হ্যারিকেন
টিনের চালে ওপর পড়া একটানা শব্দটা কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে যেন। জানালার পাল্লাটা এই এতটুকু খোলা। যতটুকু খোলা থাকলে একটা চোখ বাইরের দৃশ্যখানা দেখে নিতে পারে। খেয়াল করি ,আমার মাথার উপর আর একটা মাথা। দাদা কখন জানি , পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। জানালাটা আর একটু খুলেছি কি , প্রবল একটা জলের ছাট মুখ ধুয়ে দেয়। আবার পাল্লাটা আগের মতন করি। বাইরের দাপাদাপি আরো বৃদ্ধিমান। একটা প্রবল জলের ঘূর্ণি যেন হাওয়ার তালে পাক খেতে খেতে জাগলিং দেখিয়ে চলেছে। মাঝখানে উদীয়মান সুপারির আর খেজুরের পাতায় জাগিয়ে তুলছে অমানুষিক হিল্লোল।
কোন এক অজানা গায়কের পাগল করা কোন এক রাগে তারা দুদ্দাড় নেচে চলেছে।
কমে আসছে বাইরের আলো। একরাশ অন্ধকারের চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে আকাশের গায়ে। মাঝে মধ্যে ইতিউতি ভেসে আসে ঘন্টা নয়তো শাঁখের ক্ষীণ ধ্বনি। প্রকৃতি কে জব্দ করার নিস্ফল কৌশল।
লোকজনহীন পথঘাট। খালি একটানা বৃষ্টির শব্দ চারদিকে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করে।
না, জানালার ওইটুকু ও খুলে রাখা যায় না। বাতাসের শনশনানির সঙ্গে জলের অকুলিবিকুলি মুখ ভিজিয়ে দেয় , ঘরে ঢুকে পড়ে হাওয়া। দপ করে খানিক কমে, আবার জ্বলে ওঠে হ্যারিকেনটা।তাড়াতাড়ি জানালার পাল্লায় ছিটকিনি টেনে দিই।
হ্যারিকেনের স্তিমিত আলো যেন , অস্তমিত সূর্যের মতন। না মিথ্যে নয়। পলতে টা ডুবে আছে মায়ের জমানো শেষ ওইটুকু কেরোসিনে। হ্যারিকেনের আলোয় ধুপধুপ বসে পড়ি চার মূর্তিমান। নরম আলোয় দেওয়ালে ফুটে ওঠে বড় বড় চারখানা ছায়া।
বন্ধ হয়ে থাকা মোবাইল গুলোয় বারবার চোখ চলে যায়। কাতর চোখ - কয়েকবার ফেরে দেওয়ালে আটকানো এল সি ডি টার দিকে।
বাবার পরামর্শে ঘর থেকে নিয়ে আসা হয় লুডোখানা। ঝড়ের সাথে ছক্কার আওয়াজের মিশ্রণ- এক অদ্ভুত মাদকতায় মাতিয়ে দেয়।কিন্তু সমস্ত অনুভূতি কে এক নিমেষে খান খান করে দিয়ে কানে আসে একটা প্রবল জলের ঝাপটার শব্দ । সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাই ঘরে। মায়ের অভিজ্ঞ হাতে লাগানো জানলার পাল্লা খুলে গেছে প্রবল ঝড়ের ধাক্কায়। ঘরের মধ্যে এসে পড়ে বৃষ্টির ছাট। পাল্লা বন্ধ করে কোনমতে নিরস্ত করা হয়।
হাওয়ার বেগ যে আরো হু হু করে বেড়েছে তা মালুম হয় আওয়াজ শুনে। দূরপাল্লার ট্রেন পাশ দিয়ে গেলে যেমন হয়, অনেকটা সেরকম। সদ্য আলকাতরা মাখানো টিনের চালটা দক্ষ যোদ্ধার মতো লড়াই করে চলেছে অসম্ভব শক্তিশালী এই ঘূর্ণির সাথে। তবে কুপোকাত যে হচ্ছে না তা নয়। টিন আর দেওয়ালের মাঝের সুক্ষ ফাঁকগুলোর মধ্যে দিয়ে অতি সহজেই জল ঢুকে পড়ছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে সিঁড়ি। চারজন মিলে ছিচে তোলার চেষ্টা করি সেই জমে থাকা জল।
মনে পড়ে, দিলুকাকুর কথা- মাটির দেওয়াল টা কোনমতে অস্তিত্বের লড়াই করছে; খড়ের চাল দিয়ে হয়তো বা কুলকুল করে ঢুকছে ঠান্ডা জলের ঢেউ। পুবের দিকের দীঘি টা হয়তো কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মনে পড়ে মামার বাড়িতে গরমকালের দুপুরে পেয়ারা গাছে উঠে পা ছড়িয়ে ডাঁসা পেয়ারা খাবার কথা। হয়তো প্রাচীন সেই বৃক্ষখানি এখনো লড়াই করছে।
মনে পড়ে পিসির বাড়ির বাগানে ঘুরে ঘুরে গোলাপ তোলার কথা, আম পাড়ার কথা। আগের কালবৈশাখীতে কোনমতে টিকে থাকা সেই আম্ররাজি আজও লড়ছে।
দেশের- নিঃসঙ্গ বাড়িটা ঝড় থেকে নিজেকে কি আদৌও বাঁচাতে পারবে?
পাশের বাড়ির চাল থেকে একের পর এক খসে পড়ে এক একটা টালি। কানে আসে তার শব্দ।
হাওয়ার ঝটপটানি বেড়েই চলেছে। ঝড়ের গতিবেগ কত ? নেটটা থাকলে হয়তো দেখা যেতো ।
শেষ পর্যন্ত হার মেনে আবার হ্যারিকেনের আলোয় এসে বসি সবাই। তেল কমে এসেছে।তার ইঙ্গিত ও মিলছে।
হয়তো ভয়ঙ্কর এই ঝড় কেড়ে নেবে হাজার হাজার প্রাণ। উপড়ে পড়বে কত না আগেকার সযত্নে বা এমনই গজিয়ে ওঠা গাছ। মড়কে হারিয়ে যাবে না কতশত দীঘি, খাল, বিল ,পুকুরের মাছেরা। গৃহবন্দি ওই মানুষ গুলো হয়তো হয়ে পড়বে গৃহহীন।
তাও তো ওদের লড়াই থামার নয় ; হয়তো বৃদ্ধ বাবা শক্ত হাতে চেপে ধরে আছে বাঁশখানা, মাথার চালটাকে, পরিবার টাকে নিশ্চিত- অনিশ্চিতের হাত থেকে রক্ষা করতে। ঠিক যেমন টলমল ছন্দে , ওই হ্যারিকেনটা এখানো চেষ্টা করে চলেছে নিজের অস্তিত্ব জানানহড দেবার।হয়তো বিদ্যুৎ আসবে বেশ কয়েকদিন, তাই বাধ্য হয়ে ঘরে মজুত রাখা মোমবাতি গুলো কে বাঁচিয়ে রাখা।আলোই যে অন্ধকারের একমাত্র শত্রু।
আলোর প্রতীক্ষায় গোটা বঙ্গবাসী একযোগে প্রার্থনায় সামিল। ঝড় আরো বেড়ে উঠেছে। উন্মত্ত হাওয়ার তান্ডব লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে সবকিছু।
তাও নিদ্রাহীন চোখে জেগে আছি।হ্যারিকেনের সরু শিখাখানা দপ দপ করে এখনো জ্বলছে।