গান্ধারীর আক্ষেপ এবং অভিসম্পাত
( ভগ্নি নিবেদিতার রচনা Cradle Tales Of India : Lament Of Gandhari অবলম্বনে বাংলা অনুবাদ)
অষ্টাদশ দিবস ব্যাপী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অবসান হইয়াছে । সকালে রণভূমি উপরে মলিন পান্ডুবর্ণ সূর্যদেব উদিত হয়েছেন । এই যুদ্ধের শেষ দিনে যেমন কুরু বংশের শেষ প্রদীপ নির্বাপিত হইয়াছে , তেমনি পাণ্ডব বর্গের নিদ্রামগ্ন সন্তান-সন্ততি , আত্মীয়-স্বজন এবং রাজন্য বন্ধু-বান্ধবের উপরে এক নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছে !
নিঃসন্দেহে এই ঘটনা নিরানন্দ , নিঃসঙ্গ এবং পরিপূর্ণ হতাশা ব্যঞ্জক কলঙ্কযুক্ত একটি ঘটনা !
একথা সত্য যে বীর পাণ্ডবগণ এবং শ্রীকৃষ্ণ এই অষ্টাদশ জীবনব্যাপী ধর্মযুদ্ধে বিজয়ী হইয়াছেন এবং অক্ষত দেহে বিরাজমান । কিন্তু ,তাদের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা আজ বিধ্বস্ত এবং বিচূর্ণ ! হস্তিনাপুরের সাম্রাজ্য তাদের হস্তগত হয়েছে সত্য , কিন্তু তা উত্তরাধিকার শূন্য - তাদের অবর্তমানে কারো হাতেই তা প্রত্যার্পন করা যাবে না । সিংহাসন অধিকৃত হয়েছে কিন্তু গৃহে গৃহে আজ শ্মশানের শূন্যতা !
যুদ্ধ বিজয়ীদের চারপাশে খাতরো ধর্ম চিত্র বীরগণের চির নিদ্রায় নিদ্রিত দেহগুলো ঝরা ফুলের মত রণভূমি তে ভূমি শয্যায় ছড়িয়ে আছে ।
এইতো সেদিনও যারা বীরদর্পে বর্ণবহুল নানান রঙের পতাকা , নিশান উড়িয়ে রণক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিল , যাদের রথসমূহ ছিল সুসজ্জিত , সবচেয়ে প্রাগ্রসর , যাদের অশ্বসমূহ ছিল অমিত শক্তিকে সংহত , যাদের রণদামামায় ছিল তুমুল নিনাদ , হস্তিপৃষ্ঠ আসন ছিল রাজকীয় মর্যাদায় মর্যাদাপূর্ণ - তারাই ওই সব ভুবন বিজয়ী বীর সব আজ চিল শকুন শৃগাল এবং নেকড়ের খাদ্য হিসাবে করুণার পাত্র হয়ে কুরুক্ষেত্রের সমগ্র রণাঙ্গনের ভূমি সজ্জায় নিথর দেহে চির নিদ্রায় শায়িত !
সহসা দূরবর্তী স্থানে দেখা গেল - ভাগ্য বিড়ম্বিত কৌরব রাজকুলবধূরা দলবদ্ধভাবে তাদের মৃত প্রিয়জনদের প্রতি শোক জ্ঞাপন করবার জন্য এগিয়ে আসছেন। তাদের প্রতি দৃষ্টি পড়তেই পাণ্ডব পক্ষগণ ভয়ে কম্পিত হতে শুরু করলেন । হস্তিনাপুরের কৌরব বংশের রাজ কুল বধুদের রক্ষণশীলতা এতই দুর্বোধ্য ছিল যে , স্বয়ং দেবতারাও তাদের মুখদর্শন করবার কোন সুযোগ পেতেন না । অথচ , আজ আভিজাত্য এবং রক্ষণশীলতা কে দূরে সরিয়ে রেখে গভীর শোকাহত অন্তঃপুরবাসিনী রাজকুলবধূরা প্রকাশ্য দিবালোকে ইতরজনের দৃষ্টি উপেক্ষা করে ,
ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছেন । কৌরব রাজ শতপুত্র আজ মৃত যুদ্ধক্ষেত্রের শীতল ভূমিশয্যা চির নিদ্রায় তারা শায়িত ।
মহারানী গাড়িসহ গুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র রাজকীয় সকলে বাহিত হয়ে এই দিকেই আসবেন । এই দৃশ্য পান্ডবদের শ্রদ্ধা এবং সমবেদনায় সিক্ত করল । এই শ্রদ্ধা এবং সমবেদনা শুধুমাত্র তাদের পরিণত বয়স এবং রাজকীয় মর্যাদার জন্য নয় বরং তাদের হৃদয় বিদারক আত্মীয় বিয়োগের সুগভীর সন্তাপ ও চির অন্ধত্বের জন্য বটে । একদিকে যেমন তারা পরাজিত বর্গের অভিভাবক অন্যদিকে রক্তের সম্বন্ধযুক্ত বিজয়ীদের অভিভাবক । কাজেই শ্রদ্ধা এবং সম্মান তাদের প্রাপ্য । সে ক্ষেত্রে পান্ডবদের সঙ্গতভাবেই মনে হইল যুধিষ্ঠির বিজয় গৌরব অপেক্ষা তাদের কাছে তার আত্মনিবেদন শ্রেয় এবং সঙ্গত ।
অতঃপর যুবরাজ যুধিষ্ঠির তার ভাইদের কাছে দ্রৌপদীর কাছে এবং স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের কাছে যিনি স্বয়ং ধর্মরাজ নামে খ্যাত সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে প্রণাম করে - নির্বাক এবং নিস্তব্ধ হয়ে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলেন ।
পরিণত বয়স্কা রাজরানী গান্ধারী রানীর মর্যাদা নিয়েই তার শোক সংবরণ করে রেখেছেন । বাঙাল স্বামী ধৃতরাষ্ট্র জন্ম থেকেই অন্ধ । স্বামীর এই জন্মান্ধতার কারণে পত্নী সুলভ উত্সর্জনে নিজের দু চোখকে স্বেচ্ছায় বস্ত্রাবৃত করে সেই বিবাহ বন্ধন কাল হইতেই নিজের অন্ধত্বকে বিশ্বস্ত ভাবে বরণ করে নিয়েছিলেন । এইভাবে তার বাইরের দৃষ্টি সম্মত হইল বটে , কিন্তু আধ্যাত্বিক অন্তর্দৃষ্টি শক্তির উন্মোচন ঘটেছিল । সেই কারণে তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী ছিল , বিধাতা পুরুষের মুখনিঃসৃত বাণী । তিনি যা বলতেন , তাই হতো কখনো ব্যর্থ হতো না ।
যুদ্ধ চলাকালীন প্রতিদিনই প্রভাবে যুদ্ধজয়ের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে দূর্যোধন মাকে প্রণাম করতে আসছেন । উত্তরে গান্ধারী প্রতিদিনই বলতেন বৎস জয় ? জয় হবে , ধর্মের । জয় হবে , সত্যের । অথচ গান্ধারী যুদ্ধের প্রারম্ভকাল থেকেই জানতেন যে , এই মহাযুদ্ধ তার গৃহকে নিঃশেষ করবে । শূন্য করে দেবে ।
এই নিদারুণ মুহূর্তেও তার আত্মনিয়ন্ত্রণের কি অনমনীয় শক্তি ¡ শতপুত্র হারানোর শোকের কারণে নয় , তার হৃদয় কাঁপছে - প্রিয় স্বামীর জন্য , যিনি আজ হৃদয় বিদীর্ণ , শোকে মুহ্যমান , নিঃসঙ্গ , একাকী এবং সর্বহারা ।
এই কথাটা চরম সত্যি যে , যেদিন থেকে তিনি জানতেন আজকের এই চরম বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী , এবং তা রাজা ধৃতরাষ্ট্রের দুর্বলতা , আকাঙ্ক্ষা বা তাদের কোন পাপের দায় ভোগের কারণে নয় , তবুও তার অনমনীয় ইচ্ছাশক্তি মুহূর্তের জন্য আন্দোলিত বা বিচলিত হয়নি । তিলার্ধ সময়ের জন্য সাহায্য লাভের বাসনা তিনি তার অন্তরে স্থান দেননি । বরং , তিনি তার অন্তরের অন্তঃস্থলে সত্যকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন ।
কিন্তু এটাও চরম বাস্তব যে , গান্ধারীর স্বামী আজ শূলবিদ্ধ প্রাণীর মত নরক যন্ত্রণা ভোগ করে , পরিপূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে - একেবারেই ভেঙে পড়েছেন । তাই স্বামীর প্রতি তার সংবেদনশীল সমবেদনা হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে স্বতোৎসারিত হয়ে এই চরম দুঃসময়ে আছড়ে পড়ছে । তার নিষ্কলুষ পবিত্র জীবনের জন্য গর্ব আদর্শের প্রতি তার অবিচল নিষ্ঠা এবং কৃচ্ছসাধনে তার অনমনীয়তার কথা সারা জগতবাসী জনে । সেই পরিচয় দূরে সরিয়ে রেখে স্বামীর এই যন্ত্রণা কাতর দুঃসময়ে , তার এই যন্ত্রণা দীর্ণ মানসিকতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ক্রোধ এবং কঠোরতা কে সংবরণ করে স্বামীর জন্য শঙ্কা চিত্তে অবস্থান করছেন , কারণ তিনি তারই অর্ধাঙ্গিনী । গান্ধারী ভালোই জানেন যে এই হৃদয়বিদারক মুহূর্তে তার ভিতর থেকে একবার যদি সংহত তেজ বেরিয়ে আসে , তবে তা সব কিছুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেবে । এমনকি শ্রদ্ধা জানাতে আসা পান্ডব পক্ষের ধর্মপুত্র বলে খ্যাত - যুধিষ্ঠিরও তার হাত থেকে রক্ষা পাবে না । তাঁকে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও বাঁচাতে পারবে না । তিনি তার এই ভেতরের শক্তি সম্পর্কে সম্যক অবহিত বলেই একরকম জোর করে সেই শক্তিকে সম্বরণ করে রেখেছেন ।
অতঃপর গান্ধারী বস্তাবরণ এর মধ্যেই চোখের দৃষ্টি অবনত করলেন । সেই দৃষ্টির এমন এক ভয়ঙ্করতা এবং প্রখরতা ছিল যে , যেদিকে তা আপাতত হতো - নিমেষে তা পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যেত ! কিন্তু মহারানী গান্ধারী তার সহজাত শক্তিতে অন্তর্দাহ কে সংযত করে স্বাভাবিক রইলেন । এরপরে দ্রৌপদী এবং পান্ডব জননী খুন্তি সাথে শান্ত কোমল কন্ঠে কিছু কথা বললেন এবং সকলকে দূরে সরিয়ে রেখে একবার তো কৃষ্ণকে তাঁর আলোচনার স্বপক্ষে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করলেন ।
তিনি ঈশ্বর , তার সাথে আলোচনাকালে কোন আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন নেই । এমনকি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়ঙ্কর অনুগুলিরও প্রতিটি দিক নিয়ে , তার সাথে আলোচনা করা যায় । তীব্র কণ্ঠে কৃষ্ণকে ধিক্কারের ভাষায় সম্মোধন করে বললেন - হে পদ্মপলাশলোচন কৃষ্ণ ? তুমি কি দেখতে পাচ্ছো এই কন্যারা আমার রাজ অন্তঃপুরের অকাল বৈধব্য আজ সর্বহারা ! গৃহকোণের উষ্ণ স্নেহ ভালোবাসা এবং নিরাপত্তা বন্ধনমুক্ত হয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে এরা বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে ! হে জগতস্বামী কৃষ্ণ ! তুমি কি বধির ? স্বামীহারা বিধবাদের , সন্তানহারা জননীদের হৃদয় বিদারক ক্রন্দন ধ্বনি তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না ? তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না , যারা ছিল এই মহাভারতের শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয় বীর , ভূমিতলের চিরনিদ্রায় শায়িত তাদের দেহের উপরে বুকফাটা ফাটা হাহাকার ধ্বনিতে সদ্য বিধবা কুলবধুগন , সন্তানহারা জননী গন আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে দিচ্ছে ।
হে সর্বশক্তিমান ! দেখো , তাকিয়ে দেখো ..... আলুলায়িত রুক্ষ কেশ এবং বিধ্বস্ত উন্মাদিনীর মত এখনও তারা মৃতদেহের স্তূপের মধ্যে তাদের স্বামী , পুত্র , ভাই এবং আত্মীয়-পরজনদের সন্ধান করে ফিরছে ! ... সমগ্র রণস্থল আজ সন্তানহারা জননী , স্বামীহারা বিধবার এবং ভাই হারা ভগ্নিগণে পূর্ণ !
যে বীরগণ আজ শীতল ভূমিশয্যায় চির নিদ্রায় শায়িত , একদিন তাদের ছিল অগ্নিসম তেজ এবং বীর্য ! হে কৃষ্ণ ? তুমি কি দেখছো না - এই বীর যোদ্ধাদের পরনের পরিচ্ছদের মহামূল্যবান রত্ন রাজি , সুবর্ণ হীরক খচিত উষ্ণীষ আজ ছিন্নভিন্ন ,নিতান্ত অবহেলায় তৃণাচ্ছাদিত ভূমি তলে ছড়িয়ে পড়ে আছে ! .... তুমি কি দেখছো না যে , শাণিত অস্ত্র যে বীরগণের মুষ্টিতে আবদ্ধ , সেই সব অস্ত্র উত্থিত হয়ে ভবিষ্যতে আর কোনদিনই শত্রু নিধনে অগ্রসর হবে না । ...
এই দেখো , এই ভুবন-জয়ী বীরগণের অসহায় মৃত দেহের স্তুপের মধ্যে ঘৃণ্য মাংস লোলুপ পশুরা যথেচ্ছ ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে ! দেখো , .... তাকিয়ে দেখো !!
কি বীভৎস ! কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য ! ...। হে জগত কল্যাণ কৃষ্ণ ! বল , এর নাম যুদ্ধ ? তুমি দৃষ্টি প্রসারিত করে , উত্তর দাও - জগতের কোন কল্যাণ এই যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সাধিত হয়েছে ? তুমি জগৎ নিয়ন্ত্রক , তোমার ইচ্ছাতেই তো সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় , সংঘটিত হয় । তুমি , শুধু তুমিই এই সর্বনাশা যুদ্ধের নিয়ামক । ..... হে কৃষ্ণ ! আমি জ্বলছি , শুকানো লেলিহান শিখায় আমি দাউদাউ করে জ্বলছি ! হে কৃষ্ণ , যুযুধান দুই পক্ষের সৈন্যদল আজ বিধ্বস্ত , এরা যখন পরস্পর পরস্পরকে নিঃশেষ করছিল , তখন কি তোমার দুচোখ বন্ধ ছিল ? তুমি তো সর্বশক্তিমান ! ভালো-মন্দ সবই তো তোমারই ইচ্ছাধীন ছিল ? তাহলে দুপক্ষকে কেন চরম হত্যাকাণ্ড এবং অমঙ্গল সংঘটিত হতে দিলে ?
এখন আমি , হে গদাধারী গোবিন্দ ! সত্যের শুদ্ধ ভূমির উপরে দাঁড়িয়ে , নারীত্বের পবিত্রতা এবং সতীত্বের শক্তি নিয়ে তোমাকে এই অভিসম্পাত দিচ্ছি যে তুমিও নরক যন্ত্রণা ভোগ করবে ! কৌরব-পান্ডবের এই প্রাণঘাতী যুদ্ধে যখন তারা পরস্পরকে নিধন করছিল , তুমি তখন চরম উদাসীন হয়ে তা প্রত্যক্ষ করে - নিশ্চিন্ত ছিলে !আমার অভিশাপে তুমিও নিমিত্ত স্বরূপ দাঁড়িয়ে থেকে , তোমার আত্মীয় জনের বিনাশ প্রত্যক্ষ করবে ! .... নিধন তোমার স্বভাব প্রক্রিয়া । নিজের মাতুল কংস কে তুমি নিধন করেছিলে । আজ থেকে তিন দশক পরে , তুমি তোমার সন্তান এবং সন্ততিদের চরম নিষ্ঠুরতায় বিনাশ করবে এবং তারপর শোক বিদীর্ণ হয়ে হৃদয় নিয়ে প্রতিমুহূর্তে স্বজন হারানোর নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকবে । স্বজনহারানো শ্মশানে শূন্যতার মধ্যে নিঃসঙ্গ একাকিত্বের কি জ্বালা তা তোমাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে । যে যারা এই মুহূর্তে এই হতভাগী গান্ধারী সহ সমগ্র ভারত ভোগ করছে !!
অতঃপর গান্ধারী তার আক্ষেপ এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তার অভিসম্পাতঅভিসম্পাত বন্ধ করলেন । শ্রীকৃষ্ণ তার স্বভাবসুলভ হাস্যময় মুখে বললেন - গান্ধারী ? তোমার অভিশাপ আমার কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ । আমার করণীয় কর্তব্য সম্পন্ন করতে , তুমি পরোক্ষে আমাকে সাহায্যই করলে । আমার আত্মজন , আমার বংশধর দুর্দম এবং অপরাজেয় । বাইরের কোন শক্তি নেই , তাদের পরাজিত করতে পারে । একমাত্র পরস্পরের আত্ম কলহ এবং সংগ্রামেই তাদের বিনাশ সাধন হবে । হে কৌরব জননী ? তোমার এই অভিসম্পাত আমি সানন্দে গ্রহণ করলাম বলে , ভগবান কৃষ্ণ অবনত হয়ে প্রবীণা রাজমহিষীকে সম্বোধন করে বললেন - গান্ধারী ? ওঠো, জাগো ।হৃদয়ে দুঃখকে স্থান দিও না । দুঃখকে মনের ভেতরে স্থান দিলে , দুঃখ দুঃখকেই বাড়িয়ে তুলবে । আরো বেদনাদায়ক হয়ে উঠবে । ....
হে মহীয়সী ভারতকন্যা গান্ধারী ! জগতের চিরন্তন নিয়ম এবং সত্যকে একবার স্মরণ করো তো ! ব্রাহ্মণী সন্তান প্রসব করেন , ভবিষ্যৎ ধর্ম বাসনার উত্তরাধিকারী হিসেবে । গাভী সন্তান প্রসব করে , ভার বহনের জন্য । শ্রমজীবী কুলের মহিলাগণ সন্তান প্রসব করে , ভবিষ্যৎ কাজকর্ম সাধনের জন্য । কিন্তু , যাদের অভিজাত ক্ষত্রিয় কূলে জন্ম , জন্ম থেকেই তারা নির্দিষ্ট হয়ে আছে যুদ্ধ এবং প্রাণ বলিদানের জন্য ।এটাই তো জগতের নিয়ম । এই নিয়মের ব্যতিক্রম মেরুতে দাঁড়িয়ে , তুমি শোকাতুর হবে কেন ? তুমি তো জানো বিনাশশীলতাই ছিল জগতের নিয়ম !
মহারানী গান্ধারী স্তব্ধ হয়ে শ্রীকৃষ্ণের এই মহান বাণী গুলো শ্রবণ করলেন । এই বাণীর প্রকৃত মর্মকথা - তিনি অনুধাবন করে অন্তরে বাহিরে তিনি পরিপূর্ণ এবং স্নেহ ইত্যাদিতে আসক্তিহীন ও উদাসীন হয়ে উঠলেন । এই মানসিকতাই তো বনবাসী হয়ে নির্জনতার মধ্যে তপস্যা চর্চার উপযুক্ত মানসিকতা এবং সময় । এতক্ষণ যে বিয়োগান্ত ঘটনা তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছিল তাও প্রশমিত হয়ে অন্তরে গভীর প্রশস্তি দান করল জগতের সবকিছুই এখন তার কাছে অলীক এবং অনুরোধ করতে লাগলো । সবাইকে একত্র করে উপলব্ধ দুঃখকে মন থেকে ঠেলে দূরে সরিয়ে , পবিত্র জাহ্নবীর তীরে কৌরব পাণ্ডব সহ দুই পক্ষেরই বীরযোদ্ধাদের মৃতদেহগুলোর শেষকৃত্য সম্পন্নের ব্যবস্থা করলেন।
========================
প্রণব কুমার চক্রবর্তী
37/1, স্বামী শিবানন্দ রোড
চৌধুরীপাড়া
বারাসাত
কলকাতা 700124