Featured Post

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮২তম সংখ্যা ।। পৌষ ১৪৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

ছবি
  সূচিপত্র অন্নদাশঙ্কর রায়ের সাহিত্য: সমাজের আয়না ।। বিচিত্র কুমার প্রবন্ধ ।। বই হাতিয়ার ।। শ্যামল হুদাতী কবিতায় সংস্কৃতায়ন (দ্বিতীয় ভাগ ) ।। রণেশ রায় পুস্তক-আলোচনা ।। অরবিন্দ পুরকাইত কবিতা ।। লেগে থাকা রোদ্দুরের ঘ্রাণের মতো ।। জয়শ্রী ব্যানার্জি কবিতা ।। ভুল ।। সুপ্রভাত মেট্যা কবিতা ।। উন্মেষ ।। বিশ্বজিৎ সেনগুপ্ত কবিতা ।। গার্হস্থ্য ।। বিবেকানন্দ নস্কর একগুচ্ছ বিজয়ের কবিতা ।। বিচিত্র কুমার গল্প ।। পোষ্য ভূত ।। সমীর কুমার দত্ত কবিতা ।। আশপাশ ।। প্রতীক মিত্র কবিতা ।। মেঘ ।। তীর্থঙ্কর সুমিত অণুগল্প ।। বংশীবদনের সুখদুঃখ ।। দীনেশ সরকার কবিতা ।। গভীর রাত ।। সুনন্দ মন্ডল তিনটি কবিতা ।। সুশান্ত সেন ভালোবাসার বাসা ।। মানস কুমার সেনগুপ্ত অণুগল্প ।। শিক্ষকের সম্মান ।। মিঠুন মুখার্জী কবিতা।। প্রশ্ন ।। জীবন সরখেল কবিতা ।।ক্ষরিত সে পথ ।। রহিত ঘোষাল কবিতা ।। রক্ত দিয়ে কেনা ।। মুহাম্মদ মুকুল মিয়া কবিতা ।। কংক্রিট ।। আলাপন রায় চৌধুরী ছড়া ।। শীত নেমেছে ।। রঞ্জন কুমার মণ্ডল কবিতা ।। কিছু শব্দ ।। সমীর কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতা ।। শীতের নগ্নতা ।। রানা জামান কবিতা ।। পথ চলা ।। পাভেল আমান বেদ পু...

নাটক // সিদ্ধার্থ সিংহ

ঈশ্বরের মতো দেখতে 



(চরিত্রঃ  ভাষ্যকার, ব্রহ্মা, সবুজ, চারপা, দু’পা, তপন, পবন, বরুণ)

মঞ্চে লাল নীল সবুজ আলোর কারিকুরি শুরু হবে। তাতে অস্পষ্ট বোঝা যাবে পাথরের মূর্তির মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক দিকে গাছের ডালপাতার পোশাক পরা সবুজ। অন্য দিকে হামাগুড়ি দেওয়া চার’পা, তার পাশেই টান টান হয়ে দাঁড়ানো দু’পা। একটু দূরে তপন, পবন, বরুণ। একদম সামনের দিকে ব্রহ্মা। তারই মধ্যে শোনা যাবে— 
ভাষ্য : অনেক অনেক কাল আগের কথা। পৃথিবী তখন সবেমাত্র ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। কোথাও কিছু নেই। শুধু খানাখন্দ আর আকাশ ছোঁয়া ছোঁয়া সব পাহাড়। এতখানি জায়গা এই ভাবে পড়ে থাকবে! একদম ন্যাড়া হয়ে! মাটির এই বিশাল গোলাকার পিণ্ড দেখে ব্রহ্মার বড় শখ হল একটা কিছু করার। কিন্তু কী করবেন তিনি! ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মাটি ঘাম আর ইচ্ছে নিয়ে ব্রহ্মা মেতে উঠলেন মনের মতো এক-একটা আদল তৈরি করতে। এক একটা আদল বানান আর তাতে প্রাণ দিয়ে দিয়ে ছেড়ে দেন পৃথিবীতে। কখনও বানান সবুজ রঙের সরু সরু শ্যাওলা, কখনও আবার মহীরুহের দানা। কখনও সরীসৃপ, কখনও চারপাওয়ালা হিংস্র বা নিরীহ, কখনও আবার ডানাওয়ালা। কত কী যে বানালেন! বানাতে বানাতে যখন আর নতুন কোনও আদলেরই রূপ দিতে পারছেন না, তখন বানিয়ে বসলেন নিজেরই গড়নের সঙ্গে মিল রেখে দু’পাওয়ালা জীব। এটা বানিয়ে তিনি এত আনন্দ পেলেন যে, এদের প্রতি একটু বেশিই দুর্বল হয়ে পড়লেন। কিন্তু বিশেষ কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা তো তাঁকে মানায় না, তাই তিনি তাঁর প্রত্যেকটা সৃষ্টিকে রক্ষা করতে চাইছেন এমন একটা ভান করে প্রথম দিককার সৃষ্টি সবুজ গাছপালাগুলোকে ব্রহ্মা বললেন— 
(ব্রহ্মার মুখে তীব্র আলো) 
ব্রহ্মা : এই যে সবুজ… 
(মঞ্চের হাল্কা আলো থাকলেও সঙ্গে সঙ্গে সবুজের মুখে জোড়ালো আলো পড়বে এবং সবুজ নড়েচড়ে উঠবে) 
সবুজ : হ্যাঁ প্রভু… 
ব্রহ্মা : শোনো, এ বার থেকে তোমরা ডানাওয়ালাদের বিশ্রাম করার জন্য নিজেকে মেলে দেবে। 
সবুজ : দেব প্রভু। 
ব্রহ্মা : থাকার জন্য কোল পেতে দেবে। 
সবুজ : ঠিক আছে প্রভু। 
ব্রহ্মা : সরীসৃপরা তোমার কাছে এলে তাদেরও জায়গা দেবে। 
সবুজ : এ আর বলতে! দেব প্রভু। 
ব্রহ্মা : চারপাওয়ালা দু’পাওয়ালা জীবদের আহার জোগাবে। 
সবুজ : সবই আপনার ইচ্ছে প্রভু। 
ব্রহ্মা : আর নিজেকে সবুজে সবুজে এত ভরিয়ে রাখবে, যাতে তোমাকে দেখে কেউ চোখ ফেরাতে না পারে। মোহগ্রস্তের মতো তোমার কাছে আসে… 
সবুজ : কিন্তু এ সব কী করে করব প্রভু? 
ব্রহ্মা : সে জন্য তোমাদের দেওয়া হল ডালপালা। 
সবুজ : ডালপালা! 
ব্রহ্মা : দেওয়া হল ফল। 
সবুজ : ফল! 
ব্রহ্মা : দেওয়া হল ফুল। 
সবুজ : ফুল! 
ব্রহ্মা : তোমাদের এগুলো দিলাম। কিন্তু তাই বলে ভেবো না, তোমরা তোমাদের ইচ্ছে মতো চলবে। তোমরা যাতে খেয়ালখুশি মতো চলতে না পারো, সে জন্য যেখানেই জন্মাও না কেন, আমৃত্যু তোমাদের সেখানেই থাকতে হবে। নিজে থেকে এক পা-ও তোমরা কোথাও সরতে পারবে না। 
সবুজ : এক পা-ও সরতে পারব না! 
ব্রহ্মা : না। 
সবুজ : তা হলে কেউ যদি আমাদের উপরে অত্যাচার করে, মারার জন্য তেড়ে আসে, তখন আমরা পালাব কেমন করে? 
ব্রহ্মা : কেউ তোমাদের মারতে আসবে না। তোমাদের উপরে কেউ অত্যাচারও করবে না। কোথায় আমার চারপাওয়ালা দু’পাওয়ালা সন্তানেরা? কোথায়? 
(সবুজের মুখ থেকে আলো নিভে যাবে। সেই আলো ঠিকরে পড়বে চারপাওয়ালা দু’পাওয়ালাদের উপরে) 
চারপা-দু’পা : আমরা এ দিকে প্রভু। 
ব্রহ্মা : শোনো, ওরা নড়তে চড়তে পারবে না বলে তোমরা ভেবো না, ওদের ওপরে যথেচ্ছাচার চালাবে, একেবারে সব পাতা খেয়ে সাবাড় করবে। কিংবা ফুল পাড়ার ঝোঁকে নির্মম ভাবে ডালপালা ভাঙবে। যদি তোমরা এ সব কিছু করো, তা হলে কিন্তু তোমরাও বাঁচবে না। 
চারপা-দু’পা : আমরা সে রকম কিছু করব না প্রভু। ভুল করেও করব না। 
(সবুজের উপর আলো পড়বে) 
সবুজ : ওরা এখন বলছে, করবে না। কিন্তু পরে যদি করে? 
চারপা-দু’পা : আমরা তো বলছি করব না। 
ব্রহ্মা : যদি কোনও অত্যাচার করে, তা হলে ওরাও রেহাই পাবে না। 
সবুজ : সত্যি প্রভু? 
ব্রহ্মা : হ্যাঁ। তোমরা একে অপরের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকবে। তোমরা কেউ যদি কাউকে শেষ করার মতলব আঁটো, তা হলে জানবে, তোমরা আসলে নিজেদেরই শেষ করার দিকে এগোচ্ছ। 
চারপা-দু’পা : বাঃ বাঃ, উত্তম ব্যবস্থা। উত্তম ব্যবস্থা। 
সবুজ : তাই? 
(সবুজ, চারপা, দু’পার মুখ থেকে আলো নিভতেই তিন রঙের তিনটি আলো মিলেমিশে গিয়ে পড়বে তপন, পবন আর বরুণের মুখের ওপরে) 
তপন-পবন-বরুণ : আমরা কী করব প্রভু? আমাদের কাজ কী? আমরা কী ভাবে থাকব প্রভু? 
ব্রহ্মা : তপন, তুমি তোমার কিরণ দিয়ে এই পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার দূর করবে। এই গোলকটায় যারা থাকবে, তাদের রোগভোগ থেকে আগলাবে। সুস্থ-সতেজ রাখার জন্য প্রাণপণ লড়বে। 
তপন : যথা আজ্ঞা প্রভু। 
পবন : আর আমি? 
ব্রহ্মা : তুমি এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে যেতে আমার সমস্ত সন্তানদের মন-প্রাণ জুড়িয়ে দেবে। তোমার শরীরেই মিশে থাকবে এই ভূখণ্ডের সমস্ত প্রাণীর বেঁচে থাকার আসল জাদু… 
পবন : মানে? 
ব্রহ্মা : মানে, তোমার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে এমন এক ধরনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অণু থাকবে, যা সহজে কারও নজরে পড়বে না। অথচ সেটাই ওদের বাঁচিয়ে রাখবে। প্রাণীজগৎ সেই অণু নিয়ে নিজেরা বাঁচবে। আর সেই অণু আবার যখন তারা শরীর থেকে বার করে দেবে, তখন সেটা নিয়ে উদ্ভিদজগৎ প্রাণ ধারণ করবে। উদ্ভিদজগৎ সেটা তার শরীর থেকে বার করে দিলে, সেটা আবার গ্রহণ করবে প্রাণীজগৎ। এই ভাবেই তোমার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকবে গাছপালা, পশুপাখি সবাই… 
পবন : এত বড় দায়িত্ব আমার! প্রভু আমাকে আশীর্বাদ করুন, যাতে আমি আমার কাজ ঠিক মতো করতে পারি। 
ব্রহ্মা : কেন পারবে না, নিশ্চয়ই পারবে। 
(সবুজ, চারপা, দু’পার ওপরে আলো মৃদু থেকে তীব্র হবে) 
সবুজ : আচ্ছা প্রভু, আপনার চারপাওয়ালা দু’পাওয়ালারা যদি সেই জাদু নিয়ে আর না ছাড়ে, তখন? 
(চারপা-দু’পার উপরে আলো পড়বে) 
চারপা-দু’পা : ওরাও তো সেটা না ছাড়তে পারে প্রভু… 
ব্রহ্মা : না ছেড়ে উপায় নেই। কারণ, ওটা এমন ভাবে তৈরি, কেউ সেটা শুধু নিজের শরীরের মধ্যে কেন, কোত্থায়ও লুকিয়ে রাখতে পারবে না। উদ্ভিদরা নিলে চারপাওয়ালা দু’পাওয়ালাদের জন্য উপযোগী হয়ে সেটা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সবুজদের শরীর থেকে বেরিয়ে আসবে। আর চারপাওয়ালা দু’পাওয়ালা নিলেও ঠিক তাই-ই হবে। সবুজদের জন্য উপযোগী হয়ে ওদের শরীর থেকে বেরিয়ে পড়বে। ওরা হাজার চেষ্টা করলেও লুকিয়ে রাখতে পারবে না। 
(মঞ্চের সামনের দিকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে জটলা পাকাতে থাকবে চারপা, দু’পা আর সবুজ। ওদের মুখে উজ্জ্বল আলো পড়বে) 
চারপা-দু’পা : এটা আবার কী হল! এ তো একজন অন্য জনের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা। মানে, এ তো পরাধীন হয়ে বেঁচে থাকা, তাই না? 
সবুজ : এক্কেবারে ঠিক। আমরা যতই গলায় গলায় বন্ধু হই, যতই আপনজন হই, কখনও সখনও মনোমালিন্যও তো হতে পারে, তখন? আমাদের বাঁচা না-বাঁচা আরেক জনের ওপর নির্ভর করবে! এটা কী কথা! 
চারপা-দু’পা : তুমি ঠিকই বলছ। তবে এর পাশাপাশি আমার কী মনে হয় জানো তো… উনিও হয়তো ঠিকই বলছেন। নিশ্চয়ই অনেক ভেবেচিন্তে বলছেন, তবু আমার মন বলছে এটা ঠিক হচ্ছে না। একদম ঠিক হচ্ছে না। 
সবুজ : বলতে গেলে এটা তো আমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া, তাই না? 
চারপা-দু’পা : তা ছাড়া আর কী? 
(ব্রহ্মার মুখে তীব্র আলো পড়বে) 
ব্রহ্মা : কী হচ্ছে কি ওখানে? অত জটলা কীসের? কী ঘুজুর-ঘুজুর করছ? 
সবুজ : কই, কিছু না তো প্রভু, আমরা এমনিই কথা বলছিলাম। 
ব্রহ্মা : না না, তোমরা তো এমনি কথা বলার বান্দা নও। নিশ্চয়ই কিছু একটা ফন্দি আঁটছ। মতলবটা কী তোমদের? 
চারপা-দু’পা : কিছু না প্রভু। কিছু না। 
ব্রহ্মা : কিছু না বললে হবে? বলো বলো, তোমাদের সমস্যাটা কী? শুনি— 
সবুজ : না মানে, আসলে… 
ব্রহ্মা : অত ইতস্তত করার কিছু নেই। যা বলার বলো। মন খুলে বলো। 
সবুজ : না মানে, আমরা বলছিলাম কী, আপনি কিন্তু আর একবার ভেবে দেখতে পারতেন… 
ব্রহ্মা : হুম। বুঝেছি। একসঙ্গে থাকলেই তোমরা দেখছি জটলা পাকাবে। দাঁড়াও, একটা কাজ করি। এ বার থেকে তোমরা আলাদা আলাদা আদলের চেহারাধারীরা আলাদা আলাদা ভাষায় কথা বলবে, তার ব্যবস্থা করছি। 
চারপা-দু’পা : সে কী! 
সবুজ : তার মানে! 
ব্রহ্মা : এ বার থেকে তোমরা তোমাদের নিজেদের আদলের বাইরের কারও ভাষা কেউ বুঝবে না। 
চারপা-দু’পা : সে কী প্রভু! আমরা তো এই মাটির পিণ্ডর উপরেই একসঙ্গে থাকব। পাশাপাশি থাকব। অথচ আমরা যদি একে অন্যের ভাষা বুঝতে না পারি, আমার মনের কথা যদি পাশের কাউকে বোঝাতে না পারি, তা হলে একসঙ্গে থাকব কী করে! আমরা তো সবাই মিলেমিশেই থাকতে চাই। 
সবুজ : একসঙ্গে থাকব, অথচ কেউ কারও ভাষা বুঝতে পারব না! 
চারপা-দু’পা : একটা কিছু উপায় বার করুন প্রভু… 
ব্রহ্মা : তোমরা একসঙ্গে থাকলেই তো যত সমস্যা। যেই একটু চোখ সরিয়েছি, অমনি তোমরা জটলা পাকাতে শুরু করে দিয়েছ। আর আমি যদি না থাকি, তা হলে তোমরা যে কী করবে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। 
সবুজ : তাও আমরা একসঙ্গে পাশাপাশি থাকতে চাই প্রভু। 
চারপা-দু’পা : হ্যাঁ প্রভু, দয়া করুন। আপনার আদেশ পালটে দিন প্রভু। 
ব্রহ্মা : ঠিক আছে, এত করে যখন বলছ… কিন্তু আমি যখন একবার মুখ দিয়ে বলে ফেলেছি, সেটা তো আর বদলাতে পারব না। তবে একটা উপায় বলে দিচ্ছি। যখন কেউ কারও ভাষা বুঝতে পারবে না, অথচ একসঙ্গে থাকবে— তখন উভয়ই উভয়ের মনের ভাব তার আচার-আচরণে এবং হাবভাবে বুঝে যাবে, সে কী বলতে চাইছে। 
সবুজ : ঠিক আছে প্রভু। 
চারপা-দু’পা : তবে তাই হোক। 
ব্রহ্মা : এখন তো ‘তাই হোক’ বলছ। একটু পরেই তো আবার ফিসফাস শুরু করে দেবে। 
সবুজ : না প্রভু। 
ব্রহ্মা : একটু আগে তোমরা কী বলাবলি করছিলে? 
সবুজ : না, বলছিলাম, প্রাণীরা যদি পবনের শরীর থেকে বাঁচার জাদুটুকু নিয়ে আর আমাদের জন্য না ছাড়ে! 
চারপা-দু’পা : হ্যাঁ প্রভু, আমরাও তাই বলছিলাম। বলা তো যায় না, কার মনে কী আছে। ওই উদ্ভিদজগৎ যদি কোনও কারণে আমাদের জন্য নির্ধারিত জাদু না ছাড়ে? 
ব্রহ্মা : ও, এই কথা! ঠিক আছে, আমি দেখছি। এই, তপন কোথায় রে? 
(তপনের মুখের ওপরে তীব্র আলো) 
তপন : এই তো আমি প্রভু। 
ব্রহ্মা : শোনো, শুনলে তো সব! এ বার থেকে তোমর দায়িত্ব, উদ্ভিদরা তাদের কাজ ঠিকমতো করছে কি না তার দেখভাল করা। তুমি যতক্ষণ কিরণ দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে থাকবে, ততক্ষণ এই গুরুদায়িত্ব থেকে নিস্তার পাবে না সবুজেরা। তুমি বিশ্রামে গেলে তবেই ওদের সে দিনের মতো ছুটি। 
সবুজ : আমাদের দেখার দায়িত্ব নাহয় তপনকে দিলেন, কিন্তু চারপা দু’পাওয়ালারা যদি নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে? 
ব্রহ্মা : পবন পবন, কোথায় গেলে গো সব? 
পবন : আদেশ করুন প্রভু। 
ব্রহ্মা : গাছপালারা যখন চারপা দু’পাওয়ালাদের প্রাণ ধারণের জন্য তোমার শরীরে মিশিয়ে দেবে জাদু, তখন সেই সব জাদু প্রাণীজগৎ শুষে নিয়ে যাতে ফের গাছেদের উপযোগী করে আবার বাতাসে ছেড়ে দেয়, তা দেখার ভার তোমার। 
পবন : ঠিক আছে প্রভু। আপনার আদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। 
ব্রহ্মা : এই ভাবেই শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তোমরা প্রতিটি মুহূর্ত বেঁচে থাকবে, এক পক্ষ আরেক পক্ষের উপর নির্ভর করে। ফলে তোমাদের বেঁচে থাকার রসদে টান পড়বে না কোনও দিনই। 
সবুজ : যখন আমরা আরও আরও অনেক হয়ে যাব? 
চারপা-দু’পা : যখন আমাদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে পৃথিবী ছেয়ে যাবে? 
ব্রহ্মা : যতই পৃথিবী ছেয়ে যাক গাছপালা লতাগুল্মে কিংবা চারপাওয়ালা দু’পাওয়ালা অথবা ডানাওয়ালায়, কারও কোনও কিছুতেই কোনও অসুবিধে হবে না। একটা ভারসাম্য ঠিক বজায় থাকবে। আর বরুণ… মন দিয়ে শোনো, তুমি হবে এমন মোক্ষম একটা দাওয়াই, তোমাকে ছাড়া কেউই খুব বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারবে না। 
(সবাই পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়বে। কারও মুখে আলো থাকবে না। রং-বেরঙের আলো শুধু ঘুরতে থাকবে মঞ্চ জুড়ে) 
ভাষ্য : ব্রহ্মার আদেশে তিন জনই সঙ্গে সঙ্গে শুরু করে দিল কাজ। তপন তার রৌদ্র ছড়িয়ে দিল সবার উপরে, পবন বইতে লাগল ফুরফুর করে আর বরুণ কলকল ধ্বনি তুলে ঢেকে দিল পৃথিবীর প্রায় তিন ভাগ জায়গা। প্রথম প্রথম সব কিছু ঠিকই ছিল। কিন্তু কিছু দিন পর থেকেই এদের চালচলন যেন কেমন হয়ে যেতে লাগল। এরা তিন জনই পৃথিবীর হর্তা কর্তা বিধাতা বলে নিজেদের মনে করতে লাগল। কোনও ঘাস একটু বেশি মাথা তুললেই তপন রেগে গিয়ে তাঁর প্রখর কিরণ দিয়ে তাকে পুড়িয়ে খাক করে দিতে লাগল। পেখম মেলে বনের ময়ূরকে একটু নাচ করতে দেখলেই পবনের হিংসে হত। সে তল্লাটে আর যেতই না সে। আর বরুণ তো নদী হয়ে বইছিল, চারপাওয়ালা দু’পাওয়ালা কিংবা গাছপালারা তার ভজনা না করলে সে তার গতিপথ বদলে অন্য দিকে চলে যেত। প্রভুর এই তিন সন্তানের কর্মকাণ্ড দেখে হাহাকার উঠল পৃথিবী থেকে। সেই আর্তনাদ আর কান্না ব্রহ্মার কাছে পৌঁছতে দেরি হল না। সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মা তলব করলেন তাঁর প্রিয় তিন সন্তানকে। এলও তারা। ব্রহ্মা তপনের কাছে জানতে চাইলেন— 
(ব্রহ্মা, তপন, পবন, আর বরুণের মুখে জোরালো আলো) 
ব্রহ্মা : তোমরা এই সব কী করছ? 
তপন : কেন প্রভু? 
পবন : আমরা কী করেছি প্রভু? 
বরুণ : আমরা তো আপনার আদেশ মতোই সব পালন করছি প্রভু। 
ব্রহ্মা : ছোট ছোট গাছপালাগুলোকে কেন জ্বালিয়ে দিচ্ছ? 
তপন : আমি কী করব প্রভু? আমার শরীর তো আগুনের পিণ্ড। আমার তাপ যদি কেউ সহ্য করতে না পারে, সে দোষ কি আমার? 
পবন : আমি তো এক দিক থেকে অন্য দিকে ধেয়ে যাই, এত বড় পৃথিবী, যাওয়ার সময় কোন আনাচে-কানাচে কে পড়ে আছে, সব কিছু দেখা কি আমার পক্ষে সম্ভব? খুঁজে খুঁজে যেতে গেলে যে সামনের দিকে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। তখন আবার ওদের শ্বাস নিতে কষ্ট হবে না? কী করি বলুন তো প্রভু… 
ব্রহ্মা : হুঁ। বুঝেছি। বরুণ তোমার সমস্যা কোথায়? 
বরুণ : আমার তো কোনও সমস্যা নেই। আমি তো এ-পথ ও-পথ সে-পথ দিয়ে বয়েই চলেছি। তবে কি, কোথাও কোথাও পথ এত সরু যে আমি যেতেই পারি না। আর আমাকে যদি সব জায়গা দিয়েই বয়ে যেতে হয়, তবে তো পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল থাকবে না। ওটা পালটে করতে হবে, একচিলতে ডাঙা আর বাকিটা জলাশয়। কিন্তু একচিলতে ডাঙায় কি আপনার এত সন্তান একসঙ্গে থাকতে পারবে? 
ব্রহ্মা : তোমাদের সব কথা শুনলাম। এবং বুঝতে পারলাম। ঠিক আছে। তপন, এ বার থেকে তুমি পৃথিবী থেকে এত দূরে থাকবে যে তোমার তাপে আর কেউ জ্বলেপুড়ে খাক হবে না। তোমার কিরণ সবার ওপর সমান উষ্ণতায় পড়বে। 
তপন : পৃথিবী থেকে অনেক দূরে! 
ব্রহ্মা : হ্যাঁ, আর পবন এখন থেকে তুমি সর্বত্রগামী হবে। ইচ্ছে করলেও কোথাও কোনও জায়গায় তুমি নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারবে না। একচুল জায়গা পেলেও যে ভাবে হোক, তুমি ঠিক সেখানে পৌঁছে যাবে। 
পবন : একচুল জায়গা পেলেও! 
ব্রহ্মা : হ্যাঁ, আর বরুণ— 
বরুণ : বলুন প্রভু। 
ব্রহ্মা : এ বার থেকে তুমি চেষ্টা করেও নিজের গতিপথ আর বদলাতে পারবে না। সব সময়ই তুমি নীচের দিকে বইবে। পথ যত সরুই হোক, সেখান দিয়ে তুমি অনায়াসে ঠিক বয়ে যাবে। আর কারও যাতে অসুবিধে না হয়, সে জন্য যার যখন খুশি, যে তোমাকে যখন যাতে করে নিয়ে যেতে চাইবে, তুমি তখনই সেই পাত্রের চেহারা নেবে। 
বরুণ : সে কী, এ রকম আবার হয় নাকি! 
ব্রহ্মা :  হয় এবং এ বার থেকে তা-ই হবে। আর তুমি ঠিকই বলেছ, তুমি যদি সব জায়গা দিয়েই বইতে থাকো, তা হলে ডাঙা বলে আর বিশেষ কিছুই থাকবে না। তাই এ বার থেকে তুমি তপনের তাপে বাষ্প হয়ে মাঝে মাঝে খানিকটা উবে গিয়ে আকাশে ঠাঁই নেবে। এবং মেঘ হয়ে পৃথিবীর উপরে ভেসে বেড়াবে। 
বরুণ : একবার পৃথিবীর মাটিতে আর একবার পৃথিবীর উপরে! কেন প্রভু? এক জায়গায় থাকা যায় না! 
ব্রহ্মা : না। তবে এটা বলতে পারি, তোমাকে বেশিক্ষণ উপরে থাকতে হবে না। মাঝে মাঝেই তুমি টুপটাপ কিংবা মুষলধারে ফের নেমে আসতে পড়বে এই ধরায়। 
বরুণ : ঠিক আছে প্রভু। আপনি যখন চাইছেন, তাই হবে। 
ব্রহ্মা : তা হলে তোমাদের আর কোনও সমস্যা নেই তো? তা হলে এই কথাই রইল? 
(সবার মুখ থেকে আলো নিভে যাবে। সব রঙের আলোর কারিকুরি ঘুরতে থাকবে মঞ্চময়) 
ভাষ্য : ব্রহ্মার কথা তো শুধু কথা নয়, আদেশও। তাই সঙ্গে সঙ্গে তা ফলতে শুরু করল। সেই থেকে আজও পৃথিবী থেকে তপন এত দূরে। পবন ছড়িয়ে রয়েছে পৃথিবীর প্রত্যেকটি কোনায় কোনায়। আর বরুণ নদী হয়ে বয়ে চলেছে নীচের দিকে। সেই জলই বাষ্প হয়ে উবে, বৃষ্টি হয়ে নেমে আসছে এই পৃথিবীতে এবং আজও যে কেউ যে কোনও কিছুতে জলকে ধরে রাখতে চাইলে জল সঙ্গে সঙ্গে সেই পাত্রের আদল নিয়ে নেয়। ব্রহ্মার সেই সব আদেশ খণ্ডাতে পারেনি ওরা। গাছগাছালিও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে তাঁর নির্দেশ। সরীসৃপ, জলচর, ডানাওয়ালারাও সব মানছে। মানছে চারপাওয়ালারাও। কিন্তু দু’পাওয়ালারা? নিজের আদলে ব্রহ্মা যাদের বানিয়েছিলেন, তারা তো ঈশ্বরের মতো দেখতে। অন্তত চেহারার মান রাখতে কোথায় তারা এটা-সেটা সৃষ্টির দিকে ঝুঁকবে, তা নয়, উল্টে বনের পর বন কেটে সাফ করে চলেছে।  ব্রহ্ম বলেছিলেন— 
(ব্রহ্মার মুখে তীব্র আলো পড়বে) 
ব্রহ্মা : কেউ যদি কাউকে শেষ করার মতলব আঁটো, তবে জানবে, তোমরা আসলে তোমাদেরই শেষ করার দিকে এগোচ্ছ।
(ব্রহ্মার মুখ থেকে আলো নিভে যাবে) 
ভাষ্য : তবে কি দু’পাওয়ালারা নিজেদের অজান্তেই এক পা এক পা করে নিজেদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিছে— কে তাদের মনে করিয়ে দেবে ব্রহ্মার সেই সতর্কবাণী? 
(ব্রহ্মার মুখে তীব্র আলো পড়বে) 
ব্রহ্মা : তোমরা আসলে তোমাদেরই শেষ করার দিকে এগোচ্ছ। তোমরা আসলে তোমাদেরই শেষ করার দিকে এগোচ্ছ। তোমরা আসলে…  
(মঞ্চ অন্ধকার) 

====================








SIDDHARTHA SINGHA
27/P, ALIPORE ROAD,
KOLKATA 700027
(M) 8777829784


জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮১তম সংখ্যা ।। অগ্রহায়ণ ১৪৩১ নভেম্বর ২০২৪

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮২তম সংখ্যা ।। পৌষ ১৪৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত