেয়ে যাবার সৌভাগ্য হল । শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পারাপার উপন্যাসের বিমান রক্ষিতের মধ্যে মাঝেমাঝে পাগলামি দেখা যেত । কারণটা অদ্ভুত । সে ভাবত তার মাথার মধ্যে আকাশ ঢুকে যাচ্ছে । আর অত বিশাল আকাশ কী ঐটুকু মাথায় আঁটে । মাথাটা তাই ফাটো ফাটো মনে হত । আমিও সে রকম একটা যেন অনুভব করি আমার মাথার মধ্যে কাল বা সময় ঢুকে আছে । একটা মানুষের মাথার মধ্যে যদি তার দেখা সম্পূর্ণ কালখণ্ড ধরা থাকে তা হলে তার অবস্থাও তো ঐ বিমান রক্ষিতের মতোই হবে। মানুষকে তো ভুলে যেতে হয় । সব ঘটনা , তার যাপনকথামালার সমস্তটা তার মনে রাখার কথা নয় । কিন্তু ঐ যে নজরুল বলেছিলেন--কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি । যা ভুলে যাবার সব যে ভুলে যেতে পারি না । তাই পালদার ঐ কথাটা –"স্মৃতি খুঁজতে যেতে নেই'' মনে রাখতে পারিনি বহুবার । স্কুলে যাবার পথে ছোটো নদীর ওপর যে সাঁকো যার নীচে সারা বছরই বালি তার জন্যে আমার মন কেমন করে ওঠে । যে তরুণী আর তরুণী নেই , বন্ধুও নেই আর তার হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠিগুলো এখনও কেন ধরে রেখেছি তার কোনো কারণ জানি না । সেই চিল-ওড়া বিকেলের করুণ আশ্রয়-অন্বেষণ আজও ভারী করে দেয় চারপাশ । কত দূর দেশের ভেজা শ্রাবণ আমন্ত্রণ পাঠায় । বন্ধনের কত ফাঁস ছিল দুই হাতে । আস্তে আস্তে কখন সে গুলো আলগা হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি । ইচ্ছে করে একবার দেখে আসি সেই নির্জন রেল প্ল্যাটফর্মের ধারে ধারে সেই সব পলাশ গাছের নীচে ঘুঘুপাখিরা এখনো ঘুরে ঘুরে ঝগড়া করে কী না । কিংবা খুঁজে দেখি সেই প্রান্তর যার ভিতর দিয়ে নিয়মিত হাঁটাই ছিল আমার দস্তুর যে প্রান্তর আজ বহুতলের নীচে চাপা পড়ে আজও যন্ত্রণায় কাতরায় ।
******************************************
সুবীর ঘোষ // ৩০১ আশ্রয় অ্যাপার্টমেন্ট // গ্রুপ হাউসিং , বিধাননগর // দুর্গাপুর –৭১৩২১২ // চলভাষ---৯৯৩২৬৪০৯৪৯