মেয়েবেলার জমাট কথারা
স্বনামধন্যা গায়িকা নীপার ছেলে রাজাবাবুর আজ পাঁচ বছর পূর্ণ হল। রেখা নাতিকে আদর করে ঐ নামেই ডাকে। অন্নপ্রাশনের সময় তেমন কিছু করা হয় নি বলে রেখা নাতির জন্মদিনটা খুব ঘটা করেই করছেন। সুলেখা এসে দেখে তো হতবাক ! কি বিশাল আয়োজন!তারই মাঝে বেশ ক'টা পরিবর্তিত আধুনিক বহুরূপী সেজেগুজে, মজা করে বাচ্চাদের মনরঞ্জন করছে। যে চার্লি চ্যাপলিন সেজেছে সে তো একেবারে অনবদ্য। সুলেখা এদের দেখে ফিরে যায় তার সেই মেয়েবেলায়। ব্যস্ত রেখা একটু ফাঁক পেতেই বাল্যবান্ধবী সুলেখাকে কাছে এসে বলে,"কিরে, কি এত ভাবছিস,বল তো?"
-দেখ না এই নব্য জোকারগুলো দেখে আমাদের সেই বৈঁচীগ্রামের বহুরূপী মধুদার কথা খুব মনে পড়ছে।
-কি ভয় পেত বনু, বহুরূপী দেখলেই সটান খাটের তলায়।
-তোর বোনটা বাপু বড্ড ভীতু ছিল।
-ওটাই তো কাল হল, কাউকে কিছু বলতে না পেরে অকালে নিজেকে শেষ করে দিল।
-কি মিষ্টি কন্ঠ ছিল, কিন্তু -
-রাতে অনুষ্ঠানে যেতে দিত না, অহেতুক সন্দেহ করতো ওর স্বামী, শেষে পেটের ছেলেটা অন্য কারুর ঔরসে হয়েছে বলায়..
-আজকের দিনে চোখের জল ফেলিস না। তোর-আমার সেই বহুরূপীর পেছনে ছোটা মনে আছে?
-মনে নেই আবার? কোনদিন কালি, কোনদিন মেমসাহেব, কোনদিন বা ফকিরবাবা সেজে একেবারে সর্বধর্ম সমন্বয় ঘটিয়ে ফেলত মধুদা।
-কি অসাধারণ প্রতিভা, একাধারে গায়ক, অভিনেতা, নৃত্যশিল্পী, মেকআপ ম্যান।
-কিন্তু দুঃখের বিষয় এই লোকশিল্পটা এখন প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই কত কি তো হারিয়ে যাচ্ছ বল?
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায় ছুটতে ছুটতে গিয়ে রেখা আগত বিখ্যাত সব গায়ক-গায়িকা, পরিচালক, সুরকারদের আতিথেয়তা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দু-চারজন অভিনেতা অভিনেত্রীরও দেখা মিলেছে।নীপার গানের যে বেশ কদর বেড়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে। অথচ এই গান গাওয়া নিয়ে আজকালকার ছেলে সায়ক কি কম অশান্তি করেছে? সায়কের নিজের গানের খ্যাতির থেকে নীপার খ্যাতি বেশি হয়ে পড়াতেই কাল হল। বনুর ওরকম পরিণতি হওয়ায় রেখা নীপাকে নিয়ে চলে এসেছে। আসলে রেখার বাবা ছিলেন বিখ্যাত ধ্রুপদীয়া, সেই রক্ত রেখাও পেয়েছিল।কিন্তু শ্বশুরবাড়ি এসে তাকে সবকিছুই বিসর্জন দিতে হয়েছিল।
অতিথিদের নিয়ে সেলিব্রেটি মেয়ের ছবি তোলা চলছে। সেই তালে রেখা সুলেখার কাছে এসে আবার বসে। সুলেখা বলে,"একেবারে চাঁদের হাট বসে গেছে রে।"
-আলাপ করবি নাকি?
-না, থাক। আমার এই বন্ধুটাই বা কম কিসে? কি সুন্দর আধুনিক গানগুলো তুই গাইতিস! কলেজে কত ছেলে তোর জন্যে পাগলা ছিল বল তো? দুম করে বেরসিক অমলদার সঙ্গে কাকু তোর বিয়েটা দিয়ে দিল।
-পাঁচ বোন আমরা, ভাই নেই। সবার বড় আমাকে ঘাড় থেকে নামাতে-
-তবে নীপার গান শেখার জন্যে কিন্তু অমলদাও অনেক কষ্ট করেছে।
- আসলে বনেদী পরিবারের বৌ কিনা বেশ্যাদের মত গান গাইবে, শ্বশুরবাড়ির এসব কথার ওপর ওর কোন কথাই কেউ শোনেনি, তাই ও উঠে পড়ে লেগেছিল নীপাকে দিয়ে দেখাতে যে গান গাইলে কেউ খারাপ হয়ে যায় না।
-তোদের দুজনের স্বপ্নই সার্থকতা পেয়েছে।
অতিথিরা একে একে বিদায় নিলেন। অমলবাবু ও রেখা পরিবারের সবাই ও নিকট কিছু বন্ধুদের নিয়ে একদম শেষে খেতে বসেছে।অমলবাবু বললেন, সায়ককে বার বার আসতে বলেছিলাম, একবারটি এল না। ডিভোর্স তো হয় নি, ছেলেটার জন্যেও তো আসতে পারত। সায়ককে আসতে বলায় নীপা তো চটেই লাল। না খেয়েই উঠে পড়ল।
-খেয়ে নাও নীপা, আমি তোমাকে আর রাজাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। সবার সামনে আজ আমি স্বীকার করছি আমার থেকে তুমি অনেক বড় দরের শিশ্পী, তুমি জাত শিল্পী, তোমার রক্তে গান।
সায়ককে ঐ কথা বলে ঢুকতে দেখে তো সবাই তো হতবাক।
সুলেখা ও অমল নীপা আর সায়ককে নিয়ে খেতে বসিয়ে দেয়। রাজা এতদিন পর বাবাকে পেয়ে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
==================
ডঃ রমলা মুখার্জী
বৈঁচী, বিবেকানন্দপল্লী, হুগলী 712134
ফোন নং7003550595
হোয়াটস এপ 9474462590