সন্তান কি মা-বাবার অতৃপ্ত স্বপ্ন বহনকারী
শিরোনামটি অবশ্যই মনোগ্রাহী বা হৃদয়গ্রাহী নয় । কিন্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই শিরোনামটি অযৌক্তিক কিনা ভেবে দেখার সময় এসেছে ।
সন্তান জন্ম নেওয়ার সময় বা আগে থেকেই মা-বাবার স্বপ্ন বোনা শুরু হয় । এই স্বপ্ন মা-বাবার ব্যক্তিগত জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারার অতৃপ্ত যন্ত্রণা থেকেও তৈরী হয় । তবে এটা অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন, সন্তান জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই মা-বাবার ব্যক্তিগত সুখ মানে বিলাসিতা প্রায় উধাও হয়ে যায় । সন্তানের সুখের মধ্যেই নিজেদের সুখ দেখা বা খোঁজা শুরু করেন । সন্তানকে নিয়েই মা-বাবার জীবন ব্যস্ত থাকে । কোন কিছু কিনতে গেলে বা করতে গেলেই আগে সন্তানের মুখটা ভেসে উঠে । মোদ্দা কথা, সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তার ঘেরাটোপের মধ্যেই মা-বাবার জীবনের গণ্ডী সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে । তবে জেনে বা অজান্তে মা-বাবার মনে উচ্চাকাঙ্খাও তৈরী হয়ে যায় । এটার জন্য পারিপার্শ্বিক পরিবেশও প্রভাব বিস্তার করে ।
সন্তানের জন্য মা-বাবারা ব্যক্তিগত ভোগবিলাসিতা ত্যাগ করলেও সন্তানের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে সর্বদাই সচেষ্ট থাকেন । তাই একদিকে সন্তানের সুখের জন্য যেমন ব্যক্তিগত সর্বস্ব ত্যাগ করে দিনরাত পরিশ্রম করেন, অপরদিকে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে সন্তানকে অজান্তে 'কর্পোরেট' জগতে প্রবেশ করিয়ে দেন । এই 'কর্পোরেট' জগতে ভোগবিলাসিতা অফুরন্ত হলেও মানসিক সুখ কতখানি মা-বাবারা তা তলিয়ে দেখার প্রয়োজন হয়তো বোধ করেন না বা উচ্চাকাঙ্খার নাগপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেন । এই উচ্চাকাঙ্খা সন্তানের নাম দেওয়া থেকে শুরু করে, ভালো বা অধমের ভাষায় 'দামী' স্কুলে ভর্তি করানো, সাইন্স পড়িয়ে ভালো ক্যারিয়ার বানানো পর্যন্ত চলতে থাকে ।
বিষন্নতা গ্রাস করে যদি সন্তান 'সুসন্তান' না হয় । কিন্তু 'সুসন্তান' হিসেবে গড়ে তোলার বর্তমান যে পথ, তা আদৌ সঠিক কিনা প্রতিটি সচেতন নাগরিক যথেষ্ট গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে বোধ করেন ।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে শোনা কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরছি । তবে বলে রাখা ভালো এগুলো যে সবাইকে উদ্দেশ্য করে তা মোটেই নয়, তবে এরকম দেখা বা শোনা যায় । যেমন -
১) সন্তানকে বলা "ওকে দেখেছিস কী স্মার্ট, কী সুন্দর কথা বলে । নাচ, গান, আবৃত্তি সবই পারে । তোর ক্লাসেই তো পড়ে । আর তুই ঠিকমতো কথাই বলতে পারিস না । কিচ্ছু হবেনা তোর দ্বারা । লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে যায়..."
"৯৯ পেয়েছিস ! ১ নম্বর কেন কাটা গেল ?"
২) নার্সারীর রেজাল্টও যদি অন্যদের তুলনায় সন্তান কম পায়, মা-বাবাদের মুখ দেখে মনে হয় তাদের সন্তান যেন বোর্ড এক্সামের রেজাল্ট হাতে দাঁড়িয়ে আছে । তারপরে তো উত্তমমধ্যম আছেই...
৩) প্রায়শই শোনা যায় (অনেক সময় গর্বের সাথে) -
"আমার বাচ্চার মত দুষ্টু আর দ্বিতীয়টি নেই..."
"আমার বাচ্চা তো পড়তেই চায় না । জোর করে পড়াতে হয়..."
"আমার বাচ্চার হাতের লেখা যা বিশ্রী..."
"আমার বাচ্চা বাংলা পড়তেই পারে না..."
"বলে দিয়েছি বাচ্চাকে ভালো মার্কস না পেলে আর পড়াশোনা করতে হবে না..."
"আমার বাচ্চার ৮ জন প্রাইভেট টিউটর" "আমার বাচ্চার ১০ জন প্রাইভেট টিউটর" এরকমভাবে চলতে থাকে...
"আমি তো বাচ্চাকে বিদেশে পড়াতে চাই । সম্ভব না হলে বহিঃরাজ্যে তো অবশ্যই..."
"জানি না বাচ্চার ভবিষ্যত কি, কী আছে কপালে..."
আসলে এই কথাগুলো বলে অভিভাবকরা আগেই সাফাই গাওয়ার রাস্তা তৈরী করার চেষ্টা করেন । পুরোটাই 'সাইকোলজিক্যাল' ব্যাপার !
আসলে বেশী বেশী নম্বর পাওয়ার মানে হলো সমাজ বা 'সোস্যাইটি'র কাছে বা চোখে স্ট্যাটাস বাড়ানো । তাতে সন্তানকে যতই শারীরিক ও মানসিক চাপ সহ্য করতে হোক না কেন !
আবার শুধুমাত্র পড়াশোনাতেই থেমে থাকলে চলবে নাকি ! নাচ, গান, আর্ট, আবৃত্তি, বাদ্যযন্ত্র, সাঁতার, ক্যারাটে ইত্যাদি শেখানোর ক্ষেত্রে পারলে কোনটাই বাদ দেওয়া হয় না । এগুলো শুধু শিখলেই হবে না, সাফল্যও অর্জন করতে হবে । রীতিমত চাপ সৃষ্টি করা হয় । সন্তানকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করিয়ে চোখ রাঙিয়ে, ধমকিয়ে আরও আরও ভালো করার জন্য 'উৎসাহ' দিতে দেখা যায় । সন্তানের সীমাবদ্ধতা বা চাপ নেওয়ার ক্ষমতা যাচাই করার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেন এক অনাবিল আনন্দের নেশায় ।
পরিশেষে এটাই বলার, আসুন আমরা আমাদের সন্তানদের চাপহীন মুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠার সুযোগ করে দিই । ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক, মানুষ হোক আমাদের সন্তানেরা ।।
====================
রাজা দেবরায়
প্যারীবাবুর বাগান, জয়নগর, পো - আগরতলা, পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা, ত্রিপুরা, পিন - 799001
চলভাষ এবং হোয়াটসঅ্যাপ - +917005712884