শেষ চিঠি
বছর কুড়ি বয়েস। বাবা মায়ের দুই মেয়ের বড় মেয়ে। কলেজে পড়ে। ভালো ছাত্রী। সপ্রতিভ মেয়ে। কলকাতার উপকন্ঠে বাড়ি। মেয়েটির নাম সুহাসিনী। বাবা আদর করে নাম দিয়েছিলেন। ওর আলাদা করে কোন ডাক নাম নেই। এত বড় নামে ডাকতে অসুবিধে হওয়ায় সবাই সুনি বলে ডাকে। যেন কাঠবেড়ালির লেজটা খসে পড়েছে। ঠিক যেমন নাম থেকে হাসিটা উবে গেছে। কিন্তু সেটা মুখে যোগ হয়েছে। মুখের মিষ্টি হাসিটা ওর সব সময়ের সঙ্গী। মেয়েটি ছিপ ছিপে গড়নের। মেপে মেপে সুন্দরী না হলেও দেখতে মিষ্টি। চোখটা যেন সবসময় অশ্রুসিক্ত। বর্ষার মেঘের ছায়াটা মুখে আঁকা। একটু হলেই চোখে বর্ষা নামবে। কিন্তু নামবে নামবে বললেও নামে না। কেউ একবার দেখলে দ্বিতীয়বার দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
সুহাসিনী অর্থনীতি নিয়ে পড়ে। কলেজে বন্ধুর অভাব নেই। তার কলেজটা বাড়ি থেকে চার পাঁচ কিলোমিটার দূরে। বাসে যাতায়াত করতে হয়। অঞ্চলে একটা মেয়েদের স্কুলে পড়ত। বাড়ির অন্তরমহলটাই তার জগৎ। বাবা মায়ের হাত ধরে কখনো বাইরেটা দেখেছে মাত্র। এখন তার সুযোগ হয়েছে নিজের পথ নিজে চিনে নেওয়ার। কলেজে ঢুকে তার পরিচয়ের দরজাটা যেন অবাধ হয়েছে। সেখানে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সবার সঙ্গে অবাধ মেলামেশা। ও ক্লাসে খুব মনোযোগী। বন্ধুরা ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে আড্ডা মারলেও ও সেটা করে না। তবে আড্ডায় তার যে উৎসাহ নেই তা নয়। ক্লাস করে যতটুকু সময় পাওয়া যায় আড্ডা দেয়। বন্ধুদের কাছেও ও সুনি। তবে বন্ধুদের মধ্যে থাকলে নামের 'হাসি'টা মুখে জুড়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে । ও সেখানে সুহাসিনী, ডাকে সুনি হলেও।
প্রায়-কলকাতার মত একটা শহর অঞ্চল থেকে কলেজে এসে সে সমবয়সী শহুরে ছেলেদের সঙ্গে যেমন অবাধ মেলামেশার সুযোগ পেয়েছে তেমনি গ্রাম থেকে আসা ছেলে মেয়েদের বন্ধুত্ব তাকে আমাদের বৃহত্তর সমাজটাকে চেনার সুযোগ করে দিয়েছে। সেই দিক থেকে শহরের উপকণ্ঠে কলেজগুলো যেন গ্রামীন বাংলা আর শহুরে বাংলার এক মিলন তীর্থ। গ্রামের সকালের মিষ্টি রোদ্দুরের সঙ্গে শহরের দুপুরের যৌবনের দহনের এ যেন সঙ্গম। শহরের অনাবৃষ্টিতে যে তৃষ্ণা কেঁদে মরে তা গ্রামের বারিবর্ষণে মেটে। শহরের সাজানো বাগানে ফুলের সঙ্গে গ্রামের বৃক্ষের পাতাবাহার। এখানে শহুরে সংকীর্ণতা ও অহংটা যেন ভেঙে যায়। আবার গ্রামের সংস্কার এখানে হোঁচট খায়। সুহাসিনীরা বুঝতে পারে জীবনের পরিধির ব্যাপ্তিটা তারা এতদিন যা জেনে এসেছে তার থেকে অনেক বেশি, দৈর্ঘ্যে আর প্রস্থে। যেন রবীন্দ্রনাথের সাধারণ মেয়ে, 'সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রোদ' মিলেছে এ কলেজ প্রাঙ্গণে।
তপন কিশোর অরিন্দম ইন্দ্রানী দেবযানী সুতপা সবাই কলেজে ওর বন্ধু। এক এক জনের এক একটা বিষয়। পড়াশুনা আড্ডা নিয়ে কলেজে বেশ চলে। নিজের বিষয় ছাড়াও বন্ধুদের মাধ্যমে রাজনীতি দর্শন সমাজতত্ত্ব সাহিত্য এমন কি রসায়ন নিয়েও ওদের আড্ডা হয়। রাজনীতি নিয়ে বাক বিতণ্ডা লেগেই থাকে। বন্ধুদের মধ্যে তপন সুহাসিনীকে যেন বেশি আকর্ষণ করে। খুব যে ব্যতিক্রমী ছেলে তা নয়। তপনের সাহিত্যে উৎসাহ বেশি। ইংরেজির ছাত্র। বাংলায় কবিতা গল্প লেখে। সাহিত্যের ছাত্রী না হলেও সুহাসিনী কবিতা ভালোবাসে। তপন ওকে একজন ভালো পাঠিকা পেয়েছে। আর পাঠক পাঠিকারাই লেখকদের সবচেয়ে আপনজন। পাঠক ছাড়া লেখকের জীবন বর্ষণবিহীন বর্ষাকাল। কল্পনায় জমে ওঠা বর্ষণসিক্ত মেঘ বর্ষায় না। চাতকের তৃষ্ণা মেটে না। পাঠিকা সাহিত্যিকের স্বভাব প্রেমিকা। প্রেম নিবেদন করতে হয় না। লুকিয়ে দেখা করার দরকার হয় না। পাঠিকাকে তার লেখা পড়াতে পারলেই প্রেম নিবেদন করা হয় নিজেদের অজান্তেই। পাঠিকাও সেটা সাদরে গ্রহণ করে।
কলেজ ফেরত ওরা দুজনে প্রায়ই একই বাসে। কলেজের সামনে থেকে ওঠে। সুহাসিনী কিছুক্ষণের মধ্যেই নেমে যায়। তপনকে আরও প্রায় দের ঘন্টা যেতে হয়। তপনের বাড়ি শহর ছাড়িয়ে চব্বিশ পরগনার এক গ্রামে। চাষ-ই ওদের পরিবারের জীবিকা। আর্থিক অবস্থা খুব ভালো না হলেও স্বচ্ছল। তপন গ্রামে ভালো ছাত্র বলে পরিচিত। সাহিত্যে অনুরাগের বশবর্তী হয়ে ইংরেজি নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বলা কওয়ায় ইংরেজিতে খুবই কাঁচা।আজকের শহুরে কথায় কথায় ইংরেজি বলিয়েদের পাতে পড়ে না। কিছুটা ব্রাত্যই বটে। তবে গ্রামের স্কুল হলেও ইংরেজি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ইংরেজি ব্যাকরণটা ভালো শিখেছে। সুহাসিনীও লক্ষ্য করেছে অভিধান ওর অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। অবসর সময়ে ওকে অভিধান খুলে বসে থাকতে দেখা যায়। তাই বোধহয় যখন ইংরেজি লেখে তখন তা যেমন ব্যাকরণ ভিত্তিক হয় তেমনি লেখায় শব্দের বৈচিত্র পাওয়া যায়। ওর এই ইংরেজি জানাটা আলাপ চারিতায় একেবারেই ধরা পড়ে না। সেখানে সে গ্রাম্য বাঙালি। চলা ফেরায় তেমন সপ্রতিভ নয়। আজকের কর্পোরেট দুনিয়ার চাহিদার সঙ্গে মানানসই নয়। সেদিক থেকে কর্পোরেট ক্যারিয়ার জগৎ তার কাছে অন্ধকার। কিন্তু তার প্রিয় পাঠিকা সেদিক থেকে বেশি সরোগর। সুহাসিনী ও তপন যেন বিপরীত অক্ষে অবস্থান করে। ভবিষ্যতে কর্পোরেট দুনিয়ার হাতছানি সুহাসিনীকে ডাকে। কিন্তু তপন ডাক পায় না। দুজনের মধ্যে এই পার্থক্য সত্ত্বেও তাদের সম্পর্কের অতলে যেন কোন এক অচেনা নদীর ফল্গুধারা।
ওদের সম্পর্কে এখনও আনুষ্ঠানিকতার লাগাম পরানো হয় নি। কেউ কাউকে প্রেম নিবেদন করে নি। তবে পস্পরের আকর্ষণটা বাড়তে থাকে। তপন প্রায়ই ওর গল্প বা কবিতা নিয়ে সুহাসিনীর সঙ্গে বসে। বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে। কবিতা পাঠ করে। সুহাসিনীও আজকাল একটা আধটা কবিতা লেখে। তবে ওর পড়াশুনা থাকে যার জন্য অনেক সময় দেয়। ভালো ফল করে একটা ভালো চাকরির তাগিদ ওর জীবনে খুব বেশি। কিন্ত তপন পড়াশুনায় অনাগ্রহী না হলেও ক্যারিয়ার করার প্রশ্নে উদাসীন। ও ভালো তেমন চাকরির কথা ভাবে না। সাহিত্য চর্চায় বেশি সময় দেয়। দুজনেই দুজনের কথা ভাবে। তপনের পাঠক পাঠিকা আছে। তারাই তার প্রেম। কিন্তু সুহাসিনীর পার্থিব চাহিদাটা বেশি। সে ক্যারিয়ারই হোক আর ভবিষ্যৎ সংসার জীবনই হোক। কার সঙ্গে সংসার জীবনে জোট বাঁধা যায় সেটা সে ভাবে। পার্থিব প্রয়োজনে জোট বাঁধা আর ভালোবাসার মধ্যে যে পার্থক্য আছে সেটা তাকে ভাবায়। ভাবে বলেই তপনের সঙ্গে একটা নৈস্বর্গিক প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও তার ভিত্তিতে সংসার গড়ার ভাবনা কতটা বিশুদ্ধ প্রেমের মর্যাদা পাবে সেটা নিয়ে তার সংশয় হয়। পার্থিব প্রেম সেই বিশুদ্ধ প্রেমের মর্যাদা হানি করবে বলে মনে হয়। শেষের কবিতার বন্যা আর অমিত। মনে করে পার্থিব প্রেম বাড়ির পুকুরে সাঁতার কাটার মত। ঘরার জল যা নিত্য ব্যবহারের জন্য পুকুর থেকে তোলা হয়। কিন্তু তাতে সমুদ্রে সাঁতারের আনন্দ নেই, বিহঙ্গ আকাশে ডানা মেলে না। অপার্থিব নিষ্কাম প্রেমেই তো সেটা সম্ভব। আমাদের সমাজে সংসার ও সকাম পার্থিব প্রেম সম্পর্কে তার ধারণাটা একদিন সুহাসিনী কবিতায় রূপ দেয়। তপনের সঙ্গে দেখা হয় কলেজ প্রাঙ্গনে। সেখানে সব বন্ধুদের সামনে সে কবিতাটা পাঠ করে। কবিতাটা সবার ভালো লাগে। ওটাই সুহাসিনীর লেখা প্রথম কবিতা যেটা ও তপনকে উৎসর্গ করে ।
সুহাসিনী জানে সংসারটা জরুরি। মানিয়ে চলা। পার্থিব সুখ দুঃখ দৈনিক মিলন বিরহ এর সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সবার সঙ্গে কি সে সংসার পাতা যায়? বোধ হয় না। সে অনেকবার প্রস্তাব দেবে বলেও পিছিয়ে আসে। তপন এ নিয়ে ভাবে না। সাহিত্য সেবা নিয়েই তার কারবার। প্রয়োজনের তাগিদে যদি সংসার পাততে হয় তো পাতবে। এর জন্য প্রেম নিবেদন করতে হবে কেন? প্রেম তো নিজে থেকেই আসে। কাশর ঘণ্টা বাজিয়ে হই হই করে তাকে নিয়ে আসতে হবে কেন? সংশয়ের আঁধারে ওদের প্রেমের ইতিকথা হৃদয়ের গভীরে লুকায়। হৃদয় বাতায়ন ধরে সে উঁকি মারে।
কলেজের পালা শেষ হয়েছে। সুহাসিনী খুব ভালো ফল করেছে। তপন খারাপ করে নি। দুজনে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বিদ্যাদেবী দুজনকে বিদ্যাসাধনার প্রাঙ্গণে বন্দি করে রাখে। ইতিমধ্যে ওদের সম্পর্কটা বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিকতা লাভ করেছে । বছর খানেক আগে কলেজে পড়াকালীন একদিন বাসে বাড়ি ফেরার সময় সুহাসিনী পড়ে গিয়ে আহত হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে তপন ওকে ওর বাড়ি নিয়ে যায়। সেখানে বাড়ির সবার সঙ্গে তপনের পরিচয়। ওর আচার আচরণ সরলতা সবাইকে মুগ্ধ করে। বাড়ির দরজা ওর কাছে উন্মুক্ত হয়। সেই থেকে তপনের সুহাসিনীর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত। আনুষ্ঠানিক সম্পর্কটা গড়ে ওঠার শর্ত তৈরি হয়। মুক্ত পৃথিবীর উন্মুক্ত অপার্থিব প্রেম পার্থিব সম্পর্কে যেন বাঁধা পড়তে থাকে। সুহাসিনীর সংশয় থাকলেও সে সেটা অস্বীকার করতে পারে না। নিষ্কাম প্রেম কামনার খাঁচায় বন্দী হোয়ে পড়ে যেন। ভিন্ন বিষয় হলেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে দুজনের রোজই দেখা হয়। প্রেম নির্জনতা খোঁজে। নিষ্কাম কামনার অঙ্গে বাসা বাঁধে। কাম আর নিষ্কাম দ্বন্দ্ব সমাধান খোঁজে পার্থিব চাহিদায়। ওদের সম্পর্কটা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে দু বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সুহাসিনীর বাবা মা জানে এ ব্যাপারে আপত্তি করে লাভ নেই। সুনি একরোখা মেয়ে। ছেলের বাড়িতে এ নিয়ে সাধারণত বেশি প্রশ্ন ওঠে না বিশেষ করে মেয়েটি যেখানে দেখাশোনার পরীক্ষায় সহজেই পাশ করার উপযুক্ত।
দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালোভাবে পাশ করে। সুহাসিনী প্রত্যাশামত একটা কোম্পানিতে গবেষণা বিভাগে চাকরি পেয়ে বেঙ্গালুরে চলে যায়। তপন তার দেশের বাড়ির কাছে স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে। সে সাহিত্য সেবায় মনোনিবেশ করার সুযোগ পায়। দুজনেই জীবিকা হিসেবে তাদের পছন্দের জায়গায় স্থান পায়। দুজনের মধ্যে চিঠি পত্রে বা দুরাভাসে যোগাযোগ থাকে। সমস্যা দেখা দেয় তারা কোথায় কিভাবে ব্যাক্তিজীবনে জোট বাঁধবে তা নিয়ে। ব্যাপারটা সমাধান হয় না। দুজনকে একজায়গায় থিতু হতে গেলে একজায়গায় কাজ নিতে হয়। কর্মজীবন নিয়ে দুজনের ভাবনা দুরকম। তপন চায় গ্রামে মাস্টারি করে কর্মজীবনে কিছুটা সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে, একই সঙ্গে সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যেতে। সুহাসিনী চায় কর্পোরেট জীবনে প্রতিষ্ঠা যেটার সুযোগ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বেশি। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও সংসারের দাবি মেটান মুশকিল। তাও দুজনে অপেক্ষা করে। বিষয়টা নিয়ে কেউ কাউকে দোষারোপ করে না। তপন যেমন চায় না সুহাসিনী নিজের সত্তা ছেড়ে নেহাৎ এক গৃহবধূ হয়ে থাকবে। আবার সুহাসিনীও চায় না তপনের সাহিত্য সেবায় বেঘাত ঘটুক। বাস্তবের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের সংঘাত কিভাবে মিটবে কেউ জানে না। অথচ দুজনেই দুজনকে পেতে চায়। নিষ্কাম প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে হয়। কিন্তু কামনার টান কতদিন অস্বীকার করা যায়? কেউ জানে না। এছাড়া আছে পরিবারের বন্ধন।
বেঙ্গালুরে গবেষণার কাজে সুহাসিনী বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে। আর গবেষণার কাজ একটা যৌথ দায়িত্ব। এই কাজে অন্যদের সহযোগিতা বিশেষ দরকার। ওর সঙ্গে জনা দশেকের একটা টিম। প্রাতিষ্ঠানিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা নিজেদের অজান্তেই প্রতিষ্ঠান ছাড়িয়ে কখন ব্যক্তিগত প্রাঙ্গনে ঢুকে পড়ে সেটা সবসময় ঠাহর করা যায় না। ওর সঙ্গে কর্মরত সবাই খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। মেয়ে পুরুষ সবাই। ও ওখানে দুজন মেয়ের সঙ্গে একটা ফ্ল্যাটে থাকে। নিজেরা পালা করে নিজেদের কাজ করে। অন্যান্যরা আসে। অফিসের কথাবার্তা ছাড়াও ব্যক্তিগত আলাপ আড্ডা চলে।
স্কুলে শিক্ষকতার সূত্রে তপনের পরিচিতির বিস্তার ঘটেছে গ্রাম থেকে গ্রামে । লেখক হিসেবেও ওর নামডাক। কবিতা প্রেমিক প্রেমিকারা তাকে জড়িয়ে থাকে। বাড়িতে পাঠক পাঠিকাদের অবাধ যাতায়াত। নিজের বাড়ির একটা ঘরে কবিতা আবৃত্তির মহড়া চলে। বাচ্চাবুড়োদের নিয়ে বাচিক স্কুল। হেসে খেলে দিন যায়। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠাবার দাবি আসে।শহর থেকে প্রায়ই নেমন্তন্ন।এরই মধ্যে সংসারের কিছু দায়িত্ব। বিশেষ করে মায়ের প্রতি।ভাইরা থাকলেও বড় ছেলে হিসেবে তার দায়িত্ব বেশি। মায়ের কঠিন অসুখ। তাঁকে নিয়ে প্রায়ই কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে যেতে হয়। ছোট বোন সংসারের দায়িত্ব নিলেও তার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়। বাবা মা দুজনেই ওর বিয়ের কথা বলে। ও প্রয়োজনটা বোঝে। ওর সুহাসিনীকে মনে পড়ে, মনে পড়ে ওর সেই কবিতাটা। সংসার কেন দরকার। সেটা কি দিতে পারে আর কি পারে না। দরাজ থেকে কবিতাটা বার করে ও পড়ে:
সংসার সাগরজলে
আমি খাবি খাই
জীবনের বাগানে ফল ফলে
খাই দাই ভালো আছি ভাই।
আমি ভাবি রোজই,
বসে বসে ভাবি আর ভাবি ,
অজানা এক ভয়
আর এক সঙ্গে চলবে না
টেকানো গেল না
সম্পর্কটা বোধ হয়!
থাক সে সংসার,
সে বেঁচে থাক
আমাদের কামনায়
সকালের ভৈরোঁয়
রাতের জ্যোৎসায়
গড্ডালিকা প্রবাহে
কালের অবগাহনে
ঝর্ণার কল কল রবে
সুন্দরবনে বাঘের গর্জনে
দিনান্তে মালিন্যের আশ্রয়ে
সময়ের ডানা মেলে
বিবাদ বিষাদ রাগ অনুরাগের প্রাঙ্গনে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আগের মত সুহাসিনীর ঘন ঘন চিঠি তপন পায় না। এখন চিঠি লেখার প্রয়োজনটা ফুরিয়েছে সুহাসিনীর। মেসেজ বা আপে যোগাযোগটা হয়। মস্তিষ্কের কল্পনার জগৎটা বাঁধা পড়েছে হাতের মুঠোয়। তাতে তপনের মন ভরে না। সুহাসিনীর চলে যায়।ও নিজেও সুহাসিনীকে লেখা কমিয়ে দিয়েছে। সুহাসিনীর প্রেমটাও যেন সংসারের দরজায় করা নাড়ে।সংসারের মুঠোয় বন্দী হতে চায়।
তপন মেসেজে বার্তা পায়। সুহাসিনী তাকে জরুরি তলব করে। সে যেন বেঙ্গালোরে যায়। বিশেষ দরকার।সঙ্গে উড়ানের টিকিট। তপন বার্তা পেয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ভেবে পায় না কি এমন দরকার। সুহাসিনীর ডাককে সে কোনোদিন অস্বীকার করতে পারে না। স্কুল ছুটি নিয়ে রওনা দেয়। নির্ধারিত সময়ে উড়ান ধরে। উড়ানে বসে তার চিন্তার জগত তোলপাড়। কিছুদিন আগে সুহাসিনী অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আবার কি তবে সে অসুস্থ! আবার সে ভাবে হয়তো তাদের সম্পর্কটাকে সে ঝালিয়ে নিতে চায়। অনেকদিন দেখা নেই। দেখা করতে চায়। তপন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। এবার দেখা হলে সম্পর্কটার একটা চূড়ান্ত রূপ দিতে চায়। সে জানে সুহাসিনী বিয়ে করতে চায়। তবে তপনের পক্ষে বেঙ্গালোরে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়া কি সম্ভব! তবে কি করার! তপন বিভ্রান্ত। তার মাথায় শুধু সুহাসিনী নয়, তার পরিবার বাবা মা বোনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা মাথায় ভিড় করে। সুহাসিনীর মা তো তপনকে খুব স্নেহ করেন। হয়তো মনে মনে তাকে জামাই বলে গ্রহণ করেছেন। সুহাসিনীর ছোট বোন সোহাগ ওর বিশেষ গুণগ্রাহী । ওর সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কি। কবি বাবু বলে ওকে ডাকে। দিদিকে নিয়ে মস্করা। একদিন ঠাট্টা করে সোহাগ তপনকে বলে দিদি তো মনে হচ্ছে ফিরবে না। তখন কি করবেন? তপন গম্ভীর হয়ে ওঠে। কবিগুরুর উদাসীন গম্ভীর মুখ দেখে সোহাগ লজ্জা পায়। এমনি টুকরো টুকরো কথার ঘাত প্রতিঘাতে ওদের মধ্যে একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তপন জানে সোহাগের এক সহপাঠীর সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক ছিল। যে কোন কারনেই হোক সোহাগের সে সম্পর্ক এখন নেই। বিষয়টা নিয়ে তপন ওর প্রতি সহানুভূতিশীল। মেয়েটি পড়াশুনায় তেমন আগ্রহী না হলেও গুণী। সংসারের কাজে পটু। ভালো রান্না করে। তপন ওদের বাড়ি গেলে ওর হাতের চা না খেয়ে ফেরে না। মেয়েটি ভালো কবিতা আবৃত্তি করে।
ঘণ্টা আড়াইয়ের মধ্যে উড়ান বেঙ্গালুরু বিমান বন্দরে নামে। সেখান থেকে একটা ভাড়া গাড়ি নিয়ে ঠিকানা ধরে তপন পৌঁছে যায় সুহাসিনীর আস্তানায়। সুহাসিনী তপনের অপেক্ষায়। তখন বিকেল প্রায় পাঁচটা।কলকাতার গ্রীষ্ম থেকে সে আসে বেঙ্গালুরুর বসন্তে।অপেক্ষারত সুহাসিনীর চোখে সেই বসন্তের স্পর্শ। তপন ওকে দেখে আপ্লুত হয়। তারা যেন ফিরে যায় ফাগুনের সন্ধ্যায় কলকাতার গঙ্গার ধারে। তপনের স্মৃতিতে সেই সন্ধ্যাগুলো ফিরে আসে। আজ অনেকদিন পর সুহাসিনীকে সে একান্তে পায়। সুহাসিনী তপনকে নিয়ে ঘরে বসে। দুজনের মধ্যে আলাপচারিতা শুরু হয়। সুহাসিনী জানতে চায়
------ তোমার মা কেমন আছেন?
তপন বলে :
------ ভালো না। এখন কাজকর্ম করতে পারে না। বোনের ওপর সংসারের চাপ।
সুহাসিনীর যেন কৌতুক মিশ্রিত উত্তর:
------ এখন তো কাউকে বাড়িতে দরকার। আর বোনের তো ভবিষ্যত আছে।
তপন সুযোগ পায় কথাটা তুলতে। সে বলে:
------ এখন তো আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বাড়িতে সে ব্যাপারে সবাই অপেক্ষা করছে।
------ হ্যাঁ ঠিকই তো। এই কথা বলে সুহাসিনী অন্য প্রসঙ্গে আসে। বলে:
------ সোহাগ বললো তুমি ও বাড়িতে গিয়েছিলে। ওকে কেমন দেখলে?
তপন বলে:
------ ভালো। এখন অনেক স্বাভাবিক। মনে হয় আঘাতটা সহ্য করে নিয়েছে। আমি ফিরলে আমাকে একদিন মাংস রান্না করে খাওয়াবে বলেছে।
সুহাসিনীর উত্তর :
------ ওর হাতে খেয়ে তৃপ্তি পাবে। আমি ও কাজে লবডঙ্কা।
কথা বলতে বলতে কলিংবেল। কে আবার! কাবাব মে হাড্ডি। তপন ভাবে। সুহাসিনী দরজা খোলে। তপন আড় চোখে দেখে একজন সুদর্শন ভদ্রলোকের প্রবেশ। তপনের মনে হয় ভদ্রলোকের আসার কথা সুহাসিনী জানত।সুহাসিনী তপনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। উনার নাম রামস্বামী যার কথা তপন আগেই শুনেছে। উনিই অসুস্থ সুহাসিনীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিন জন গল্প করতে বসে।ওদের দুজনের মধ্যে তৃতীয়ের এই উপস্থিতি তপনকে অস্বস্তিতে ফেলে। ভদ্রলোক অবাঙালি।তাই ইংরেজিতে আলাপচারিতা যা তপনের পক্ষে বিড়ম্বনা। তপন কোনমতে চালিয়ে যায়। কথা বলতে বলতে রাত হয়। ইতিমধ্যে ফরমাস অনুযায়ী দোকান থেকে খাবার আসে। খাবার শেষ হলে সুহাসিনী বলে:
------- তপন তুমি উনার সঙ্গে যাও।ওখানে তোমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। উনি তোমার জন্য হোটেলে ব্যবস্থা করতে দিলেন না।
পরের দিন । সুহাসিনী রামস্বামীর বাড়িতে হাজির। ইতিমধ্যে তপনের উনার সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। রামস্বামীর আতিথেয়তায় তপন মুগ্ধ হয়। রামস্বামী অবিবাহিত। একাই থাকে। সকালে উঠে চা ব্রেকফাস্ট নিজের হাতে করে খাওয়ান। বাড়ি চেন্নাই। রামস্বামী পাশের ঘরে যান। তপনের সঙ্গে সুহাসিনী একা। কালকের কথার রেশ টেনে তপন বলে:
----এবার আমাদের ব্যাপারটা ঠিক করে ফেলা যাক। সুহাসিনী বলে
----আমার বাড়িতে চলো সব কথা হবে।
এরপর দুজনের আলাপচারিতা। রামস্বামী এসে যোগ দেয়। দুপুরে এখানেই খাওয়া দাওয়া সেরে সুহাসিনী তপনকে নিয়ে ওর ডেরায় যায়। বাড়িতে এসে দুজনে আবার নিভৃতে আলাপ। তপন বিয়ের কথা তোলে। সুহাসিনীও তার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। তপনকে প্রস্তাব দেয় এখানে একটা স্কুলে চাকরি নিতে। ইংরেজি ওর বিষয় বলে সেটা পেতে অসুবিধে হবে না জানায়। যদি তপন রাজি হয় তবে সে তাকে একটা স্কুলে কালকেই নিয়ে যেতে পারে। এই ইন্টারভিউএর ব্যবস্থা করেই সুহাসিনী তাকে আসতে বলে।তপন জানায় সেটা তার পক্ষে সম্ভব নয় । দুজনের মধ্যে এ নিয়ে মনোমালিন্য হয়। তবে তা বেশিদূর এগোয় না। সুহাসিনীর সংশয় ছিল তপন তার জায়গা ছেড়ে আসবে কি না। আর তপন জানে সুহাসিনী আত্মমর্যাদা আত্মসত্তা ছেড়ে সংসার করবে না। সেটা তার কাছে দাসত্ব। তাও ও বিশ্বাস করে সুহাসিনী কখনো পশ্চিম বঙ্গে কোথাও চাকরি নিয়ে চলে আসবে। সে আর জোরাজুরি করে না। বাড়ি ফিরে আসে ।
একদিন দুজনের মধ্যে মোবাইলে কথা হয়। কে কেমন আছে জানার পর উভয়ের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময়। সুহাসিনী জানায় যে সে তপনকে একটা চিঠি দিয়েছে। তপন জানায় সে সেটা পেয়েছে। চিঠিতে কি লিখেছে? সেটা আমাদের সকলেরই কৌতূহলের।
সুহাসিনী রামস্বামীর এক বন্ধুর সঙ্গে নিজের বিয়ের একটা কার্ড পাঠিয়েছে। বিয়েতে ঘটক রামস্বামী। তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার থেকে একটা কবিতার অংশ:
মোর লাগি করিও না শোক,
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই---
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে,
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
এর সঙ্গে তার অনুরোধ তপন যেন বিয়ে করে। সংসারের প্রয়োজনটা তারও আছে। তপনকে সে ভালোবাসে তাই তার দায় আছে এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা। সে উপযুক্ত পাত্রী হিসেবে তার বোন সোহাগকে চিঠিতে উপস্থিত করে। তপন একটু বোকা বনে যায়। একটা সন্দেহ উঁকি মেরেছিল। প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কিন্তু এ কি, সোহাগিনীর তরফ থেকেই! ভেবে পায় না। সোহাগিনীর ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে যায়।
একটু ধাতস্থ হয়ে কদিন পরে তপনও চিঠিতে তার বাস্তব অবস্থাটা জানায়। সে প্রস্তাবটা মেনে নেয় তবে সোহাগের স্বেচ্ছামত সাপেক্ষে। সে মতটা পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে তার সংশয় আছে যেখানে তাদের সম্পর্কটা ও জানে। ব্যাপারটা সুহাসিনীর ওপর ছেড়ে দেয়। সে চিঠিতে তার অনুমতি জানায়। যেন এরকম একটা কিছুর জন্য সে প্রস্তুত ছিল। ভাবনার জগৎটা তার ছিন্ন ভিন্ন। সে ভেবে চলে :
ভালোই করেছ। কোন নিশ্চয়তার শর্তে ঘর বাঁধা! শত সহস্র ফুটো সে ঘরের ছাদে। গ্রীষ্মের দহন শীতের কাঁপন বর্ষায় প্লাবন সে ঘরে। বসন্তে ফুল ফোটে না এ বাগানে। প্রেমের কলি মুর্চ্ছা যায় সে বাসরে। ভালোই করেছ তুমি বালির বাধ না বেঁধে, অনিশ্চয়তার জোয়ারে না ভেসে। আর জেনো প্রেম বাঁধে না নিজেকে, ধরা দেয় না সংসারের পাঁকে। মুক্ত বিহঙ্গ সে, ডানা মেলে ওড়ে আকাশে, নীরব গুঞ্জন তার বাতাসে।
তপনের ভাবনায় দোলাচল। হঠাৎ একটা দমকা হওয়া। তার ভাবনায় একটা চমক, একটা সংকোচ, যেন একটা উদ্বেগ: সোহাগের থেকে কি ছাড়পত্র পাওয়া যাবে?
সোহাগের সেদিনের সেই ইঙ্গিতপূর্ণ কৌতূহলী চোখটা ভেসে ওঠে। সেদিনের সে ঔদাসীন্য তপনের মুখে আর দেখা যায় না । আবার সুহাসিনীর পাঠানো চিঠিটায় যেন লেখা শেষের কবিতায় অমিতের প্রতি বন্যার অভয় বাণী :
তোমার হয় নি কোন ক্ষতি
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
হোক তব সন্ধ্যাবেলা,
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগ-বেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোন নৈবিদ্যের থালে।
তোমার মানস-ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষ্ণায়,
তার সাথে দিও না মিশায়ে
যা মোর ধুলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আগে তুমি নিজে
হয়তো - বা করিবে রচন
মোর স্মৃতি টুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন।
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়,
হে বন্ধু, বিদায়।