Featured Post

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮৪তম সংখ্যা ।। ফাল্গুন ১৪৩১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ছবি
  এই সংখ্যায় একটি গ্রন্থ আলোচনা ও একটি ধারাবাহিক রচনা ছাড়া সব লেখাই ভাষা দিবস, মাতৃভাষা, ভাষাচেতনা ও ভাষা সমস্যা বিষয়ক রচনা। লেখাগুলি এই সংখ্যাকে অনেকটাই সমৃদ্ধ করেছে। পড়ুন। শেয়ার করুন। মতামত জানান। লেখকগণ নিজের নিজের লেখার লিঙ্ক শেয়ার করুন যতখুশি, যে মাধ্যমে খুশি। কিন্তু স্ক্রিনশট শেয়ার নৈব নৈব চ!  অন্য বিষয়ের লেখাগুলি আগামী সংখ্যার জন্য রইল।  সকলকে ধন্যবাদ, অভিনন্দন। ভালো থাকুন।   --সম্পাদক, নবপ্রভাত। ==  সূ  চি  প  ত্র  == প্রবন্ধ-নিবন্ধ অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙ্গালীর বাংলা ভাষা দুর্জয় দিবস।। বটু কৃষ্ণ হালদার ভাষা শহীদদের পঁচাত্তর বছর।। অনিন্দ্য পাল একুশে ফেব্রুয়ারি : বাঙালির শ্রেষ্ঠ অশ্রুবিন্দু।। জীবনকুমার সরকার কবিগানের সাহিত্যিক ও সমাজতাত্ত্বিক মূল্য।। বারিদ বরন গুপ্ত বিপন্ন মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি।। শ্যামল হুদাতী মায়ের দুধ আর মাতৃভাষা।। প্রদীপ কুমার দে একুশে ফেব্রুয়ারি : কিছু কথা।। বনশ্রী গোপ বাংলায় কথা বাংলায় কাজ।। চন্দন দাশগুপ্ত বিপন্ন মাতৃভাষা ও তার মুক্তির পথ।। মিঠুন মুখার্জী. হে অমর একুশে, তোমায় ভুলিনি, ভুলব না।। মহম্মদ মফিজুল ইসলা...

স্মৃতিগদ্য ।। সুবীর ঘোষ








ভেসে আসে সুদূর স্মৃতির সুরভি

                        
                    

অফিসের পালদা বলেছিলেন—স্মৃতি খুঁজতে যেতে নেই । কথাটা সব সময় মনে রাখতে পারি না । কোন্  সেই কৈশোরবেলায় বন্ধু টুকুর দাদার বাড়ি গিয়ে আদরযত্নের এক খনি আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম। সেই দাদার নাম অলক । সুন্দর গান করত । আবার নিজে গান লিখতও । ওর লেখা ও সুর করা গানও শোনাত সে সময় । বাড়িতে অলকদা আর ওর মা । আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না । সেটা বুঝতে পারতাম । তবু ওরই মধ্যে অলকদার মা লুচি তরকারি করে খাওয়াতেন । কখনো মিষ্টি আনাতেন । নিজেকে মনে হত যেন অলকদার নিজের ভাই ।  মা নামক বস্তুটি যে স্নেহের খনি তা বেশ অনুভব করতে  পারতাম । মা'রা যতই ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে কাটিয়ে দেন না কেন, আতিথেয়তার প্রশ্নে তাঁরা সব সময়ই বিপ্লবী । কোনো অভাব কারোর কোনো আপত্তি তাঁরা কানে তোলেন না । অলকদার বাড়ির কাছেই ছিল আমার পিসির বাড়ি । অনেক সময় আমার পিসতুত দাদা কাঞ্চনও সঙ্গে থাকত । অনেকন আড্ডা দিয়ে আমি আর কাঞ্চনদা এসে দাঁড়াতাম শালনদীর ব্রিজের ওপর । ঝির ঝির করে নদীর জল বয়ে যেত । স্বচ্ছ জলে খলসে চাঁদা মাছ লাফিয়ে বেড়াত । দিনের শেষে কমলারঙের আলো মেখে আদিবাসী নারীরা ঘরে ফিরত । মাথায় গাছের শুকনো ডাল । কাঁঠাল পাতা ছাগলের খাবার জন্য । পুরুষদের কারো কারো কাঁধে এক দুটো মরা কাঠবিড়ালি বা মেঠো ইঁদুর । অলকদার গানের রেশ ধরেই আমাদের ঘরে ফেরা শুরু হত—আমি চলতে চলতে থেমে গেছি , আমি বলতে বলতে ভুলে গেছি ।
এর পর শালনদীর ব্রিজের নীচ দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে । আমার আর ওদিকে বড় একটা যাওয়া হয়নি । তরুণী আদিবাসী কন্যা যারা  ঠোঙায় করে বনের গাছ থেকে পাকা পিয়াল এনে দিত তাদের মেয়েদেরই হয়তো এতদিনে বিয়ে হয়ে গেছে । অলকদার কথাও প্রায় ভুলতে বসেছিলাম । একদিন অফিস থেকে ফিরেছি । আমার স্ত্রী বলল -- জানো এ পাড়ারই এক বয়স্ক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হল । পরিচয় দিতে গিয়ে তোমার নাম বলতেই চিনতে পারলেন ।  তোমার দাদার নাম বলাতে বললেন—তাহলে তো আর কথাই নেই । ওই হবে । ওকে একদিন নিয়ে এসো তো  । এ পাড়াতেই যখন থাকো । ঐ সপ্তাহের রবিবারটায় আমরা মাসিমার বাড়ি গেছিলাম । অলকদা কোথায় যেন বেরিয়েছিল ।  এত বছরের ব্যবধানে সেই পুরোনো স্নেহময়ী জননীকে আমি আর খুঁজে পাইনি ।  লুচি খাওয়ানোর প্রশ্ন উঠছে না , আমরা ঐ পাড়াতেই থাকি ।  কিন্তু যখন অলকদাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসতে বললাম , খুব উৎসাহ দেখলাম না । বললেন—ও তো খুব টিউশনি করে গানের । একদম সময় পায় না । ভেবেছিলাম আমার লেখা গান অলকদাকে দেব সুর করার জন্য । তা আর হল না । শান্ত গ্রামীণ পরিবেশ থেকে এই কলকারখানার শহরে এসে মাসিমা অহঙ্কার আভিজাত্য সবই বোধহয় খুইয়ে ফেলেছিলেন । অফিসের পালদা বলেছিলেন—স্মৃতি খুঁজতে যেতে নেই । কথাটা সব সময় মনে রাখতে পারি না । এখন মনে হয় ওদের সঙ্গে আর দেখা না হলেই ভালো হত । কই অলকদা তো একগাল হেসে এগিয়ে এসে বলল না—শোনো একটা গান এখন খুব গাইছি—এক তাজমহল গোড়ো হৃদয়ে তোমার আমি হারিয়ে গেলে ।

অলকদার সঙ্গে যখন প্রথম আলাপ আমি তখন স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র । আমাদের স্কুলে দুটো মুখোমুখী বিল্ডিং ছিল । অফিসঘরের দিকে নীচু ক্লাসের ঘর আর খেলার মাঠের দিকে উঁচু ক্লাসগুলো । অফিসঘরের সামনে যখন আমাদের হেডমাস্টারমশাই এসে দাঁড়াতেন আমাদের দোতলা বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রাণ উড়ে যেত । এমন রাশভারী ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর । তাঁর ছেলে আমার সঙ্গে প্রায় পুরো স্কুলজীবনটাই পড়েছে । আমার খুব বন্ধু ছিল সে । বহু বছরের বন্ধু ।  তারপর একদিন খুব তুচ্ছ কোনো কারণে তার সঙ্গে একটা মনোমালিন্য হল । সেই যে বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে গেল বেশ কয়েক বছর তা আর চালু হল না । জীবনের নানা রঙ্গরসের কথা , অনেক অ্যাডভেঞ্চার অভিযানের গল্প তার সঙ্গে বাটোয়ারা করে নিতে ইচ্ছে করত কিন্তু অচলায়তন কিছুতেই ভাঙছিল না । একবার হেডস্যার ছুটিতে তাঁর বাড়ি গিয়ে অনেক রসগোল্লা নিয়ে এলেন । স্যার তাঁর ছেলে কালীকে বললেন—মিষ্টিগুলো বন্ধুদের খাইয়ে দাও । কালী কয়েকজন বন্ধু নিয়ে টিফিনের সময় তাদের বাসার দিকে পা বাড়াতেই স্যার আমাকে দেখিয়ে কালীকে জিজ্ঞেস করলেন—ওকে নিলি না ? একটি ছেলে তখন সাহস করে এগিয়ে এসে বলল—স্যার অনেক বছর হয়ে গেল ওদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ । হেডমাস্টারমশাই শুনে বললেন -- সে কী , এই বয়সেই রেষারেষি ! যাও ওকে নিয়ে যাও আর গিয়ে ভাব করে নাও । আমার মতোই কালীও কিন্তু ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছিল । সেটা বুঝলাম সবাইকে সে দুটো করে মিষ্টি দিল । আমাকে  দিল তিনটে ।  তারপর সময়ের নদী বয়ে চলে গেছে অনেকদূর । আমাদের স্কুলের মাঠের আকাশমণি গাছের কত পাতা ঝরে গেছে আবার কত নতুন নতুন পাতা বেরিয়েছে । আমরা যে যার নিজের রাস্তা তৈরি করে নিয়েছি । জীবনের পড়-বেলায় একদিন খবর এল কালী আমার শহরেই একটা অফিসের প্রধান হয়ে এসেছে । যেখানে তার অফিস সেটা আমার বাড়ি থেকে খুব দূর নয় । একদিন ফোন করে পৌঁছে গেলাম তার কাছে । তার অফিস তখনও ছুটি হয়নি । কাজও করছে, আমার সঙ্গে কথাও বলছে । এর মধ্যে চা আনাল । সৌজন্যেরও একটা সীমা থাকে । এক সময় উঠলাম । তাকে বারবার আমার বাড়ি আসার কথা বলে এলাম । কালী বলল ও জায়গাটা খুব ভালো মতোই চেনে । আশা করলাম ত হলে নিশ্চয় সময় করে একদিন আসবে । আসেনি । তেত্রিশ বছর কেটে যায় । কেউ কথা রাখে না । হয়তো ইচ্ছে থাকলেও হয়ে ওঠে না । স্কুলে আমরাই আমাদের প্রভু ছিলাম । যখন যা মনে আসত তা-ই করতাম । এখন জীবনের অবস্থান বদলেছে । পেশা সংসার সবার দাবি মিটিয়ে নিজের জন্য তলানিতে যা পড়ে থাকে তা দিয়ে নিজের সব শখ আহ্লাদ মেটানো যায় না। তার পর থেকে আমাদের আর দেখা হয়নি । কখনো কখনো স্বপ্নের ভিতর দিয়ে স্কুলের খেলার মাঠের ওপর বয়ে যাওয়া পলাশফাগুনের হাওয়া আমাকে ছুঁয়ে উড়ে চলে যায় । আমার চোখের সামনে একটা মৃত সময় যযাতির নতুন দেহের বিকাশমানতায় ফিরে আসে । এক একবার মনে হয় কালী যদি আমার কাছে একদিন দেখা করতে আসতও আমি কী তাকে খেলার মাঠের সেই ধুলোজড়াজড়ি জীবন ফিরিয়ে দিতে পারতাম ? সময় বোতলের ছিপির মতন । এক বোতলের ছিপি আর এক বোতলে ফিট করে না । এক সময়ের খাপে অন্য সময়কে বসানো যায় না। তার থেকে পালদার কথাটাই বড়ো বেশি করে মনে ধরে--স্মৃতি খুঁজতে যেতে নেই ।

তখন আমি চাকরিতে ঢুকেছি । বাসে যাতায়াত করি । কম্পানির বাস । বাসে অনেকেই যায় । সবার সঙ্গে আলাপ না হলেও মুখচেনা তো হয়েই যায় । একদিন ফেরার সময় সবে বাস থেকে নেমেছি ঐ রকম একজন মুখচেনা লোক এগিয়ে এসে বলল—আপনার কাছে পাঁচটা টাকা হবে ? একটা জিনিস কিনছিলাম , একটু টাকা কম পড়ে গেল । কাল অফিসে দিয়ে দেব ।  আমি বেশি কিছু চিন্তা না করেই তাকে পাঁচটা টাকা দিয়ে দিলাম । মানুষটির নাম আমি জানি না । বিশ্বাস রাখলাম যে পরদিন অফিসে দিয়ে দেবে । এ গল্প শুনে এখনকার ছেলেমেয়েরা ভাববে কী ভারী  পাঁচটা টাকার গল্প শোনাতে বসেছে । তাদের জন্য বলি , যে সময়ের কথা বলছি তখন দু'টাকায় চারটে দেশি হাঁসের ডিম বা চারটে রাজভোগ পাওয়া যেত । কাটা পোনার দর ছিল কুড়ি টাকা কিলো এবং খাসির মাংস এগারো টাকা কিলো । অতএব পাঁচ টাকা নেহাত ফেলনা ছিল না সে সময় । যাই হোক্ পরদিন অফিসের কাজের চাপে ঘটনাটা ভুলে গেছিলাম । মনে পড়ল একজনের কথায় । অফিসে আমারই টেবিলের কাছাকাছি দুজন কথা বলছিলেন । তাঁদের বক্তব্যও একই । কেউ একজন হাতের মধ্যে কয়েকটা টাকা দেখিয়ে কিছু টাকা ধার নিয়ে গেছে । আমি তখন আমার অভিজ্ঞতাও বললাম । ওঁরা জিজ্ঞেস করলেন যে নিয়েছে তার নাম কী নীতিশ । বললাম –নাম তো জানি না , তবে ওকে এই অফিসে আমি দেখেছি । দেখলে চিনতে পারব । অফিস ছুটির পর ঐ ভদ্রলোক দুজনের সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছি দেখি সেই নীতিশ । একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে গা ঘেঁষে চলে গেল । তখন আমি আমার সঙ্গীদের বললাম—এ যে দেখি চিনেও চেনে না । নীতিশ আমার কথাটা বোধহয় শুনতে পেয়েছিল । যেতে গিয়ে ফিরে এসে বলল—কাল আপনিই আমাকে বাজারে পাঁচ টাকা দিয়েছিলেন, না ? আমি বললাম -- মনে পড়ল তা হলে ? নীতিশ এর পর আমাকে পাঁচটা টাকা দিয়ে দিল । আমার সঙ্গী বললেন—আর আমারটা ? সে তখন এক গাল হেসে বলল—আপনার সঙ্গে তো আমার অন্য সম্পর্ক, দাসদা । আমি মাইনে পেয়েই আপনারটা দিয়ে দেব । তখন দাসবাবু আমাকে বুঝিয়ে বললেন—ও যে অভাবে অমন করে তা কিন্তু নয় , ওটা ওর স্বভাব । এর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওকে শোধ দেবে , আবার আর এক জনের কাছ থেকে নিয়ে অন্যজনকে দেবে । এই অঙ্ক খাটিয়ে ও সারা মাস চালিয়ে দেয় । ওর নিজের মাইনেতে হাতই দিতে হয় না । জীবনের পথে চলতে চলতে যে কত বিচিত্র রকমের মানুষের দেখা পাওয়া যায় তার ইয়ত্তা নেই ।

যে দাসবাবুর কথা বলছি তিনি খুব গুণী মানুষ । দারুণ ছবি আঁকতেন । আমাকে একটা মা দুর্গার মুখ এঁকে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন । বেশ বড়ো ছবি । বহু বর্ণে উজ্জ্বল । আমার সদর দরজার মাথায় শোভা পেয়েছিল বহুদিন । ছবি তোলাও ছিল তাঁর নেশা । সে যুগে যখন দেশে ভালো ক্যামেরা পাওয়াই যেত না তখন তিনি বিদেশি ক্যামেরার জন্য হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতেন । একবার দাসবাবুর তোলা ছবি দেখতে ওঁর বাড়িতে গেছি । অনেকখন ধরে ছবি দেখলাম। এটা সেটা নানা জিনিস খাওয়ালেন । পরে যখন ফেরার সময় হল নিজেই একটা রিক্সা ডেকে আনলেন । বাড়িতে নেমে যখন ভাড়া দিতে গেলাম রিক্সাওয়ালা নিল না । বলল—দাদা তো ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন ।  এমন সজ্জন মানুষ যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি নিঃস্বার্থ মানুষও । আমার পুত্রের জন্ম হয়েছিল আমাদের কম্পানির হাসপাতালে । ডেলিভারির পর হাসপাতাল থেকে জানায় এক বোতল রক্ত দেওয়া হয়েছে । সেটা আনিয়ে দিতে হবে যাকে বলে রিপ্লেসমেন্ট । আমার তো তখন শহরের ব্লাডব্যাঙ্ক ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই । সে সময় আমার কাছে একটি তরুণ ছেলে কোনো কাজে এসেছিল । সে পেশায় ড্রাইভার । সে সব শুনে বলল—দেখি আমি কোনো ব্যবস্থা করতে পারি কী না । সেই ছেলেটি এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এল । সঙ্গে আর একজন তরুণ  । বলল—এ দেবে রক্ত ।  ভালোয় ভালোয় রক্ত দেওয়া হয়ে গেল । রক্তদাতার জন্য এক প্যাকেট ফলের বরাদ্দ ছিল । ছেলেটা সেটা নিতে চায় না । আমি জোর করাতে অবশেষে সেটা নিল । এর পর আমি তাকে কিছু টাকা দিতে গেলাম । সে সেটাও নিল না। অনেক বোঝানোর পরেও না । ছেলেটি কিন্তু বেকার ছিল । আমার চেনাও নয় । শুধুমাত্র নিজের বন্ধুর কথায় এক অচেনা লোকের জন্য এ রকম নিঃস্বার্থ সেবা করে চলে গেল । আমরা যারা কথায় কথায় স্বার্থের গন্ধ পাই তাদের মুখের ওপর কেমন নিঃশব্দ কৌতুক করে চলে গেল ছেলেটি ভাবলে এখনও আমি তাকে কুর্নিশ করি । সে ও তার বন্ধু আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে কিন্তু ছেড়ে রেখে গেছে এক অজানা জ্যোতিষ্কের উজ্জ্বল আলো ।

একজন লেখকের জীবনে মানুষের ভূমিকা থাকবেই । কত মানুষের সঙ্গে তাঁর আলাপ পরিচয় হবে । কত মানুষ তাঁকে সঙ্গ দেবে , সময়ে সময়ে দেবে বেদনাও । তবু মানুষের ছবি দেখা , মানুষের ছবি আঁকা থেকে লেখকের মুক্তি নেই । তাঁর দেখা মানুষদের যাপনচিত্র নিয়েই তাঁর স্মৃতির সঞ্চয় । তাঁর সৃষ্টি করা চরিত্রগুলো তাঁর সংসারেরই অংশ । আমি বা আমার সমসময়ের মানুষ যাঁরা তাঁদের পথচলার বয়স অনেক লম্বা হয়ে গেছে । আমরা এক যুগসন্ধিক্ষণের মানুষ । সদ্য পাওয়া স্বাধীনতার সমস্ত রকম দৈন্য আমাদের ওপর দিয়ে গেছে । দেশভাগজনিত উদ্বাস্তুসমস্যা থেকে শুরু করে খাদ্যসংকট , একাধিক বৈদেশিক আক্রমণ ইত্যাদি নানা কিছু আমাদের সময়ের ওপর দিয়েই গেছে । আমাদের ছোটোবেলায় মানুষের জীবনে পাওয়ার থেকে নেই-এর তালিকাটাই ছিল অনেক লম্বা । আমরা যে সময়টায় জীবন শুরু করেছিলাম তখন গ্রামের পর গ্রাম অন্ধকারে ঢাকা । কুপি-লন্ঠনের দিনগুলি চলে গিয়ে এখনকার এল ই ডি বাতির যুগকে বড়ো সমৃদ্ধ লাগে । ক্ষীণ ট্রানসিস্টরের যুগ পেরিয়ে বর্তমান স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেটের প্রসাদগুলিও পেয়ে যাবার সৌভাগ্য হল । শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পারাপার উপন্যাসের বিমান রক্ষিতের মধ্যে মাঝেমাঝে পাগলামি দেখা যেত । কারণটা অদ্ভুত । সে ভাবত তার মাথার মধ্যে আকাশ ঢুকে যাচ্ছে । আর অত বিশাল আকাশ কী ঐটুকু মাথায় আঁটে । মাথাটা তাই ফাটো ফাটো মনে হত ।  আমিও সে রকম একটা যেন অনুভব করি আমার মাথার মধ্যে কাল বা সময় ঢুকে আছে । একটা মানুষের মাথার মধ্যে যদি তার দেখা সম্পূর্ণ কালখণ্ড ধরা থাকে তা হলে তার অবস্থাও তো ঐ বিমান রক্ষিতের মতোই হবে। মানুষকে তো ভুলে যেতে হয় । সব ঘটনা , তার যাপনকথামালার সমস্তটা তার মনে রাখার কথা নয় । কিন্তু ঐ যে নজরুল বলেছিলেন--কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি । যা ভুলে যাবার সব যে ভুলে যেতে পারি না । তাই পালদার ঐ কথাটা –"স্মৃতি খুঁজতে যেতে নেই'' মনে রাখতে পারিনি বহুবার । স্কুলে যাবার পথে ছোটো নদীর ওপর যে সাঁকো যার নীচে সারা বছরই বালি তার জন্যে আমার মন কেমন করে ওঠে । যে তরুণী আর  তরুণী নেই , বন্ধুও নেই আর তার হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠিগুলো এখনও কেন ধরে রেখেছি তার কোনো কারণ জানি না । সেই চিল-ওড়া বিকেলের করুণ আশ্রয়-অন্বেষণ আজও ভারী করে দেয় চারপাশ । কত দূর দেশের ভেজা শ্রাবণ আমন্ত্রণ পাঠায় । বন্ধনের কত ফাঁস ছিল দুই হাতে । আস্তে আস্তে কখন সে গুলো আলগা হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি । ইচ্ছে করে একবার দেখে আসি সেই নির্জন রেল প্ল্যাটফর্মের ধারে ধারে সেই সব পলাশ গাছের নীচে ঘুঘুপাখিরা এখনো ঘুরে ঘুরে ঝগড়া করে কী না । কিংবা খুঁজে দেখি সেই প্রান্তর যার ভিতর দিয়ে নিয়মিত হাঁটাই ছিল আমার দস্তুর যে প্রান্তর আজ বহুতলের নীচে চাপা পড়ে আজও যন্ত্রণায় কাতরায় । 

******************************************

সুবীর ঘোষ // ৩০১ আশ্রয়  অ্যাপার্টমেন্ট // গ্রুপ হাউসিং , বিধাননগর // দুর্গাপুর৭১৩২১২ // চলভাষ---৯৯৩২৬৪০৯৪৯

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

প্রচ্ছদ।। ৮৩তম সংখ্যা ।। মাঘ ১৪৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ।। প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮১তম সংখ্যা ।। অগ্রহায়ণ ১৪৩১ নভেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮২তম সংখ্যা ।। পৌষ ১৪৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮৪তম সংখ্যা ।। ফাল্গুন ১৪৩১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত