সে
অন্তরিন দশার মধ্যে ক'দিন সকালে, নিয়ম করে, ক্যালেন্ডারে তারিখ দেখেছে সমরেশ। অজন্তার চাকরি কত দিন বাকি, তার হিসেব কষেছে। লকডাউনে অজন্তাকে নিয়ে ভাবনার পিছনে আছে একটা সূত্র। মনের মধ্যে গোপন বাক্সে, ছেলেবেলা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত স্মৃতির রেশ ধরে সমরেশ যেখানে বহু চরিত্রকে বন্দি করে রেখেছে, সেখানে অজন্তাও থাকে। বারো বছর আগে অজন্তা একবার এসেছিল, সমরেশের বাবার শ্রাদ্ধে। সেদিন থেকে সমরেশ তাকে বাক্সে ভরেছে। নিজের খেয়ালে বাক্স থেকে বার করে অজন্তার সাথে সে গল্প করে, বেড়াতে যায়। মাঝে মধ্যে অজন্তার শরীরও তার কাছে ঘন হয়ে আসে।
অবসর নিতে অজন্তার বেশি দিন বাকি নেই। অফিসে অনেক বার সমরেশ বাস্তবের সঙ্গে কল্পনাকে মিলিয়ে দেখেছে। আর কিছু দিন পরে অজন্তাকে আর অফিসে দেখা যাবে না। সকাল থেকে এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে, হঠাৎ রজতের ফোন এলো।
কি করছিস?
এই তো, কাগজ পড়ছি।
দেখেছিস, অতিমারি কি ভয়ানক চেহারা নিয়েছে!
হ্যাঁ, পড়ছি তো। ছোট পর্দাতেও দেখছি। এক মুহূর্তের জন্য তো চোখ সরাতে পারছি না।
একটা বিষয় ভেবেছিস? মাস শেষ হতে চলল। যারা অবসর নেবে, শেষ দিনে তাদের কারও সাথে, আমাদের দেখা হবে না।
ঠিক বলেছিস। আগে কখনও এমন হয়নি। একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী কিভাবে আমাদের ঘরবন্দি শুধু নয়, অসামাজিকও করে দিয়েছে।
চিন্তা কর, কেউ চল্লিশ বছর ধরে চাকরি করছে আর শেষ দিনে...
বাড়ি বসে অবসর...
অজন্তার এ মাসেই শেষ না?
তাই তো জানি।
এই ক'দিনে যোগাযোগ হয়েছে?
না, ফোন নাম্বার নেই। থাকলে ফোন করে দেখতাম!
আমার সাথে আঠারো তারিখ দেখা হয়েছিল।
আঠারো মানে?
আঠারো মার্চের কথা...
বুঝেছি, তার মানে শেষ যে দিন অফিস করেছি, তার দু দিন আগে...
ছোট করে ব্যবস্থা করেছিল। চিকেন আর রুটি। চিকেন বাড়ি থেকে রেঁধে এনেছিল...
বুঝলাম না!
রিটায়ারমেন্টের আগে খাওয়াদাওয়ার কথা বলছি!
ওহ, তাই বল! তুই আমন্ত্রিত ছিলি?
হ্যাঁ, ডেকেছিল...তবে একটা ব্যাপারে খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম।
কি ব্যাপার?
বেশি দিন হয়নি, তুই সেকশন থেকে ট্রান্সফার হয়েছিস। আর তোকেই কি না...
ভুলে গেছে হয়ত। এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে?
আচ্ছা, তুই, অজন্তার মেডিক্যাল কার্ড করে দিয়েছিলি না!
সেরকম কিছু না। ডাটাগুলো অনলাইনে ভরে দিয়েছিলাম শুধু...
ওটা তো তোর করার নয়। অফিসে বলে দিয়েছিল, সবাই নিজে নিজে অনলাইনে আবেদন করবে।
অজন্তা খুব ভাল কমপিউটার জানে না, তাই আমি করে দিয়েছিলাম।
হতে পারে, তাই বলে উপকার নিয়ে এক মাসের মধ্যে ভুলে যাবে। তাছাড়া তুই তো এই সেদিনও এক সাথে পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করেছিস। অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে বেছে বেছে পেয়ারের লোকদের ডেকে নিয়ে এসেছে খাওয়ানোর জন্য আর...
ওতে আমি কিছু মনে করিনি। তুইও ভুলে যা।
তুই সেদিন ক্যান্টিনে যাসনি? তুই তো রোজ ক্যান্টিনে লাঞ্চ করিস!
হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো। কেন?
ক্যান্টিন আর অজন্তার সেকশন তো পাশাপাশি। যদ্দুর জানি, তুই রোজ লাঞ্চ করে তোর পুরানো সেকশনে একবার চক্কর দিতে যাস। সেদিন যাসনি?
গেলে তো দেখতে পেতিস।
উঁহু, তুই কিছু লুকোচ্ছিস। তোর সাথে অজন্তার দারুণ বন্ধুত্ব ছিল!
ছাড় না রজত! সামান্য বিষয়কে কেন এত বড় করে দেখছিস। তাছাড়া ওর বাড়ির খবরও ভাল নয়। হতে পারে, নানা চিন্তার মধ্যে আমার কথা মনে পড়েনি। এটা নিয়ে যে এতক্ষণ কথা হচ্ছে, সেটাই বাড়াবাড়ি...
রজত ছাড়বার পাত্র নয়। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মত, মানুষ গৃহবন্দিত্ব উপভোগ করছে। তার মধ্যে এমন মুচমুচে প্রসঙ্গ। এত তাড়াতাড়ি আলোচনা থামালে চলে?
বাড়িতে আবার কি হয়েছে?
অজন্তার একমাত্র ছেলে দুবাইয়ে থাকে। সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। যদ্দুর জানি, লকডাউনের আগে ফিরতে পারেনি।
ওহ, বুঝেছি, এটা নিশ্চিত, যথেষ্ট চিন্তার কারণ...
নামকাওয়াস্তে ছেলের বিয়ে দিয়েছে। বৌমা শাশুড়িকে দেখে না। মন্তেসরি স্কুলে চাকরি করে। মাসের পর মাস মাইনে পায় না। অজন্তাই হাতখরচের টাকা দেয়। সেভাবে কোন রান্নাই করতে জানে না। ছেলে বাইরে। ফ্ল্যাটে থাকে সাকুল্যে দুটি প্রাণী। বিধবা শাশুড়ি এত দিন একার হাতে সংসার সামলে ছেলে বড় করেছে। সে রেওয়াজ এখনও চলছে। আগে ছেলের জন্য করত, এখন বৌমাকে রেঁধে খাওয়াতে হয়। তার ওপর ফি হপ্তায় বাপের বাড়ি গিয়ে বসে থাকে।
বলিস কিরে? এতো লম্বা কাহিনী!
তবে আর বলছি কি!
বুঝলি সমরেশ, আমাদেরও সে দিন আসছে। তোর, আমার, দুজনেরই তো চাকরি আর চার-পাঁচ বছর করে বাকি। অবসরের পরে, কে জানে, কপালে কি আছে?
আমি ওসব ভাবি না। যা হওয়ার হবে। এত ভেবে করব কি?
সেটা ঠিক। আচ্ছা, অজন্তার কি কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরি?
হ্যাঁ, ওর স্বামী এই অফিসে চাকরি করত।
অফিসের যা অবস্থা, পেনশন, রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট সব কিছু ঠিকঠাক পাবে তো?
পাবে না কেন? তবে দেরি হতে পারে। বিল পাশ করবে কে? সবাই কি আসছে?
আমাদের মাইনে হবে তো?
জানি না। কোন খবর নেই। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের তো অর্ডার হয়েছে! সরকারি অফিসের সব কাজ কি আর বাড়ি থেকে করা যায়? সেরকম পরিকাঠামো কি আছে?
আচ্ছা, অজন্তার শেষ মাসের মাইনে তো আলাদা পাস হবে।
নিয়ম হচ্ছে, মাস শেষ হলে পে-রোল থেকে ডাটা আউট করে, আলাদা বিল পাস হয়।
এই ডামাডোলের মধ্যে ওই বিল কি সময়ে তৈরি হবে?
সম্ভাবনা কম। সেক্ষেত্রে মাসের শেষে, আমাদের মাইনে হলেও ওর হয়ত দেরি হতে পারে।
খুব অসুবিধা হবে অজন্তার।
সে তো হবে। অবসরের শেষ মাসে মাইনের বিলেও অজন্তা একা হয়ে গেল।
অফিসের আর কেউ ফোন করেছিল?
না, কই! তুই যা করলি।
তোর বাড়িতে মোটামুটি সবাই ঠিক আছে তো?
আছে মোটামুটি। তোর বাড়িতে?
শারীরিক দিক থেকে সবাই সুস্থ। তবে বাজার-দোকান করতে খুব অসুবিধা হচ্ছে।
কেন?
জানিস তো, আমার বাড়ি, বৈদ্যবাটি স্টেশন থেকে বেশ খানিকটা ভিতরে। বাড়ির কাছাকাছি দোকানপাট যা আছে, সেখান থেকে কিনে কোন রকমে চলছে। তাছাড়া, বছরের শেষে হাতে টাকাকড়িও তো কম! মোটা টাকা ইনকাম ট্যাক্সে কেটে নিচ্ছে। এ মাসেও কাটবে।
আমারও তাই অবস্থা। যাই হোক, তবু যা মাইনে পাব, ঠিক সময়ে পেলে হয়। ডাল-ভাতটুকুর তো কমপক্ষে ব্যবস্থা করতে পারব।
সামনে খুব খারাপ দিন আসছে রে সমরেশ।
বলতে বলতে অমিতার গলা শোনা গেল।
শুনছ, তাড়াতাড়ি একবার এদিকে এসো তো।
রজত, আমি এখন ফোন রাখি। পরে কথা হবে।
হ্যাঁ, ভাল থাকিস। কথা হবে।
----------------------
অমিতা ইঙ্গিতে দেখাল। বাবীনের ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, পাশের বাড়ির সামনে ভিড়। চার-পাঁচজন জটলা করে দাঁড়িয়ে। কারও মুখে মাস্ক নেই। প্রতিবেশি পল্টু নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, রীতিমত টলছে। পল্টুর বৌ, দরজা আগলে, ঝাঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে। অমিতা নীচু গলায় বলল।
দেখছ, আকন্ঠ গিলে কিরকম করছে?
লকডাউনের মধ্যে মদ পাচ্ছে কি করে?
ওসব ঠিক পাওয়া যায়। বিলিতি বন্ধ হতে পারে। বাংলা ঠিক পাওয়া যাচ্ছে।
বাব্বা, তুমি দেখছি, বিলিতি-বাংলা সব বোঝ।
মিচকি হেসে, অমিতা ইঙ্গিতে বোঝাল যে সে সব জানে।
রিক্সা চালিয়ে খায়। আজ খেয়ে কাল কি খাবে, তার ঠিক নেই। তার ওপর, এরকম একটা অবস্থা চলছে। অথচ দেখো, মদ ঠিক গেলা চাই।
সমরেশ আর চুপ করে থাকতে পারল না।
অতসী? এই যে ওপরে...সমরেশদা বলছি।
অতসীর দু-চোখ জলে ভিজে।
দেখছেন দাদা, আমার অবস্থা। এ লোকটার জন্য মান-ইজ্জত সব জলাঞ্জলি গেল।
আমি কি বলি, ধরাধরি করে ওকে ভিতরে নিয়ে যাও। সরকার থেকে ভিড় করতে মানা করেছে। মাথা ঠাণ্ডা কর। কি আর করবে? আপনারাও এবার আসুন। বাড়ি যান। আর একটা অনুরোধ, দয়া করে মাস্ক ছাড়া বাইরে বেরোবেন না।
জানলা থেকে সরে এসে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অমিতা বলল
আলু আর চাল বাড়ন্ত। রামরাজা ভাণ্ডারে একবার যাবে?
চট করে গায়ে জামা আর মুখে মাস্ক চড়িয়ে, হাতে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সমরেশ। রাস্তা শুনশান। গলি থেকে বেরোবার মুখে, সুকুমারদার সঙ্গে দেখা। বয়স হয়েছে। সাড়ে আটটার হালকা রোদেও হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। সাইকেল থামিয়ে সমরেশ দাঁড়িয়ে পড়ল।
ছেলের খবর কি, দাদা?
নিজের মনে হাঁটতে হাঁটতে, সুকুমারদা গায়ের কাছে চলে এসেছেন। হঠাৎ খেয়াল হল।
কেমন আছ সমরেশ? বৌমা আর বাবীন ভাল আছে তো?
ওরা সব ঠিক আছে, দাদা। আপনি কেমন আছেন?
আমার তো সারা বছর লকডাউন। একটু হাঁটলে, গোড়ালি টনটন করে। বাড়ি থেকে বেশি বেরোই না। তোমার বৌদিও বাতের ব্যথায় কাবু। ছেলের কথা আর কি বলি! ওরা পুনেতে আছে। ফোনে রোজ কথা হয়। ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে। আছে যা হোক।
মহারাষ্ট্রের অবস্থা সঙ্গীন।
জানি, সমরেশ। প্রায় সারা দিন টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখেছি। চাইলেও তো সমু আর বৌমাকে বাড়ি ফিরতে বলতে পারছি না। ফিরবে কি করে? ট্রেন-প্লেন সব বন্ধ।
সাবধানে বাড়ি যান, দাদা।
দোকানে যাচ্ছ? যাও। যতটা সম্ভব বাড়িতে থাকার চেষ্টা কর। ভাল থেকো।
ফ্লাইটের কথা শুনে, অজন্তার ছেলের কথা মনে পড়ল। মন বলছিল ফোনে নাম্বার সেভ আছে। তাও রজতকে তখন ইচ্ছে করে মিথ্যে বলেছিল যে নাম্বার নেই। রামরাজা ভাণ্ডার যাওয়ার পথে রাস্তার মাঝে শিব মন্দিরের বটগাছের ছায়ায় সাইকেল দাঁড় করিয়ে ফোন ঘেঁটে, নাম্বার বার করে, মনে মনে ভাবল, একবার কি ফোনে খবর নেবে? অফিসে রোজ দেখা হয় বলে, ফোন কোন দিন করা হয় না। আবার চিন্তা হল, যদি ফোন না ধরে! আজকাল কোন বিষয়ে দ্বিধা তৈরি হলে সমরেশ আর এগোয় না। ফোন পকেটে পুরে, ফিরে হাঁটা শুরু করল।
রামরাজা ভাণ্ডারের এক পাল্পা বন্ধ। খোলা অংশে সাকুল্যে গোটা তিনেক খদ্দের দাঁড়িয়ে। তপন মাস্ক পরে দোকানদারি করছে। সমরেশকে দেখতে পেয়ে ইশারায় একটু দূরে দাঁড়াতে বলল। তিন খদ্দেরের মধ্যে কোন তাগিদ নেই, নূন্যতম দূরত্বে দাঁড়ানোর। প্রথমে অস্বস্তি বোধ করলেও, শেষ পর্যন্ত সমরেশ না বলে থাকতে পারল না।
আপনারা সরে সরে দাঁড়ান না! নিয়ম মানতে অসুবিধা কিসের! প্লিজ সরে দাঁড়ান।
দুজন কোন আমল দিল না। তৃতীয় জন বলে উঠল
দূরে দাঁড়াতে আপত্তি নেই। দাঁড়িপাল্লার ওজনটা তাহলে দেখবো কি করে!
ভদ্রলোককে সমরেশ চেনে। আগেও এখানে দেখেছে।
যখন বিশ্বব্যপী মানবজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন, ভদ্রলোক তখন ওজনের গণ্ডিতে আটকে!
দুজনকে মাল দেওয়া শেষ করে টাকার হিসেব করতে করতে, তপন মাস্ক আর চশমার ফাঁক দিয়ে সমরেশের দিকে তাকিয়ে, চোখের চাহনি দিয়ে বুঝিয়ে দিল
বলে লাভ নেই। নিজে সাবধানে থাকুন, তাহলেই হবে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম।
রামরাজা ভাণ্ডারের পাশে একটা গলি। ভিতরে বেশ কয়েকটা বাড়ি। সমরেশ কোন দিন এই গলিতে ঢোকেনি। হালকা চালে টহল দেওয়ার মত দু-পা এগিয়ে গলির মুখে পৌঁছতে কানে এলো কান্নার শব্দ। ভাল করে শোনার চেষ্টা করল। মনে হল, বেশি দূরে নয়। দোকানের পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে কান্নার শব্দ। চাল আর আলুর অর্ডার দেওয়ার পরে আর থাকতে না পেরে, তপনের কাছে জানতে চাইল।
বিধবা মা নাকি একা থাকেন। একমাত্র ছেলে বেঙ্গালুরুতে, ঢালাইয়ের কাঠ সাঁটার কাজ করে। ছেলের সাথে শেষ কথা হয়েছে পরশু। তারপর থেকে ফোন বন্ধ। দুশ্চিন্তা থেকে ওরকম ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে।
কিভাবে চলছে ওনার?
আমার দোকানে খাতা আছে। মাসকাবারি মাল যায়। আমি বলেছি, যা লাগবে নিয়ে যাবেন। পয়সা নিয়ে ভাবতে হবে না।
দুজন আগে দোকান ছেড়েছিল। তৃতীয় জন বিদায় নেওয়ার আগে, বলতে বলতে গেল
ওসব ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় নয়, ভাইরাসই মানুষকে হাপিস করে দেবে।
পাঁচ কিলো চাল একটা ব্যাগে আর একটা ব্যাগে পাঁচ কিলো আলু, দুপাশ থেকে সাইকেলের হাতলে ঝুলিয়ে দেওয়ার পরে, চড়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। হাতল ভাল করে ঘুরছে না। অগত্যা ঠেলে নিয়ে যাওয়া। বড় রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকতে না ঢুকতে ফোন। অচেনা নাম্বার। সাইকেল কাত করে, গায়ে ঠেকনা দিয়ে, ফোন ধরল সমরেশ।
কে বলছেন?
কিরে, কি করছিস? সুবীর বলছি।
হ্যাঁ বল। নাম্বার বদলেছিস?
নাতো, আগের নাম্বারই আছে।
কেমন আছিস? বাড়িতে সবাই ভাল আছে তো?
আছি একরকম। বাড়িতে খুব একঘেয়ে লাগছে। ভাবলাম, ফোন করি। তোর খোঁজ নিই।
ভাল করেছিস। আমরা মোটামুটি ঠিক আছি।
শুনেছিস, শ্যাওড়াফুলিতে একটা সংক্রমণ ধরা পড়েছে।
সেকি? কখন জানলি? কোথায়? তোর বাড়ির কাছাকাছি নাকি?
খুব কাছাকাছি নয়। তবে খুব দূরেও নয়। পুলিশ থেকে এসেছিল। রুগীর বাড়ি আর পাড়া কোয়ারান্টাইন করে দিয়েছে।
সাবধানে থাকিস ভাই। যত শুনছি, খুব ভয় হচ্ছে।
হাওড়ার কি খবর? শুনলাম, সালকিয়াতে একজন আক্রান্ত। তোর বাড়ি থেকে কত দূর?
আমি তো রামরাজাতলায়! এখান থেকে সালকিয়া অনেক দূর।
শ্যাওড়াফুলির নাম শুনে, সমরেশের বুক কাঁপতে শুরু করেছে। সুবীরকেও ফোন কাটতে বলতে পারছে না। দূরে দেখা যাচ্ছে, উর্দিধারী দুজন হেঁটে আসছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফোন করছে বলে, যদি উল্টোপাল্টা কিছু বলে। সমরেশ মনেপ্রাণে চাইছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ঢুকতে।
আমি এখন রাখছি, সুবীর। বাজার নিয়ে ফিরছি। সাইকেল গায়ে ঠেকিয়ে কথা বলছি।
ঠিক আছে, তুই যা। ভাল থাকিস। পরে আবার কথা হবে।
সাইকেল ঘরে ঢুকিয়ে, অমিতার হাতে কোন রকমে বাজারের ব্যাগ গুঁজে দিয়ে, সমরেশ বাথরুমে ঢুকল। তারপর স্যানিটাইজার দিয়ে হাত আর মাস্ক ধুয়ে, তড়িঘড়ি পৌঁছল নিজের ঘরে। সুবীরের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। টেলিভিশন একবার না দেখলে নয়। খেয়াল হল, বাইরের জামাকাপড় না ছেড়ে ঘরে চলে এসেছে। অমিতা দেখতে পেলে, খুব বকবে। দ্রুত পায়ে বাথরুমে ঢুকে, একটা শুকনো খালি বালতিতে জামাকাপড় ছুঁড়ে দিয়ে খালি গায়ে, কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে ঘরে পৌঁছে দেখল, বাবীন টেলিভিশন চালিয়েছে।
নদীর জলের মত পর্দার নীচে বয়ে যাওয়া খবরের স্রোতের মধ্যে শ্যাওড়াফুলির খবর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অনেক চেষ্টা করেও লাভ হল না। ততক্ষণে বাবীন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। ঘরে সমরেশ একা। পর্দায় আবার শিরোনাম আসছে। দু-চারটে খবরের পর উঠে এলো সে খবর। যা শুনেছিল তাই। সুবীরের কথা সত্যি। আঁতকে উঠল সমরেশ। ভিতরে ভিতরে ছটফট করতে করতে ঠিক করে ফেলল, আর নয়, ফোন করে একবার অন্তত অজন্তার খোঁজ নেওয়া খুব দরকার। টেলিভিশন মিউট করে ফোন ঘেঁটে ডায়াল করল। পুরো সময় বাজল। কেউ ধরল না। আবার ফোন। এবারও তাই। তৃতীয় বারের ডায়ালের পরে কেউ ধরল। শোনা গেল বিরক্তি ভরা গলা। বোঝা গেল কারও সঙ্গে কথা বলতে বলতে ফোন ধরেছে।
বৌমা, রান্নাঘরে কি করছ? ঋক চা চেয়েছিল। ওকে এক কাপ চা করে দাও। আমাকেও দিও। দেখি, এখন আবার কে ফোন করল! লোকের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। যত্তোসব!
অমিতা কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, সমরেশ বুঝতে পারেনি।
কার ফোন? এলো না তুমি করেছিলে? কি অসভ্য রে বাবা! কথার কি ছিরি!
===========০০০===========
অরূপম মাইতি, ১৫ নন্দীপাড়া লেন, রামরাজাতলা, হাওড়া – ৭১১১০৪
চলভাষঃ +৯১-৯৪৩৩০২৬৩৩৮ এবং +৯১-৯৮৩০০৬৫২৬৪ (W)