সামাজিক দূরত্ব বলতে বোঝায়, "সংক্রামক রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রুখতে মানুষের সাথে মানুষের মধ্যেকার সংস্পর্শের ঘটনা কমানোর পদ্ধতি" | সামাজিক দূরত্ব স্থাপন হল সংক্রামক রোগ বিস্তার প্রতিরোধের জন্য সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের একগুচ্ছ ঔষধবিহীন পদক্ষেপ | সেই সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তি যেন অপরের মাধ্যমে রোগ ছড়াতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা | তবে জল বা মশা মাছি বাহিত সংক্রামক রোগে দূরত্ব সেভাবে কাজে আসেনা | সামাজিক দূরত্ব বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয় যখন রোগটি হাঁচি কাশি বা যৌন সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সংক্রামিত হয় |
সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে গেলে জনসমাগম এড়ানো, অন্যের থেকে ছয় ফুট প্রায় দুই মিটার দূরত্ব রক্ষা করা, যে কোনো সমাবেশ, সে ধর্মীয় বা সামাজিক যাই হোক না কেন পরিত্যাগ করতে হবে | ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখার নীতিটি এসেছে 'শ্বসন শারীরতত্ব' থেকে | যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ ব্যাধি বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম শাফনার ব্যাখ্যা করেছেন 'নিঃশ্বাস ফেলার সময় আমরা যদি না হাঁচি না কাশি তবে পরস্পরের মধ্যেকার তিন থেকে ছয় ফুট দূরত্বকে শ্বাস বান্ধব বলা হয় |'
জনসমাগম এড়ানোর জন্য স্কুল, কলেজ, কাজের জায়গা, বাজার, গণপরিবহন সব বন্ধ করতে হবে | কেবলমাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিষের দোকান খোলা রাখা যেতে পারে | সেক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার নিয়মগুলো কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে | জীবাণু সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে বাজার থেকে আনা জিনিষপত্র স্যানিটাইজ করতে হবে |
সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে গেলে একের সাথে অন্যের সাক্ষাত্কালীন আলিঙ্গন একেবারেই চলবেনা | হৃদয়ের উষ্ণতা বোঝাতে নিজের হাতের সাহায্যে "লাভ" চিহ্ন আঁকা যেতে পারে | এবং করমর্দন এড়ানোর সহজ পন্থা হাত জোড় করে দূরত্ব বজায় রেখে নমস্কার জানানো | এছাড়াও বিভিন্নরকম চিহ্নের মাধ্যমে আমরা দূরত্ব রেখেও উষ্ণতা আদান প্রদান করতে পারি |
গাণিতিক মডেলিংয়ে দেখা গেছে স্কুল বন্ধ থাকলে প্রাদুর্ভাবের সংক্রমণ ধীরে হতে পারে | কর্মক্ষেত্র বিশেষ করে যেখানে অধিক জনসমাগম হয়, যেমন সিনেমার শ্যুটিং, খেলার স্টেডিয়াম, বড় কারখানা সেগুলো বন্ধ করলেও সংক্রমণ ধীর গতিতে হয় | খোলা বাজার বা হাট থেকে সংক্রমণ ছড়ায় দ্রুত গতিতে |
Covid-19 সারা বিশ্বে মহামারীর আকার ধারণ করেছে | তারই প্রেক্ষিতে এই আলোচনা | করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব এক সঠিক পদক্ষেপ | একই সাথে আক্রান্ত ব্যক্তিকে থাকতে হবে সেলফ আইসোলেশনে | খাবার-দাবার বা ওষুধপত্র কিনতে বাইরে বেরোতে হলে অবশ্যই পরস্পরের মধ্যে দুই মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে | সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখলে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশির থেকে সূক্ষ থুতুকণা বা ড্রপলেট বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে | এই ড্রপলেটে ঠাসা থাকে ভাইরাস | যেসব জায়গায় এই কণাগুলো পড়ছে সেসব জায়গায় হাত দিয়ে স্পর্শ করে নাকে মুখে হাত দিলে সেই কণাগুলো নিশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকে সহজেই সংক্রমিত করে | সেই কারণে কঠোর ভাবে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা একান্তভাবে জরুরী |
সেলফ আইসোলেশন বা স্বেচ্ছাবন্দী বলতে বোঝায় ঘরের ভেতর সম্পূর্ণভাবে একা থাকা | এই সময় বাইরে বেরোনো তো চলবেই না, বাইরে থেকে কেউ কোনো কিছু দিতে এলে দুই মিটার দূর থেকে তা গ্রহণ করতে হবে | এবার প্রশ্ন, করোনা আক্রান্তের কি কি উপসর্গ দেখা দিলে সেলফ আইসোলেশনে যাওয়া উচিত | হাই টেম্পারেচার, হাঁচি, কাশি গলা ব্যথা হলে সঙ্গে সঙ্গে আলাদা থাকতে হবে | যে ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন তার পরিবারের অন্য কারোর মধ্যে তিন দিন পরে এই উপসর্গ দেখা দিলে মোট দশ দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে |
সামাজিক দূরত্ব ব্যাপারটি আমাদের কাছে নতুন সংজ্ঞা মনে হলেও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এর আগেও বিভিন্ন রোগে এটিকে ব্যবহার করা হয়েছে | ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী চলাকালীন কলোরাডোর গুনিসন শহরকে দুই মাসের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা হয়েছিল | মহাসড়কগুলো ব্যারিকেড করে রাখা হয়েছিল | ট্রেন যাত্রীদের পাঁচ দিনের জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছিল | বিচ্ছিন্নতার ফলস্বরূপ গুনিসন শহরে ইনফ্লুয়েঞ্জায় একজন ও মারা যায়নি |
১৯৯৫ সালে জায়কারের রাষ্ট্রপতি মোবুতু সেসে সোকো সেনাবাহিনী নিয়ে পুরো শহরটাকে ঘিরে ফেলে সমস্ত ফ্লাইট স্থগিত করে দিয়েছিলেন | এর ফলে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হয়েছিল | ২০০৩ সালে সিঙ্গাপুরে SARS প্রাদুর্ভাবের সময় ৮০০০ জনকে বাধ্যতামূলকভাবে হোম কোয়ারানটাইনে রাখা হয়েছিল | এই পদক্ষেপটি সংক্রমণের বিস্তার রোধে সাহায্য করেছিল |
২০১৫ সালে প্রকাশিত মডেলিং টু ইনফর্ম ইনফেকশাস ডিজিজ কন্ট্রোল গ্রন্থে নিলস বেকার পাঁচটি পদক্ষেপের কথা বলেছেন, যা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার অন্তর্ভুক্ত | এগুলি হল এক, জনসমাগমস্থলে যাওয়া থেকে জনসাধারণকে বিরত করা | দুই, আক্রান্ত ব্যক্তিকে অন্তরীণ করা | তিন, আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা রোধ করা | চার, স্কুল, কলেজ বন্ধ করা | পাঁচ, জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা |
ইউনিভার্সিটি অব ডেলওয়ারের অধ্যাপক মার্কিন মহামারী রোগ বিশেষজ্ঞ জেনিফার হর্নি বলেছেন, "কোভিড- ১৯" রোগটি যেহেতু এক নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ, এই মুহূর্তে টিকা বা অন্য কোনো চিকিত্সাবিধি আমাদের জানা নেই যা মানুষকে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে | সে কারণেই আমাদের অন্যভাবে এর মোকাবিলা করতে হবে | আইসোলেশন, কোয়ারানটাইন ছাড়াও সব ধরণের জমায়েত, অনুষ্ঠান বাতিল করতে হবে | গণপরিবহনে নিষেধাজ্ঞা থাকবে |
চার্লস ডারউইনের ভাষায় যোগ্যই টিকে থাকবে এই পৃথিবীতে | মানুষ প্রায় প্রতি শতাব্দীতেই মহামারীর বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার পরীক্ষা দিয়েছে | হয়তো এই নতুন ভাইরাসটির বিরুদ্ধে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা প্রয়োগ করে এবারেও জয়ী হবে | মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে গর্ব করে, গর্ব করে ভবিষ্যতদ্রষ্টা হিসেবে | সেই দিক থেকে পরিস্থিতি বুঝে কৌশলী হওয়াটাও তার বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ |
করোনা ভাইরাসের কারণে উদ্ভুত এই মৃত্যু মিছিল রোধ করতে হলে জীবনানন্দের বনলতা সেনের সাথে "মুখোমুখি বসিবার" দিন নয় আজ | এখন দূরে দূরে, দূরভাষে গল্প করার দিন | একটা কথা মনে রাখতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বলতে শারীরিক দূরত্বকেই বোঝানো হচ্ছে | নিজে বাঁচতে হবে ও অন্যকেও বাঁচাতে হবে| তাই অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সামাজিক নৈকট্য গড়ে তুলতে হবে|
সামাজিক অর্থাৎ শারীরিক দূরত্ব বা বিচ্ছিনতা রক্ষা করাই এখন বেঁচে থাকবার একমাত্র কৌশল | সে কারণেই সমগ্র বিশ্বের এখন একটাই স্লোগান "মেনে চলো, সামাজিক দূরত্ব" | যূথবদ্ধ হয়ে আমাদের এই কাজ করতে হবে |
এটাই এখন "পরিবর্তিত সামাজিকতা"|